বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান

শব্দ পথিক এর ছবি
লিখেছেন শব্দ পথিক [অতিথি] (তারিখ: শনি, ৩১/১০/২০১৫ - ১১:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের কথা বলি, পাঠ্যক্রম বিজ্ঞানসম্মত করার কথা বলি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কেবল পাঠ্যক্রম বিজ্ঞাসম্মত হলেই বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিজ্ঞান পড়ানোর চেয়ে বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদী শিক্ষক বেশি দরকার যিনি সত্যিকারের শিক্ষার আলোটা ছড়িয়ে দিবেন।

কয়েক বছর আগে দেশে কিছু নতুন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত, বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের বিভিন্ন বিভাগে যোগ দেয়া অধিকাংশ শিক্ষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির এবং হিজবুত তাহরীরের সাথে যুক্ত থাকা প্রাক্তন ছাত্র। আমরা যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলি, তারা সংস্কার কোথায় শুরু করতে হবে ধরতে না পারলেও যারা দেশে প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধর্মান্ধ সমাজ কায়েম করতে চায় তারা তাদের উপযুক্ত কর্মস্থল ঠিকই খুঁজে নিয়েছে। সোশ্যাল সায়েন্স এবং লিবারেল আর্টসের বিষয়গুলোর শিক্ষকদের চেয়ে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের শিক্ষক তালিকায় কয়েকগুণ বেশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের সাথে জড়িত শিক্ষক দেখে আমি অবাক হইনি, এটাইতো হবার কথা। উদাহরণস্বরূপ, চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় হলো সোশ্যাল সায়েন্স এবং লিবারেল আর্টসের পড়াশুনা ও গবেষণার সূতিকাগার, তারা ঐতিহাসিকভাবেই সরকারের আগ্রাসনবিরোধী; কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে, বাকস্বাধীনতার পক্ষে লেখালেখি করে, কর্মসূচি চালিয়ে ক্রমাগত নির্যাতিত হয়েছে তারা। অপরদিকে সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় হলো বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষণার কেন্দ্র, এবং যথারীতি সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত সরকারের অংশ।

স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তাদের মাঝে প্রগতিশীল এবং মধ্যমপন্থী দুটি অংশের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য দেশের বাইরে এসে দেশে ফিরছেন না, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল-ধর্মান্ধ অংশের ৯৯ ভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরছেন। এমনকি ধর্মান্ধ অংশের যারা দেশে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারছেন না, তারা দেশের বাইরে এসে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন কেবলমাত্র দেশে ফিরে শিক্ষক হবার জন্য। আমার কাছে এটিকে প্রতিক্রিয়াশীল-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিশাল পরিকল্পনা বলেই মনে হয়েছে। ঢাকার বাইরের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং প্রকৌশলের অধিকাংশ বিভাগে প্রতিক্রিয়াশীল-ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এবং আগামী দশ বছরে ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। শিক্ষক প্যানেলে অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষককে জায়গা ছেড়ে দিয়ে শুধু লেখালেখি করে ধ্বংস এড়ানোর সুযোগ এখন তেমন একটা নেই।

লেখালেখি চালিয়ে যেতে হবে, তবে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে আমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে। তা নাহলে, আগামী পাঁচ বা দশ বছরে বাংলাদেশী প্রগতিশীলরা ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকাতে একটি ক্ষুদ্র সমাজে কেন্দ্রীভূত হবে। যে সমাজ থেকে উঠা আওয়াজ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রচারিত হলেও বাংলাদেশের মিডিয়াতে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার মতো একটি মানুষও বাংলাদেশে অবশিষ্ট থাকবেনা।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত, বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের বিভিন্ন বিভাগে যোগ দেয়া অধিকাংশ শিক্ষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির এবং হিজবুত তাহরীরের সাথে যুক্ত থাকা প্রাক্তন ছাত্র।

এই শংকাটা আমারও আছে। আপনি এই স্টেটম‍েন্টটার ড‍্যাটা ব‍্যাকআপ দিতে পারবেন?

শব্দ পথিক এর ছবি

আমি নিজের অন্য একটি লেখার জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক তালিকা দেখছিলাম, তখন শিক্ষক তালিকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের আধিক্যের বিষয়টি নজরে আসে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কয়েকজনের ব্যাপারে খোঁজও নেই। আরো একটি বিষয় হলো এসব শিক্ষকদের প্রায় সবাই বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, কিন্তু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

হাসিব এর ছবি

কিছু মার্কামারা বিশ্ববিদ‍্যালয় হলেই সেখানকার লোকেরা শিবির/মৌলবাদি এটা শক্ত আর্গুমেন্ট না।

শব্দ পথিক এর ছবি

স্যাম্পল হিসেবে কয়েকজনের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি সেটা আগের কমেন্টে উল্লেখ করেছি, তারা অধিকাংশই হল পর্যায়ে শিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থক ছিলো।

ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের বিভাগসমূহের অধিকাংশ পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক (যারা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন) কোন না কোন রাজনৈতিক বা দাওয়াতি ধর্মীয় সংগঠনের সাথে জড়িত। এই বিষয়টাকে আমার কাছে এলারমিং মনে হয়েছে।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

অতিথি লেখক এর ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে একটা কথা জানি, যেসব সিনিয়র শিক্ষকের খুঁটির জোর খুব শক্ত, তাঁরা যে দলেরই হোন না কেন, নিজের পছন্দের বা নিজের প্রয়োজনের শিক্ষার্থীকে ঠিকেই শিক্ষকতায় নিয়ে আসতে পারেন। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ যে ছাত্রাবস্থায় শিবিরের সক্রিয় সদস্য, এটা সর্বজনস্বীকৃত বিষয়, হাতে তথ্য-উপাত্ত নেই বটে, নিজের চোখে দেখা বলে এটা বলতে পারি।

আরও একটা আশঙ্কাজনক কথা শুনেছিলাম, জামায়াত শিবির নাকি প্রতিবছর তাদের টার্গেট নির্ধারণ করে কোন প্রতিষ্ঠানে কতজন তাদের ছেলেমেয়ে ভর্তি হবে, সেভাবেই তাদের তৈরি করতে থাকে, পরে এই লক্ষ্য শতভাগ না হলেও বেশিরভাগটাই পূরণ হয়। সত্যি মিথ্যা জানি না, শোনা কথা এটা।

দেবদ্যুতি

সাবিহ ওমর এর ছবি

সময় লাগবে, আরো অনেক সময়। সময়কে অতিক্রম করতে হলে রক্ত ঝরাতে হয়। কিন্তু রক্তের দাম বড় চড়া, তার সামনে সবই অর্থহীন হয়ে যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

এখানে আরেকটা স্যাটায়ার আছে...প্রগতিশীল ধারার (রাজনীতির সাথে যুক্ত বা যুক্ত নয়) শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ শিক্ষাজীবনে মোষ তাড়াতে গিয়ে, রেজাল্টে পিছিয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোরও এ বিষয়ক কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নেই। সংগঠনে থাকার সময় কিছু অনুজকে এ বিষয়ে উৎসাহী করার চেষ্টা করেছি ব্যক্তিগতভাবে। এজন্য অনুজদের সংগঠনবিমুখ করছি এমন কথাও শুনতে হয়েছে। তাদের কেউ কেউ স্ব স্ব বিভাগে প্রথম দ্বিতীয় হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে গেছে। দু-একজন বিজ্ঞন-প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। এদের কজন ফিরবে বলা যায় না। ফিরলে যেখানে ফিরবে তাতে কতটা নিরাপদ থাকতে পারবে তা এ সময়ে আর স্পষ্ট করে বলার দরকার পড়ে না।

আমাদের প্রগতিশীল সংগঠনগুলোর এটা ভীষণ এক দুর্বলতা। শিবির থেকে শুররু করে ইসলামী সংগঠনগুলোর এক্ষেত্রে পৃথক উইং আছে। প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় বা পুলিশ কোথায় কতজন যাবে তার একটা লক্ষ্য আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। ক্যাডারসুলভ কাজে এ অংশকে সাধারণত জড়ানো হয় না। আমার নিজের বিভাগে যে প্রথম হয়েছিল সে শিবিরকর্মী। মজার বিষয় হলো আমাদের কয়েকজন ছাড়া তাকে এই সম্পৃক্ততার বিষয়ে কেউ সন্দেহও করেনি কখনো। শিবিরের মেস থেকে এরেস্ট হওয়ার পর বাকিরা নিশ্চত হলো যে, সে শুধু করতোই না, তার কেন্দ্রীয় পদও ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে তারপরও তার জন্য নিয়োগের সার্কুলার পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। এটা ২০০৯ এর ঘটনা। তাহলে গভীরতাটা নিশ্চতভাবে অনুমান করা যাচ্ছে।

এ জায়গাগুলোতে যদি মনযোগ না দেয়া যায়, তাহলে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর লেখা দিয়ে কিছু হবে না। ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। অনেক বেহুদা কথা বলে ফেললাম।

স্বয়ম

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শিক্ষক প্যানেলে অধিকাংশ প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষককে জায়গা ছেড়ে দিয়ে শুধু লেখালেখি করে ধ্বংস এড়ানোর সুযোগ এখন তেমন একটা নেই।

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।