বইয়ের পাতা আর বাস্তবতার মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘোচানোর জন্য আমরা একদিন কারখানা পরিদর্শনে গেলাম।
এমন এক শান্ত, স্নিগ্ধ সকালে বাসে উঠলাম যেমন সকালে রাষ্ট্রের অসুখ ভুলে ব্যক্তিক সুখে নিমজ্জিত হওয়া যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ-শ্যামল শিক্ষাঙ্গন; নীলক্ষেতের সাদা-কালো ভারতীয় পাঠ্যবই কাফনের কাপড়ের মতো গায়ে মুড়িয়ে যেখানে বিদ্যার্থীরা আপন কবর খোঁড়ে; যে গোরস্তানেও হাসি-কান্না-প্রেম-বিরহের রঙ-বেরঙের ফুল ফোটে; সেই ডায়ালেকটিক প্রাঙ্গন ত্যাগ করে আমরা দেশের শিল্পাঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম, যেখানে গাছ মরে কারখানা গজায়। জীবনের মতো বাস কখনও ধীরে চলে, কখনও উড়ে চলে। ধূলো-খিস্তিখেউড়-সূর্যরশ্মির একটি মিশ্রণ, বাঙ্গালী নগরজীবনের টিপিক্যাল মিশ্রণ, জানালা গলে মুখে লেপটে থাকে। অবশেষে আমরা কারখানার কপাটে উপনীত হই।
কপাটের ভেতরে আছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন পরিসংখ্যানের খাতায় যেসব হিজিবিজি সংখ্যা থাকে সেগুলো। তবে আমরা মূলত যন্ত্রপাতি দেখতে এসেছি, বিকট গর্জনে যা উন্নয়নের পরিসংখ্যান প্রসব করে। স্কুল-কলেজে বাপ-মায়ের ঘুষি-লাত্থি খেয়ে কোচিং থেকে কোচিং এ দৌড়িয়েছি, অংক-বিজ্ঞান গলাধঃকরণ করে প্রকৌশল বিদ্যাপীঠে ঢুকেছি। জ্ঞানের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক তালাশের স্ট্যামিনা ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিনেই হারিয়েছি। মেশিনের গর্জনের সাথে ক্ষমতার তর্জন নয়, ব্যাংক হিসাবের অর্জনটাই ধৈর্যে সয়।
ইস্পাত কারখানা।
আর সকল কারখানার মতো মানুষের আগে মেশিনটাই চোখে পড়ে। আর চোখে পড়ে কাঁচামাল ও বর্জ্য। উৎপাদনযন্ত্রে মানুষও কাঁচামাল বৈকি, এটা একটা অফ দ্যা রেকর্ড সত্য। কারখানার এক পাশে স্ক্র্যাপ মেটালের বিশাল এক পাহাড়, যা গলিয়ে ইস্পাত বানানো হয়। কারখানার মেঝে কোকের বোতলের ছিপিতে সয়লাব। লোহার বিলেট, লাল উত্তপ্ত, লিকলিকে সাপের মতো কারখানা জুড়ে আপন প্রণালী দিয়ে ছুটে বেড়ায়। কোথাও ডাকটাইল স্ট্রেস, কোথাও কমপ্রেসিভ স্ট্রেস, কোথাও কোয়েঞ্চিং, কোথাও বা গ্যাস কাটিং। বোতলের ছিপি থেকে ইস্পাতের বিলেট তৈরী করা এক বিশাল যজ্ঞ। কবি-সাহিত্যিক যা-ই বলুক, এই বিশাল যজ্ঞ সাধনের লক্ষ্যে প্রসেস ডিজাইন ও অপটিমাইজেশনের মধ্যেও একটা অস্ফূট সৌন্দর্য আছে। নিখুঁতভাবে এই ম্যাস প্রোডাকশন প্রক্রিয়ার ব্যাপকতার সম্মুখে বাকরুদ্ধ হতে হয়। দিনপ্রতি হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টন উৎপাদনের এই যে প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়াই তো প্রসব করেছে মডারনিটি। ধর্ম-মূল্যবোধ-রাজনীতি-রুচি-অভিরুচি প্রভৃতি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উৎস আমাদের এই মডারনিটি।
সভ্যতা নির্মাণের রেসিপিটি কিন্তু বেশ সরল – তরল লোহার মাঝে সামান্য একটু কারবন মিশিয়ে ঘনীভবন। এই লোহা-কারবন সংকর দিয়ে মানুষ তার মধ্যবিত্ত স্বপ্নের বাড়ি-গাড়ি বানায়। ভূমিকম্পের দেশে পৃথিবী কেপে কেপে উঠলেও ভবনের ইস্পাত মানুষের স্বপ্ন সমুন্নত রাখে। ধাতব সংকরের উড়োযানে উড়ে বেড়ায় মেঘরাজ্যের সম্রাট। সমুদ্রের বুক চিড়ে দিগন্তে বিলীন হয় লৌহদানব। রাতের অন্ধকারে ধাতব চাপাতিতে শাণ দেয় লৌহকঠিন ইমানদার মানুষ।
ইউফোরিয়াটা কেটে যায়। যে ধাতব ভিত্তির উপর হাজার বছরের সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, সেই একই ধাতু দিয়ে নির্মিত ছুরি তারই কোমল জন্মদাত্রী মস্তিস্ককে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। ২০-৩০-৪০ বছর ধরে যে মানুষটি পৃথিবীর বুকে স্মৃতি বুনে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠেছে, পেছন থেকে কেবল একটি কোপে এতগুলো বছর, এতগুলো বিনিয়োগ মিথ্যা হয়ে যায়। ঘরের মেঝেতে হামাগুড়ি দেওয়া শিশু, স্কুলের মাঠে ছুটোছুটি করা বালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেতে আড্ডাবাজি করা যুবক, একাডেমিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করা গবেষক, অবসর সময়ে প্রিয়জনের সাথে বিমলানন্দের মুহুর্তের ফটোগ্রাফ - শাণিত ইস্পাতের একটি কোপেই একটি পূর্ণ মানব জীবনের সকল স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে যায়।
ঘরে ফিরে পাঠ্যবই খুলি, কারণ জীব্ন বয়ে চলে। ইন্ডিয়ান বইয়ের ছোট ছোট হরফ আর বড় বড় ফ্লোচার্ট, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, অ্যানাডাইনের মতো কাজ করে। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় জলছাপ দেখি – ফুটপাথে মস্তিস্কের টুকরো, হাতের আঙ্গুল, চশমার কাঁচ, রক্তের ছোপ।
দৈনন্দিন জীবনের হ্যালুসিনেশনের মাঝে একটু একটু সমাজবাস্তব ডিজোনেন্স।
মন্তব্য
কোনটা ডিজোনেন্স? মাঝে মাঝে যে জলছাপটা দেখা যায় সেটা, নাকি কোপের ঘটনাটা? কোপটা এখন সোশ্যাল হারমনির অংশ। জলছাপ দেখাটা বরং ডিজোনেন্স হতে পারে। পিংক ফ্লয়েডের গানের চিত্রায়ণের মতো মেশিনের গহ্বরে বই-খাতা-কলম-পেন্সিল-যন্ত্রপাতি-শিক্ষার্থী সব কিছু ঢেলে দিয়ে আউটপুট হিসেবে জোম্বি পাওয়াটা সিস্টেম। এই সিস্টেমের বাইরে গিয়ে চিৎকার করে ওঠাটা বিদ্রোহ বটে। প্রমিথিউসের নাড়িভুঁড়ি প্রতিদিন ঈগল এসে ছিন্নভিন্ন করেছে, স্পার্টাকাসকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে, হাইপেশিয়াকে পিটিয়ে মেরে পোড়ানো হয়েছে, ব্রুনোকে জীবন্ত পোড়ানো হয়েছে, স্তেপান রাজিন আর ইয়েমেলিয়ান ইভানোভিচের চার হাত-পা ঘোড়ার সাথে জুতে টেনে ছেঁড়া হয়েছে। সিস্টেমের বাইরে গিয়ে চিৎকার করা পাজী লোকদের এভাবে শায়েস্তা না করলে সোশ্যাল হারমনি নষ্ট হয়। শান্তিরক্ষার জন্য কারখানাতে চপার বানাতে হয়। পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়লে বইয়ের পাতায় জলছাপ দেখতে হবে।
পুরা লেখাটাই একটা হ্যালুসিনেশনের মতো লাগলো। ঘোরগ্রস্থ।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
লেখাটি কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি দিল।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
অসাধারণ লেগেছে। উত্তম জাঝা
ভালো লাগছে লেখা। কিন্তু মানে এর মধ্যেও 'আর সকল কারখানার মতো মানুষের আগে মেশিনটাই চোখে পড়ে' এই লাইনটা পড়ে না হেসে থাকতে পারলাম না
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
নতুন মন্তব্য করুন