আজ ৩১শে মে, ২০১৩।
না, এমনিতে কোন বিশেষ দিন নয়। কিন্তু একজন মানুষের কাছে আজকের দিনটা খুব মন খারাপ করা, ভারি হয়ে ওঠা একটা দিন। তিনি একজন সাধারন মানুষ, খাটো উচ্চতার একজন মধ্যবিত্ত স্কুলশিক্ষক। আজ তাঁর অবসরগ্রহণের দিন।
ষাঠ বছর আগে, ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে তাঁর জন্ম। ইতিহাসের এক জঘন্য চক্রান্তে সুস্থ দেহে, আহত মনে তাঁর ভারতে চলে আসা। রংপুর সীমান্ত ঘেঁসা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে কাটে তাঁর অবশিষ্ট শৈশব। যদিও জীবনের কিছু রূঢ় অভিজ্ঞতা ততদিনে ছিনিয়ে নিয়েছে তাঁর শৈশবের সারল্য। নিঃস্ব পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে টিকে থাকার জন্যে লড়াই ছাড়া আর কোন রাস্তাই খোলা ছিল না তাঁর সামনে। বই হয়ে উঠল তাঁর লড়াইয়ের হাতিয়ার।
ক্লাস এইটে গ্রাম ছেড়ে মফস্বল মহকুমা শহর তুফানগঞ্জে চলে আসা। ভর্তি হওয়া বড় স্কুলে। থাকার জায়গা বলতে সেই স্কুলেরই এক শিক্ষকের বাড়ির একটা ছোট্ট চকি। সেই বাড়িরই ছোট শিশুদের পড়ানো, রেশন আনা, বাজার করা এসবের বিনিময়ে তাঁর পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া। কিন্তু মেধা আর লড়াই করার জেদের সামনে হার মানল ভাগ্যের পরিহাস। দু দুবার বৃত্তি আর ডবল প্রোমোশন তাঁকে এগিয়ে দিল অনেকখানি।
ঘটনাবহুল তাঁর লড়াইয়ের জীবন সেসময়কার হতদরিদ্র, উদ্দ্বাস্তু আর পাঁচটা পরিবারের যুবকদের মতই। পার্থক্য শুধু তাঁর মেধা আর বইয়ের প্রতি ভালবাসা। তবু একটা ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
উঁচু ক্লাসে বিজ্ঞান পড়ার সময় রসায়নের ল্যাবেও তাঁকে যেতে হত খালি পায়ে। কারন নিত্য প্রয়োজনীয় জুতোও তাঁর কাছে তখন বিলাসিতা। মেঝেতে পরে থাকা নানা রাসায়নিক জ্বালা ধরাতো তাঁর পায়ে। সেভাবেই তাঁর রসায়নকে চিনতে শেখা। প্রধানশিক্ষকের মহানুভবতায় একটুকরো স্লিপ নিয়ে তাঁর দোকানে যাওয়া এবং জুতো পায়ে দেওয়া।
উচ্চমাধ্যমিকে যখন বিজ্ঞান শাখায় পাশের হারই নগন্য, তখন তাঁর প্রথম বিভাগে পাশ করা। স্কুলের দুজনের মধ্যে একজন হয়ে। এরপর নম্বরের ভিত্তিতে তাঁর হয়ে যাওয়া উচিত ছিল ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু সমস্ত অর্থনৈতিক বাধাকে হয়তো জেদের বশে জয় করা যায় না। তাই রসায়নে স্নাতক করে কুড়ি-একুশ বছর বয়সে তাঁর শিক্ষকতায় আশা। উপার্জনের তাড়ায় স্নাতকত্তোর পড়াশোনাও হয়ে ওঠে না। তাঁর উপার্জনের ওপর ভিত্তি করে ছিন্নমূল সেই নিঃস্ব পরিবার আবার করে ফিরে পেতে থাকে মাটি। কেরিয়ারের সাফল্য থেকে যায় অধরা কিন্তু দেশহারা একটা পরিবারকে নতুন ঠিকানা দেবার মধ্যেই তিনি খুঁজে পান সাফল্য।
এ স্কুল, সে স্কুল ঘুরে, একটা সময় শিলিগুড়ি শহরের বড় স্কুলের সুযোগকে অবহেলা করে তিনি ফিরে যান সেই তুফানগঞ্জে। তাঁর নিজের স্কুলে। সেই রসায়নের ল্যাবে আবার ঢোকেন তিনি, এবারে শিক্ষক হিসেবে।
এরপর তিস্তা-তোর্সা দিয়ে বয়ে যায় অনেক জল। কালের অমোঘ চক্রে একদিন সেই ল্যাবেই, তাঁরই ক্লাসে দেখা যায় তাঁর ছেলেকে। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবন পেরিয়ে সেই মানুষটা আজ অবসরের সীমান্তবিন্দুতে।
একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি। যে পেশা তাঁকে জীবন দিয়েছে, পরিচয় দিয়েছে, সম্মান দিয়েছে, আজ ম্লান মুখে তাকে বিদায় জানাবার পালা।
এর মাঝে অনেকখানি বদলে গেছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গায় এসে গিয়েছে অধিকার আর দায়িত্বের প্রশ্ন। সংবাদপত্র আর টিভির খবরই তার প্রমাণ। সেই হতাশা সাথে নিয়েই তাঁর সরে যাওয়া। তাঁর হাত ধরে বড় হয়েছে বহু দুস্থ ছাত্র। তারা আজ ভারত এবং ভারতের বাইরেও বিভিন্ন উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেবের বাইরে সেটুকুই তাঁর অর্জন। আর সেই সন্তুষ্টি সাথে নিয়েই তাঁর অবসর।
তাঁর সেই সন্তুষ্টিতে আজ আমি গর্বিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী না হন, আমার কাছে সেই মানুষটার এটুকুই পরিচয় যে, - তিনি একজন শিক্ষক, তিনি আমার বাবা।
======================================
আজ স্কুলে আমার বাবাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হবে, অগণিত ছাত্রছাত্রী, সহশিক্ষকেরা তাকে অভিবাদন জানাবে। আমি সেখানে থাকব না, থাকতে পারলাম না কিংবা বলা ভাল থাকতে চাইলাম না। ভয় পেলাম, যদি কোন দুর্বল মুহূর্তে তার চোখ দুটো ভিজে আসে – আমার হিরোকে আমি সেভাবে দেখতে পারব না। তাই আপনাদের সাথেই ভাগ করে নিলাম আমার অনুভূতিগুলো। বাবাকে দিলাম তার বিশেষ দিনের উপহার।
মন্তব্য
শুভ কামনা রইলো আপনার বাবার জন্য
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
দাঁড়িয়ে স্যালুট করলাম
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকবেন।
শ্রদ্ধা ও ওভকামনা রইল আপনার বাবার জন্য।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো থাকবেন।
ভালো লাগল, চোখে জল এসে গেল। ওনাকে অভিবাদন।
অনেক ধন্যবাদ।
আমার লেখাটা আপনাকে ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছে জেনে খুব ভাল লাগল।
ভালো থাকবেন।
আপনার বাবাকে অনেক শ্রদ্ধা জানাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো থাকবেন।
আপনার পরিবারের জন্য শুভকামনা।
আর আপনার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকবেন।
আপনাদের প্রত্যেকের শুভকামনা আমি জানাব।
আমি জানি আপনাদের মন্তব্যগুলোই তাঁর পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার হবে।
এই শিক্ষকের জন্য শুভকামনা
অনেক ধন্যবাদ রাব্বানী।
ভালো থাকবেন।
শ্রদ্ধা ও ওভকামনা রইল আপনার বাবার জন্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো থাকবেন।
প্রদীপ্তময়, আপনার বাবাকে শ্রদ্ধা।
আপনাকে ভাল লাগা জানাচ্ছি। ভালো থাকুন। লেখায় পাঁচ তারা।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অকুণ্ঠভাবে ভাল লাগা জানাবার জন্যে
আপনিও ভালো থাকুন।
শ্রদ্ধা, শুভকামনা।
আপনার লেখা কম কম, কী ব্যাপার?
facebook
ধন্যবাদ দাদা।
হ্যাঁ, আসলে চাকরির পাশে আবার এম, বি, এ শুরু করে খুব চাপে।
এখন সামার ইনটার্নশিপের দৌলতে একটু কম চাপে, তাই আবার ফিরে আসা।
তবে হ্যাঁ এবার আর পুরোপুরি হাওয়া হব না। ভ্যানিশ হলেও আশেপাশেই থাকব।
শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
আমার বাবাও একজন শিক্ষক এবং প্রায় একই রকম ঘটনা।
আপনার বাবার জন্য শুভকামনা।
**************
সুবোধ অবোধ
***************
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!
অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার বাবাকেও আমার প্রণাম।
কাকাবাবুকে আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন প্রদীপ্তময়।
শূন্য থেকে শুরু করে যারা নিজেকে এবং পরিবারকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন, তাঁদের জন্য আমার হৃদয়ে অন্যরকম একটা শ্রদ্ধার জায়গা সংরক্ষিত আছে, কারন আমার বাবাকে ঠিক এই কাজটিই করতে হয়েছিল। ওনার অবসরে যেতে আর মাত্র মাস ছয়েক বাকি।
আপনার সম্বোধনটা মন ছুঁয়ে গেল।
সত্যি এই শ্রদ্ধা, সম্মান এঁদের প্রাপ্য।
সারাজীবন লড়াই করার পর, ব্যস্ত কর্মজীবন পার করার পর এরকম মানুষেরা অবসরের সামনে এসে কেমন যেন একটু দিশেহারা হয়ে পড়েন। আসলে অবসর কী জিনিস তা তাঁরা বোঝার সময়ই পাননি ঠিক করে।
আপনার বাবার জন্যে রইল আগাম শুভেচ্ছা আর প্রণাম।
সুন্দর লেখা গল্পটিও খুব ভাল
কোন স্কুল? যদিও আমার মনে থাকার কথা নয় - তবুও আমার শৈশবের প্রথম স্মৃতি তুফানগঞ্জ তাই প্রশ্ন করছি।
এটা গল্প হলেও সত্যি।
তাই নাকি !!
তুফানগঞ্জ এন, এন, এম, হাই স্কুল। শহরের একদম মাঝখানে। অনেক পুরোন স্কুল(স্থাপিত ১৯১৬)।
মনে পড়ছে কি?
না হলে এই পুরোন ছবিটা দেখুন, আপনার স্মৃতির সাথে মিলতে পারে -
প্রদীপ্তময় ভাই - আপনি আমার থেকে বেশী আশা করে ফেলেছেন, শৈশব এর স্মৃতি বলতে জন্ম ইস্তক ৪ বৎসর . ৮০-র দশকের গোড়ার কথা, চাকুরিসূত্রে পিতৃদেব ধুপগুড়ি চলে আসেন আমাকে নিয়ে - ওখানে কিছুদিন থাকার পর তুফানগঞ্জে আসি - পরের তিন বছর কাটে তুফানগঞ্জ এ - যার খুব আবছা একটা স্মৃতি রয়ে গেছে - অবচেতন এ। কারণ আমি হাঁটতে শিখেছিলুম ওখানে - আর যাবতীয় দুষ্টুমি করে বেড়াতুম। আমার জীবনের প্রথম কিশলয় বিদ্যালয় (তখন মনে হয় কিন্ডার গার্টেন বলতো) যাওয়াও তুফানগঞ্জে। পরে কখনো সখনও শহরের ওপর দিয়ে বাসে করে গেছি - তবে সে অর্থে যাওয়া হয়নি।
আপনাকে হয়ত নিরাশ করলুম - কিছু মনে করবেন না। বাই দ্য ওয়ে - আপনার দেওয়া ছবিটা আমি দেখতে পাচ্ছি না - হয়ত আমার ব্রাওজার এ সমস্যা রয়েছে। আদ্যক্ষর দেখে বুঝলুম ওটি কোচবিহারের মহারাজা শ্রী নৃপেন্দ্রনারায়ণের নামাঙ্কিত বিদ্যালয়।
না, না, নিরাশ হই নি দাদা।
এরকম তো হতেই পারে।
দেখি, ফটোটার কী করা যায়।
আপনার অনুমান একদম ঠিক।
স্কুেলর নাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল।
শিরোনামটা দেখেই বুঝেছিলাম- এ নিশ্চয় আপনার বাবার কথা।
সংগ্রামী এই মানুষটির জন্য আমার শ্রদ্ধা এবং প্রণাম ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকবেন।
চমৎকার লাগলো।।।।।।।। অনেক শুভকামনা আপনার বাবার জন্য
অনেক ধন্যবাদ,
নীচে নামটা দিলে জানতে পারতাম কে বলছেন।
যাই হোক, খুব ভালো থাকবেন।
ভালো লাগল, চোখে জল এসে গেল।
আমার লেখাটা আপনাকে ছুঁতে পেরেছে জেনে ভালো লাগল।
খুব ভালো থাকুন।
শিক্ষকতা আমার কাছে খুবই মহৎ একটি পেশা। অসংখ্য মানুষ গড়ার কারিগর আপনার বাবার জন্য আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা রইল।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
সত্যি শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। কিন্তু সেখানেও ইদানীং কিছু মানুষের ভুলের মাসুল গুনতে হচ্ছে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে।অন্তত আমাদের এখানে একটা বিপরীত স্রোত দেখতে পাই ইদানীং।
বাবা খুশি যে, তিনি শান্তিতে অবসর নিতে পারলেন। আজকাল এমন ঘটনা ঘটছে যে, অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়ে ছেলের নকল করার কথা জানালে, তারা সন্তানের পক্ষ নিয়ে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে,"প্রমাণ কোথায় ও অন্যের খাতা দেখছিল?"
আপনার বাবাকে স্যালুট।
অনেক ধন্যবাদ।
খুব ভালো থাকবেন।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
আপনার বাবার জন্য শুভেচ্ছা রইলো অনেক।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ভালো থাকবেন।
নতুন মন্তব্য করুন