শুক্রবার সারাদিন কি করা, এই বিষয়ক চিন্তাভাবনা আমাকে পুরো সপ্তাহ তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক প্ল্যান করি। মোবাইলে নোটস লিখে রাখি। কিন্তু এর কোনোটাই শেষ পর্যন্ত করা হয় না একমাত্র ঘুম ছাড়া। বুকসেলফটা মাথার কাছাকাছি। হাত বাড়ালেই যাতে বই নাগাল পাওয়া যায় এই উদ্দেশ্যে।আজকে বই ঘাটতে গিয়ে একটা কবিতার বই হঠাৎ করে চোখে পড়লো। বইটা অনেকদিন ধরেই খোঁজছিলাম। না পেয়ে ভেবেছিলাম কেউ নিয়ে আর ফেরত দেয়নি হয়তো বরাবরের মতো।
মৃদুল দাশগুপ্তের নির্বাচিত কবিতা। বেরিয়েছে অফবিট পাবলিশিং, লেকটাউন কলকাতা থেকে ১৯৯৯ সালের ১৭ অক্টোবর। বইটি যখন প্রথম আমার হাতে আসে, আমি আচ্ছন্নের মতো পুরো বইটা শেষ করেছিলাম। এরপরো নানাভাবে-নানাসময়ে বইটি আমার হাতে উঠে এসেছে। কী সেই মুগ্ধতার কারণে আমি দিনের পর দিন মৃদুল নিয়ে মেতে থেকেছি, আসুন কারণগুলো উদঘাটন করা যাক।
দীপঙ্কর কুমার লিখেছিলেন, ... পাগল কবি, হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। তোমার পাঠককে তুমি ভীড়ে খুঁজো না। সে কবিতা পাঠের আসরে, রবীন্দ্রভবনে, সদনে, কালিমন্দিরে, বইমেলায় ভিড় করে না। সে অপ্রকাশিত আছে মলিন গলিতে, গ্রামের প্রত্যন্তে। তুমি নও, তোমার কবিতাই তাকে ঠিক খুঁজে পাবে।
গত শতকের সত্তর দশকের গোড়া থেকে তার পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ শুরু, সে সূত্রে তিনি পরিচিত "সত্তরের কবি" বলে। কিন্তু তার কবিতা দশকদেয়াল ডিঙিয়ে আরো দূর দূর দশক পদচারণার উপাদানে ঋদ্ধ--সে প্রমাশ পাওয়া যায় ঘনরহস্যব্যঞ্জিত আশ্চর্য মিত-উচ্চারণে ঋদ্ধ মৃদুলেরই একের পর এক কবিতাপংক্তিতে। "মুক্তির দশক" বলে খ্যাত সত্তরে লিখতে এসে কবিতায় সিদ্ধি পেয়েছেন যে-কজন কবি, আঙ্গিকে/ইঙ্গিতে ভাবে/স্বভাবে মৃদুল সবার থেকে আলাদা। সতীর্থ কবিবন্ধুদের থেকে মৃদুলের আলাদাত্ব দেখা যায় অনেকদিন থেকেই : তিনি উচ্চারণে মিত, আবেগে সংহত, সবসময় অল্পপ্রজ, তার কবিতা প্রকাশের মাধ্যম মূলত এবং একমাত্র লিটলম্যাগ। সবধরনের হল্লা-কোলাহল থেকে দূরে স্থিত তার ধ্বনি, অভিজ্ঞতা ও অনুভবের দীর্ঘ জারনক্রিয়ার পর লিপিতে ধৃত--ঋজু কিন্তু দার্ঢ্য স্বর, শৈলীতে অভিজাত, প্রকাশভঙ্গিমায় মার্জিত; স্বভাবে তার কবিতা কেন্দ্রমুগ, উচ্চারণ মনোলীন, অর্ন্তমুখী, ভেতরের দিকে ফেরানো তার কবিতামুখটি--নিমগ্ন ও নিভৃত, সন্ত-সমাহিত; স্তরীভূত ও বহুতলীয় তার কবিতা দাবী করে পাঠকের সপ্রেম অভিনিবেশ; মৃদুল-পাঠক তার কবিতা পাঠোত্তর লাভ করেন ডুবুরি-সমান অভিযানের আনন্দ-অদেহ, অনঙ্গ, পূর্ব-অনাস্বাদিত। 'সত্তরের যে বীজ মৃদুলের কবিতায় পল্লবিত হয়েছে, তা কোনো একমাত্রিক সীমাবদ্ধতায় ঘুরপাক খায়নি, বরং বারবার আঙ্গিকে ও বাচনে, নতুন নতুন হয়ে উঠেছে। শৈল্পিক পরিমিতিবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি, বিষ্ময়কর সপ্রতিভতা আর প্রসাদগুণ বা হাতযশ--প্রধান কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে-লক্ষনগুলি খুব জরুরি, তার সবই মৃদুলের স্বভাবে বেশ উঁচু মাত্রায় আছে।'
সত্তর থেকে এ-তক্ প্রায় ত্রিশ বছর মৃদুলের কবিতাকাজের গ্রন্থরূপ সংখ্যায় চার: জলপাই কাঠের এস্রাজ, এভাবে কাঁদে না, গোপনে হিংসার কথা বলি, সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ।
মৃদুলের এই নাতিদীর্ঘ প্রকাশনা-তালিকাটিও এক অর্থে নির্দেশ করে ফারাক, আর-পাঁচ সতীর্থের সঙ্গে তার;--দেখিয়ে দেয় কবিতায় নতজানু এক ধ্যানস্থ কবিমুখ, মগ্ন ও মৃদু।
..............................................................................................
দু'একটা কবিতা এখানে দেয়ার লোভটা কোনোভাবেই সংবরণ করতে পারলাম না।
জলপাইকাঠের এসরাজ
কোনোদিন কিছুই ছিলো না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ
আমরা কি বাজাবো না জলপাইকাঠের এসরাজ?
ও কি ফুল? বুনো ফুল গোলাপি পাপড়িময় চাবুকের দাগ
আমরা কি চলে যাবো? কখনো দেবো না ওকে পুরুষ-পরাগ?
অনেক লন্ঠন ওড়ে, হাওয়াবাতাসের রাত, কেউ এলো আজ?
বাজাবো না আমাদের, বাজাবো না জলপাইকাঠের এসরাজ?
পাপ
বিদেশি ছবিতে দেখি সামনে বাগানঅলা থমথম বাড়ি
আমিও বেঁচেছি শোনো বহুবার মরে যেতে যেতে
আনন্দ বিহ্বলা তুমি শিউরে উঠেছো খোলাঠোঁট
এই পরিখার কাছে অনেক পথিক এসে থমকে গিয়েছে
মন্তব্য
মৃদুল দাশগুপ্ত যে বাংলাদেশেও এতো পরিচিত নাম ভাবিনি। বাবার বুকশেল্ফে কবির ঐ বইটাই ছিলো যেটার কথা আপনি লিখেছেন। তখন আমি জীবনানন্দে মগ্ন, তাছাড়া সুনীল শক্তি এঁদের লেখা পড়ি। যখন কঠিন কবিতা পাঠের শখ হয় তখন বিষ্ণু দে সুধীন দত্ত সমর সেন আছেন। ফলে মৃদুল অবহেলিতই ছিলেন আমার মতো পাঠকদের কাছে। এখন হাতে পেলে পড়ি কিন্তু সে বই তো বাবার আলমারিতেই রয়ে গেছে। আপনার দেওয়া কবিতা পড়ে বুঝলাম আরো কতো ভালো জিনিস অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
আপনার সাথে সেই সব অজানা মহাদেশ আবিষ্কারের পথে হাঁটতে চাই, আরো চেনান আমাদের এই সব অচেনা শুঁড়িপথ অরণ্য উপত্যকা নদীতট।
মৃদুলভক্তসংখ্যা অনেক আমার জানামতে। বাবার বুকসেল্ফ থেকে বইটা নিয়ে পড়ে দেখতে পারেন।
আরে বাড়িতে একটা বাংলা বই আছে আর সেটা পড়বো না তা তো হয় না, কাজেই পড়েছিলাম। কিন্তু এখন সে বই হাতের কাছে কই, সে তো দেশে রয়ে গেছে। তাই আপনারা পোস্টালে পড়া হয়।
আরে নাঃ! আমি এখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি!
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
এই তো? ইয়ার্কির চান্স পেলেই জিভ সুড়সুড় করে, না?
আবার শুরু করেন।
উপাদেয় হইছে। মৃদুল তাইলে পড়তে হবে।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলেন।
উজানগাঁ,
আপনার অবৈপ্লবিক কবিতালোচনা পড়ে মনে হয় আপনি আলোচনার সাথে নিজের কবিতা লিখলে আমরা সাধারণ পাঠকেরা পড়ে আনন্দ পাই। লিখুন না কিছু এই খানে।
এই লেখাটাকে আমি কবিতালোচনা মানতে নারাজ। উজানগাঁয়ের ১ম সংখ্যাতে মৃদুলদাশগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার আমরা রিপ্রিন্ট করেছিলাম। অই সাক্ষাৎকারটি ছাপাতে গিয়ে এই ভূমিকাটি তখন লেখা হয়েছিল।
শাওন, আপনার লেখাটা দেখেই লগ-ইন করা হলো ।
মৃদুল !
নাতিদীর্ঘ প্রিয় সারি থেকে উজ্জ্বলতম তারার নাম মৃদুলস দাশগুপ্ত !
জলপাই কাঠের এস্রাজ টা এখানে আনতেও ভুলি নি ! প্রিয়তম কবিকে নিয়ে লিখলেন বলে - ধন্যবাদ । সেই শব্দবন্ধনী- হাওয়াবাতাসের রাত !!! আবার পড়া হলো আপনার বদৌলতে ...
শাওন, ফাল্গুনী রায়ের নষ্ট আত্মার টেলিভিশন নিশ্চয়ই আছে আপনার কাছে ... তুলে দিয়েন দু'একটা ।
[ অফটপিকঃ আপনি বোধকরি 'শব্দপাঠ' আর 'স্রোতচিহ্ন' কে মিলিয়ে ফেলেছেন ! আমি স্রোতচিহ্ন সম্পাদনা করি ]
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !
নাতিদীর্ঘ প্রিয় সারি থেকে উজ্জ্বলতম তারার নাম মৃদুল দাশগুপ্ত !
মৃদুল এতই অর্ন্তমুখী যে প্রথম পাঠে রসাস্বাধন প্রায় অসম্ভব।
ফাল্গুনী রায়ের নষ্ট আত্মার টেলিভিশন আছে। কিন্তু আপনি লিখছেন না কেন? আপনার লেখা পড়তে আগ্রহী।
মৃদুলের বই কি আজিজে পাওয়া যাবে ?
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
পাওয়া যাওয়ার কথা।
পড়া হয় নাই কতো কিছু জীবনে। উজ়ানগাঁ মাঝে মাঝে কিছু আমাদের জন্য তুলে দিয়েন, প্লীজ।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
শাওন, ২০০২ এর কথা আমার দোকানে নিয়ে এলে ''জলপাইকাঠের এসরাজ''
আমার সামনে পাঠ করলি ক'টি কবিতা তোর কাছ থেকে ধার করে পড়ছিলাম।
স্মৃতিপটে আজো ভাসে
ভাল থাকা চাই।
নতুন মন্তব্য করুন