এক
এখানে, এইখানে, মাটির অনেক গভীরে শিমুল গাছটার ছড়ানো মূলের আভাস পেয়ে নদীটা জলের একটা ঘূর্ণি হয়ে গেছে।
নদীটা সারাবছর মরেই থাকে। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি ঈশান কোণে খুব ঘন মেঘ করে এলে বুকজোড়া বালির চাংড়া ভেঙ্গে নদীটার হঠাৎ যৌবন উথলে উঠে যেন। তখন দলছুট কচুরিপানা, উপড়ানো ভুট্টা আর পাটগাছের মূলসমেত রাজ্যের ভাসমান বস্তু অল্প অল্প ঢেউয়ের দোলায় ডুবিয়ে ভাসিয়ে চরবৈরাতির প্রায় শ’দেড়েক বাড়ির ভিটা ছুঁই ছুঁই হয়ে কাদামাখা জলের স্রোত নেমে যায় ভাটির পথে। কখনো কখনো সেই আন্দোলিত বেনোজলে ঝুপ ঝুপ ভেসে যায় সমিরুদ্দি অথবা আক্কাস কিংবা আলী হোসেনদের খড়ের চালা, মাটির হাড়ি, খেজুর পাতার পাটি আর কালো বকনা গাইগরুটি। তা বলে জীবন এখানে নদীর বানে ডুবে যায়নি আজও।
ঘূর্নিটার দিকে তাকিয়ে কোবাদ আলীর মনে হল যেন নদীর পানি একটু বেড়ে উঠছে। স্রোতটা একটু ভাটিতে ছিদাম মাঝির শ্যালো নৌকার ঘাটের বাঁধা বাঁশের গোড়ায় গোত্তা খেয়ে পাঁক ধরে উঠছে ভেতর থেকে। আর প্রায় মিশমিশে কালো ঘোলা পানির তোড়ে কোবাদ আলীর পায়ের সীমানায় শিমুল গাছটির গোড়ার মাটি কেমন আলগা হয়ে হয়ে নেমে যাচ্ছে নদীর অতলে। গাছটা এই বর্ষা টিকবে না। তবে চরের বাড়ির ভিটিগুলো এখনো কাদামাটির ভিতের উপর নড়বড়ে হয়ে জেগে আছে। আজকালের ভেতর বৃষ্টি ধরে এলে এযাত্রা হয়ত বানের পানিতে গেরস্থালী ভাসবে না। কিন্তু আকাশের কি ভরসা আছে? গেলো তিনদিন হল কেমন এখন তখন বড় বড় ফোঁটায় মুষলধারে বৃষ্টি গড়িয়ে নামছে! বৃষ্টির ধার দেখে মনে হয় আকাশটার কোন একখানে যেন ফুটোফাটা হয়ে গেছে। আজ বিকেলে মেঘ একটু ধরে এলেও নদীর ঐপারে গঙ্গাচড়ার সীমানা ধরে দক্ষিণ পশ্চিমের আকাশে বড় বড় কয়েক প্রস্থ মুশমুশে কালো হাতীর মতন মেঘের সারি ঝুলে আছে। বৃষ্টি হয়ে গলে পড়ার খুব অপেক্ষা নিয়ে বেকায়দা রকম ঝুলে থাকা এলোমেলো মেঘগুলোর মৌন আড়াল একটু ভয়ে ভয়ে দেখে উত্তরে ভাকারির বাঁধের দিকে দৃষ্টি গেলো কোবাদ আলীর।
ভাকারির বাঁধের উজানে শৈলমারীর চরে কাল থেকে নাকি পানি উঠেছে বেশ। বাঁধের আরও উজানে বান হয়েছে খুব, গফুর মেম্বার কাল গঞ্জে থেকে শুনে এসেছে। সেই বানের আচানক ঢল নদীর অপ্রশস্ত বুক জুড়ে ধাই ধাই এসে যেন শৈলমারী আর বৈরাতির চরে ঠেকেছে। এর ভেতর মুষলধারে বৃষ্টি এসে নদীটাকে উস্কানি দিয়ে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে। কোবাদ আলীর হঠাৎ ভয় ভয় হয় কেমন। আজ রাতে যদি বানের পানি উঠে আসে চরবৈরাতির ভিটেয় ভিটেয়!
দুই কুড়ি বয়েস পেরিয়ে বান সে দেখেছে অনেক। নিজের দুইহাতে কতবার দুধেল গাইয়ের গলার রশি খুলে পানিতে নামিয়ে দিতে হয়েছে তার! বানের তোড়ে নিজেদেরই দাড়ানোর মতন শুকনো মাটি নেই। গাইগরুটাকে আর রাখবে কোথায়। ঘরের ভেতর বাঁশ পুঁতে আর চালার সাথে ঝুলিয়ে মাচাং পেতে সংসার নিয়ে জলবন্দী জীবন তো অনেকবারই কেটেছে। বানের পানি নেমে গেলে পরে বাঁশগাড়ি নিয়ে মারামারিতে পড়ে গেলো বারের আগেরবার তার বাম হাতের উপরই তো দম ফেলল পূবপাড়ার রহিম শেখের মুশকো ছেলেটা। এইরকম দুঃখের বেসাত নিয়ে বানের দিনগুলো বুঝি খুব দ্রুতই ফিরে আসে, মনে হল কোবাদ আলীর।
আবজাব ভাবতে ভাবতেই নদীর পূবের নালা ধরে একটা সরু কালো ধোঁয়ার রেখা ছড়িয়ে ঘাটের দিকে আসতে থাকা শ্যালো নৌকাটি দেখতে পায় সে। নৌকার গলুইয়ের উপর ছিদাম মাঝির মেঝ ছেলেটির উদাম পিঠ ঠাহর করা যায় খুব। শ্যালো নৌকার বিকট ভটভট শব্দতাড়িত হয়ে পেছনের কাশবনের ঝোপ থেকে কতোগুলো মাছরাঙা ইতস্তত উড়ে উড়ে দূরের দিকে ফিরে যায়। ঘাটের খুব কাছে এসে শ্যালো বন্ধ করে মাঝির ব্যাটা কায়দা করে গুণের রশিটা ছুড়ে দেয় কোবাদ আলীর দিকে।
- ও ও ও কাকু। রশিখান বান্ধি ফেলাও দিকি খুঁটির নগে। ছিদাম পাটনির ছেলে হাঁক ছাড়ে।
- ক্যারে, তোর বাপক্ ঘাটত্ আসিয়া খাড়া হয়া থাক্পার কবার পারিস নোয়ায়? উয়ায় আসিয়া তোর নাওয়ের অশিখান (রশিটা) বান্ধি দেউক। মোক ক্যান বা পুছ করিস?
মুখে কপট রাগ এনে কোবাদ আলী এসব বলে বটে। তবে মাঝির ছেলের ছুড়ে দেয়া শ্যালো নৌকার রশিটা ঠিকই জুতমত ধরে ফেলে সে। তারপর শিমুল গাছটার আগে পুঁতে রাখা বাঁশের খুঁটিটায় দুটো প্যাঁচ দিয়ে কষে বেঁধে ফেলে। শ্যালো নৌকার এই খ্যাপটি আজকের শেষ। সূর্য তলিয়ে গেলে পরে এইপথে আর কোন নৌকা নেই পারাপারের। ওপারে মূল ভূখণ্ডে নানা কাজে যেতে তো হয়ই সবাইকে। তবে সে আসাযাওয়া খুব নিয়ম মেনে ঘটাতে হয়। খুব বিপদ না ঘটলে গাঁয়ের সবাই চেষ্টা করে বেলাবেলি চরে ফিরে আসতে।
নৌকা স্থির হয়ে এলে পরে পাটাতন থেকে গাঁয়ের অনেকেই আলগোছে নেমে আসে বৃষ্টির জল পেয়ে ভেজা কদম ফুলের মত নরম বালির ফোলা মাটির জমিনে। কৈবর্তপাড়ার জলু আর তার ব্যাটা দেলু মাথায় মাছ বিক্রি করার ডালি একহাতে ধরে লাফিয়ে নামে সবার আগে। তার পেছনে নব্বেস মৃধা। তার হাতে বেশ বড়সড় পলিথিনের পোঁটলা দেখে কোবাদ আলী জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
- মির্ধার পো। কি ধরি আসলেন গো?
ডাক শুনে ঘর ফিরতি মানুষের ভিড় ঠেলে নব্বেস মৃধা শিমুল গাছটার নীচে কোবাদ আলীর দিকে সরে এসে দাড়ায় একটু।
- আর না ক’ন। তুমার ভাইস্তা ব্যাটা বায়না ধরিল গঞ্জে থিকা ডাইল পুরী খাইবে। উয়াক ধরিয়া (ওকে নিয়ে) এই বাদলার দিনে কি আর গঞ্জে যাওয়া সম্ভব অয়? মুই কি আর করি। ভুলাইয়া ভালাইয়া উয়াক বাড়ি রাখিয়া গঞ্জে গেইনু। ডাইল পুরী আর মুড়ি কিনিয়া আনলু। বাড়িত গিয়া উয়াক একটা গামলার উপরে বসাই খাবার ঢালি দিমু। দেখি। উয়ায় কত খাবার পারে, খাক।
- কন কি মির্ধার পো। একখান ছাওয়া আপনার। উয়ার পরে আগ করিয়া (রাগ করে) কি কাম করেন।
এটুকু বলে কোবাদ আলী গোপন শ্বাস নেয় একটু। নিজের ঘরের কথা মনে পড়ে তার। ঘরে পিঠাপিঠি চার ছেলেমেয়ে। একেকটার একেক বায়না। একটা গুড়ের জিলিপির বায়না ধরে তো তার বড়টা বুন্দিয়া খাবে। একেবারে ছোটটার বয়েস তিন হল। ওটা এখনো বায়না করতে শেখেনি। শিখলেও অবশ্য লাভ হতো না কোন। কেননা, গেলো দু তিন মাসে বুন্দিয়া জিলিপির কোনটাই তার ঘরের চৌকাঠ মাড়ায়নি।
- তা টিভিত্ বানের কুন খবর আসিল নাকি?
কোবাদ আলী প্রসঙ্গ পাল্টায়। গঞ্জে কি উপায়ে যেন আজকাল অনেক টিভি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে। নদীর ওপার গঞ্জের ওদিকে গেলে কোবাদ আলীও শুকুর মিয়ার চায়ের দোকানে মাঝেমধ্যে বসে পড়ে। চার টাকা কাপ ডেনিশ দুধের চায়ের সাথে দুই টাকা দামের কুকিস বিস্কিট নিয়ে গরম চায়ের কাপে ডুবিয়ে ডুবিয়ে আস্তে আস্তে খেতে খেতে দোকানের এক কোণায় উঁচুতে আটকানো টিভিতে চোখ রাখে সে। চায়ের কেতলিতে জ্বালানো আগুনের ধোঁয়া মাখা সেই টিভিতে কি সব বাহারি ছবি! আর দুনিয়ার সব সব খবর দেখা যায়। নেতা মন্ত্রীদের ছবিতো আছেই। আরও কিসব নায়ক নায়িকাদের বেশরম ছবি যে দেখায়। কথাটা মনে হতেই কোবাদ আলী আলগোছে জিভ কাটে।
গঞ্জে শুকুর মিয়ার চায়ের দোকানে টিভি দেখা যায় বটে। তবে খুব বেশি সময় না। এক কাপ চা আর কতক্ষণ ধরেই বা খাওয়া যায়! চা খাওয়া শেষ হতেই হাত থেকে কাপ নিয়ে ক্যাশে টাকা জমা করার তাগাদা দিতে থাকে দোকানের বাচ্চা ছেলেটা। আর নতুন কাস্টমার এসে টিভির ভেতর প্রজাপতির মতন ছুটতে থাকা ছবির উপর চোখ রেখে একেবারে ঘাড়ের উপর দাড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে গরম শ্বাস ফেলে। অগত্যা নিতান্ত অনিচ্ছায় ছয় টাকা উসুল না হতেই চায়ের দোকান ছাড়তে হয়। কি আর করা। কোবাদ আলীর খুব গোপন একটা ইচ্ছা, একদিন একমণ ভুট্টা বেঁচে সবকটি টাকা নিয়ে শুকুর মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসবে। তারপর এক দুই করে অনেক অনেক কাপ চা খাবে। সাথে টোস্ট বিস্কিট নেবে এক প্যাকেট। কুকিস বিস্কিট না। ওগুলো কেমন যেন কাঠ কাঠ। এতোগুলো চা আর বিস্কিট একবারে খেতে থাকলে নিশ্চয়ই শুকুর মিয়া জায়গা ফাঁকা করার জন্য দোকান থেকে বেড়িয়ে যেতে তাগাদা দিতে পারবে না। আর এই ফাঁকে টিভির পর্দায় তিস্তার বড় বড় আইর মাছের মতন পেলব শরীরের নায়িকাদের দিকে সে তাকিয়েই থাকবে। অপলক। হঠাৎ তার মনে হয় নব্বেস মৃধা কিছু একটা বলছে তাকে। কোবাদ আলীর ঘোর ছুটে যায়-
- হ। কুড়িগ্রামত ভালোই বান হবার নাগছে। টিভিত্ দেখনু। হামার লালমনিতে বান নাই আসে এখনো। নব্বেস আলী কথা শেষ করে।
- ঠিক শুনি আসছেন তো মির্ধার পো? ভালোয় ভালোয় এই পালায় বান না আসিলেই হয়। কোবাদ বিপুল ভরসা পায় মৃধার কথায়। টিভির কথা কি আর ভুল হতে পারে?
কোবাদ আলীর হঠাৎ মনে পড়ে ধানের দাম খোঁজ নেয়া দরকার। নব্বেস মৃধার বা হাতে ধরা চটের বস্তার দিকে নজর করে সে শুধায় আবার- গঞ্জে ধানের দাম পুছ করি আসছেন নাকি?
- হ। ধান বেচিয়া আস্নু তো। পাঁচশ ট্যাঁকা মণ।
- ইবার ধান ভুট্টা সবতেই তো খালি লস আর লস হবার নাগসে। হালচাষ বুঝি বাদ দিবার হয় এই চালানে।
কোবাদ আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মনে পড়ে, মাস খানেক আগে দু মণ ধান নিয়ে গিয়েছিল সরকারী গোডাউনে। তখন ধানের দাম খুব পড়তির দিকে। গঞ্জে থেকে খবর এসেছিল, সরকারী গোডাউনে ধান কিনবে ন্যায্যমূল্যে। কোবাদ আলীর ঘরে বিক্রির মতন ধান তো খুব বেশি নেই। বাজার সদাই আর ফসল কাটা কামলার দাম দিতেই সব ধান ফুড়িয়ে যায়। একটু ভালো দাম পাবার আশায় শ্যালো নৌকায় নদী পেরিয়ে এরপর ওপারে একটা ভ্যানগাড়ি ধরে ধান নিয়ে গোডাউনে পৌছাল সে। গোডাউনের একটু আগেই গঞ্জের ফড়িয়া হাতেম ব্যাপারি থামায় তাকে।
- মিয়া ভাই। খাড়া হন দিকি।
কোবাদ আলী কিছু বলার আগেই ভ্যানগাড়ির চালক দাড়িয়ে যায় ব্যাপারির বরাবর।
- কি বিষয়? কোবাদ আলী কিছুটা অবাক হয়।
- ধান ধরি আসছেন?
- হ।
- গোডাউনে বেচাইবেন?
- হ। কোবাদ কিছুটা বিরক্ত হয়। এই ব্যাটা কি বলতে চায় পথের মধ্যে?
- নাই পারবেন ধান বেচাইতে।
- ক্যান? কোবাদ আলী লোকটার কথা বুঝতে পারে না ঠিকঠাক।
- উমায় তো সরেস (ভালো) ধান কেনবে। তুমার ধান কি সরেস? এক কাম করেন। মুই পাঁচশ ট্যাকা দেই। ধান মোক দিয়া যান।
- পাঁচশ ট্যাঁকায় ধান নাই বেচি। গোডাউনে সরকারী লোক সাতশ ট্যাঁকায় কিনিবে। খুব বিরক্তি নিয়ে কোবাদ কথাগুলো বলে।
- কৈসে আপনেরে। হাতেম ব্যাপারি রাস্তার ইটের উপর থু করে পানের পিক ফেলে একটু হাসে।
- আইচ্ছা। মুই গোডাউনে যায়া দেখি। কত ট্যাঁকা দেয়। কোবাদ আলী ভ্যানগাড়িওয়ালাকে সামনে যেতে বলে।
হাতেম ব্যাপারি একটু সরে দাড়ায় পথ থেকে। পাঞ্জাবীর কোণায় ঠোঁটের ফাঁকের পানের রসটুকু মুছে সে আবার ডাকে।
- আরে খাড়া হন মেজবান।
কোবাদ আলীর ইচ্ছে না থাকলেও ভ্যানগাড়িওয়ালা কেন যেন থেমে যায়।
- কি কন। দূর থেকেই কোবাদ আলী জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
- আইচ্ছা। যান। আরও পঞ্চাশ দিমু। সাড়ে পাঁচশ।
কোবাদ আলী শোনে। কিছু বলে না। কেবল একটা গালি দেয় মনে মনে ব্যাপারিকে। তারপর ভ্যানগাড়ি নিয়ে একেবারে গোডাউনের গোড়ায় হাজির হয়। তবে সেখানে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। গোডাউনের অফিসার তার বস্তার ধান কি সব দেখেটেখে ঘোষণা দিলেন এই ধান নেয়া যাবে না। ময়েশ্চার না কি যেন নাকি নেই। কোবাদ আলী আর কিছু বলার সাহস পায়না। পায়ে পায়ে সে ফিরে এসে দাড়ায় হাতেম ব্যাপারির ছাউনির নীচে। ফেরত আসার পর ব্যাপারি যেন তাকে দেখতেই পায় না। ধানের বস্তা একেবারে ব্যাপারির পায়ের কাছে গড়িয়ে ফেলে দিলে পরে ব্যাপারি কোবাদ আলীর পরাজিত চোখের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচায় একটু।
- মিয়ার পো। হামার এইডা তো গোডাউন না। এহানে কি কামে ধান ধরি আসলেন।
কোবাদ আলী কিছু বলে না। তার কেবল ধানের বস্তাটার ভেতর নিজেকে লুকিয়ে লজ্জা ঢাকতে ইচ্ছে করে।
- আমি গোডাউন ফেরতা মাল নাই ধরি। তাও যাক। দূর থাকিয়া আসছেন। তুমার ধান মুই নিলাম। আইচ্ছা। যান। পাঁচশো ট্যাঁকা পাইবেন। ধান ঐহানে ঢালি আসেন। হাতেম ব্যাপারির চোখে এখন আর কৌতুক নেই।
শেষমেশ কোনমতে হাতেম ব্যাপারির আড়তে পাঁচশ পঞ্চাশ টাকায় ধান গছিয়ে কোবাদ আলী বাড়ি ফেরে। এরপর আর ধান বেচতে যায়নি ওদিকে। ধানের দাম তবে এখনো বাড়েনি একটুও।
সন্ধ্যার কুয়াশামাখা ঘুমঘুম মায়াময় অন্ধকারে এইসব ভাবতে ভাবতে ওরা দুইজন ছোট আইল পথে বাড়ির পথ ধরে। ঠিক তখন শিমুল গাছের গোড়া আলগা হয়ে আরও বড় একটা মাটির ঢিবি ঝুপ ঝুপ করে জলের ভেতর গলে যেতে থাকে।
দুই
রাতের খাবার হয়েছে অনেক আগেই। ঘরে কেরসিন তেল বাড়ন্ত। বাপ চুপচাপ বিছানায় উঠে না এলে ছেলেমেয়েগুলো বিছানায় থিতু হতে চায়না। ওরা মনে হয় আজ বেলাবেলি ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের খাবার সুবিধে ছিল না বিশেষ। কোবাদ আলী অনুমানে বিছানার মাঝখানে নেতিয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর দিয়ে ফুলমতির দিকে হাত বাড়ায়। বউটা এক ঝটকায় তার হাত এদিকে ফেরত পাঠায়। আজ মেজাজ মর্জি খুব খারাপ আছে বউয়ের- কোবাদ আলী ভাবে। সন্ধ্যায় চুলা জ্বালানোর মতো কোন কাঠ টাঠ কিছু ছিল না। সব কিছু তো ভেজা। সে নিজেও আবার ঘাটের পাড় থেকে বেলা ডুবিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এদিকে বউটা একা রান্নাবান্না করতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছে ভীষণ। তবুও রান্না দেরী দেখে মেজাজ চড়িয়েছে বেশ বউয়ের উপর। সেকথা ভেবে এখন খুব খারাপ লাগলো তার। কাল কিছু লাকড়ির জোগাড় দেখতে হবে। নইলে চুলো জ্বলবে না।
এইসব ভেবে ভেবে রাত আরও গভীর হয়ে এলে দূরের ডোবায় ব্যাঙের একঘেয়ে ডাক কোন এক অজানা সঙ্গীতের সুরের সাথে মিলিয়ে আসে। দক্ষিণ ভিটির গর্তজীবি শেয়ালের দল কোন এক অজানা আশংকায় ডাকতে ভুলে গিয়ে ঘাটলার পাড়ের নেড়ি কুকুরটার একটু পেছনে দাড়িয়ে অন্ধকার শূন্যে তাকিয়ে থাকে। তখন তেল চিটচিটে বালিশের ওপর বেঘোর ঘুমে আলুথালু ফুলমতি, কোবাদ আলী আর নব্বেস মৃধা, কৈবর্তপাড়ার ছিদাম মাঝি, জালু, দেলুদের মগজের ভেতর হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে চরের একমাত্র এনজিও ইশকুলের মাইকটা বিভীষিকার মতন বেজে উঠে-
ভাইসব!! ভাইসব!! তাড়াতাড়ি জাগেন। ভাকারির বিলের বাঁধ ভাঙ্গি গেইছে। বানের পানি ধেয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বাইর হন।
কোবাদ আলী তড়াক করে লাফিয়ে নেমে যায় বিছানা থেকে। তার দুইহাতে দুটো অমৃতের পুত্রকন্যা। তার বউটিও নিষ্কৃয় থাকে না। এলোমেলো শাড়িটা কোমরে গুঁজে দুধের শিশুটিকে একহাতে তুলে সেও স্বামীর অনুগামী হয়। বানের পানি চলে আসার আগেই উঁচু ফ্লাড শেল্টারে পৌঁছুতে হবে। ওদের পেছনে চরবৈরাতির জলের সীমানায় তখন অনেকগুলো বড়বড় ঢেউ।
তিন
চর বৈরাতির এন জি ও ইশকুলের মাইকের ঘোষণার ঘণ্টা তিন আগে। ভাকারির বিলের বাঁধের উপর টর্চ লাইট আর কোদাল হাতে কয়েকটি ছায়া শরীর নড়েচড়ে উঠে। বিলের ভেতর অনেক মাছ। উজানের বন্যার পানির তোড়ে মাছ গুলোর ভেসে যাবার উপক্রম হয়েছে। এতোগুলো টাকার মৎস্য প্রকল্প। এভাবে বানের তোড়ে ভেসে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখা কোন বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়। মুখোশগুলো তাই রাতের কোন এক প্রহরে কেউ একজনের নির্দেশে বাঁধের ভেতর কয়েকটি ফুটো গলে দেয়। আটকে পড়া বানের পানি সেইসব ফুটো গলে বিপুল ঢল হয়ে গড়িয়ে নেমে যায় ভাটিতে কোবাদ আলীদের ভিটেবাড়ির দিকে।
ভাকারির বাঁধের ফুটো গলে অনেক পানি নেমে আসারও দুই তিন দিন আগে। কোন একটি নদীতে প্রচুর পানি জমে গিয়েছিল। পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য একটা ব্যারেজের স্লুইস গেটগুলোর সব একেবারে খুলে দেয়া হয়েছে। সেই হাট করে খোলা স্লুইস গেট ধরে এক বরষার বিপুল জলরাশি কোন এক নদীর পথ ধরে জল পিয়াসী সমুদ্রের টানে ছুটে চলেছে।
সেই প্রবল জলের স্রোতে কিছু ঘরবাড়ির চালা আর কিছু হাড়ি পাতিল ভেসে গেলে তা কোবাদ আলীদের যেতে পারে। তা যাক। আসুন। আমরা আরও একটা নতুন গল্পের প্লট বানাই।
মন্তব্য
হাচল হওয়ার পর প্রথম লেখা? অভিনন্দন...
ধন্যবাদ
খুব ভালো লেগেছে বিশেষ করে শেষের অনুচ্ছেদটি।
ধন্যবাদ
হাচলাভিনন্দন!
সচল জুলিয়ান সিদ্দিকী'র একটা উপন্যাস আছে - 'কম্পেন্ডার'। মেঘনা অববাহিকার বানভাসি মানুষের জীবন, বাঁধের ওপরের জীবন - এসবের চমৎকার, অথেনটিক বর্ণনা আছে সেখানে। এই গল্পটাতে তিস্তা-যমুনা অববাহিকার বান নিয়ে অমন একটা অথেনটিক বর্ণনা পাওয়া গেলো। এই অঞ্চলের মানুষের পেশা, বিশেষত মওসুমের সাথে সাথে যা পালটায় তা নিয়ে; এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে গল্পটিতে আরো ইন্ট্রো থাকার প্রয়োজন অনুভব করেছি। সংলাপগুলোতে ব্যবহৃত কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট-নীলফামারী এলাকার মুখের ভাষা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। বর্ণনা নিয়ে কোন কথা নেই, তবে গল্পের অভাবটা একটু বোধ করেছি। গল্পে ট্যুইস্ট থাকাটা জরুরী নয়, তবে ক্লাইমেক্সটাকে ঠিকমতো জমিয়ে না তুললে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখা যাবে না।
কোবাদ আলীদের গল্প আরো আসুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পাণ্ডব দা
আপনার অসাধারণ মন্তব্যগুলো আমায় একটা উম্মুক্ত আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে আমি নিজের লেখার প্রায় সব ভুলগুলো পড়ে ফেলতে পারি। এজন্য ধন্যবাদ নয়, কৃতজ্ঞতা জানবেন। আপনার মন্তব্যগুলো সচলে লেখার জন্য আমায় অসম্ভব রকমের অনুপ্রাণিত করেছে।
সচল জুলিয়ান সিদ্দিকীর 'কম্পেন্ডার' - এর সচলে প্রকাশিত অংশটুকু পড়লাম। অসাধারণ বর্ণনা। তবে কোন অজানা কারণে হয়ত পিডিএফ টি ডাউনলোড করতে পারিনি। পরে আবার চেষ্টা করে দেখব।
লালমনিরহাট এলাকার ভাষা আমি নিজে পুরোপুরি জানি না। নিজের একটু জানার সাথে এখানকার একজন সুহৃদের সাহায্য নিয়ে বাক্যগুলো লেখা। আমি আবার বাক্যগুলো অন্য কারুর সাথে মিলিয়ে দেখে সংশোধন করব-আশা রাখছি।
অনেক ভালো থাকুন আপনি।
হাচলাভিনন্দন!
লিখুন নিয়মিত...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ
অভিনন্দন!
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ধন্যবাদ শিমুল আপু
হাচলাভিনন্দন!
__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;
ধন্যবাদ ক্রেসিডা
ভালো থাকবেন অনেক।
আপনি খুব সুন্দর লেখেন।
অভিনন্দন
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
অনেক ধন্যবাদ উচ্ছলাপু
অভিনন্দন। লেখালেখি পুরোদমে চলুক। গল্প ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ মুরুব্বী
মশাই আপনি তো আগে বেশ নিয়মিতই ছিলেন হাচলও হয়েছেন এই পোস্ট দেয়ার বেশ কয়েকদিন আগে। আলসেমি ঝেড়ে লিখতে থাকুন।
যাই হোক বিলম্বিত হাচলাভিনন্দন
ভাইরে আলসেমি না মোটেও।
নেখানেখি বড়ই কঠিন কম্ম-- মনের অন্দর থেকে কি বোর্ডের ভিতর নিয়ে আসা বড়ই কঠিন
ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন