বিল্টুকে আপনারা সকলেই চেনেন। ও শহরের বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে লিফলেট বিলি করে। আমাদের ব্যস্ততার সময়ে অপ্রয়োজনীয় লিফলেট বাড়িয়ে দিয়ে বিরক্ত করে। ওর নাম হয়ত শহর থেকে শহরে পালটে যায় কিন্তু ব্যাপারটা একই থাকে। আমরা অনেকেই এইসব উটকো ঝামেলা পাত্তা দিই না, অনেকে হাতে নিয়ে একটু সামনে গিয়ে ফেলে দিই আবার কেউ কেউ মাঝে মধ্যে দু-একটা লিফলেট পকেটেও পুরে ফেলি। যাই হোক, কথা হচ্ছিল বিল্টুকে নিয়ে।
বিল্টুর বাড়ি শিলিগুড়ি শহর সংলগ্ন মাটিগাড়ায়। সাদামাটা বাড়ি। মানে ঐ টিকে-বেঁচে থাকার জন্যে যতটুকু দরকার ততটুকুই। বাবা বলতে গেলে সেরকম কিছুই করে উঠতে পারেন না। মা কিভাবে দুবেলার রান্না করবেন তাই বুঝে উঠতে পারেন না। বিল্টুর স্ত্রী দুমাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে অনেক খরচ। সামনেই যে আসতে চলেছে তাকে কীভাবে বড় করে তুলবে সেই চিন্তা তাড়া করে ফেরে বিল্টুকে। বিল্টু আগে সিকিমের একটা হোটেলে কাজ করত। কিন্তু গতবছরের ভয়াবহ ভূমিকম্প কেড়ে নিয়েছে বিল্টুর সেই কাজ।
এদিক সেদিক কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে বিল্টু কাজ নিল একটা ভেষজ ওষুধ সরবরাহকারী দোকানে। ওর কাজ লিফলেট বিলি করা। আয় দিনের শেষে ১১৬ টাকা। শিলিগুড়ি শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম মোড় সেবক মোড়। সেখানেই আপাতত বিল্টুর পোস্টিং। বাঙালী, নেপালী, মাড়ওয়ারী হরেক রকম লোকের আনাগোনা, ব্যবসা। এতবড় শহরের পথে ঘাটে প্রতিদিনই কতলোকের কতকিছু হারিয়ে যায়, চুরি যায়। কিন্তু তাদের কতটুকুই বা খুঁজে পাওয়া যায়! সত্যিই তো কিছু হারায় না। শুধু হাতবদল হয়। অথবা ভুল ঠিকানায় পচে মরে নালা-নর্দমা-নেড়ি কুকুরের আস্তাকুঁড়ে, ল্যাম্পপোষ্টের গোড়ায় কিংবা পাগলের ময়লা বস্তায়।
সেই দিনটার শুরুটাও আর পাঁচটা সাধারন দিনের মতই ছিল। কিন্তু এখন ফিরে তাকালে সেই দিনটা আর সাধারন নেই। কারন সেদিন বিল্টু কুড়িয়ে পেয়েছিল এক লাখ টাকার একটা বাণ্ডিল।
এরপর এই কাহিনীর মোড় সেবক মোড় থেকে অন্য অনেক দিকেই ঘুরতে পারত। কিন্তু তা হল না। বিল্টু বাণ্ডিলটা নিয়ে সোজা চলে গেল তার দোকানের মালিকের কাছে। তারপর তাঁকে সাথে নিয়ে চলে গেল থানায়।
সেদিন রাতে যাঁর টাকা তিনি থানায় গিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে টাকাগুলো ফেরত পান।
অবশ্য এরকমই একটা ঘটনা বিল্টুর জীবনে আগেও এসেছিল। তখন ও সিকিমের হোটেলে কাজ করত। রেস্তরাঁর টেবিল সাফাই করতে গিয়ে একটা টাকার ব্যাগ পেয়েছিল বিল্টু। সহকর্মী এবং উপরমহলের উপর ভরসা না করে, সেবারে একটা ফ্রিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল সেই টাকার ব্যাগ। পরে যাঁদের টাকা, তাঁরা ফিরে এসে খোঁজ করলে ফেরত দিয়েছিল ব্যাগটা। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে কোন টাকা ও কিছুতেই নেয়নি। যেটা স্বাভাবিক একটা কাজ, তার জন্যে পুরস্কার কেন? সেটাই বিল্টু বুঝতে পারেনি।
এবারেও কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে টাকার মালিক যুক্তি দেখান যে, তিনি বিল্টুদের সংসারে যে নতুন অতিথি আসতে চলেছে তার জন্যে দিতে চান। কিন্তু বিল্টুর কাছে তার কোনও প্রয়োজনই নেই। নিজের সামর্থে সে নিজের মত করে যতটা সম্ভব তাই দিয়েই ‘মানুষ’ করতে চায় আগামী প্রজন্মকে। ঠিক যেভাবে তাকে ‘মানুষ’ করেছেন তার গর্বিত বাবা। তাতে হয়ত অনেক কিছুই হয়ে উঠবে না, কিন্তু ‘মানুষ’ হতে বাধা কোথায়!
অবশেষে থানার দারোগা মশাই এক রকম ‘হুমকি’ দিয়ে বিল্টুকে ছয় হাজার টাকা নিতে বাধ্য করেন।
না, এটা কোনও বানানো গল্প নয়। এটা এই মাত্র দুদিন আগের বাস্তব। এই সময়ের বাস্তব। বিল্টু সেন এর নিজের কথায়, ঘরে যতই অভাব থাকুক, “অন্যের টাকা নিতে পারব না। তাতে পাপ হয়। আমি গরিব হতে পারি, তা বলে পাপী হতে চাই না”।
কে জানে, ধর্ম কী, অধর্ম কী। স্বর্গ কী, নরকই বা কোথায়। পাপ বা পুণ্যের হিসেব কোথায় হয় তাই বা কে জানে। কিন্তু আজকে আমি গর্বিত এই জন্যে যে, আমিও সেই শহরে থাকি যেখানে অন্তত একজন বিল্টুর মত মানুষ থাকে। হয়ত বি-শা-ল কিছু করে উঠতে তারা পারে না। কিন্তু এরাই বাঁচিয়ে রাখে বেঁচে থাকার বিশ্বাসটাকে।
অভাব আর স্বভাবের সম্পর্কটা অতটা একরৈখিক থাকে না, যখন মনুষ্যত্ব কথা বলে ওঠে।
বিল্টুকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম, বুকভরা ভালবাসা আর গর্বিত স্যালুট।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
(আপনারাও আপনাদের অভিজ্ঞতা থেকে এরকম কিছু কথা জানান না। আরেকটু অক্সিজেন আসুক এই দমবন্ধ সমাজে।)
মন্তব্য
শিরোনামের 'কী' টাকে 'কি'করে দিন। লেখা এখনও পড়িনি, শিরোনামে ভুল বানান বেশ চোখে লাগছে। অনেকদিন পরে লিখলেন মনে হয়?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
এরকম একটা বাজে ভুলের জন্যে দুঃখিত।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। অনেকদিন পরে লিখলাম।
আসলে ঘটনাটা এমন যে, আলসেমি ছেড়ে, ব্যস্ততা ভুলে বসে পড়লাম।
এবারে পড়ে ফেলুন।
খুব ভাল করেছেন লিখে। উঠে আসুক বিল্টুদের কথা।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ দাদা।
ভাল থাকবেন।
লেখাটা ভালো লাগলো। বিল্টুর মতন মানুষেরা যখন সমাজে অনেক বেড়ে যাবে, তখন সত্যিকারের মানুষ-সমাজ হবে আমাদের সমাজটা।
লেখাটার জন্য অভিনন্দন আপনাকে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
একদম ঠিক বলেছেন।
ভাল থাকবেন।
বিল্টুর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করলাম "আমি কি এই লোভ সংবরণ করতে পারতাম?" উত্তরটা যদিও বিল্টুর সাথে মিলে গেলো, কিন্তু উত্তরটা আসতে দেরী হলো ৫ সেকেন্ড। এই দ্বিধাটাই বিল্টুর সাথে আমার পার্থক্য গড়ে দিলো মানুষ হিসেবে। নিজের প্রতি ধিক্কার দিলাম, আর বিল্টুকে স্যালুট।
ফারাসাত
এরকম অকপট স্বীকারোক্তি দেখে খুব ভাল লাগল। এজন্য আপনাকেও কুর্ণিশ।
সত্যি ঐ পার্থক্যটুকুর মূল্য কিন্তু অনেক।
খুব ভাল থাকবেন।
আর মন্তব্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বিল্টুর মত লোক সমাজে বিরল। তারপরেও হঠাৎ এমন দু-একটা খবর চোখে পড়ে -
আরো একটা -
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে লিঙ্ক দুটো শেয়ার করার জন্যে।
পরের জনের নামটা জানতে পারলাম না। তবে রূপচান এর সাথে তাঁকেও স্যালুট।
মন্তব্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
খুব ভাল থাকবেন।
বিল্টুরা ভালো থাকুক
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ধন্যবাদ দাদা।
সত্যি, বিল্টুরা ভাল থাকুক আর বেড়ে উঠুক ওদের মত মানুষের সংখ্যা।
এমন আরও কয়েকজন বিল্টুকে মাঝে মাঝে দেখা যায়, আবার ঝাপসা হয়ে যায় সব...
ডাকঘর | ছবিঘর
তাই তো একফালি পোষ্টে স্পষ্ট করার চেষ্টা।
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ভাল আছো তো?
হ্যাঁ, বিল্টুরা ভাল থাকুক। ভাল থাকুন আপনিও।
পড়ার জন্যে আর মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
আপনিও ভাল থাকবেন।
নতুন মন্তব্য করুন