মকদ্দস আলম উদাসীর কথা প্রথম কোথায় শুনেছিলাম সেটা অনেক চেষ্টার পরও স্মরণ করতে পারলাম না। তবে বিস্তারিত জানতে পারি কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের কাছে। ততদিনে মোস্তাক আহমাদ দীন ও শুভেন্দু ইমামের সম্পাদনায় লোকচিহ্ন থেকে বের হওয়া উদাসীর পরার জমিন বইখানিও আমার হস্তগত হয়েছে। পেপারব্যাকে ছাপানো ৩২ পৃষ্ঠার এই বইখানির শুরুতেই ভূমিকা হিসেবে কবি মোস্তাক আহমাদ দীনের একটি গদ্য ছাপা হয় মকদ্দস আলম উদাসী ও তার গান নামে। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি উদাসীর জন্ম বাংলা ১৩৫৪ সনে ছাতক থানার চরবাড়া গ্রামে। পিতা মুজেফর আলী , মাতা সুখীর মা খাতুন।
যার নাম সুখীর মা খাতুন, তার ছেলের কিন্তু জন্মের পর থেকে দুঃখের অন্ত ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর জন্মভিটে ছাড়েন, যার দুঃখে মকদ্দস লিখেছেন- চরবাড়ায় মোর থাকা হল না বিধির লিখারে...। পরবর্তী সময়ের মুর্শিদ সুকুর আলী চিশতীর আদেশে দিরাইয়ের কর্ণগাঁয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হন। বিয়ে করে সেখানেই থেকে যান। দারিদ্রতা আরো বেড়ে যায়-আর তা ঘোচাতে কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় হেকিমী ফার্মেসী খুলেছেন, তাতে যদিওবা কখনো-সখনো পসার মিলেছে তবু নিরন্তর ঘোর-তাড়িত উদাসী কোথাও মন বসাতে পারেননি। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে ঘোরেন, পরিচিত বলয়ে কখনো যন্ত্রশিক্ষা দিয়ে থাকেন আর গান বাঁধেন। মাঝে-মধ্যে ভক্ত সুহৃদরা ভালোবেসে এখানে-সেখানে নিয়ে যান। বয়স হয়েছে। বায়না-টায়না তেমন নেই; এখন আর সেই দিনও নেই, সেই মানুষও নেই, মকদ্দস আলম উদাসীর কথায়- একসময় কত গান যে কত জায়গায় গেয়েছি তার হিসাব করা যাবে না। নিয়মিত গান বাঁধেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান সব সময় হয় না, যখন ভাব আসে তখন লিখেন। প্রায়শ উদাসীকে এখানে-সেখানে নিরিবিলি হাঁটতে দেখা যায়, তখন হয়তো দুপুর অথবা বিকেল কিংবা সন্ধে।
মোল্লার ছেলে গান গায় এ নিয়ে গ্রামে প্রায়ই কানাঘুষা চলতো। মকদ্দস তাতেও নির্বিকার থাকতেন। এসব কানাঘুষা-তাকে স্পর্শ করতো না, কিন্তু গান চলতে থাকে, সেই সব গানের ভাব আর তত্ত্বসমূহ তাকে বিচিত্র রকমের ভাবনার মধ্যে ফেলে দেয়, আচ্ছন্ন করে ফেলে; এরকম আচ্ছন্নতার মধ্যে একসময় নিজে গান বাঁধতে শুরু করেন। এসব ৬৮ বাঙলার কিছু পরের কথা। বেরিয়ে পড়েন পথে-প্রান্তরে; তখন কী যে হয় তার, শ্মশানের মধ্যে রাতের পর রাত কাটাতে শুরু করেন। ঐ সময় অনেকগুলি গান তিনি বাঁধেন; ঐ সময়কার গানগুলির দিকে নজর দিলে শ্মশানের অনুষঙ্গ এবং প্রধানত মৃত্যুচেতনা চোখে পড়ে।
তো সেই উদাসীর সাথে আমার দেখা হয়ে যায়২০০২ সালের সেপ্টেম্বরের এক দুপুরে বইপত্রে। মোস্তাক আহমাদ দীন ও শুভেন্দু ইমামের মালিকানাধীন এই লাইব্রেরীটি সিলেটের লিটলম্যাগ কর্মীদের একমাত্র নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। আমার অফিস থেকে লাইব্রেরীটি খুব কাছে থাকায় প্রায়ই দুপুরের খাবারটা লাইব্রেরীর পাশের রেস্টুরেন্টে সেরে বাকি সময়টা এই লাইব্রেরীতে বসে আড্ডা দেই মোস্তাক ভাইয়ের সাথে। ঐ দিনও যথারীতি আমি দুপুরে গিয়ে হাজির হই, মোস্তাক ভাইয়ের সাথে কথার ফাঁকে-ফাঁকে আমার বার-বার চোখ যাচ্ছিল বাম পাশে বইয়ের স্তুপের আড়ালে প্রায় ঢেকে যাওয়া মুখের ছোটখাটো মানুষটির দিকে। আমি শুধু তার বামদিকের একটা চোখ আর কপালের কিছু অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম। ঢেউখেলা চুলের লোকটির চোখে আশ্চর্য একধরনের নির্লিপ্ততা। কপালজুড়ে অগুনতি ভাঁজ। খুবই নিচুস্বরে কথা বলছিলেন। খুব মনোযোগ দিয়ে না শুনলে কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না।
মোস্তাক ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি উদাসী। মকদ্দস আলম উদাসী। আমি করমর্দন করতে উঠে দাঁড়ালে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। ছোটখাটো মানুষটি লম্বায় আমার কান ছুই-ছুই। হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবীর সাথে লুঙ্গি, পায়ে প্লাস্টিকের সস্তা সেন্ডেল। তাতে কাদার দাগ স্পষ্ট। আমি হাত বাড়াতেই তিনি বুকে টেনে নিলেন। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত, কোলাকুলি করে অভ্যস্ত নই। ততক্ষণে তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাসছেন। খেয়াল করলাম আশ্চর্য একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো তার চোখে মুখে। তাতে শিশুর সারল্য।
এই যে উদাসী। টাকা না থাকায় জগন্নাথপুর থেকে টানা ৪৫/৫০ কিলোমিটার হেঁটে সিলেটে চলে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ানো ক্লান্ত উদাসী কিংবা বিনা চিকিৎসায়/অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যাওয়া সন্তানের ব্যর্থ পিতা উদাসী কিংবা ভরণপোষণ দিতে না পেরে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত কুচকে যাওয়া উদাসী, কেমন ছিলেন তার গানে, জানার জন্যে প্রথম দেখারও ৬ বছর পর ২০০৮ এর নভেম্বরের এক পড়ন্ত বিকেলে আমরা হাজির হলাম তার জগন্নাথপুরের বাড়িতে।
চলবে
মন্তব্য
জমবে আশা করি,
চলুক
ভালো কথা একদিন পূর্ণিমা রাতে তাকে নিয়ে চলেন মাঝ নদীতে নৌকায়
...........................
Every Picture Tells a Story
রোজার পরে প্ল্যান তো করাই আছে। আপনি বললেই হয়।
হ, কইলাম, কতজনের মানে নৌকা কত বড় জানান। আর খোঁজ নেন পূর্নিমা শুক্রবারে কীনা
...........................
Every Picture Tells a Story
এই বিরল মানুষগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরার আপনার এই প্রচেষ্টাকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। অবশ্যই চালিয়ে যাবেন!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধন্যবাদ তীরুদা।
মিয়া খালি আমারে ঝাড়ি দেন অজায়গায় সিরিজ থামাই বইলা? আর এখন আপনে কী করলেন? পরের পর্ব এক্ষন ছাড়েন কোনো ফাইজলামি না কইরা। গান শুন্তে মঞ্চাইতেছে...
আর
সহমত তো অবশ্যই... কবে বলেন... আমি হাজির...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনারে দেই শিখছি।
পরের পর্বে রেকডর্কৃত গান আছে। পূর্ণিমাতে হাওড়ে নৌকাবিহারের প্ল্যান একটা হচ্ছে। জানামুনে।;)
দারুণ লাগতেছিলো পড়তে। পাঁচ তারা। কিন্তু থামাইয়া দিলেন ক্যান?
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
ব্যস্ততার জন্যে লেখা এগুচ্ছে না আসলে। গত তিন দিনের লেখা দিয়ে এই পোস্টটা দিলাম।
চিন্তা করেন অবস্থাটা !!!
দারুণ! গান শুনতে আমারও খুব ইচ্ছা করছে। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি....
ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো তাড়াতাড়ি দেয়ার।
আমারো গান শুনতে মঞ্চায়----
অপেক্ষায় আইজুদ্দীন---
সামনের পর্বে আসিতেছে
লেখাটা খুব ভাল্লাগছে। পরেরটুকুর জন্যে অপেক্ষা করবো।
-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ধন্যবাদ।
গানের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
থাকেন। চিন্তা করছি পরের পর্ব শুধু গান দিয়াই পোস্ট দিমু।
এটা কোথায় থামলেন রে ভাই?! দ্রুত পরের পর্ব নামান। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
জানতে চাই
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
পরের পর্বের গান এবং কথার অপেক্ষায় থাকলাম...
"Life happens while we are busy planning it"
ভালো লাগলো! ছবিটাও চমৎকার। পরের পর্ব আর গান, তাড়াতাড়ি, প্লীজ!
গান শোনার আশা নিয়া ঢুকলাম কিন্তু গান নাই।
কিন্তু লেখাটা কিন্তু বেশ। পরের পর্ব আর গানের অপেক্ষায় রইলাম বাকীদের মত।
দৃশা
চমৎকার লেখা, শিগগির পরের পর্ব দিন। "দারিদ্রতা"টা ক্লাসিক ভুল, ঠিক করে দিন না।
ভুল আরো অনেক যায়গায় পেলাম। কিন্তু সম্পাদনা করার ক্ষমতা মনে হয় অতিথি সচলদের নেই। ভালো থাকবেন।
মকদ্দস আলম উদাসী আর আমার বাড়ি পাশাপাশি ছিল বলে তাঁর গাওয়া হৃদয়স্পর্শী
কিছু গান শুনার ভাগ্য হয়েছিল আমার।
এখন আর শোনা হয় না...।
আহ্ পরবাসী জীবন!
ভাল থাক বন্ধু...
সৈয়দ আফসার
আমি সিলেটি না হওয়ায় হয়তো উনার গান শুনি নাই। উনার গান শোনার অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার লেখায় উনার সারল্য, দারিদ্রের নুয়ে পড়া একজন শিল্পী সম্পর্কে পড়তে গিয়ে বার বার মনে হচ্ছে আমরা গুণীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে জানি না।
আমি সিলেটি না হলেও বাউল গানের প্রতি আমি অনুরক্ত। পরের পর্বে উনার গান পাব আশা করছি। ভালো থাকুন
শুভেচ্ছা থাকলো।
"হামিদা আখতার"
পরের পর্ব কবে আসবে?
মনে হল হঠাৎই মাঝপথে থেমে গেল।
নতুন মন্তব্য করুন