যখন সন্ধ্যা নামে ডেট্রয়েটের তীরে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: শুক্র, ০৯/১১/২০০৭ - ৫:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নভেম্বর ৭, ২০০৭
আজ শীত আরো একটু জাঁকিয়ে বসেছে। বাতাসের বেগ কম। ম্যাপল গাছেরা সবগুলো পাতা হারিয়ে শান্ত দাঁড়িয়ে আছে। ডেট্রয়েট নদীর সজুজাভ জল ছলাৎ ছলাৎ করে আছড়ে পড়ছে আমার পাদদেশে। ঐপাড়ে আমেরিকার ডেট্রয়েট। জেনারেল মটরস এর হেডঅফিস দেখা যায় বহুদূর থেকে। নদীতে একটা দু'টা জলযান এদিক থেকে ওদিকে চলছে ধীর লয়ে। এ্যম্বাসেডর ব্রীজের নীচে দাঁড়িয়ে নদীর কথা ভাবতে থাকি-- কতকাল থেকে বয়ে চলেছে কানাডা আর আমেরিকার মাঝখান দিয়ে!

ক'দিন আগেও সূর্য ডুবত সোজাসুজি, নদীর ঐপাড়ে। এখন আরো বেশ খানিকটা বাঁয়ে হেলে অনেকটা নদীর উপরেই ডুবে যায়। সূর্যটা এখন অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সাড়ে পাঁচটা হতে হতেই বিদায়ের আয়োজন তার। দিন এখন তাই অনেক ছোট। আমি বসে আছি শীতের সন্ধ্যায় সূর্য ডোবা দেখব বলে। হ্যাট পড়া হয়নি, কানে একটু একটু ঠান্ডা লাগা শুরু হয়েছে। গ্লাভসও নামাতে হবে শীঘ্রই। ঠান্ডায় মাঝে মাঝেই গা শিরশির করে উঠছে। হাতজোড়া জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে আমি গা টানটান করি। অনেক দূরে একটা বড় জাহাজ, মনে হয় এদিকেই আসছে। ভেঁপু বেজে উঠল। সেই শব্দে নগরবাড়ি ফেরি ঘাটের কথা মনে পড়ে গেল। যমুনা সেতু তখনো হয়নি। ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে অসংখ্যবার সেপথ মাড়িয়েছি। ঘাটের হোটেলে বসে ডাল আর নদীর মাছ দিয়ে ভাত কী অসাধারণই না লাগত!

সন্ধ্যা নামছে। নদীর উপর দিয়ে কানাডা-রাজ-হাঁসের দল খইয়ের-মালা হয়ে উড়ে গেল। আর কদিন পরেই এদের দেখা মিলবেনা, চলে যাবে দূরে কোথাও, শীত থেকে বাঁচতে। সারাটা আকাশ নীলচে-ধূসর রঙে ছেয়ে গেল। সূর্য ডুবছে। শীতের সূর্য। মলিন, অবসন্ন যেন লুকিয়ে পড়লেই বেঁচে যায়। আমেরিকানরা নদীর পাড় জুড়ে সব শিল্পকারখানা বসিয়েছে। যোগাযোগের সুবিধাই সম্ভবত মূল কারণ। কারখানার চিমনী থেকে সাদা ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠে সন্ধ্যার আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। সহসাই সবগুলো বাতি জ্বলে উঠলো, কিংবা আগেই জ্বালানো ছিল এখন স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি পানির কাছাকাছি নেমে এসে সিমেন্টের সিঁড়িতে বসি। ওপাড়ের বাতিগুলি পানিতে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে, আর সেগুলো মোমের নরম আলোর মত ঢেউয়ের তালে তালে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারপর আঁধার নেমে এল। সবকিছুকে কেন যেন পদ্মাপাড়ের কোন এক বন্দরে দিবাবসানের মত মনে হল। শেষ হল একটি দিনের। আর আমি ফিরে এলাম প্রতিদিনের ব্যস্ততায়।

উৎসর্গ: আনোয়ার সাদাত শিমুল-- আমার আগের পোস্টে যাঁর কমেন্ট পড়ে এই লেখাটির জন্ম।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

প্রবাসে এই গভীরতম যন্ত্রনা । কি করে যেনো যে কোনো প্রসংগে স্মৃতিকাতরতা ভর করে,মিল থাকুক কিংবা নাই থাকুক মনে পড়ে,মনে পড়ে যায় দেশের কথা ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

কোন কিছুর দিকে মগ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকার সময় আচমকা নিজের দেশে চলে যাওয়ার যে কী যন্ত্রণা। 'পলকে পলকে দেশান্তর' আর কি! ভাল লেখা, তবে অযথা মনটা আমারো খারাপ করলেন আর কি!

??? এর ছবি

প্রকৃতিপ্রেমিক উঠে যাওয়ার পর ঐ সিমেন্টের সিঁড়িতে আমি যে বসেছিলাম। মাঝরাত পর্যন্ত!
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

সৌরভ এর ছবি

আমি পানির কাছাকাছি নেমে এসে সিমেন্টের সিঁড়িতে বসি। ওপাড়ের বাতিগুলি পানিতে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে, আর সেগুলো মোমের নরম আলোর মত ঢেউয়ের তালে তালে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তারপর আঁধার নেমে এল।

দারুণ।
বিভূতিভূষণ এর "আরণ্যক" মনে করিয়ে দিলেন।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সৌরভ কাজটা ঠিক করে নাই ।
আমি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, বিভূতিভুষণের কথা কমেন্টে লিখবো!মন খারাপ
ওহ! আরেকটা মনে পড়লো - 'মাধুকরী'র পৃথু, এরকম বানজার নদীর পাশে বসে থাকে। পাশ থেকে ঠুঠা বাইগা তাড়া দেয়, শেষে তাকেও ফিরতে হয় - আধুনিকতার সমাজে, রুষার কাছে।

প্রকৃতিপ্রেমিক: শেষের দু'লাইনে কি একটা লিখলেন? বরং প্রত্যাশা নিয়মিত এরকম পোস্ট লিখুন। সবিনয় কৃতজ্ঞতা।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনারা (যারা নিজেরাই একেকজন অতি ভাল লেখক/কবি) এত সুন্দর করে কমেন্ট করেন যে আমার লজ্জা লাগে, আবার খুবই ভাল লাগে। তারচেয়েও বড় কথা হল আরো লিখতে ইচ্ছে করে। উৎসাহ দেবার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

দিগন্ত এর ছবি

আমাদের ছবি থেকে বঞ্চিত করা চলছেনা চলবেনা ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

দিগন্ত দা, ছবির দরকার কি! পুরো লেখাটিতেই তো দারুন সব চিত্রকল্প আছে। লেখাটি খুবই ভাল লাগলো।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।