কুলীন প্রতিক্রিয়াশীলতা - ১

পৃথ্বী এর ছবি
লিখেছেন পৃথ্বী [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২৯/০৬/২০১৩ - ৭:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“No doubt there exist thoughts so profound that most of us will not understand the language in which they are expressed. And no doubt there is also language designed to be unintelligible in order to conceal an absence of honest thought.” – Richard Dawkins, A Devil’s Chaplain

এই পোস্টটা লিখে অনেকবার পড়লাম, নিজের কাছেই নিজের লেখা অনেক খটমটে মনে হল। আসলে কিছু কিছু বিষয় এতই জটিল যে সেগুলোকে আদৌ সহজ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব কিনা সেটা নিজেই একটি জটিল প্রশ্ন, আবার অর্থহীন ভাবনাকেও জটিল ভাষায় প্রকাশ করে গূঢ় অর্থপূর্ণতার ভাব সৃষ্টি করা যেতে পারে। দুর্বোধ্যতার জন্য পোস্টমডার্নিস্ট থিওরির দুর্নাম আছে, প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের চিন্তাভাবনাও বেশ বিতর্কিত। উত্তরাধুনিকদের এই বিতর্কিত বিজ্ঞানভাবনাই এই পোস্টের বিষয়বস্তু।

কিছু কিছু বিভাষা বা jargon আমি নীল রঙে টাইপ করেছি, এগুলোর টীকা পোস্টের একদম শেষে সংযুক্ত করে দিয়েছি। টীকা অংশটির জন্য সূত্র হিসেবে Oxford Dictionary of Philosophy এবং Blackwell Dictionary of Western Philosophy ব্যবহার করেছি।

এই পোস্টের ধারাবাহিকতায় আরও দু’টি পোস্ট লেখার ইচ্ছা আছে, পুরোটাই ভারতীয় লেখিকা Meera Nanda এর The Epistemic Charity of the Social Constructivist Critics of Science and Why the Third World Should Refuse the Offer প্রবন্ধটি ভিত্তি করে লেখা। প্রবন্ধটি A House Built on Sand: Exposing Postmodernist Myths about Science বইতে পাওয়া যাবে।


একেক সংস্কৃতির মানুষ জগতসংসার সম্পর্কে একেক রকম বিশ্বাস লালন করে। এক সংস্কৃতির মানুষ কি আরেক সংস্কৃতির মূল্যবোধকে মূল্যায়ন করার সামর্থ্য রাখে? পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের একটা বিশেষ গোষ্ঠী উত্তর দিবে – না, রাখে না। তাদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি সংস্কৃতি আসলে একেকটি স্বতন্ত্র্য দুনিয়া, এই দুনিয়াগুলোর রয়েছে তাদের নিজস্ব নিয়ম। এক দুনিয়ার রীতি দিয়ে আরেক দুনিয়ার নীতি বোঝা সম্ভব না। ধরেন, এক সংস্কৃতিতে বিধবা নারীদের পুনঃবিবাহ করার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হল, কিন্তু আরেক সংস্কৃতিতে স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে স্ত্রীর আত্মাহুতি দেওয়াকে পুণ্যের কাজ মনে করা হল। এই দু’টো সংস্কৃতির মধ্যে কোনটি বেশি উদার ও নারীবান্ধব এটা কি বিচার করা সম্ভব? উক্ত বুদ্ধিজীবিরা বলবেন – না, দু’টো সংস্কৃতিই তাদের নিজেদের মত করে “উদার” ও “নারীবান্ধব”। নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান আর সার্বজনীন নৈতিকতা বলে কিছু নেই, পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধ(moral code) ও জ্ঞানবাচক বিবৃতির(truth claim) সংঘাতে কোন নৈর্ব্যক্তিক মানদন্ডের দোহাই দিয়ে একটির উপর আরেকটিকে প্রাধান্য দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ, আপনি যখনই দাবি করবেন সৌদি সমাজ বাঙ্গালী সমাজের চেয়ে পশ্চাৎপদ, তখনই আপনি আসলে প্রগতিশীলতার কোন না কোন মানদন্ডের শরণাপন্ন হবেন। আপনি কেন এই বিশেষ মানদন্ডটি অন্য সব সম্ভাব্য মানদন্ডের বদলে বেছে নিলেন, উপরোক্ত বুদ্ধিজীবিরা সেই প্রশ্নের প্রতিই বেশি আগ্রহী, সৌদিরা আদৌ বাঙ্গালীদের চেয়ে বেশি সহনশীল বা সংস্কৃতিমনা কিনা সেটা নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। আমি বলছি না যে আমাদের প্রগতিশীলতার মানদন্ডগুলোকে কখনওই প্রশ্ন করা যাবে না, তবে কেবল এই প্রশ্নটাকেই ভাবজগতের একমাত্র হালাল প্রশ্ন ধরে নিলে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়।

এসব চিন্তকদের লেখালেখি এবং তত্ত্বসমূহ কিছু মোড়ল সৃষ্টি করেছে, যারা বিদ্যমান status quo এর প্রতি কোন চ্যালেঞ্জ আসলেই সেটাকে “সাম্রাজ্যবাদী” কিংবা “পশ্চিমা জাতিকেন্দ্রিক(ethnocentric) প্রেজুডিস” আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। উক্ত তাত্ত্বিকগণ ও তাঁদের অনুরাগীরা মনে করেন আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিজ্ঞান শিখি, সেটি আসলে “পশ্চিমা” বিজ্ঞান। দুনিয়াতে “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের পাশাপাশি আরও অনেক “বিজ্ঞান” আছে – হিন্দু বিজ্ঞান, ইসলামী বিজ্ঞান, আফ্রিকান বিজ্ঞান, এশীয় বিজ্ঞান, নেটিভ আমেরিকান বিজ্ঞান ইত্যাদি। “বিজ্ঞান” এর পেছনে এতগুলো ধর্মীয়-আঞ্চলিক-জাতিবাচক লেবেল লাগানোর কারণ হল, উক্ত চিন্তকদের মতে, এই সকল বিজ্ঞান আসলে কোন না কোন অঞ্চলের আর্থসামাজিক বাস্তবতার ফসল। নিউটন-আইন্সটাইন-ডারউইনের তত্ত্ব আসলে কোন ব্যক্তি নিরপেক্ষ, বাস্তব জগতের কার্যকলাপকে ব্যাখ্যা করে না, তাঁদের বৌদ্ধিক কর্মগুলো কেবলই তাঁদের নিজ নিজ সময় ও অঞ্চলের বাস্তবতাকে তুলে ধরে। শুনতে হয়ত পাগলের প্রলাপ মনে হবে, কিন্তু এই চিন্তকরা আসলে এই দাবিটাই করছেন যে পৃথিবীর সব মানুষ কোন একক বাস্তবতা যাপন করে না; নিউটন-ডারউইনদের বাস্তবতা আর আমাদের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ফেনোমেনা! প্রজাতির উৎপত্তি নিয়ে ডারউইনের তত্ত্ব হয়ত ডারউইনের সময়কার ইংল্যান্ডের জন্য সঠিক, কিন্তু অন্য কোন অঞ্চলের জন্য সত্য নহে! প্রজাতির উৎপত্তি নিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষের যদি কোন নিজস্ব বিশ্বাস থাকে, তবে প্রজাতির উৎপত্তির ব্যাখ্যায় ডারউইনের তত্ত্বকে গ্রামীণ বাংলার লোককথার উপরে প্রাধান্য দেওয়ার কোন যুক্তি দেখেন না এসব চিন্তাবিদ। আপনি যদি তাঁদেরকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কথা বলেন, তাঁরা বলবেন আপনি নিজের শেকড় ভুলে গিয়ে ঔপনিবেশিকদের দালালি করছেন। মোদ্দা কথা হল, দুনিয়াতে কোন একক “বিজ্ঞান” নেই যা স্থান ও কাল ভেদে যেকোন প্রাকৃতিক ঘটনার স্থায়ী ব্যাখ্যা দিতে পারে; একটি একক বিজ্ঞানের বদলে বরং মানব সমাজে প্রচুর “জাতিকেন্দ্রিক”(ethnocentric) বিজ্ঞান রয়েছে যা সেসব জাতির সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ফসল বৈ কিছু না। দুনিয়ার অগুনতি সংস্কৃতির অগুনতি জগতদর্শন বাদ দিয়ে একটি একক, সার্বজনীন বিজ্ঞান দিয়ে প্রকৃতি ও মানুষকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা যেন বৃথা চেষ্টা।

এই চিন্তকরা কারা? এঁরা মূলত দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ও স্বঘোষিত উত্তরাধুনিক একাডেমিক, তবে সাম্প্রতিককালে এঁদের কাতারে তৃতীয় বিশ্বের অনেক একাডেমিকও সামিল হয়েছেন। এঁরা আধুনিক বিজ্ঞানের সার্বজনীনতার দাবিকে আঞ্চলিক স্বার্থবিরোধী ও বহিঃস্থ বিশেষজ্ঞদের তোষামোদী হিসেবে দেখেন। স্যান্ড্রা হারডিংয়ের ভাষায়, আধুনিক বিজ্ঞানের সার্বজনীনতার দাবি হল “the West's ploy for disvaluing local concerns and knowledge and legitimating outside experts

এই ধারার ভাবনাচিন্তার সবচেয়ে তীব্র অনুরাগীরা হলেন প্রাক্তন উপনিবেশের সংস্কৃতিকে পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত করার আন্দোলনের বুদ্ধিজীবি ও কর্মীরা। এঁরা এঁদের পূর্বসুরী “science for the people movement”(যেটা প্রকৃতিগতভাবে আধুনিকতাবাদী কিন্তু ঔপনিবেশিকতাবিরোধী ছিল) প্রত্যাখ্যান করে উত্তরাধুনিক/পোস্টকলনিয়াল “alternative science movement” প্রচার করেন। “science for the people movement” এর উদ্দেশ্য ছিল বিজ্ঞানকে আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে একীভূত করে ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা, কিন্তু উত্তরাধুনিকরা মনে করেন আধুনিক “পশ্চিমা” বিজ্ঞানই প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর দুর্বস্থার কারণ। তাঁরা মনে করেন প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর উচিত “পশ্চিমা” বিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করে তাদের স্বীয় সভ্যতার হাজার বছরের পুরনো “ways of knowing” গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে পশ্চিমা ও তৃতীয় বিশ্বের সমালোচকদের ভাবনা স্যান্ড্রা হারডিংয়ের উক্তিতেই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে – তাঁরা আঞ্চলিক লোকজ্ঞানকে(folk wisdom) আধুনিক বিজ্ঞানের সমান মর্যাদা দিতে চান ও বহিঃস্থ বিশেষজ্ঞদের একেবারে বাতিল করে দিতে চান। তাঁদের এই দর্শনের মৌলিক অনুমিতিগুলো হল – ১) আঞ্চলিক জ্ঞান আর বহিঃস্থ জ্ঞান মজ্জাগতভাবেই পরস্পরবিরোধী ২) আধুনিক বিজ্ঞান আসলে আঞ্চলিক চিন্তকদের উপর “চাপানো জ্ঞান”।

উত্তরাধুনিকদের আধুনিক বিজ্ঞান আর আঞ্চলিক জ্ঞানকে একটা আরেকটার বিকল্প সংস্করণ হিসেবে দেখার এই প্রবণতা একটি সুনির্দিষ্ট তত্ত্বীয় ভিত্তির উপর দন্ডায়মান – social constructivism of science। বিজ্ঞানকে তাঁরা একটি সামাজিক নির্মাণ হিসেবে দেখেন। সামাজিক নির্মাণবাদী থিওরিগুলোর প্রধানতম মূলনীতি হল – সত্য, যুক্তি, সাফল্য ও প্রগতিশীলতার মাপকাঠিগুলো সবই একেক সংস্কৃতির একেক অনুমিতির উপর নির্ভরশীল। আমাদের দৃষ্টিশক্তির লাগাম আমাদের লিঙ্গ, বর্ণ, জাত ও শ্রেণীতে ন্যস্ত। সত্য, প্রগতি, যুক্তির যেই মাপকাঠিগুলোকে আমরা “পরম” ভেবে অভ্যস্ত, সেগুলোকে “আপেক্ষিক” করার কিছু সুবিধা আছে – আপনার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী যদি আপনি লাইনে থাকেন, তবে অন্য সংস্কৃতির লোক হিসেবে আমার কাছে আপনার আচরণকে অনৈতিক মনে হলেও আমি আপনাকে দোষ দিতে পারব না। যেহেতু উত্তরাধুনিকরা সংস্কৃতি-নিরপেক্ষ নৈতিকতার মাপকাঠিকে অস্বীকার করেন, তাই আপনার কীর্তিকলাপ আমার সংস্কৃতিতে গর্হিত অপরাধ হলেও আপনার সংস্কৃতিতে সেটা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হলে আমাকে তা-ই মেনে নিতে হবে। ধরেন, আপনার সংস্কৃতিতে পুরুষের বহুবিবাহকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু আমার সংস্কৃতিতে পুরুষদের বহুবিবাহ গর্হিত অপরাধ। এখন আমি যদি আমার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ হতে আপনার সংস্কৃতির এই বৈশিষ্ট্যটার সমালোচনা করি, তবে উত্তরাধুনিকদের দৃষ্টিতে সেটা “সীমা লঙ্ঘন” করা হবে, কারণ তাদের দৃষ্টিতে দুনিয়ার সকল সংস্কৃতিই তাদের নিজেদের মত করে সঠিক। উত্তরাধুনিকদের ধারণা - এরুপ “নৈতিক আপেক্ষিকতাবাদ”(moral relativism) বহু বছর ধরে ঔপনিবেশিক শাসনে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোকে নিজের পায়ে মাথা উচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, কিন্তু আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে এই থিওরির লাভের গুড় সবসময় জালিমের ঘরেই যায়। জালিমমাত্রই ঔপনিবেশিক শক্তি হতে হবে এমন কোন কথা নেই, ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্ত হয়ে শোষিত জনগোষ্ঠী থেকেও নতুন জালিম শাসকগোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে পারে। এই জালিমগোষ্ঠী যখন আমাদের মূল্যবোধকে আমাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে, তখন কি আমরা তাদেরকে “সাম্রাজ্যবাদী” আখ্যা দিয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে পারব?

উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকরা আধুনিক বিজ্ঞানকে স্রেফ একটি পশ্চিমা নির্মাণ হিসেবে দেখেন, বস্তুজগত নিয়ে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির লোকবিশ্বাসগুলোও আমাদের আঞ্চলিক নির্মাণ। এই বিভিন্ন আঞ্চলিক নির্মাণগুলোকে তাঁরা আখ্যা দিয়েছেন ethnoscience বা জাতিবিজ্ঞান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বর্তমান জীববৈচিত্র্যের ব্যাখ্যায় চার্লস ডারউইন এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের বিবর্তনের যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন, সেটি পশ্চিমা জাতিবিজ্ঞান; আবার মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে “আদম-হাওয়া” এর গল্পটা একটা সেমীয় জাতিবিজ্ঞান। আপনি হয়ত প্রশ্ন করবেন, “চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও যদি স্রেফ একটি ‘পশ্চিমা’ জাতিবিজ্ঞান হয়, তবে প্রাণ সৃষ্টি সম্পর্কে নর্স রুপকথা কিংবা কেলটিক রুপকথাকে আমরা কোন দেশী জাতিবিজ্ঞান আখ্যা দিব? এই রুপকথাগুলো ইউরোপে উদ্ভূত হয়েছে, আবার ডারউইনের তত্ত্বও ইউরোপের সমাজব্যবস্থায় উদ্ভূত হয়েছে, এই জগতদর্শনগুলো প্রবলভাবে পরস্পরবিরোধী হওয়ার পরও কি আমরা এদেরকে একটি একক ‘পশ্চিমা জাতিবিজ্ঞান’ মোড়কের ভেতর ঢুকিয়ে দেব?”। Ethnoscience প্রসঙ্গে এই প্রশ্নগুলো না ওঠাটাই অস্বাভাবিক। তবে অনেক বিদ্বান কিন্তু সমস্যাটা ধরতে পারেন না। এক ভারতীয় তাত্ত্বিক দীপেশ চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন যে জাতিবিজ্ঞান ধারণাটার উপযোগীতা হল এটি “আধুনিক বিজ্ঞান”কে ইউরোপের সীমানায় আটকে রাখে, উপনিবেশের কন্ঠরুদ্ধ বিজ্ঞানগুলোকে কন্ঠস্বর প্রদান করে। উত্তরাধুনিক সমালোচকরা দাবি করেন যে আধুনিক বিজ্ঞান একাধিক জাতিবিজ্ঞানের মাঝে স্রেফ আরেকটি “জাতিবিজ্ঞান”। আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বজনস্বীকৃত ধ্রুবকগুলো প্রমাণসিদ্ধ হওয়ার জন্য নয়, উপনিবেশের লালসা আর গায়ের জোড়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমের বাইরের সংস্কৃতিগুলো এই “পশ্চিমা জাতিবিজ্ঞান” ব্যবহার করে কখনওই দুনিয়া সম্পর্কে তাদের নিজস্ব প্রতীতি খুঁজে পাবে না; তারা বরং তাদের নিজস্ব জাতিবিজ্ঞান ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রথা, মূল্যবোধকে ভিত্তি করে তাদেরই নিজস্ব কিছু সার্বজনীন “ধ্রুবক” নির্মাণ করে নিতে পারে, যা পশ্চিমা বিজ্ঞানের ধ্রুবকগুলোর বিকল্প হিসেবে কাজ করবে।

যুক্তিটা এরকম যে প্রাক্তন উপনিবেশের বাসিন্দারা যখন বুঝতে শিখবে যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক অবস্থান মিলেমিশে “বিজ্ঞান” নির্মাণ করে, তখন তারা নিজেদের মনকে উপনিবেশের শেকলমুক্ত করায় আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ঔপনিবেশিক কুসংস্কারকে পরিহার করতে চাইলে আপনাকে রনে দেকার্তের যুক্তিবাদও পরিহার করতে হবে, এঁরা কেউই যে “আমাদের” লোক নয়! ইউরোপে এনলাইটেনমেন্টের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার জন্ম হয়েছিল, সেকুলার চেতনা-যুক্তির শ্রেষ্ঠত্ব-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সহ আরও অনেক মতাদর্শ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলোকে আমরা সবাই “আধুনিক” যুগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে জানি। উত্তরাধুনিকরা উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞামতেই এই আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁরা আধুনিকতার বিকল্প খুঁজতে বদ্ধ পরিকর। আধুনিকতা অতিক্রম করে উত্তরাধুনিকদের এই অভিযাত্রা এই পোস্টের বিষয়বস্তুর মধ্যে পড়ে না, আমি আপাতত উত্তরাধুনিকদের বিজ্ঞানবিমুখতা ও এর অফশুট হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীলদের তোষামোদ করার টপিকেই বেশি আগ্রহী। উত্তরাধুনিকরা এনলাইটেনমেন্টকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, তাঁরা এনলাইটেনমেন্ট এবং এনলাইটেনমেন্টের সূর্য সন্তান আধুনিক বিজ্ঞানকে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশের আদিকারণ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। উত্তরাধুনিকরা বিজ্ঞানের ন্যায় “কী?” জাতীয় প্রশ্নে আগ্রহী না, উত্তরাধুনিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হল “কেন?”। আধুনিকরা সত্য আবিস্কার করে, উত্তরাধুনিকরা সত্য interpret করে।

উপনিবেশোত্তর বিশ্বের কাছে এই “জাতিবিজ্ঞান” এর ধারণাটা উত্তরাধুনিক থিওরির উপহার। উত্তরাধুনিকরা এই উপহারকে তাঁদের পক্ষ হতে সহনশীলতা ও “বৈচিত্র্যেই সৌন্দর্য” মনোভাবের প্রকাশ হিসেবে দেখেন, তবে আমার কাছে এটি তাঁদের উন্নাসিকতাই মনে হয়। তাঁরা যেন বলতে চাচ্ছেন যে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান প্রদত্ত যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে আমাদের বিশ্বাসগুলোকে সংশোধন করার সাধ্য রাখি না। আমাদের যেসব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আমাদেরকে পেছনে টেনে রাখছে, সেসবের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এই জ্ঞানতাত্ত্বিক “উপহার”, যা বহু আগেই মৃত, পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়ানো আঞ্চলিক মূল্যবোধকে এই সদা পরিবর্তনশীল বিশ্বে সকল সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের একমাত্র ছহিহ উৎস দাবি করে। বলা বাহুল্য, এই ধরণের চিন্তাভাবনা জনমানুষের মাঝে আঞ্চলিক কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করা আধুনিক বিজ্ঞান প্রসারের আন্দোলনকে তীব্রভাবে বাধা দেয়।

উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকরা এই উপহারটা ভাল মনেই আমাদের সামনে পেশ করেছিলেন। পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী মানসের একটা কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য ছিল যে তারা নিজেদেরকেই একমাত্র আলোকিত, যুক্তিবাদী ও স্বাধীন মনে করত, তারা হল পুরুষের মত বলিষ্ঠ; অন্যদিকে প্রাচ্য হল নারীর মত অবলা, আবেগী, যুক্তিবিমুখ, মজ্জাগতভাবেই পরাধীন। আর পুরুষতান্ত্রিক বয়ানে যেহেতু পুরুষ দ্বারা অধিকৃত হওয়া নারীর নিয়তি, সিমিলারলি প্রাচ্যকে অধিকরণ করাও যেন পশ্চিমের অধিকার ও দায়িত্ব। পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে পশ্চিম হল “আমি”, আর প্রাচ্য হল “সে”(ইংরেজিতে “the Other”)। অতীতে এই দ্বিবিভাজনমূলক দর্শনই গণহত্যা, দাসত্ব ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল। দুনিয়াতে কিছু কিছু বিষয় আসলেই “সামাজিক নির্মাণ” – পুরুষত্ব, নারীত্ব, যৌনতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি ধারণাগুলো সৃষ্টিতে প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় বিধানের চাইতে পারিপার্শ্বিক সমাজ ও সময়ের অবদানই বেশি। প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদগুলো(তা সেটা ধর্মীয় মৌলবাদী হোক, আর ওরিয়েন্টালিস্টই হোক) এই পরিবর্তনশীল নির্মাণগুলোকে কিছু ধ্রুব “নির্যাস”(essence) এ পর্যবসিত করে। কিছু নির্যাস ভাল, কিছু নির্যাস খারাপ। দুনিয়াতে আছে শুধু শয়তান ও ফেরেস্তা, কিন্তু একই দেহে দু’টির অস্তিত্ব যেন অসম্ভব। Essentialist লোকজন হয় সাদা নয় কালো দেখে, ধূসর তারা কখনওই দেখে না।

বস্তুজগত সম্পর্কে জ্ঞান মোটেই “সামাজিক নির্মাণ” ক্যাটাগরিতে পড়ে না, এই জ্ঞান সমাজ ও সময়ের বদলে বস্তুজগতের উপর নির্ভরশীল। উন্নততর পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই জ্ঞানকে আমরা ধীরে ধীরে পরিশীলিত করতে পারি, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার মত আপাদমস্তক উলটে দিতে পারি না, কারণ প্রকৃতি মানুষের মর্জিমাফিক চলে না। সামাজিক নির্মাণবাদী থিওরি ও উত্তরাধুনিকরা যখন আপেক্ষিক কনসেপ্টগুলোকে পরমত্বের খাঁচা হতে মুক্ত করেন তখন তাঁদের প্রশংসা করতেই হয়, কিন্তু তাঁরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই তত্ত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেন, এবং এখানেই আমার আপত্তি। আদিবাসীদের “মজ্জাগত যুক্তিবিমুখতা” সংক্রান্ত সাম্রাজ্যবাদী থিওরির বিরোধীতা করতে গিয়ে যখন উত্তরাধুনিকরা দাবি করে বসেন যে “যুক্তি” নিজেই একটি পশ্চিমা “নির্মাণ”, অথবা আদিবাসীরা তাদের নিজেদের “ব্র্যান্ডের” যুক্তি মেনে চলে – তখন তাঁরা আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের মতই আদিবাসীদের সম্পূর্ণ ভিন্ন “নির্যাস” এর মানুষ হিসেবে দেখছেন। পশ্চিম ও প্রাচ্যের মানুষরা সম্পূর্ণ আলাদা ধাতের মানুষ কিনা সেটা ইস্যু না, ইস্যু হল এই দুই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মেরুর মানুষগুলোর একে অপরের সম্পর্কে বিশ্বাস ও তাদের নিজেদের সম্পর্কে বিশ্বাসগুলো যুক্তির ক্রস-কালচারাল কষ্টিপাথরে টিকবে কিনা। মীরা নন্দাকে উদ্ধৃত করি,

By defining the very nature of rationality and truth as internal to social end practices, social constructivist theories do indeed give the natives their ‘permission’ to be different—but, then, so did apartheid.

আমরা সাধারণত “জ্ঞান” বলতে সেসব ফ্যাক্টকে বুঝিয়ে থাকি যা বাস্তব জগতটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। উত্তরাধুনিকরা মনে করেন “জ্ঞান” ও “বাস্তব” জগত কেবলই কিছু নির্মিত কনসেপ্ট, এই কনসেপ্টগুলোর গায়ে রয়েছে সমাজ ও ইতিহাসের স্বাক্ষর। উত্তরাধুনিকদের দৃষ্টিতে আধুনিকতা মানেই উপনিবেশ, অন্যদিকে উত্তরাধুনিকতা মানে উপনিবেশ হতে মুক্তি। অন্য সংস্কৃতির নিজস্ব লোকবিশ্বাসকে বাস্তবতার বিকৃত উপস্থাপন হিসেবে চিহ্নিত করে আধুনিকতাবাদী, নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞান যেন ঔপনিবেশিক শাসনকে সরাসরি বৈধতা দান করেছে। এর বিপরীতে উত্তরাধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের পথ বাৎলে দিচ্ছে, কারণ উত্তরাধুনিকরা “পশ্চিমা” জ্ঞান ও বাস্তব দুনিয়া নিয়ে পশ্চিমাদের দর্শনকে সার্বজনীন স্বীকৃতি দেয় না।

[postmodern worldview] allows for understanding how cultural stratagems and even violence play a decisive role in the establishment of meaning, in the creation of truth regimes, in deciding
whose and which universals win (Chakrabarty 1992, 21)

ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লা যদি ভিন্ন দিকে ঝুঁকত, তবে ভিন্ন কোন সংস্কৃতির জগতদর্শন হয়ত “সার্বজনীন” সত্যের স্বীকৃতি পেত। চক্রবর্তী আরও বলেন, “truth is but a dialect backed by an army”। উত্তরাধুনিক প্রোজেক্ট শুধুমাত্র “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের সার্বজনীনকরণের নেপথ্যের কাহিনী উদঘাটনেই আগ্রহী না, এই প্রোজেক্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পশ্চিমের দাসত্ব হতে মুক্ত করতেও আগ্রহী।

পোস্টকলনিয়াল থিওরি আর উত্তরাধুনিক থিওরির মাঝে সাদৃশ্য প্রবল হলেও বৈসাদৃশ্যগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মত না। জ্ঞানের অগ্রগতির সাথে মানব উন্নয়ন বৃদ্ধির যেই স্বপ্ন এনলাইটেনমেন্ট দেখেছিল, এই দু’টো থিওরিই তা প্রত্যাখ্যান করে – মানব উন্নয়নের ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই, তাদের আপত্তি বরং এই দাবিতে যে জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে মানব উন্নয়নের কোন সম্পর্ক আছে(কথায় আছে না, knowledge is power, আর আমরা খুব ভাল করেই জানি ক্ষমতা সবসময় কল্যাণকর হয় না)। তবে এনলাইটেনমেন্টকে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে উত্তরাধুনিকতাবাদ পরীক্ষালদ্ধ সত্যের(empirical truth) দৃঢ় ভিত্তিপ্রস্তর ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় খোঁজে; আর এনলাইটেনমেন্টের পোস্টকলনিয়াল সমালোচকরা শুধুমাত্র বিদেশী পরীক্ষালদ্ধ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে, তারা “বিদেশী” সত্যকে “দেশী” সত্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। পোস্টকলনিয়াল যুক্তি অনেকটা এরকম যে আমার দেশের প্রাচীন পন্ডিতরা বাস্তবতা ব্যাখ্যায় যে তত্ত্ব দিয়েছেন, সেটিকে বিদেশের কোন তত্ত্ব দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে না। সৌরজগতের গঠণ নিয়ে যদি আমাদের পন্ডিতদের কোন মতামত থাকে, তবে সেটি দেশীয় শাস্ত্রের আলোকে আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে, পশ্চিম থেকে কোন মডেল আমদানি করা যাবে না। এদিক দিয়ে পোস্টকলনিয়াল তাত্ত্বিকরা বেশ জাতীয়তাবাদি, কিন্তু উত্তরাধুনিকরা জাতীয়তাবাদকে সংশয়ের চোখে দেখেন। এই দুইটা গোত্রের এনলাইটেনমেন্ট-বিরোধী মনোভাব এতই প্রবল যে আমপাবলিক তাদেরকে একটা আরেকটার প্রতিমূর্তি মনে করে বসে, যদিও এরকম সূক্ষ্ম মতপার্থক্যগুলোর কারণে এই দুই গোত্রের তাত্ত্বিকরা নিজেদেরকে একে অপরের দলভুক্ত মনে করেন না।

দুনিয়ার সকল জ্ঞানকে সাংস্কৃতিক নির্মাণ মনে করার কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত, এতে করে বিদ্যমান অন্যায় সামাজিক রীতিগুলো আমাদের জ্ঞানচিকীর্ষা সবসময় শাসনের উপর রাখে, সমাজের মোড়ল ও মূল্যবোধের সোল এজেন্টরাই নির্ধারণ করে দেয় বাস্তব জগত সম্পর্কে আমরা কী কী জানতে পারব অথবা পারব না ২) বিদ্যমান status quo এর সমালোচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ সিস্টেমের বাইরে না গিয়ে সিস্টেমের সমালোচনা করা সম্ভব না ৩) যেসব বুদ্ধিজীবিরা ক্রুটিযুক্ত লোকবিশ্বাসগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করছেন, এই ধরণের চিন্তাভাবনা তাঁদেরকে একঘরে করে ফেলে।

উপরের তত্ত্বীয় আলোচনাগুলো যদি আপনার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়, তবে নিচের অতি পরিচিত সিনারিওগুলোর উপর চোখ বুলালেই বুঝে যাবেন কেন আমি এবং আমরা এত বিমূর্ত সব বিষয় নিয়ে মাথা কুটছি। বিমূর্ত থিওরিকে হেলাফেলা করা যায়, এগুলো নিয়ে রসিকতা করা যায়, কিন্তু এই বিমূর্ত থিওরিগুলোই পর্দার আড়ালে প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদীদের দুধ-কলা দিয়ে পুষে। জ্ঞানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধ বিচার করার মানদন্ড সংক্রান্ত বিমূর্ত দার্শনিক আলাপই নির্ধারণ করে দেয় মোড়লরা সমাজে কতটুক বৈধতা নিয়ে থাকবে, কুসংস্কার হটানোর জন্য বিজ্ঞান প্রসারের আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলনগুলো বৃহত্তর শিক্ষিত সমাজ হতে সহযোগিতা পাবে নাকি অর্ধচন্দ্র পাবে।

দৃশ্যপট:ভারত

খৃষ্ট্যপূর্ব ১৫০০ শতকে ভারতে গুটিবসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে সুস্থ মানুষের দেহে নিয়ন্ত্রিতভাবে গুটিবসন্ত রোগ সঞ্চারিত করা হত যাতে তার দেহে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়ে উঠতে পারে, এর সম্পূরক হিসেবে শীতলা দেবীর কাছে প্রার্থনাও করা হত। আধুনিক যুগে গুটিবসন্তের টিকা হিসেবে গুটিবসন্তেরই কোন স্ট্রেইনকে ব্যবহার করা হয় না, বরং অপেক্ষাকৃত নিরীহ cowpox এর স্ট্রেইনকে ব্যবহার করা হয়। গুটিবসন্তের এই আধুনিক টিকাই ভারতবর্ষে গুটিবসন্তকে বিলুপ্ত করেছিল, কিন্তু ভারতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা Frederique Apffel Marglin নামক এক আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী আধুনিক বিজ্ঞানকে এর জন্য ক্রেডিট না দিয়ে উলটো অরিজিনাল গুটিবসন্ত দিয়ে টিকাদানের প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিকে “খাঁটো” করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানকেই তিনি দোষ দিয়ে বসলেন! তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে গুটিবসন্ত প্রতিরোধের ভারতীয় পদ্ধতিতে রোগ প্রতিরোধের বদলে রোগ সংক্রমণ করার সম্ভাবনা অন্যূন দশ গুণ বেশি, কিন্তু ভারতে ব্রিটিশদের আধুনিক টিকাদান পদ্ধতির প্রচার ও পরবর্তীতে ভারত সরকারের গণ-টিকাদান কর্মসূচীর প্রসারকে তিনি পশ্চিমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অভিহিত করলেন। পশ্চিমের টিকাদান আর ভারতীয় টিকাদান পদ্ধতির মাঝে তিনি পশ্চিমের logocentric দর্শন ও ভারতের non-logocentric দর্শনের সংঘাত দেখতে পেলেন। পশ্চিমা বিজ্ঞান স্বাস্থ্য ও রোগের দ্বিবিভাজনকে স্বীকার্য ধরে নেয়, কিন্তু ভারতীয় দর্শন এরকম কোন দ্বিবিভাজনে বিশ্বাস করে না; শীতলা দেবী নিজেই রোগের উৎস, তিনি নিজেই সেই রোগের প্রতিকার।৩ ফ্রেডেরিক মার্গলিনের দৃষ্টিতে ভারতে যারা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে আধুনিক টিকা পদ্ধতির বিরোধীতা করছে, তারা আসলে এমন একটি জীবনধরণের পক্ষে লড়ছে যা লৌকিকতা ও অলৌকিকতার মাঝে পার্থক্য করে না। আরেক র‍্যাডিকাল অর্থনীতিবিদ স্টিফেন মার্গলিন মনে করেন মানুষের বিচিত্র বিশ্বাস তাদের জন্য তাদেরই একান্ত কিছু সত্য সৃষ্টি করে, তাই পশ্চিমের বস্তুনিষ্ঠ, মূল্যবোধ-হীন বিজ্ঞান ব্যবহার করে অন্য সংস্কৃতির আঞ্চলিক, নিজস্ব “জ্ঞান”কে হটানো অনুচিত হবে। মার্গলিনরা একে বলেন “মানসকে উপনিবেশমুক্ত করার প্রকল্প”। তাঁদের চিন্তাভাবনা আসলে অনেক বিখ্যাত ভারতীয় চিন্তকদের কর্মের ধারাবাহিকতা বজিয়ে রাখছে। মহাত্মা গান্ধী তো বটেই, নব্য-গান্ধীবাদি আশীষ নন্দি থেকে শুরু করে গান্ধীবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের সংমিশ্রণ লালনকারী Vandana Shivaও আছেন। এসব চিন্তকরা আধুনিক বিজ্ঞানকে মজ্জাগতভাবে সহিংস, ঔপনিবেশিক ও পুরুষতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে “বিকল্প”, “জাতীয়তাবাদি” বিজ্ঞানের স্তুতি গেয়েছেন। এই “বিকল্প” বিজ্ঞান আন্দোলনগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধেও জিহাদে নিরত; নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধান ও বস্তুজগতকে অবগাহনের সম্ভাব্যতার অনুমিতি আধুনিক বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দু’টো বৈশিষ্ট্য, উক্ত চিন্তকরা এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে সার্বজনীনতার মুখোশে পশ্চিমা সংকীর্নতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

এই “বিকল্প বিজ্ঞান” আন্দোলনের সদস্যরা “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের বিপরীতে এক নতুন বিজ্ঞান প্রস্তাব করতে চান যার অনুমিতিগুলো ভারতীয়(মূলত হিন্দু, এই “ভারতীয় বিজ্ঞান” আন্দোলনে মুসলমান ভারতীয়দের কোন প্রতিনিধি দেখা যায় না) সভ্যতা ও দর্শনের অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাসসমূহে প্রোথিত থাকবে। আঞ্চলিক সংস্কারের প্রতি হুমকিস্বরুপ সকল আধুনিকীকরণ শক্তিকে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দেন। তাঁদের আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দু হল জনগণের মাঝে বিজ্ঞান প্রসারের আন্দোলন, তাঁদের দৃষ্টিতে এই আন্দোলনগুলো “[tramples] on ordinary people's epistemological rights… by gallantly attempting to replace the village sorcerer or tantrik with the barbarism of modern science's [methods]”। আশীষ নন্দীর মত ছহিহ “দেশপ্রেমিক” আরেক ধাপ এগিয়ে সতীদাহ চর্চার সমালোচকদেরও নিন্দা করেছেন, এসব সমালোচকরা তো পশ্চিমা-দীক্ষিত এলিট লোকসংস্কৃতির প্রতি রয়েছে যাদের অশেষ অবজ্ঞা! বলা বাহুল্য, এরকম স্বজাত্যবাদী ও আধুনিকতাবিরোধী চিন্তাভাবনা ডানপন্থী উগ্র হিন্দু শিবিরে সমাদৃত হয়েছে।

যেহেতু People’s Science Movement(PSM)গুলো এই পোস্টকলনিয়াল তাত্ত্বিকদের ক্রশহেয়ারে প্রধান লক্ষ্যবস্তু, তাই এর সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ভারতের সামাজিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে PSM বেশ বড় একটি আন্দোলন, দেশজুড়ে প্রায় ১৫০০০-২০০০০ কর্মী ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশকর্মী থেকে শুরু করে যেসব কারখানা শ্রমিক ও কৃষকও এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই বিচিত্র প্রেষণা ও মতাদর্শ ধারণ করেন; কারও চিন্তা মার্ক্সবাদী, কেউবা জাতীয়তাবাদী, অথবা সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। পরিবেশ-সংবেদনশীলতা ও স্বনির্ভরশীল উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ’৮০ এর দশকে এই আন্দোলনগুলো বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ও জনগণের মাঝে বিজ্ঞানমনস্কতা উৎসাহিত করার উদ্যোগেও নিবিষ্ট হয়েছিল। কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ, কিশোর ভারতী(বর্তমানে লুপ্ত), একলব্য প্রভৃতি বহু সংগঠণ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাসগুলো ব্যবচ্ছেদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কনসেপ্টের উপর কর্মশালার আয়োজন করত। PSM এর মাঝে এই আধুনিকতাবাদী উপাদানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল একটি বিজ্ঞানমনস্ক, সংশয়ী মনোভাব সৃষ্টি করা যা দীর্ঘকাল ধরে লালিত ও বাপ-দাদা হতে প্রাপ্ত বিশ্বাসগুলোকে অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিবে। এই উদ্দেশ্য সাধন করার লক্ষ্যে তাঁরা রোগের জীবাণুতত্ত্ব থেকে শুরু করে সকল প্রাণের ঐক্যের জেনেটিক ভিত্তি এবং নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার কনসেপ্টগুলোকে বোধগম্য করার চেষ্টা করেছিলেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে এই তত্ত্বগুলোর ভূমিকা তুলে ধরেছিলেন(সুবিখ্যাত কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ এর কার্যবিবরণীর জন্য Zachariah 1994 দ্রষ্টব্য)। আমেরিকা ও ইউরোপে ’৬০ এর দশকে গজিয়ে উঠা নব্য বামদের(New Left) দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ভারতের PSM, নব্য বামদের মতই তারা যুক্তি ও প্রগতির কনসেপ্টে কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল, এর ফলে তারা সবুজ বিপ্লব ও অনুরুপ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রত্যখ্যান করেছিল। তবে আমেরিকার নব্য বামদের মত ভারতের বামরা তখনও এনলাইটেনমেন্ট মূল্যবোধের নাড়ি সম্পূর্ণ কর্তন করেনি। ’৬০ থেকে ’৮০ এর দশক জুড়ে জহরলাল নেহেরু, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং মেঘনাদ সাহার মত ব্যক্তিত্বরা লোকাচারের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির প্রয়োগ উৎসাহিত করেছিলেন।

সাম্পতিককালে যখন ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা বিজ্ঞান চিন্তায় নির্মাণবাদী দর্শন ও সমাজ চিন্তায় উত্তরাধুনিক দর্শনের দিকে মোড় ঘুরলেন, তখন people’s science movement এর এনলাইটেনমেন্ট ঐতিহ্য ধীরে ধীরে নীরব হতে থাকল। ’৮০ এর দশকের শুরুর দিকে বুদ্ধিবৃত্তির এই নতুন বিন্যাসের লগ্নে বিজ্ঞান আন্দোলনের আধুনিকতাবাদী ও যুক্তিবাদী উপাদানগুলোই সর্বপ্রথমে আক্রান্ত হল। আশীষ নন্দী, Vandana Shiva এবং সমগোত্রীয় ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা বিজ্ঞানমনস্কতাকে মানবতান্ত্রিক দর্শনের(humanistic temper) মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন, যেন একটা আরেকটার প্রতিপক্ষ! যারাই এই দ্বিবিভাজনকে অস্বীকার করেছে, তারাই “পশ্চিমমুখী এলিট”, “সাম্রাজ্যবাদী” ট্যাগ খেয়েছে। লোকসংস্কারকে বিজ্ঞানের আলোকে মূল্যায়ন করার যেই এনলাইটেনমেন্ট প্রেষিত প্রবৃত্তি পরবর্তীতে ভারতের বিজ্ঞান আন্দোলন থেকে হারিয়ে গিয়েছে, সেটি ছিল এই “scientific temper বনাম humanistic temper” দ্বন্দ্বের প্রথম ক্যাজুয়ালটি। আধুনিক বিজ্ঞানকে “চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমা জ্ঞান” হিসেবে দেখার এই মনোবৃত্তিটা বর্তমানে উপনিবেশোত্তর ভারতীয় বামদের মধ্যে ঢুকে গেছে, যার মধ্যে নারীবাদি তাত্ত্বিক ও পরিবেশকর্মীরাও অন্তর্ভুক্ত।

ভারতের এই Science war এর সাথে পশ্চিমের সায়েন্স ওয়ারের ব্যাপক সাদৃশ্য আছে – এনলাইটেনমেন্ট ও বিজ্ঞানের ভারতীয় এবং পশ্চিমা সমালোচকরা একই তত্ত্বীয় ভাষায় কথা বলেন। ভারতে এই বিজ্ঞান বিতর্কের মূল প্রভাবক ছিল মহাত্মা গান্ধীর এনলাইটেনমেন্ট বিরোধী চিন্তাভাবনা, দার্শনিক থমাস কুনের ভুল পাঠ এবং পশ্চিমে বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বের(Sociology of Science) উত্থান। স্বঘোষিত উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য বর্তমানে মিশেল ফুকো ও এডওয়ার্ড সাইদের Orientalism গ্রন্থেও অনুপ্রেরণা খুঁজে। এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে - এই ভারতীয় সমালোচকরা “পশ্চিমা” বিজ্ঞানের মূলনীতিগুলোকে গ্রহণ করতে অসম্মত হলেও আমেরিকান একাডেমিয়াতে উদ্ভূত বিজ্ঞানের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নির্মাণবাদী থিওরিগুলোকে জ্ঞানের একমাত্র “প্রগতিশীল” ব্যাখ্যা মেনে নিতে তাঁদের একটুও বাধেনি। এসব থিওরিস্টদের লেখাকে পশ্চিমের সায়েন্স স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলোতে তৃতীয় বিশ্বের “প্রামাণ্য” কন্ঠস্বর হিসেবে তুলে ধরা হয়। ভারতের যেসব বিজ্ঞান কর্মী আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সামাজিক সংস্কারগুলো ব্যবচ্ছেদ কিংবা পুনরুজ্জীবিত করেছেন, সায়েন্স স্টাডিজ একাডেমিকদের চোখে তাঁদের কোনও অস্তিত্বই নেই! প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর সাথে বিজ্ঞান আন্দোলনের জটিল সম্পর্ককে তাঁরা শেষমেষ ঔপনিবেশিকদের আরোপিত প্রপঞ্চে পর্যবসিত করেছেন।

দৃশ্যপট:পাকিস্তান

ভারতে PSM “বিকল্প বিজ্ঞান” আন্দোলনকারীদের রোষানলে পড়েছিল; অন্যদিকে পাকিস্তান, মিশর, সৌদি আরবের মত ইসলামী দেশগুলোকে জেনুইন বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট “ইসলামী বিজ্ঞান” এর খপ্পরে পড়েছেন। নোবেলজয়ী প্রথম মুসলিম(যদিও কাদিয়ানিদের “মুসলমান” মনে করা হয় না) বিজ্ঞানী আব্দুস সালামও রেহাই পাননি। সালামের দেশ পাকিস্তানে ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব বা ইলম্‌ এর প্রচারকরা মূলত বিলেত প্রবাসী পাকিস্তানী জিয়াউদ্দিন সরদার ও আমেরিকা ভিত্তিক জীববিজ্ঞানী ও ইসলামিস্ট মুনাওয়ার আহমেদ আনিসের শিষ্য। ভারতে যেমন একটা “হিন্দু” বিজ্ঞান সৃষ্টির পায়তারা করা হয়েছিল, পাকিস্তানেও জিয়াউদ্দিন সরদাররা একটা “ইসলামী” বিজ্ঞান সৃষ্টির প্রয়াস নিয়েছিলেন। এই “ইসলামী বিজ্ঞান” চিরাচরিত বিজ্ঞানের সিদ্ধ কর্মপদ্ধতি অনুসরণের বিরুদ্ধবাদী, বরং তারা ইসলামের নিজস্ব দার্শনিক কনসেপ্টগুলো হতে প্রকৃতি সম্পর্কিত বিধান আহরণেই বেশি আগ্রহী। জিয়াউদ্দিন সরদারদের দৃষ্টিতে মুসলমান সমাজের সমস্যাগুলোকে আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করা আবদুস সালামরা আসলে “বিভ্রান্ত”। আরও বেশি মাত্রায় মুমিনরা হয়ত এই প্রচেষ্টাকে ধর্মদ্রোহীও আখ্যা দিবেন।

যেহেতু আধুনিক বিজ্ঞান সংশয়কে উৎসাহিত করে(এবং ধর্মগ্রন্থও এই সংশয়ের গ্রাস থেকে রেহাই পায় না), তাই এই ইসলামী সমালোচকরা আধুনিক বিজ্ঞানকে ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্বের প্রতি হুমকি প্রতিপন্ন করেন, আধুনিক বিজ্ঞান তাঁদের দৃষ্টিতে ইলম এর সাথে অসংগতিপূর্ণ। ফেমিনিস্ট বিজ্ঞান সমালোচক ও কুনের ভাবশিষ্য সমাজবিজ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে তাঁরা সংশয় প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বাসকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেন, সত্যানুসন্ধানের প্রতিটি পর্যায়ে তাঁরা ইসলামি মূল্যবোধকে অঙ্গীভূত করতে চান।৯, ১০ সান্ড্রা হারডিংয়ের মত পোস্টকলনিয়াল ফেমিনিস্ট সমালোচকরা আবার এঁদেরকে “প্রগতিশীল’ বিজ্ঞান সমালোচক আখ্যা দিয়েছেন। পাকিস্তানে যেহেতু এমনিতেই ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষণ করা হয়, তাই এই “ইসলামী বিজ্ঞান” আন্দোলন বিজ্ঞান শিক্ষাকে তুমুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; বিবর্তনবিদ্যা কিংবা আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পড়ানোর বিরোধীতা করার পাশাপাশি “বৈজ্ঞানিক মিরাকল” এর আবর্জনা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করা হচ্ছে।১১ তবে ইলম প্রতিষ্ঠার দাবি শুধুমাত্র ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বে সীমাবদ্ধ না; মানবাধিকারের কনসেপ্টকেও এখন ইসলামীকরণ করা হচ্ছে১২। শুধু ইসলামীকরণ না, মানবাধিকারের মত সার্বজনীন বিষয়কে “হিন্দু”, “আফ্রিকান”, “কনফুসীয়” প্রভৃতি আলাদা প্রজাতিতে ভাগ করার অপচেষ্টাও করা হয়েছে।১৩ মানবাধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে জুলুমকেই এক “বিকল্প” ব্র্যান্ডের “মানবাধিকার” আখ্যা দিলে ফায়দা কী বুঝতে সমস্যা হয় না।

টীকা:-

Enlightenment – ১৭ ও ১৮ শতকের ইউরোপে(মূলত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতে) কুসংস্কার ও সকল প্রকার obscurantismকে প্রত্যাখ্যান করে এর বিপরীতে মনুষ্য যুক্তি ও বিজ্ঞানকে আলিঙ্গন করে একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেটাকে এখন Enlightenment বলা হয়। এনলাইটেনমেন্টের যুগকে Age of Reason ও বলা হয়। মানুষের জীবনের উপর ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে এই আন্দোলন সেকুলার যুক্তিকেই একমাত্র বৈধ বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। এনলাইটেনমেন্ট দার্শনিকরা মনে করতেন প্রত্যেকটি মানুষের যুক্তিবোধ থাকায় তারা সকলেই সমানাধিকার ভোগ করার অধিকার আছে, জ্ঞানের উপর পুরুত-পাদ্রী বা অন্য কোন ইশ্বরপুত্রের কোন একক কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। সকল ঘটনাকেই প্রকৃতি বিজ্ঞনের কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করে অনুসন্ধানের আওতাধীন করতে হবে। যৌক্তিক অনুসন্ধানের কষ্টিপাথরে টিকতে না পারলে যেকোন কিছুই বাতিলযোগ্য গণ্য হবে।

ধর্মতত্ত্বের অঙ্গনে এই আন্দোলন deism মতবাদের জন্ম দিয়েছিল। Deistরা বিশ্বাস করতেন “নাযিলকৃত” কেতাব নয়, নিজের বুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ খাটিয়েই ইশ্বরকে আবিস্কার করা সম্ভব। সঙ্গত কারণেই Deistদের ইশ্বর প্রচলিত ধর্মের মত মানবকেন্দ্রিক হত না, যে কিনা মানুষ প্রতিটা সেকেন্ডের কীর্তিকলাপ নিয়ে মাথা ঘামায়। Deistদের ইশ্বর একেবারেই ভাবলেশহীন, বস্তুজগত সৃষ্টি করে সে আর কিছু নিয়েই মাথা ঘামায় না। রাজনীতির অঙ্গনে এনলাইটেনমেন্ট ধর্মীয় সহনশীলতা আর প্রকৃতিজাত স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ধারণা প্রবর্তন করেছিল। দর্শনের অঙ্গনে এনলাইটেনমেন্ট বস্তুবাদনির্ধারণবাদ মতবাদ উৎপাদন করেছিল।

এনলাইটেনমেন্ট আন্দোলন সংস্কৃতি ও প্রথাকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অনেক সমালোচকই দাবি করেছেন যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে এনলাইটেনমেন্ট সম্প্রদায়বোধের অবমূল্যায়ন করেছে।

Logocentrism – সহজ ভাষায় বললে, এই দর্শন signifier ও signified এর দ্বিবিভাজন নিয়ে চিন্তিত। মানুষ প্রতীক বা sign ছাড়া চিন্তা করতে পারে না। ফরাসী ভাষাবিদ Ferdinand de Saussure প্রবর্তিত রীতি অনুযায়ী sign এর দু’টো অংশ থাকে – ১) signifier ২) signified। Signifier হল প্রতীকের ভৌতরুপ যা কোন কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে, signified হল সেই প্রতীতি যার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য signifier ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ – “তিতাস” শব্দটা আসলে একটা প্রতীক। এই প্রতীকের ভৌতরুপ বা signifier অংশ হল কিছু বাংলা হরফ যা আপনি দৃষ্টিশক্তি দিয়ে এইমাত্র মনিটরের পর্দায় অবলোকন করলেন, এই পোস্ট পত্রিকায় ছাপা হলে ছাপার হরফে অবলোকন করতেন। হরফগুলো পড়ার কারণে আপনার মনের পর্দায় তিতাস নদীর নিশ্চয়ই কোন চিত্র ভেসে উঠছে? এই চিত্রটিই হল signified।

এই signified-signifier দ্বিবিভাজনটা ব্যাপক পরিসরে নিয়ে গিয়ে বলা যায় যে আমাদের ভাষাটা নিজেই আসলে একটি signifier, আর এই ভাষা ব্যবহার করে আমরা যেই বস্তুজগত ও মানবসমাজকে বর্ণনা করি সেটা হল signified। Logocentric দর্শন এই signifier আর signified এর মধ্যে পার্থক্য করে, কিন্তু non-logocentric দর্শনে যাহা signifier তাহাই signified। অর্থাৎ, আমরা যেটাকে “বহিঃজগত” বলি, সেটা আসলে আমাদের ভাষারই সৃষ্টি; আমরা যেসব বিষয়কে ধ্রুবক ও অপরিবর্তনীয় মনে করি, সেগুলো তাদের অস্তিত্বের জন্য অনেকাংশেই আমাদের উপর নির্ভরশীল।

আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিজ্ঞান শিখেছি, সেটি logocentric দর্শনের ফসল। Logocentric দর্শনের সমালোচকরা একে পশ্চিমা দর্শনের সংজ্ঞায়নকারী বৈশিষ্ট্য মনে করেন(উল্লেখ্য, এই সমালোকরা নিজেরাও পশ্চিমা)।

New Left – ’৫০, ’৬০ ও ’৭০ এর দশকে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দর্শন। পুঁজিবাদ ও শ্রমিক অধিকার ছিল ওল্ড লেফটের মনযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, দলীয় রেখায় চিন্তা করে তারা শ্রমিক শ্রেণীকে বিপ্লবী শ্রেণীতে রুপান্তরের স্বপ্ন দেখত। এর বিপরীতে নব্য বাম বুদ্ধিজীবিরা স্বাধীন ও নির্দলীয়, অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্সের বদলে তারা সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্সের প্রতি বেশি আগ্রহী।

Postmodernism – পশ্চিমা বিশ্বে কান্ট, হেগেল ও মার্ক্সরা বিবর্তন, শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন ও বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে সভ্যতার প্রগতির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, প্রগতির সেই “গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ”কে প্রত্যাখ্যান করে জন্ম নিয়েছে উত্তরাধুনিকতাবাদ। উত্তরাধুনিকরা কোন ধ্রুব অর্থে(meaning) বিশ্বাস করেন না, মনুষ্য ভাষার সাথে বাহ্যিক দুনিয়ার কোন ঐক্য তাঁরা দেখতে পান না(অর্থাত, মানুষের ভাষা নিজেই একটি স্বতন্ত্র্য দুনিয়া, এটি বাহ্যিক জগতের প্রতিনিধিত্বকারী কোন মাধ্যম নয়), কোন নৈর্ব্যক্তি সত্য/ফ্যাক্ট/বাস্তবতাকে তাঁরা অনুসন্ধানের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন না।

উত্তরাধুনিক দর্শনের সবচেয়ে বিখ্যাত পূর্বসূরী বোধকরি ফ্রেডরিখ নিয়েৎশে, যিনি নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানের অনুমিতির বিরুদ্ধে দার্শনিক অস্ত্র হিসেবে perspectivism মতবাদের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে নৈর্ব্যক্তিকতা(objectivity) হল ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের মুখোশ, শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বিশেষাধিকারের(privilege) শেষ দূর্গ। যুক্তিবাদী চিন্তা মানেই যেন বিদ্যমান ঘটনাসমূহের উপর চাপিয়ে দেওয়া স্বীয় সংস্কৃতির arbitrary দ্বিবিভাজন(dichotomy)। উত্তরাধুনিক দর্শনের এসব সিদ্ধান্তের পরিণতি কী, তা নিয়ে খোদ উত্তরাধুনিক দার্শনিকদের মাঝেই মতপার্থক্য রয়েছে। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করা আপাতঃদৃষ্টিতে একটি স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক মতবাদ মনে হতে পারে, কিন্তু এই মতবাদ একই সাথে বহু প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার জন্ম দিতে পারে। আপনি যদি নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার কোন মাপকাঠিকেই স্বীকার না করেন, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-হলোকস্ট-বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতাগুলোকে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে কোন অন্তরায় থাকে না। পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রতি তো বটেই, নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে নিজের বিশ্বাসের প্রতিও এক ধরণের পরিহাসপর মনোভাব সৃষ্টি হয়; কোন কিছুই যদি বাতিলযোগ্য না হয়, তবে নিজের দর্শনকে গ্রহনযোগ্য করার পেছনে শ্রম দিয়ে লাভ কী? এই মনোভাবকে Richard Rorty এর মত অনেক দার্শনিক “সামাজিক দায়িত্বহীনতা” আখ্যা দিয়েছেন, ক্ষেত্রবিশেষে এই মনোভাব রক্ষণশীলতারও জন্ম দেয়। Jean-François Lyotard এর “The Postmodern Condition” বইটি ভিত্তি করে উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর সারমর্ম মোটা দাগে তিনটি পয়েন্টে উপস্থাপন করা যায় - ১) মানব উন্নয়নে বিজ্ঞানের ভূমিকাকে অস্বীকার করা ২) মানবিক ডিসিপ্লিনগুলোতে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ত্রুটিপ্রবণতার মাত্রাকে অতিরঞ্জন করা ৩) এই সহজ সত্যটাকে এড়িয়ে যাওয়া যে মানুষের ইতিহাস ও তার আইনকে কখনওই “ধ্রুব সত্য” আখ্যা দেওয়া হয়নি। আমাদের ইতিহাস ও আইন কোন শ্বাসত সত্য নয়, তবে তারা কম-বেশি accurate। চিন্তা করে দেখুন – একটি ভূ-দৃশ্যকে উপস্থাপন করার জন্য একটি একক নির্ভুল মানচিত্র প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। একই ভূ-দৃশ্যকে একাধিক মানচিত্র কম-বেশি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে। একই ভূ-দৃশ্যের জন্য একাধিক মানচিত্র থাকলে এমনটা মনে করার কারণ নেই যে উক্ত ভূ-দৃশ্যের কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই, পুরোটাই মানুষের সৃষ্টি, সব মানচিত্রই সমানভাবে সঠিক! সময়ের সাথে সাথে আমরা মানচিত্রগুলো সংশোধন করতে পারি। মানচিত্রের মাঝে আমরা কোন ভূ-দৃশ্যকে কখনও হুবহু তুলে ধরতে পারব কিনা, সেটি ভিন্ন বিতর্ক।

Science Wars – এটার অনেক বড় কাহিনী, তাই শুধু লিংক রেখে গেলাম দেঁতো হাসি

Thomas Kuhn – বিজ্ঞানের দার্শনিক, যদিও প্রথম জীবনে তিনি পদার্থবিদ ছিলেন। তাঁর The Structure of Scientific Revolutions বইতে তিনি বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার জন্য প্যারাডাইম আর প্যারাডাইম শিফট তত্ত্ব প্রবর্তন করেছিলেন। প্যারাডাইম হইল ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক সমাজে সর্বজন স্বীকৃত কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস এবং আচার। এই প্যারাডাইম ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা যখন বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধান করেন, তখন সেই সময়ের বিজ্ঞানকে কুন normal science আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিদ্যমান প্যারাডাইম সব সময় সমস্যা সমাধানে সমর্থ হয় না, অমীমাংসিত সমস্যাগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে বিদ্যমান প্যারাডাইমকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। Normal science এর বিপর্যয়ের এই সময়কে কুন crisis period আখ্যা দিয়েছেন(মূল শব্দটা মনে নেই, স্মৃতি থেকে লিখছি)। বিদ্যমান প্যারাডাইমের এই বিপর্যয় হতে উত্তোরণের জন্য নতুন এক প্যারাডাইম আবির্ভূত হয়, যার সাথে অতীতের প্যারাডাইমের কোন সামঞ্জস্য নেই। একে তিনি আখ্যা দিয়েছেন “প্যারাডাইম শিফট”। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হল একটি স্থিতিশীল কাঠামোর ভেতরে থেকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান স্তরে স্তরে বৃদ্ধি পেয়ে সামনে এগিয়ে যায়, কুনের “প্যারাডাইম শিফট” মতবাদ এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। কুনের মতবাদ বিজ্ঞানের দর্শনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে, উত্তরাধুনিকদের মাঝেও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে।

তথ্যসূত্র


১) Harding, S. Is Science Multicultural? Challenges, Resources, Opportunities, Uncertainties. Configurations 2: 301–30, 1994
২) Chakrabarty, D. Postcoloniality and the Artifice of History: Who Speaks for “Indian” Pasts? Representations 37, 1992
৩) Marglin, F. A. Smallpox in two Systems of Knowledge. In Dominating Knowledge: Development, Culture and Resistance, Frederique A. Marglin and Stephen A. Marglin, eds. Oxford: Clarendon, 1990.
৪) Marglin, S. A. Losing Touch: The Cultural Conditions of Worker Accommodation and Resistance. In Dominating Knowledge: Development, Culture and Resistance, ed.
৫) Alvares, C. Science, Colonialism and Violence: A Luddite View. In Science Hegemony and Violence: A Requiem for Modernity, A. Nandy, ed. Oxford: Oxford University Press, 1988.
৬) Nandy, A. The Human Factor. The Illustrated Weekly of India, 17 Jan., 1988
৭) Meera Nanda, Restoring the Real: Rethinking Social Constructivist Theories of Science. In Socialist Register, L. Panitch, ed. London: Merlin Press, 1997b.
৮) Zachariah, M., Science for Social Revolution? Achievements and Dilemmas of a Development Movement. London: Zed Books, 1994.
৯) Anees, M. A. Islam and Scientific Fundamentalism. New Perspectives Quarterly Summer, 1993.
১০) Sardar, Z., ed., The Revenge of Athena: Science Exploitation and The Third World. London, Mansell, 1988.
১১) Hoodbhoy, P., Islam and Science: Religious Orthodoxy and the Battle for Rationality. London: Zed, 1991.
১২) http://en.wikipedia.org/wiki/Universal_Islamic_Declaration_of_Human_Rights
১৩) Afshari, R. An Essay on Islamic Cultural Relativists in the Discourse of Human Rights. Human Rights Quarterly 16: 235–76, 1994.


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

খুবই আগ্রহ নিয়ে এই লেখাটা পড়লাম; আর পরের পর্বগুলির অপেক্ষায় থাকলাম। আপাততঃ কিছু মন্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ দিচ্ছি।

১) আধুনিকদের কাছে সত্য = Truth; আর উত্তরাধুনিকদের কাছে সত্য = truth।

২) বিজ্ঞান সম্পর্কে অধিকাংশ উত্তরাধুনিকদের ধারণা শিশুতোষ। তাঁরা (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) ভুলে যান যে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিজ্ঞান নিজেকে সংশোধন করে।

৩) লোকজাত (Indigenous) জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এর সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য হল বিজ্ঞান systematic; যা লোকজাত জ্ঞান না।

৪) সার্বজনীন প্রত্যয়কে (বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইত্যাদি) বিশেষায়িত করা (উদাহরনঃ ইসলামী গণতন্ত্র, কনফুসীয় মানবাধিকার) মানে যে তাদেরকে খর্ব করা, এটা উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক এবং তাদের সমর্থকদের মাথায় সব সময় থাকে না।

৫) উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিকদের লেখায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রত্যয়ের অপব্যবহার নিয়ে Alan Sokal এবং Jean Bricmont "Fashionable Nonsense" নামে একটি চমৎকার বই লিখেছিলেন। আমার ধারণা আপনি হয়ত বইটা এর মধ্যেই পড়ে থাকবেন। যদি এটা আপনার সংগ্রহে না থাকে, এবং যদি পড়তে আগ্রহি হন, আমাকে জানাবেন। আমার কাছে ডিজিটাল কপি আছে।

পৃথ্বী এর ছবি

এলান সোকালের এই বইটা পড়েছি, চমৎকার চলুক এর দু'একটা অধ্যায় অনুবাদ করার ইচ্ছা আছে।


Big Brother is watching you.

Goodreads shelf

Emran  এর ছবি

আরেকটা মন্তব্য করতে ভুলে গিয়েছিলাম। ১৯৮০র দশকে জিয়াউল হকের শাসনামলে পাকিস্তানে একটা বিজ্ঞান সেমিনার হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল জিন (মানে জিন-পরীর "জিন" আর কি) থেকে শক্তি আহরণ।

সত্যপীর এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

..................................................................
#Banshibir.

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হ, ঠিকই তো আছে, জ্বিন হইল "পোলা তো নয় যেন আগুনেরই গোলা"... অক্করে সলিড এনার্জি দেঁতো হাসি

তারেক অণু এর ছবি
সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বিলাই দিয়া গুল্লি করান কিল্লাই? কি কইচ্চি?
বিলাইয়ের পিছের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখি আবার বিমূর্ত জ্বিন চিন্তিত

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আপাতত ইটা রাইখ্যা গেলাম...

হাসিব এর ছবি

মূল টেক্সটে সায়েন্স শব্দটার উল্লেখ (যেটার অনুবাদ আপনি করেছেন বিজ্ঞান) থাকলেও আসলে এটা মূলত "সামাজিক বিজ্ঞান" বলা উচিত। এটাতে যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড পড়াশোনাটা নেই তাদের কাছে বক্তব্য আরোও সহজভাবে পৌছানো যায়। ন্যাচারাল সায়েন্সের বেশিরভাগ ইস্যুতে ক্রিটিকাল বা পোস্টমর্ডানিস্ট আর্গুমেন্টের পার্থক্য করা সম্ভব না।

পুনশ্চ: চমতকার একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য সাধুবাদ।

রণদীপম বসু এর ছবি

সহমত। অনুবাদে কেবল বিজ্ঞান শব্দটা ব্যবহারের কারণে লেখাটাতে বারেবারে হোঁচট খেতে হচ্ছিলো। আমিও মনে মনে শব্দটাকে বিজ্ঞানের বদলে সামাজিক বিজ্ঞান জাতীয় কিছু একটা কল্পনা করেই বোঝার চেষ্টা করেছি।
প্রচলিত অর্থে বিজ্ঞান বলতে যা বোঝায় তা এখানে প্রযোজ্য করা যায় না। বৌদ্ধ দর্শনেও বিজ্ঞান শব্দটা খুব বেশি ব্যবহার হয়েছে বুদ্ধের সময় থেকেই। তবে তা প্রচলিত বিজ্ঞান যে নয় এটা পরিষ্কার না হলে পুরোপুরি জট পাকিয়ে যায়। ওখানে বিজ্ঞানপ্রবাহ মানে অসংখ্য ক্ষণিকত্বের অবিচ্ছেদ্য প্রবাহ বোঝানো হয়। একইভাবে উত্তরাধুনিক ধারণায় এই বিজ্ঞানটাকে আসলে মিথলজিক্যাল কনসেপ্ট থেকেই বুঝতে হয়।

যাক্, উত্তরাধুনিকতা বিষয়টাতে আমার অস্পষ্টতা এখনো সীমাহীন। আমি ফান করে বুঝি যে, একালের যে মিশাইল ক্ষেপনাস্ত্র, উত্তরাধুনিকদের মতে এটা খেরেস্তানদের অস্ত্র, এর বহু বহু আগে থেকেই আমাদের সেই অস্ত্রটি রয়েছে যা মহাভারতে অগ্নিবান শক্তিশেল ইত্যাদি নামে উল্লেখ করা আছে ! অতএব আমরা তাদের থেকে অনেক বেশি সভ্য ও আধুনিক !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

স্পর্শ এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। এই বিষয় নিয়ে এতটা শ্রম ব্যয় করে লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা।

পোস্টমর্ডানিস্ট বুলশিট এর ক্ষপ্পরে পড়ে কত সময় যে নষ্ট করেছি। আজকাল এসবের সামনে পড়ে গেলে রীতিমত বিবমিষা জাগে। তবে এর বিপদ আছে, শুরুর উদ্ধৃতিটার সূত্রে বলা যায়, এসব এড়াতে গিয়ে হয়তো সত্যিই দারুণ কিছু মিস করে যাবো। কিন্তু কী আর করা। সসীম এবং ছোট্ট জীবন আমার। কিছু পথ না হাটার সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

আর সত্যিই তো, যারা নিজের বক্তব্য আর চিন্তাধারাকে অসচ্ছ করে রাখতে ভালোবাসে, তাদের সাথে বিতর্ক করাটা স্রেফ সময়ের অপচয়, এবং ছোট্ট যে জীবনটা পেয়েছি, তার কিছু অংশ অফলপ্রসু স্বরোপিত যন্ত্রণায় কাটানোর সমতুল্য। ইন ফ্যাক্ট এইসব থিওরিস্টকে পাত্তা দিলেই মাথায় চড়ে। সাধারণের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে এরা অক্ষম, বরং, সেই পরিবর্তন যারা ঘটাতে পারতো, তাদের কালক্ষেপণ করানো বা বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কোনো ভাবে এরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না. . .

র্যান্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। থামি।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তারেক অণু এর ছবি

যা বলতে চেয়েছিলাম মোটামুটি সবই আপনই বলে দিয়েছেন,

শুধু অবাক হতে হয়, হাতে কি প্রমাণ সময় থাকলে এইসব চিন্তাতে মানুষ সময় নষ্ট করে অ্যাঁ যত্তসব

এত পরিশ্রমসাধ্য লেখার জন্য ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো লেখাটা।

আব্দুল্লাহ এ এম

অর্ণব এর ছবি

পোস্টমডার্নিজম জিনিষটা আসলে ব্যাপক মজাদার। আমি বাস্তব জীবনে পোস্টমডার্নিস্টদের বেশ কয়েকবার কনফ্রন্ট করেছি, তাদের ভাষ্য শুনে রাগে হাসি পায়- এই বিচিত্র অনুভুতিটা লাভের জন্যই কনফ্রন্ট করেছিলাম! মানুষ যে কি পরিমান এন্টিসোশ্যাল হতে পারে এর একটা সুন্দর নিদর্শন সম্ভবত পোস্টমডার্নিস্টেরা। ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে পৃথিবী হতে পোলিও ও স্মলপক্স নির্মুল করাটা ক্যাম্নে একটা সামহোয়াট খারাপ কাজ হয় এইটা কম্প্রিহেন্ড করতে আমি অপারগ, সতিদাহ প্রথার সর্ট অফ ডিফেন্সে বা সতিদাহ প্রথাকে যে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে এই নোশনটার সামহোয়াট বিরোধীতা ক্যাম্নে একজন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব আমি বুঝতে অপারগ। এই গুল্বি ডি গুকের সরেস খিচুরী নাকি বলে আবার একপ্রকারের 'বিজ্ঞান'ও বটে! 'সমাজতত্ব' বা সোশিয়লজিকে হাইজ্যাক করে নিয়ে তারা এটাকে 'সমাজ বিজ্ঞান' বানিয়ে জনবলে অধিগ্রহন করে নির্মান করেছে তাদের বিরিঞ্চিবাবাগিরির নিশ্ছিদ্র দুর্গ; এইটাকে তারা লাঞ্চিং প্যাড হিশেবে ব্যাবহার করে সত্যিকারের বিজ্ঞানকে আক্রমন করার তরে। তারা বসবাস করতে চায় এমন একটা পৃথিবীতে যেইখানে কোন কল্যান নেই, অগ্রগতি নেই, আশা নেই, প্রমিস নেই। কিন্তু সায়েন্স যখন পৃথিবীকে পোলিওমুক্ত করে সাধন করে প্রভুত অগ্রগতি এবং প্রমিস করে এইডসমুক্ত বিশ্ব গড়ার- তখন পোস্টমডার্নিস্টদের ডগ্মাটিক ধর্মানুভুতি হয় গুরুতররকম আহত। তারা প্রমান করতে নামে কেনো সায়েন্সও একটা সামহোয়াট খারাপ জিনিষ। তারা বলে- ওয়েল পোলিও মিলিয়ন মিলিয়ন শিশুর জীবন বাঁচালেও এইটাতো সাম্রাইজ্যবাদ হই যাচ্ছে তাইনা'? দেঁতো হাসি :D দেঁতো হাসি

হাসান এর ছবি

বিজাতীয় সংস্কৃতির চাপে "শেতলা" বা "মনসা" কে পুজো করার রীতি লোপ পাওয়া আর বিজাতীয় জ্ঞান ও গবেষনা থেকে তৈরী গুটিবসন্তের ওষুধ আর অ্যাটি-ভেনমের বিপরীতে শেতলা আর মনসা দেবীর পুজোর অসারতা প্রমানিত হওয়া- এই দুইটা যে তুলনীয় নয় এই কথা আমাদের বাংলাদেশের পোস্টমডার্নিস্ট (অনেকে আবার বেশ একটু ঘেঁটে দেবার জন্য পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্টও বলেন) জ্ঞানের ভান্ডদের মাথায় হয় এমনিতেই ঢোকে না, নাহয় আল্লা পাপ দিবে মনে করে এঁরা নিজেরাই ঢোকাতে চান না- ফলাফল: বরবাদ মার্জার কতৃক তালেবানের বুদ্ধমুর্তি ওড়ানো সমর্থন

কৌস্তুভ এর ছবি

অতি চমৎকার একটা লেখা। ফুকো-সাইদের বলদার্গুর এরকম একটা ব্যবচ্ছেদের খুবই দরকার ছিল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।