ব্রজেন্দ্রনাথ মল্লিক
(নোটঃ: স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগান এলাকায় পাকিবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল। সে সময়ে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন শর্ষিণার পীর রাজাকার বাহিনীর মাধ্যমে। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পেয়ারাবাগানের মানুষ। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নারীরাও ছিলেন। তারাই প্রথম শর্ষিণার পীর বাড়ির ঘাটে খানসেনাদের গানবোট গ্রেনেড দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। পেয়ারা বাগানের মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই বীর নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম বিভা মণ্ডলের ডাইরীর অনুলিখন করেছেন তার ভাই ব্রজেন্দ্রনাথ মণ্ডল।)
আগের পর্বের লিঙ্ক--
প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব
এরপর দু-তিন দিন বেগ সাহেবের কোনো খবর পাই নি। তিনি কোথায় গিয়েছেন তা আমাদের নীরোদস্যারও জানেন না। তৃতীয় দিনে খবর পেলাম বেগ সাহেব ফিরেছেন। তিনি হঠাৎ আমাদের গ্রুপ কমান্ডারদের এক এক করে ডাকলেন, শিখাও গেল দেখা করতে।
দুপু্র বেলা ফিরে এল শিখা। আমি বললাম, খেয়ে নে।
লক্ষ করছি শিখা কেমন অন্যমনস্ক। খাবার দিকেও তার মন নেই। আমি বললাম, খাচ্ছিস না কেন?
শিখা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, করতে পারবি?
আমি বললাম, মানে?
--ক্যাপ্টেন বেগ যদি মরতে বলেন?
-তাহলে পারব না বলেও তো রেহাই নেই। মরতে হবেই।
--আমি তাকে কথা দিয়ে এসেছি। তোকে নিয়েই যাব বলেছি। তিনি অর্ডার দিয়েছেন আমাদের দুজনের উপর।
গোপন অর্ডার। জানানো হয়নি কাউকে। গ্রুপ কমান্ডার পর্যন্ত জানত না এ পরামর্শ। সকাল থেকেই দেখছি নীরোদস্যারের মুখ গম্ভীর। তাঁর মুখখানা কালো হয়ে আছে।
আমি আর শিখা শুয়ে পড়েছিলাম পাশাপাশি। চোখে ঘুম নেই—নেই আলস্য বা তন্দ্রার ভাব। আমি নীরোদস্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যেন খুব দুশ্চিন্তা করছেন, স্যার?
--আপনজনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে কেউ নিশ্চিন্তে থাকতে পারে, মা?
আমি উঠে বসি। বললাম, বিপদের একদম শেষ অবস্থা তো মৃত্যু। অস্ত্র হাতে নেবার দিন থেকেই তো মৃত্যুর ট্রেনিং নিচ্ছি স্যার। আগে থেকে মন তৈরী হয়ে আছে মরার জন্য। মরণটা এবার সহজ হবে।
নীরোদস্যার আমার মাথার কাছে এলেন। বললেন, এই শিক্ষা কি তোদের দিতে পেরেছি, মা?
--এ শিক্ষা তো কাউকে দিতে হয় না স্যার। আপনার মনের ভাবটাই আমার বিবেক থেকে সহজাত ভাবেই উঠে এসেছে।
নীরোদ স্যারের চোখ দুটো ছল-ছল করে উঠল। তিনি তাঁর ডান হাতখানা আমার মাথার উপর রাখলেন।
সেদিন ছিল স্বরূপকাঠি হাটের দিন। বিকেলবেলা আমি ও শিখা উঠে যৈজ্ঞকাকার বাচারি নৌকায়। ছই-এর আগচালটা টেনে বাড়িয়ে দেওয়া ছিল। যাতে সহজেই কেউ বাইরে থেকে আমাদের দেখতে পাবে না।
খালে চলছিল হাটুরে নৌকাগুলি। তার মধ্যেই বেরিয়ে গেল কাকার বাচারি নৌকা।
মাছের বাজারের কাছে পৌছে যাই। বাইরে থেকে একজনের গলা টের পেলাম, ও যৈজ্ঞ ভাই, কী মাছ আনছ?
--গত রাইতে জাল পাতি নাই। মাছ আইব না আইজ।
লোকটা জুল জুল করে তাকিয়েছিল ছই-এর ফাঁকা দিয়ে। বলল, নৌকার মধ্যে মেইয়া-ছেইলা দেখছি, বাজারে ওডবা না?
--নৌকায় আমার মেইয়া আছে। মেইয়ার ননদ আইছিল গেল হাটবারে। আইজ মেইয়ারে তার শ্বশুরবাড়ি দিয়া আইবার যাইতাছি। দিনকালের অবস্থা ভাল ঠেকছিল না। যাদের বউ তাগো বাড়ি দিয়া আসি।
সন্ধ্যা নাগাদ সন্ধ্যা নদীতে পৌঁছাই আমরা। বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ ছিল—বৃষ্টিও এল ঝিরি ঝিরি।
এরপরের ঘটনা আগেই বলেছি। সেই পীরের ঘাটে মিলিটারীর লঞ্চ ডোবানোর কাহিনী।
পীরের ঘাটের অপারেশনের পরে খানসেনারা এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল। ফায়ারিং করতে করতে তারা ফিরে গিয়েছিল পিরোজপুরে।
পরের দিন ভোরবেলা। ক্যাপ্টেন এজাজ পায়চারি করছিলেন পিরোজপুরের অস্থায়ী ক্যান্টনমেন্টে। তিনি অসহিষ্ণু, অস্থির। আগের দিন পিরোজপুর টাউনের হেডমাস্টারদের ডেকেছিলেন এক মিটিং-এ। তখন বিদেশি সব সাংবাদিক ঢুকে পড়ে পড়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক এটা দেখাতে হবে তাদের। জেঃ নিয়াজির এই নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছিল সব ক্যান্টনমেন্টে। তাই ক্যাপ্টেন এজাজ হেডমাস্টারদের ডেকে অর্ডার দিলেন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা সব খোলা রাখতে হবে। হাট-বাজার সব মিলবে। পিরোজপুর আদর্শ হাইস্কুলের হেডমাস্টার ফররুখ আহমদ সাহেব উপস্থিত ছিলেন সেই মিটংএ। তাঁর স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। তাঁরা সব ভয়ে পালিয়ে গেছেন। তিনি কী করে স্কুল খোলা রাখবেন? তাই তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, হোয়াট এবাউট হিন্দু টিচারস?
--হিন্দু! কুফফর?
ক্যাপ্টেন এজাজের গোল গোল চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল বাইরে।
চেয়ার থেকে এক লাফ মেরে উঠে এলেন তিনি। ফররুখ সাহেবের একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কাঁধের উপর আলতো করে দুটো গাট্টা মেরে বললেন, ডু ইউ নো জেটি?
--জেটি বাই দি রিভারসাইড?
এই জেটি পিরোজপুর শহরের খেয়াঘাট। এখান থেকে গত দশ দিনে প্রায় সাতশো হিন্দুকে গুলি করে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলেশ্বর নদীতে। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক হল কুখ্যাত মালেক এজাজ জুটি।
আর তার একদিন পরেই মুক্তিবাহিনী কুখ্যাত মালেক-এজাজের লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যা নদীতে--খাস পীরের জেটি ঘাটে। সেই লঞ্চে মারা গেছে তার দুজন সহকর্মী মিলিটারি অফিসার।
দুপুরবেলা ক্যাপ্টেনের অস্থিরতা বাড়ল। সিকিউরিটি অফিসার নিয়ে গট গট করে উঠে গেলেন তার গান বোটে।
বেলা একটায় ক্যাপ্টেন এজাজের গান বোট এসে লাগলো স্বরূপকাঠির থানার সামনের খালে। সঙ্গে আজও রয়েছে দুখানা স্পীডবোট। গান বোট ভিড়িয়ে গট গট করে উপরে উঠে গেলেন এজাজ। পিছনে তার সিকিউরিটি ফোর্স তো রয়েছেই। থানার অফিস ঘরের সমুখে সেন্ট্রিকে প্রশ্ন করলেন, ও.সি. কাঁহা হ্যায়?
মিলিটারি দেখেই সেন্ট্রির কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা সরছে না তার। হাত তুলে ও.সি.র বাসা কোনোমতে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল।
ও.সি. সবেমাত্র খেয়ে উঠেছিল। লুঙ্গি পরা অবস্থায় বারান্দায় বেরোলেন। এক সেপাই দৌঁড়ে এসে খবর দিল যে থানায় মিলিটারি এসেছে।
ও.সি. তড়িঘড়ি করে ইউনিফর্ম পরবার জন্য ঘরের দিকে পা বাড়াতে যান। ক্যাপ্টেন এসে সোজা দাঁড়ালেন তার সামনে।
--শালা কুত্তাকা বাচ্ছা। তুম দুশমন পাশ রহে হো?
প্যান্টালুন আর পরা হল না ও.সি.র। হাত দিয়ে লুঙ্গিটা ভাল করে কোমরে আটকে নিতে না নিতেই তার ভুড়িওয়ালা পেটের উপর বুটের গুঁতো পড়ল ক্যাপ্টেনের।
--তোমহারা থানা এলাকামে সব জানা মিসক্রিয়ান্ট হ্যায়। কাল তোমহারে আঁখোকে সামনে এয়সা অপারেশন হো গয়া। দো অফিসার মর গিয়া। আউর শালা তুম আরামসে সো রহে হো?
দারোগার গলা শুকিয়ে গেল। তিনি শুধু আমতা আমতা করতে লাগলেন।
ক্যাপ্টেনের রাগ তাতে বেড়ে যায় আরো। সজোরে আর এক বুটের লাথি তার পেটের উপর পড়ল। আর চেঁচিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন, তুম দুশমন কাফেরকো মদদ কর রহে হো, শালা।
ও.সি. পড়ে যেতেও নিজেকে সামলা্লেন কোনো মতে। কোনোরকমে বলতে যান, নেহি—নেহি, স্যার।
--হোয়াট? কেয়া বোলতা হ্যায়? তুম এক ঘণ্টাকে অন্তর বিশ কাফেরকো পাকড় করে লাও। নেহি তুমসে মার ডালেঙ্গে।
গট গট করে অফিস ঘরের মধ্যে চলে এলেন ক্যাপ্টেন এজাজ এবং তারপরেই সোজা গানবোটে।
এদিকে দুখানা স্পীডবোট তৈরি। তাতে জন পনেরো সশস্ত্র পাকসেনা। ও.সি-ও তার পুলিশ নিয়ে উঠলেন বোটে। তারা বেরিয়ে পড়লেন সন্ধ্যা নদীতে।
দুখানা বাচারি নৌকায় জেলেরা ছান্দিজাল পাতছিল নদীতে। দু নৌকার চৌদ্দজন লোক। তাদের মধ্যে ছিল আমাদের যৈজ্ঞকাকা ও তার ভাইপো কালু।
আপন মনে সারি গান গেয়ে জাল ফেলছিল জেলেরা।
মাঝ-গাঙ্গের জলে/
ঝাঁকে ইলসা চলে/
ও ভাই—ভাইরে
ফেল জাল গহীন গাঙ্গের জলে।
রোজই এমন করে জাল ফেলে জেলেরা। মিলিটারি লঞ্চ দু-একবার পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। আজ দুখানা স্পীডবোট বাচারি নৌকার দুপাশে এসে থেমে গেল।
ঝপ করে থেমে গেল সারি গান। জাল বৌঠা যে যার হাতে করে নিস্পলক তাকিয়ে আছে হা করে। যৈজ্ঞকাকা বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। এটা গতদিনের ঘটনার জের। সে শুকনো চোখেই কালুকে ইঙ্গিত করল নদীতে ঝাঁপ দিতে।
স্পীডবোটের খান সেনারা বন্দুক উচিয়েই ছিল। লাফ ঝাপ দিলেই গুলি। পালাবার পথ নেই আর।
এর মধ্যে ও.সি.র বোট নৌকাটা এল। পুলিশের বাচারিতে উঠে পিঠমোড়া করে বাঁধতে লাগল এক এক করে।
কালুর বাঁধনটা একটু ঢিলে ছিল। জোরে টান দিয়ে বাঁধা থাকলেও বেশ নাড়ানো যাবে। সে সুযোগ খুঁজছিল পালাবার। বাচারি থেকে বোটে তোলার এক ফাঁকে কালু লাফ দিয়ে পড়ে যায় নদীতে। কেউ দেখতে পায়নি। দুনৌকার মাঝখান থেকে ডুব সাঁতার দিয়ে একদম জলের রেতে চলে যায়। সে কচুরিপানার দাম ধরে ভাসতে ভাস্তে নদীর পারে পৌঁছে যায়।
অন্য সবাইকে বেঁধে বোটে করে নিয়ে এল থানায়। একখানা কাগজে কী যেন লিখে সেনারা নিয়ে গেল গানবোটে। কাগজখানার ওপর সই করে দিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ।
পিঠমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় তেরোজনকে নামানো হল নদীর চরে। শুধুমাত্র এস.এল.আর.-র কয়েক রাউন্ড ফায়ারিং। পরে সব চুপ।
মাত্রে আঠারো দিন আমাদের কাজ করেছিল যৈজ্ঞকাকা। মিলিটারি ভিজিলেন্স সেই দিনের ঘটনায় বুঝে ফেলেছিল—জেলেরা ছাড়া আর কেউ আমাদের সাহায্য করতে পারে না। তাই যৈজ্ঞকাকার এই পরিণতি। তার কথা স্মরণ করে আজও দুঃখ হয়। দুফোটা চোখের জল ফেলি। দুঃসাহদিক কাজে তাকে ভয় করতে দেখিনি কোনোদিন।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে পিছনের কিছু ঘটনা মনে পড়ছে। কী করে আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মনোভাব দানা বেঁধে উঠেছিল, কারাই-বা আমাদের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। হয়ত আমার ব্যক্তিগত জীবনের খানিক অংশের কথা আমাকে বলতে হবে। যাঁদের সান্নিধ্যে আমরা আসতে পেরেছিলাম—তাঁদের কথা এখানে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে যাব।
শেখ সাহেবের কথা আগে উল্লেখ করেছি। তার কাছাকাছি যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আর হবে কিনা তাও জানি না (এই ডায়েরী লেখার সময়ে শেখ সাহেব জীবিত ছিলেন)। তবে সেদিনের বক্তৃতার কথা মনে পড়লেই আজও মনে হয় শেখ সাহেব যেন আমার চোখের সামনে দঁড়িয়ে আছেন।
সেদিন কলেজ মাঠে হাজার বিশেক লোকের সমাবেশ। শেখ সাহেব বক্তৃতা করবেন। দলে দলে ছুটে এসেছিল বালক, বৃদ্ধ, যুবা। মেয়েরাও এসেছিল শেখ সাহেবকে দেখতে। শিখা সেদিন বক্তৃতা করেছিল। তাকে একটা টুলের উপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল শ্রোতাদের অনুরোধে যাতে সেই বেটে-খাটো মেয়েটির মুখ সকলে দেখতে পায়। শেখ সাহেব বক্তৃতা করতে উঠলেন বিশাল হাততালির মধ্যে। দরাজ গলায় বক্তৃতা শুরু হতেই সভা একদম নীরব। সে কী ওজোস্বিনী ভাষা—কী মনের জোর। সেদিনের বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে কী উদাত্ত আহবান। শ্রোতারা সব মন্ত্রমুগ্ধ। সেদিনের বক্তৃতায় তিনি আমাদের মনে আমার মত আরো কয়েকটি মেয়ের বিপ্লবী মনের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন। সেই কলেজের মাঠে বক্তৃতা শুনেই আমার বিপ্লবীজীবনের নবজন্ম হয়েছিল।
মন্তব্য
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
আব্দুল্লাহ এ.এম.
নতুন মন্তব্য করুন