সিলেক্টিভ মানবতা এবং অন্যান্য

শব্দ পথিক এর ছবি
লিখেছেন শব্দ পথিক [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১১/১১/২০১৩ - ১০:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম প্রেম যেমন ভুলা যায়না, ঠিক তেমনি প্রথম জনসেবার ইচ্ছা থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতাও আমি ভুলিনি। প্রিয় ব্লগার চরম উদাসের 'মাইক' পড়ার পর সেটা নিয়ে লেখার ইচ্ছা জাগলো। ভালো লিখতে পারিনা, তাও ভাবলাম লিখি, অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। যতোটুকু লিখতে চেয়েছিলাম তার শুরুটা একই রাখছি, কিন্তু ঘটনাচক্রে সমাপ্তিটা অন্যভাবেই টানতে হচ্ছে। যাই হোক, প্রারম্ভিকা টেনেটুনে লম্বা না করি।

সর্বশেষ তিনবছরে গোটা দুয়েক হাফসোল খেয়ে আমার তখন টালমাতাল অবস্থা, ভাল জব করি, আয়-রোজগার বেশ। দু:খে যখন খাবি খাচ্ছি, তখন মনে হলো এই টাকা-পয়সা রোজগার করে কী লাভ? তাই অর্জিত ধন-সম্পদের একটা অংশ মানুষের কাজে লাগাতে হবে, এই চিন্তায় আমার বাথরুম আটকে গেলো। জনসেবা শুরু করতে না পারলে আমার পেট আর ক্লিয়ার হচ্ছেনা। তাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এবং নোট লিখে জনসেবার আহবান জানালাম। ভাল ভাল কথা লিখলে ফেসবুকে লাইক, শেয়ার বহুত পাওয়া যায়; আমিও পেলাম, সেইসঙ্গে বোনাস হিসেবে পেলাম অনেকগুলো কমেন্ট, জনসেবার উপায় এবং বিদ্যমান পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ। অনেকেই আমার সঙ্গে যোগ দিতে চাইলেন। আমি বেজায় খুশি, হাফসোল না খাওয়া সুখী মানুষেরাও জনসেবায় নামতে চাইসে, এই উর্ধ্বমুখী মানবতাকে দাবিয়ে রাখা যাবেনা চিন্তা করি আমি তখন আনন্দের আতিশয্যে উর্ধ্বগামী অবস্থায়। ভূমিতে নেমে আসতে আমার সপ্তাহ দুয়েকের বেশি লাগলোনা, আগ্রহী প্রায় সবাই চুপ মেরে গেলেন। ফেসবুকে ইনবক্স করলেও জবাব নাই, ফোন করলেও রিসিভ করেন না। একজন আমার সাথে বসতে চাইলেন, তিনি আমার সিনিয়র বন্ধু। বসলাম একদিন তার সাথে, জনসেবা করার যে ফর্মূলা নিয়ে তিনি আসলেন তা ড. ইউনূস সাহেবের সঙ্গেই ভালো যায়। এবং কাকতালীয় হলেও সত্য, আমার এই সিনিয়র বন্ধুটি চট্রগ্রামের এবং তিনি চট্রগ্রাম থেকেই তার মস্তিস্কপ্রসূত জনসেবার নাম সামাজিক ব্যবসাটি শুরু করতে চান। বিশিষ্ঠ চিত্রনায়ক অনন্ত জলিলের নি:স্বার্থ ভালবাসার মতো আমার নি:স্বার্থ জনসেবার পরিকল্পনা এভাবে অঙ্কুরেই মাঠে মারা গেলো।

একই এলাকায় থাকি তাই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হতো নিয়মিত, ফেসবুকে বন্ধু তালিকাতেও ছিলো তাই তার কর্মকান্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম সবসময়। কক্সবাজার-চট্রগ্রামে সংখ্যালঘুদের (সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু কনসেপ্টে ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করিনা) উপর হামলার পর ত্রাণ পাঠানোর জন্য ফান্ড রেইজ শুরু করেছি তখন, সবাই দায়িত্ব নিলাম পরিচিতদের কাছ থেকে ফান্ড চাইবো বলে। যাই হোক, লজ্জার মাথা খেয়ে এই লোকের কাছে ফান্ড চাইলাম, ভাবলাম চট্রগ্রামের মানুষ চট্রগ্রামের মানুষের বিপদে-আপদে হয়তো এগিয়ে আসবেন। কিন্তু তার সাড়া পেলাম না।

এরপর এই লোকের সাথে যোগাযোগ বন্ধ প্রায়, তিনি একদিন আমাকে একটি ফেসবুক ইভেন্টে ইনভাইট করলেন। ইভেন্টের বিষয় হলো, সিরিয়ায় মুসলিম ব্রাদারদের উপর অন্যায়-অবিচার করা হচ্ছে, তাদের অনেক সাহায্য দরকার, সেখানে অনেক ত্রাণ পাঠাতে হবে। বুঝলাম, মানবতা একটি সিলেক্টিভ বিষয়। মানবতা প্রদর্শনেও যখন ধর্ম মূখ্য, যখন ভিন্ন মতাবলম্বীকে মানবতা প্রদর্শনের আওয়তার বাইরে রাখা হচ্ছে তখন ধর্মের নামে কী বড় অধর্ম করা হচ্ছেনা? যাই হোক, একদিন অন্য এক বন্ধু আপডেট দিলেন, সিরিয়ায় ত্রাণ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশীরাই প্রায় সোয়া লাখ ডলারের অনুদান তুলেছেন। আর আমরা বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য চার হাজারের ডলারের বেশি তুলতে পারিনি। নিজেকে মানুষ হিসেবে, বাঙালি হিসেবে ব্যর্থ মনে হলো। হাফসোল পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কোন সময়েই এমন দু:খ আর পাইনি।

দুর্বলের মত প্রকাশের একমাত্র জায়গা ফেসবুক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সংলিষ্ট প্রক্রিয়া নিয়ে ফেসবুকে সরব থাকি সবসময়। উপরোক্ত দানবীর ভদ্রলোক বন্ধু তালিকায় তখন আর নেই, আমার ফেসবুক কার্যক্রম পাবলিক থাকে তিনি আপডেট পেয়ে যান। একদিন ইনবক্সে তার মেসেজ দেখলাম, ''দেশে এখন এমনিতেই এখন সমস্যা অনেক, এর মাঝে এভাবে একপাক্ষিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে লাফালাফি করলে কী লাভ,..................'' এমন নসিহত দিয়ে আমাকে লাইনে আসার আহবান জানালেন। আমি উত্তর না দিয়ে তাকে ব্লক করে দেই।

এ পর্যন্তই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু এই উইকেন্ডে তার একটি ইমেইল পেলাম। যা লিখেছেন তার সারমর্ম হলো, গত কিছুদিন টানা যে হরতাল চলতেছে তাতে গাড়ি ভাংচুরের রেশে তার একমাত্র ছোট বোনের সাত বছর বয়সী পুত্র গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তিনি যে ভুল পথে, ভুল মানুষদের সমর্থনে ছিলেন এতদিন সেটা নাকি বুঝতে পেরেছেন।

কোনটা খারাপ এবং কোনটা ভালো সেটা যেনো আমরা নিজের উপর বিপদ আসার আগেই বুঝতে পারি, এতোটুকু বুদ্ধিমত্তা মানুষ হিসেবে আমাদের থাকা উচিত। নিজের পরিবার-পরিজনের বিপদে যেমন মন কাঁদে, অন্যের বিপদেও যেনো মন একটু হলেও কাঁদে। সিলেক্টিভ মানবতার অবসান হোক, তবেই না সাম্য আসবে।

--------------------------------------------------------
শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

চট্রগ্রাম > চট্টগ্রাম

অতিথি লেখক এর ছবি

ভুল ধরিয়ে দেয়ায় ধন্যবাদ হিমুদা।

দুইটা 'টি' এর পর অযথাই একটি 'আর' দিয়ে দেয়ায় এই ভুল।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইরে, মানবতা আজ সিলেক্টিভ। লন্ডনে বসেই দেখি, রোজার মাস আসলে দেশী টিভিগুলোতে ফান্ড উঠায় কোটি কোটি টাকা। কি করবে? দেশে মাদ্রাসা, মসজিদ আর এতিমখানা দিবে, কিন্তু শিক্ষিত হওয়ার জন্য স্কুল করবে না। তারা দেশে স্কুল করার জন্য বা গরীবদের চিকিতসার জন্য ফান্ড দিবে না। আপনার এই লেখা পড়েই ভাবলাম, এই যারা কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে, তাদের কাছে মানবতা একটা সিলেক্টিভ বিষয়, তারা ঐ নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া তাদের মানবতা আসেনা। দেশে একটা মানুষ রাস্তায় পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখলেও তাদের মানবতা উঠলে উঠবে না। তাদের মানবতা ধর্মীয় কার্যকলাপকে ঘিরে, মানব সেবার কার্যকলাপকে ঘিরে না।

দেশ বন্ধু

অতিথি লেখক এর ছবি

একসময় মনে করতাম অশিক্ষা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু এখন আর তা মনে হয়না। সত্যি বলতে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির মানবতার দৌড় ধর্মীয় আগুনে সিগারেট জ্বালানো পর্যন্তই।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

ধর্মীয় আগুনে শুধু সিগারেটতো জললে তো সমস্যা ছিল না। পুরা দুনিয়াটাই তো জালায়ে দিচ্ছে।

ঘছাং ফু

অতিথি লেখক এর ছবি

লিখতে থাকুন

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন বিষয় নিয়ে আসলে দিন রাতি কথ বলছি ব্লগে, ফেসবুকে। কিন্তু আমি কোন পরিবর্তন দেখি না আমার আশে পাশে। মন খারাপ
সিরিয়ার দু:খে যারা ভীষন দু:খী হয়, উঠতে বসতে যাদের বিশ্বজিতের কথা মনে পড়ে, ফেলানীর নির্মম হত্যা যাদেরকে ঠিক মতো ঘুমাতে দেয়না সেইসব নরম মনের ভীষন অনুভূতিশীল মানুষরা দ্বীপ এর মৃত্যুতে শোকাগ্রস্থ হয়না, রামুতে বৌদ্ধ মন্দির হামলা কিংবা সর্বশেষ মনির কে পুড়িয়ে মারা এগুলো কোনটাই আসলে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ হত্যাকান্ড নয় তাদের কাছে। এদের মৃত্যু তাই কোন শোক জন্মায় না ওদের হৃদয়ে, মানববোধ কিংবা মানবতা লক্ষ্য মাইল দূরের কথা তাদের কাছে। তাই তাদেরকে নিয়ে লেখতে আর ইচ্ছে করে না। এরা আপনার গল্পের সিনিয়র বন্ধুর মতো ঠক খেয়ে যদি কোনদিন বুঝে তাহলে লাইনে আসবে ।(ঠক তো আর সবাই খায়না, তাই এইসব কাঠালপাতা ভক্ষনকারীরা লাইনেও আসবে না কোনদিন) তার আগে এমনি থাকবে তারা।

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

কোথায় যেন শুনেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাসের বদলে ৯ বছর ধরে হওয়া দরকার ছিল। প্রতিটি পরিবার থেকে যদি সন্তান এবং সম্ভ্রমহানির ঘটনা ঘটত, তাহলে আর কেউ রাজাকার হওয়ার কথা, জামাত করার কথা চিন্তা করত না।

ওয়াই-ফাই ক্যান্সার

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি যখন দেখবেন আপনার পাশের মানুষটি/মানুষগুলো কোন যুক্তি তর্ক মানে না, বাস্তবতা বুঝে না, সত্য মানে না আর এই ঘটনা দিনের পর দিন চলতে থাকলে দেখবেন আপনিও একরোখা হয়ে যাচ্ছেন, ওদের বিরোধীতা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে আপনার মাঝেও সিলেক্টিভ মানবতা কাজ করছে অনেকটা। এবং সেটা আসাকে আমি খুব স্বাভাবিক মনে করি। নইলে আপনি আমি বলতাম না ওদের ঠক খাওয়া উচিত। আমাদের যু্দ্ধ ৯বছর চলা উচিত ছিলো, কিংবা মুনতাসির মামুন বলতেন না শেখ মুজিবর রহমান এমন একটা জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়ে ভুল করেছেন।

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রকৃত মানুষ আর মানবতা দুটোই আজ বড় একা ।

-আরাফ করিম

স্যাম এর ছবি

লেখালেখি চলুক নিয়মিত

অতিথি লেখক এর ছবি

স্যাম দা, ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। নিয়মিত লেখালেখির ইচ্ছে আছে, তাই পড়ছি অনবরত।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

চারপাশে এইধরনের মানুষের ছড়াছড়ি দেখতে দেখতে এদানিং হতাশ হয়ে যাই, ডিগ্রীধারী লোকেরা যে কত অশিক্ষিত হয় তা বোঝা যায় এদের দেখলে।

ইসরাত

চরম উদাস এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।