ভূমিকা
এই লেখা কোন ভূমিকার দাবি করে না।
কিন্তু কয়েকটা কথা জানানোর দায় থেকেই এই ভূমিকার অবতারনা। সচলায়তনে এত জ্ঞানী-গুণী মানুষের ভিড়ে শুরুতে খুবই ভয় করত। তারপর যখন একটা লেখা প্রকাশিত হল, সাহস পেলাম। চেষ্টা করেছি প্রতিদিন সব লেখা পড়ে মন্তব্য করার। যতটুকু পেরেছি করেছি। কিন্তু তা বলে মাত্র দুটো লেখা প্রকাশের পর হাচলত্ব অর্জন করব তা সুদূর কল্পনাতেও ভেবে উঠতে পারিনি। জানি আমার চেয়ে অনেক গুণী মানুষেরা বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবে হাচল হয়েছিলেন। মড়ু মামার মেইল পেয়ে তাই আনন্দিত, সম্মানিত হবার পাশাপাশি লজ্জিতও হয়েছি। এতদিন ভেবেছি অনেক, কিন্তু লিখে উঠতে পারিনি। এবারে ভাবলাম হাচলত্বের মান রাখতে কিছু একটা লিখতে হবে। তাই অনেকের দেখাদেখি একটা সিরিজ শুরু করলাম। জানিনা মানোত্তীর্ণ হবে কিনা। এই লেখার সমস্তকিছুই আমার জীবন এবং বাস্তব থেকে নেওয়া। তাই ঘটনাপ্রবাহে আমার কোন হাত নেই। আমি শুধু এক অদ্ভুত তরুণের গল্প আপনাদের পেশ করছি। কষ্ট করে এই আবোল-তাবোল ভূমিকা পড়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভ্যানতারা অনেক হল, আসুন এবারে মূল প্রসঙ্গে ঢুকি।
মূল প্রসঙ্গ
তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার ইমেজ একদম বিদ্যাসাগর বর্ণিত সুবোধ বালক টাইপের। পড়াশোনার পাশপাশি মাপা খেলা-ধূলা, মাপা গল্পের বই। আমার বাবাও আমি যে স্কুলে পড়ি সেখানেই কেমিস্ট্রির টিচার। বাবা-মায়ের অত্যাচারে ফার্স্ট-সেকেণ্ড হতে হয়। স্যারের ছেলে বলে ক্লাসের আর পাঁচজন একটু মান্য করে। তো একদিন কি হল, ক্লাস শুরু হয়ে যাবার মিনিট পনের বাদে একটা ইউনিফর্মবিহীন কলার উঁচু করা ছেলে দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখে অনেকগুলো বড় বড় টিউমারের মত ফোলা ফোলা গোটা। আমাদের ইংরেজি দিদিমণি কয়েকটা চড়-চাপড় মেরে তাকে ক্লাসে ঢোকালেন আর আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ছেলেটার নাম নাসির আনসারি। আগেরবছর ইতিহাস পরীক্ষায় টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় এবং তার আরও নানবিধ কির্তীকলাপে যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে আরও একটি বছর একই ক্লাসে আগলে রাখতে চায়। যাই হোক, ক্লাস শেষ হবার পর আমাকে আলাদা করে ডেকে দিদিমণি সাবধান করে দিলেন সেই ছেলেটা সম্পর্কে। ওর সাথে মিশলে কিভাবে আমি খারাপ হয়ে যাব, তাও বুঝিয়ে দিলেন।
আমি ছিলাম ক্লাসের মনিটর। দুটো ক্লাসের মাঝের গ্যাপে বা অফ পিরিয়ডে কেউ দুষ্টুমি করলে, গণ্ডগোল করলে তাদের নামের লিস্টিটা পরের ক্লাসের স্যারের হাতে তুলে দেওয়া ছিল আমার অপরিসীম ক্ষমতার প্রধান অঙ্গ। কেউ বেশি বেয়াদপি করলে তার নামের আগে স্টার বসত। অনেকটা মোস্ট ওয়াণ্টেড টাইপের ব্যাপার আরকি। আমি মনে মনে এই নাসির আনসারির নামের আগে স্টারের রেকর্ড বানাবার প্ল্যান করলাম। কিন্তু ওপরোয়ালার একি পরিহাস! আমার বাড়া ভাতে পানি ঢেলে নাসির আনসারি চুপচাপ শান্ত হয়ে থাকল। স্টার তো দূরে থাক, ওর নামটাই আমি লিখতে পারলাম না। ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে হিসেবে সে নিজেকে প্রমাণ করে ছাড়ল। কিন্তু পড়াশোনা সে একদমই পারে না। ইউনিফর্ম সে কোনদিনই পরে না।
আমি মনে মনে বিরক্ত হলাম। এ আবার কোন ধরনের ছেলে রে বাবা! আসলে আমার অভিধানে তখন দু ধরনের ছেলেদেরই কেবল অস্তিত্ব ছিল। একদল পড়াশোনা করে, আরেকদল বদমাইশি। এ ব্যাটাকে কোনও ক্যাটেগরিতেই ফেলতে না পেরে কেমন যেন একটা লাগছিল। তো এরই মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটল।
টিফিন পিরিয়ডে আমরা সবাই মাঠে ক্রিকেট খেলছিলাম। চপ্পল দিয়ে বাউণ্ডারি, চপ্পল দিয়েই উইকেট, আবার চপ্পল দিয়েই রানারের হাতের ব্যাট। নাসির বসে ছিল বাউণ্ডারির বাইরে। বসে বসে ঘাস আর চোরকাঁটা নিয়ে গভীর গবেষণা করছিল। এমন সময় এল,বি,ডব্লিউ নিয়ে ব্যাটসম্যান আর আম্পায়ারের মধ্যে মারামারি শুরু হল। টি,ভি তে আম্পায়ারের যতই ক্ষমতা থাকুক না কেন, আমাদের চপ্পল-ক্রিকেটে তা মোটেই ছিল না। ব্যাটসম্যানের হাতের অত মোটা কাঠের বাটাম (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেটিই আসলে ব্যাট) দেখে আম্পায়ার বেচারা মেনে নিচ্ছিলই প্রায়। কিন্তু ব্যাটসম্যান সাহেব তবু দমেন না। এদিকে গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত নাসির ভাই এলেন মারামারি থামাতে। কিন্তু তিনি নিজেই খেলেন ঐ তথাকথিত ব্যাটের একটি মোক্ষম ঘা। ফলাফল? ব্যাটসম্যানের চোয়াল ফেটে রক্ত এবং একটি দাঁত পড়ে যাওয়া। ও হ্যাঁ মাঝে একটা লাইন বাদ দিয়ে গেলাম মনে হয়। নাসিরের ভুরুর কাছটা ফেটে যাওয়ায় ও বদলা নিতে গিয়ে ব্যাটসম্যানকে একটা আলতো ঘুসি মেরেছিল। কিন্তু ব্যাটসম্যান বাবু ‘ভাল ঘরের ছেলে’ হওয়ার সুবাদে এবং কান্নাকাটি করে হেড স্যারকে নালিশ করে ফার্স্ট-এড নেওয়ার ফলে এবং তার বাবা-মা স্কুলে চলে আসায় সে নির্দোষ সব্যস্ত হল। আর নাসির ‘নিল-ডাউন’ হয়ে থাকল স্কুল ছুটি পর্যন্ত। না, ও নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার সপক্ষে কোন যুক্তি পেশ করেনি। আসলে কোন কথাই বলেনি। আর আমি? আমি প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও এই ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। কারন তাহলে বাবা জেনে যাবে। আর আমার সেই ইমেজ নস্ট হবে। আসলে তো সে ইমেজ যতটা আমার ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল আমার বাবার।
পাঠকদের কাছে এই ঘটনা মামুলি ঠাহর হতে পারে। কিন্তু এই ঘটনা সেদিন এক চোদ্দ বছরের কিশোরের মনে চিঁড় ধরিয়েছিল প্রচলিত বিচার-ব্যবস্থার প্রতি আর ভাল-খারাপের সোজা-সাপ্টা বর্ডারের প্রতি। সেটাই ছিল আমার বাস্তবকে চেনার হাতেখড়ি। সুবোধ কিশোর থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ।
(চলবে)
----------------------------------------------------------------------------------------
কথা বলার ভাষায় লিখতে গিয়ে অনেক ইংরেজী ব্যবহার হয়ে গেল। সমালোচনা কাম্য।
মন্তব্য
নিয়া বসলাম। আরও আসুক।
বসেন দাদা। আসতাছে।
স্টার হবার এমন সুযোগ গেল তো হাতছাড়া হয়ে?
লেখায়
স্টার হবার সুযোগ বারবার আসে না।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো হয়েছে, চলুক...
অভয় যখন দিচ্ছেন, নিশ্চই চলবে।
অনেক ধন্যবাদ ।
facebook
বসেন বসেন। আসতেছে।
ভাল লাগলো -
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ভাল থাকবেন।
লেখাটা পড়ার আর মন্তব্য করার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
প্রথমত হাচল হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন । আর লেখাটা ভালো লাগল, অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের জন্য
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনাদের অপেক্ষা আমাকে পরের পর্বের জন্যে প্রেরণা যোগাবে।
ভাল থাকবেন।
শুভেচ্ছা।
অভিবাদন !! হাচল হবার জন্য।।।
সেই স্কুল জীবনের অনেক কথা মনে করিয়ে দিলেন। ঘটনাগুলো এমন যে মনে হয় অনেকের স্কুলজীবনেই ঘটেছে। মিলে যাচ্ছে অনেক কিছুই। আরও পর্ব আসুক আর ফিরে যাই সেই সব মধুর দিনে। যখন পড়াশুনা ছাড়া আর সবকিছুই ছিল মধুময়।
ধন্যবাদ আপনার অভিবাদনের জন্যে।
আসলে আমাদের প্রত্যেকের স্কুলজীবনই একই রকম আলো দিয়ে ঘেরা।
আরও অনেক পর্ব আসবে।
ধৈর্য ধরে সাথে থাকবেন।
শুভেচ্ছা।
এই লেখার জন্য
পরের পর্বের জন্য
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
পরের পর্ব শীঘ্রই আসছে।
ভাল থাকবেন।
খুব ভাল লেগেছে প্রদীপদা। আপনার লেখাটি আমাদের চিরচেনা জগত থেকে আহরিত। সম্ভবত আমরা সবাই ক্ষমতাহীন আম্পায়ার, ক্ষমতাবান ক্লাস ক্যপ্টেন, টুকলি করা নাসিরদের দেখেছি। কিন্তু আপনার কৃতিত্ব হল, আপনি তার ভিতর থেকেও বের করে আনতে পারেন প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ফাঁক আর 'ভাল-খারাপের সোজা-সাপ্টা' বর্ডার। আর আপনার ভাষা আগের মতই ঝরঝরে, সুখপাঠ্য। যেমনঃ
তাছাড়া নীচের লাইনটি আপনার লেখার দক্ষতাই প্রমাণ করেঃ
পরিশেষে, আপনাকে হাচলত্বের জন্য অভিনন্দন।
আপনার মন্তব্য বরাবর আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
ভাল লাগার লাইনগুলো কোট করে দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
আশা রাখি গোটা সিরিজ জুড়ে আপনাকে পাশে পাব।
খুব ভাল থাকবেন।
অপেক্ষায় রইলাম।
অনেক ধন্যবাদ দীপালোক ভাই।
ভাবছি এরপর কোচবিহারের ইতিহাস নিয়ে কিছু লিখব।
আপনার কাছে কিছু 'রিসোর্স' থাকলে বলবেন।
খুব ভাল থাকুন।
লেখালেখি চলুক সচল ভাবে।
ডাকঘর | ছবিঘর
অনেক ধন্যবাদ তাপসদা।
মাঝে কিছুদিন খুব ব্যস্ত থাকায় তোমার কিছু লেখা মিস করে গেছি।
দেখি কতদূর মেকাপ করা যায়।
আমি আসলে জানিনা আপনি কোন স্কুলে পড়েছেন। কিন্তু আপনার লেখায় দিদিমনি শব্দটা দেখে আমার মাধ্যমিক স্কুলের কথা মনে পড়ে গেল। আমি ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত যে স্কুলে পড়েছি সেখানে ম্যাডামদের দিদিমনি বলতাম।
লেখা ভালো লেগেছে।
লিখতে থাকুন।
সুলতান
আমার স্কুলের ব্যাপারে আরও থাকবে পরে।
লেখাটি পড়ার আর মন্তব্য করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
খুব ভাল থাকুন।
শুভেচ্ছা ।
জীবনের গল্পগুলো গল্পের থেকে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং হয়।
বসলাম শুনতে।
ছোটবেলায় ইটের টুকরো মেরে এক ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। এই লেখাটা সেই কথাটা মনে করিয়ে দিলো।
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
বাপ রে, ভয় পাইছি ।
পরের পর্ব আসছে। আশা করি গোটা সিরিজ জুড়ে আপনাদের সহযোগিতা পাব।
অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়ে মন্তব্য করার জন্যে।
খুব ভাল থাকুন।
ভালো হয়েছে।
চলুক...
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
আপনার মন্তব্যের অপেক্ষায় ছিলাম।
আশা করি এভাবেই সিরিজ জুড়ে আপনাদের সহযোগিতা পাব।
আপনার ভাষা ঝরঝরে। পড়তে আটকায়না।
একদম ডায়নোসর হাতির সম্মিলিত রুপ না হলে এরকম লেখা একবারেই পড়তে ভালো লাগে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার আর মন্তব্য করারা জন্যে।
আপনার মন্তব্য আমাকে প্রেরণা যোগাবে।
আর খেয়াল রাখব যাতে ডাইনোসর আর হাতির সম্মিলিত রূপ না হয়।
পোষ্টের শুরুতে আপনার ভূমিকার অংশের জন্য অভিনন্দন ও পরবর্তী অংশের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পর্ব - ২ পড়তে ছুটি
আমি তো আগে ওখানকার মন্তব্য পড়ে তারপর এটা পড়ছি।
যাই হোক, অনেক ধন্যবাদ।
একটু পুরোন হয়ে গেলেও আপনি খেয়াল করে পড়ছেন এবং মন্তব্য করছেন।
খুব ভাল লাগল।
চক দিয়ে বোর্ডে দুষ্টু মেয়েদের নাম লিখার কথা মনে পড়ে গেলো, আমি নিজে ও দুষ্টূ ছিলাম, তাই ওনে ছাড় দিতাম। আপনার লিখা আসলেই বেশ ঝরঝরে।
আমাদের আবার বোর্ডে না, চিরকূটে লেখা হত।
লেখাটি পড়া ও মন্তব্য করার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভাল থাকুন।
শুভেচ্ছা।
ভীষন ভালো লাগল। পরের লেখাগুলো পড়ার জনে গুছিয়ে বসলুম
নতুন মন্তব্য করুন