বার্নস এন্ড নোবলের কফি কর্নারে জানালার পাশে বসে বই পড়ছিলাম। সুজান কলিন্সের 'ক্যাচিং ফায়ার'। বইটা ২০১২ এর বেস্ট সেলার লিস্টে আছে, ইদানিং সবকিছুই কেমন জানি উল্টা-পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। কন্টেন্ট না জেনে বেস্ট সেলার লিস্ট দেখে বই পড়ি এবং আইএমডিবি রেটিং দেখে দেখি মুভি। এমন সময় চোখ ফিরিয়ে তাকে দেখলাম।
মেয়েটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আমার সামনে। চুল ছোট করে কাটা, কোনরকমে একটি বেণী হবে হয়তো। তার ঠোঁট দৃঢ়ভাবে একসাথে চাপানো, আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে।
আমি জানি তার সাথে কথা চালিয়ে যেতে পারবোনা, যদিও চোখ বন্ধ করলেই আমি আমাদের সন্তানদের দেখতে পাই। মেয়েটা উনিশ কি বিশে হবে, আমি আঠারোতে।
আমার চোখে জল, কিন্তু জানিনা কেনো।
মেয়েটির নাম ফারহানা। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম যাতে কথা বলতে নাহয়। কিন্তু ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার সাথে কথা বলার জন্য। এটা সত্যি, আমি তার প্রেমে পড়েছি। এই ক্যাম্পাসে আমরা দুটি মাত্র বাংলাদেশী প্রাণী। ওরিয়েন্টেশন এর দিন প্রথম দেখা, কিন্তু আমার কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য তার সাথে মেশা হয়ে উঠেনি, কথা বলতেও ইচ্ছাকৃত জড়তা দেখিয়ে আসছি গত দুমাস ধরে।
তার এক হাত কোমরে রাখা, অন্য হাতটি নেড়ে আমাকে বললো, ''হাই''
আমার গলা শুকিয়ে আছে, তাও অস্পষ্টভাবে বললাম, ''হ্যালো''
''আপনি পড়তে পছন্দ করেন মনে হয়, প্রায়ই এখানে দেখি"-আমি উত্তর দেয়ার আগেই সে বললো, ''স্যরি, স্টুপিডের মতো প্রশ্ন করলাম, সবসময় যেহেতু পড়েন, অবশ্যই পছন্দ করেন তাহলে"
কফি মেশিনের শব্দ শুনছিলাম আমি, বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ''দিনটা সুন্দর, গাছের পাতাগুলোতে সুন্দর রং ধরেছে''
''প্লিজ লজ্জা পাবেন না, এটা অদ্ভুত''-সে বলতে থাকলো, ''আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই, এখানে বাংলায় কারো সাথে কথা বলবো সে সুযোগতো নেই''
''আ...আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারবোনা"-তোতলিয়ে বললাম আমি, নার্ভাস থাকলে আমি বেশ তোতলাই।
''কেন পারবেন না''
এটা যদি তাকে বলি তবে সব বদলে যাবে, সে অযথাই ভয় পাবে। যে স্বপ্নটা আমি দেখছি সেটা ফিকে হয়ে আসবে।
আমি ঘামছি, ''আপনাকে বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না''
আমার দিকে একটু হেলে এসে ফারহানা বললো, ''কোন সমস্যা নাই, আপনি বলেন''-বলে মুচকি হাসলো। এই হাসিটা আমার অনেকদিনের চেনা, নিজেকে ভুলে যাবার মতো হাসি তা।
আমি না বলতে চাচ্ছিলাম, এমন সময় শুনলাম কেউ একজন বলছে, ''ফারহানা, দুই মিনিট!''
''উনি তোমার বাবা''-আমি বললাম
সে বললো, ''হ্যা''
"তাঁর স্ত্রী, আই মিন আপনার মা, দুবছর হলো মারা গেছেন। আপনার বাবা একজন আর্কিটেক্ট, আপনি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলেই তিনি আপনাকে একটি অডি গিফট দিবেন বলেছেন আর তিনি চান আপনি অক্সিডেন্টালের পর হার্ভার্ডে বিজনেস স্কুলে এটেন্ড করেন''
''অডি! আপনি জানেন কিভাবে?''-অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললো ফারহানা, ''আর হার্ভার্ডে যেতে চাই, এটাকি কোন জোকস, বাই দ্যা ওয়ে আর কী জানেন বলেন?''
নুসাইবা, আমাদের ছোট মেয়েটা-তৃতীয় জন্মদিনের আগেই হার্টের প্রবলেমে মারা যাবে। কি করে আমি তোমাকে বলবো এ কথা।আমি নি:শ্বাস নিতে পারছিলাম না, তোমার সমস্ত কমফোর্ট তখন আমাকে ঘিরে। জীবন পুরোটাই বদলে গেছে ততদিনে।
অনেক কষ্টে অশ্রু সংবরণ করে আমি বললাম, ''না''...এরপর আমরা ইটালি গেলাম ঘুরতে, সুপ্ত ভিসুভিয়াসের দিকে তুমি অনেকদিন পর হাসবে।
''প্লীজ''-আশাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো ফারহানা। এই দৃষ্টি আমার হৃদয়ের ক্ষতকে আরো গভীর করলো।
এই মুহুর্তটিকেই যতো ভয় আমার, কতবার এমন হয়েছে তা ঠিক জানিনা। আসেনি এমন নবজাতকের ক্ষতির কথা ভেবে এভাবেই কী পালিয়ে বেড়াবো? একটু শান্তির খুঁজে এই দূর দেশে চলে এসেছিলাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সম্ভাব্য সবখানে।
কিন্তু এবার কি গল্পটা একটু অন্যরকম হতে পারেনা।
আমি ফারহানার বাদামী চোখের দিকে তাকালাম এবং চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলাম না। তেমন ইচ্ছেও আর নেই।
''আমরা বিয়ে করি, আমাদের দুটো বেবি হয়। একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে।''
ফারহানা বিস্ময়ে মুখ হাত দিয়ে ঢাকলো, ''কী? আমি ভাবলাম আপনি বই পড়েন, আপনি ভদ্র মানুষ। কিন্তু আপনার মাথা যে এতোটা খারাপ সেটা বুঝিনি। আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছেন কিছু?''
এমন সময় আমার মনে হলো, যে মেয়েটিকে আমি দেখছি তাকে এর আগে কখনো দেখিনি। কখনো কথা বলা হয়নি আগে। কিছুই মনে করতে পারছিনা আমি।
একটি লোককে এদিকে আসতে দেখলাম।
''আপনি আমার কাছে এসেছেন''-তাকে বললাম। ''কিন্তু আমি আপনাকে চিনিনা''
আমি ফারহানাকে অনুভব করছি তখন বিশেষত তার দু:খগুলোকে, বলা ভালো আমাদের দুজনের দু:খগুলোকে। এবং অলরেডি আমি তাকে মিস করা শুরু করেছি।
''আপনি যে ঠিক বলছেন তা প্রমান করুন''-আমার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে সে বলতে থাকলো, ''একটা মেয়েকে আপনি বিয়ে করবেন সেটা একদিন কথা বলেই আমি নিশ্চিত হলেন কী করে?''
''আমি প্রমান করতে পারবোনা, আমি অক্ষম''
আমি আবার বইতে মন দিলাম। ফারহানা তার বাবার হাত ধরে চলে যাচ্ছে সেই দু:খটাকে ভুলতে এবং ভিজে যাওয়া চোখ ফারহানার কাছ থেকে আড়াল করতে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা।
আমি একটু পর ফিরে তাকালাম, সে একটু থামলো। বাবার হাতে হাত তখনও, আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বললো। আমি ঠোঁটের মুভমেন্টে বুঝলাম ''অডি'', আমি হাসলাম।
মুহুর্তেই তার চেহারায় হাসির আভা দেখতে পেলাম, খুশিমনেই সে বুকস্টোর থেকে বের হয়ে গেল।
তার নাম ফারহানা, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গোলাপটা একদিন আমি তার হাতে তুলে দিবো।
-----------------------------------------
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৭, ২০১৩
মন্তব্য
ভাল্লাগছে। মেলাদিন পর এইরকম ধাঁচের গল্প পড়লাম। লেখা চলুক।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ধন্যবাদ অনার্য সঙ্গীত। আমি লেখক নই, সচলায়তনে অংশগ্রহন করার জন্যই চেষ্টা শুরু করলাম। ভাল থাকবেন।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৯, ২০১৩
ভালো লাগলো, অনেকটা 'বাটারফ্লাই ইফেক্ট' মুভিটার মত কিন্তু আপনারটা অনেকটাই স্বতন্ত্র।
আরও লিখুন।
শব্দপথিক কে শুভেচ্ছা
অনেক ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। নিয়মিত লিখে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৯, ২০১৩
বেশ রহস্যঘেরা আবহ তৈরী করলেন। কিন্তু দিব্যদৃষ্টির ব্যপারটা ক্লিয়ার হলোনা। ভবিষ্যত কি স্বপ্নে দেখেছে, নাকি ওখানে ফারহানাকে দেখা মাত্র ভবিষ্যত চলে এলো মাথায়?
তবে পড়ে মজা পেলাম।
____________________________
প্রোফেসরকে অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। কাউকে দেখলে ভবিষ্যত এ তার সাথে মিথস্ক্রিয়া কেমন হবে সেটা বুঝতে পারা-এটাই এই গল্পে দিব্যদৃষ্টি।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৯, ২০১৩
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খুব সুন্দর গল্প। ভাল লেগেছে।
ওয়াইফাই ক্যানসার
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৯, ২০১৩
বেশ ভাল লাগল। সহজ সাবলীল ভঙ্গি কিন্তু প্লটটা বেশ অন্যরকম।
লেখা চলুক।
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
অনেক ধন্যবাদ শাব্দিক। নিয়মিত লিখে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ২৯, ২০১৩
গল্পটা দারুণ। আরেকবার একটু চোখ বুলিয়ে নিয়েন; বুঝতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে বারবার আগের লাইন পেছনের লাইন মিলাতে হচ্ছিল; বর্ণনা আর কথা বোধহয় মিশে গেছে কয়েক জায়গায়
মন্তব্য এবং পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ লীলেন দা। নেক্সট থেকে আরো সতর্ক হবো বর্ণনায়।
শব্দ পথিক
মিষ্টি প্রেমের গল্প যদি এমনে এমনেই বের হয় হাত থেকে তবে কেন হাত বেঁধে রাখা।
চলুক ঝড়ো গতিতে।
ভালো থাকবেন শব্দ পথিক।
অনেক শুভ কামনা।
-----------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
নতুন মন্তব্য করুন