ঋণ করে ঘী খাওয়ার ইকোনোমিক্স

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: সোম, ২৫/০২/২০০৮ - ৮:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের একটা কোর্স পড়তে হয়েছিল। প্রিন্সপলস অফ ইকোনোমিক্স। আইবিএর এক প্রফেসর পড়াতেন সেই কোর্স। সম্ভবত ২০ টিরও কম লেকচার তিনি দিয়েছিলেন কারণ প্রফেসর ছিলেন অসম্ভব ফাঁকিবাজ। যাই হোক, তিনি পড়াতেন অসাধারণ। সেকারণেই ইকোনোমিক্স তেমন না বুঝলেও ইকোনোমিক্সের ব্যাপার-স্যাপার ভালই লাগতো। শিক্ষক বলেছিলেন, যারা দিন আনে দিন খায়, যেমন, রিক্সাওয়ালা; এদেরকে যদি তুমি ১০০ টাকা বেশি দাও তাহলে সে এই বাড়তি টাকা সেভ করতে পারবেনা; সে হয় সিনেমা দেখবে অথবা কোন বিলাসি দ্রব্য (রিক্সাওয়ালার সাপেক্ষে বিলাসি) কিনে টাকাটা খরচ করে ফেলবে। ব্যাপারটা তখন কেমন যেন খটকা লেগেছিল। কিন্তু বহু বছর পরে এসে যখন নিজেকে সেই রিক্সাচালকের অবস্থানে আবিস্কার করছি তখন ইকোনোমিক্সের সেই থিওরীর কথা মনে পড়ল।

কানাডায় (এবং আমেরিকায়) উচ্চশিক্ষার খরচ অভাবনীয় রকমের বেশী। কানাডিয়ানরা যারা উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী তাদের হাইস্কুল পেরোলেই চিন্তা ধরে যায় উচ্চশিক্ষার খরচ তারা যোগাবে কীভাবে। আমাদের দেশের একটা সাধারণ পরিবারের ছেলে ইউনিভার্সিটি স্তরে এসে যেখানে বেনসন বা বাঙলা ফাইভ ফুঁকে, রেস্তোরা-পার্কে আড্ডা মেরে, মোবাইল ফোন মেইনটেইন করেও অলমোস্ট বিনা খরচায় ডিগ্রী অর্জনের মসৃণ পথ অতিক্রম করে, এখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারটা ঠিক ততটাই অমসৃণ। কিন্তু টাকার অভাবে পড়াশুনা হবেনা এমনটি অন্টারিওর প্রাদেশিক সরকার মানতে রাজী নয়। তাই ইউনিভার্সিটি বা সেই লেভেলের কলেজে পড়াশুনার জন্য আছে শিক্ষাঋণ। এরা বলে ওসাপ (OSAP- Ontario Student Assistance Program)

কানাডিয়ান বা ল্যান্ডেড ইমিগ্রান্ট হলে নানাবিধ সুবিধা পাওয়া যায় যা ভিসা স্টুডেন্টদের থাকে না। দেশি ছাত্ররা (আমার সাথে শুধু গ্রাজুয়েট লেভেলের ছাত্রদেরই পরিচয় আছে, তাই অন্যদের কী অবস্থা তা জানিনা) ইমিগ্রান্ট হওয়ার পর প্রথমেই যে কাজটি করে তা হল ওসাপের জন্য আবেদন করা। আমি অনেকের কাছে এ সম্পর্কে ভাল মন্দ শুনে এতদিন আবেদন করা থেকে বিরত ছিলাম। কিন্তু ইদানিং দেখছি ইউনিভার্সিটি থেকে নানাধরনের স্কলারশীপ ও নীড-বেজড এ্যাসিস্ট্যান্স ফান্ডগুলোতে আমি আবেদন করতে পারছিনা। কারণ কিছুই না, আমি ওসাপ নেইনা। টিচিং এ্যাসিস্ট্যান্স থেকে যা পেতাম তা দিয়েই জোড়াতালির সংসার চলছিল। কিন্তু এভাবে আর কত? তাছাড়া ওসাপ না নেয়ায় অন্য সুবিধাগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিলাম।

ওসাপের বিষয়টা হলো সরকার শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য ঋণ দেবে। পড়াশুনা শেষ করার ছয় মাসের মধ্যেই আপনাকে চাকুরী যোগাড় করে সেই ঋণ সুদে-আসলে শোধ দিতে হবে। আর ঋণ শোধের বিষয়টা বেশ কড়াকড়ির সাথেই পরিচালিত হয়। তবে ঋণের কয়েকটা ভাল দিকের মধ্যে একটি হল সময়ের সাথেসাথে সরকার ঋণের কিছু অংশ মাফ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় চার বছরে যদি ৫০ হাজার ডলার ঋণ নেয়া হয়ে থাকে, ফেরত দেওয়ার সময় হয়তো তা ৪০ হাজারে নেমে আসে। যেটুকু মাফ পাওয়া যায় সেটুকুই লাভ।

শীতকালীন সেমিস্টারের ঋণের ঘী আমার ঘরে পৌঁছেছে। সেই ডলার ইতোমধ্যেই যথাস্থানে বরাদ্দও হয়ে গেছে। আমাজন থেকে গোটা বিশেক বই, বাসায় নতুন লেজার প্রিন্টার, পড়ার জন্য ভাল একটা টেবিল। সাহস করে লেনোভো'র হাইপ্রোফাইল থিংকপ্যাডের অর্ডারও দিয়ে ফেলেছি। আসছে ২৭ ফাল্গুনের আগে ওটা ডেলিভারি আসলেই পুরানো ডেল -টাকে ডিকমিশন করে ফেলব। ঋণ করে ঘী খাওয়ার ইকোনোমিক্স এবার ভালই বুঝতে পারছি।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

অভিনন্দন আপনাকে !

অবশেষে আপনি ও ক্ষুদ্রসুচিকার মাজেজা বুঝতে পেরেছেন। অচিরেই আপনাকে আরেকজন নোবেলজয়ী ডাক্তার সাব হিসাবে দেখব বলে আশা প্রকাশ করছি। হাসি


কি মাঝি? ডরাইলা?

এস্কিমো এর ছবি

হু, খরচ না করলে অর্থনীতি অচল হয়ে যাবে যে। সেপ্টেম্বর ১১ এর পর একদিনে আমেরিকান সরকার মানুষকে ভয় দেখাচ্ছিলো - অন্যদিকে বলছিলো - বাইরে যাও, খরচ করো।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- টেনশন নিয়েন না বস, আমার মতে ঘি খেলে ঋণ করেই খাওয়া উচিৎ। নিজের টাকায় খাওয়া ঘিতে স্বাদ আর চর্বি উভয়েরই উপস্থিতি লঘু আর এইটা বাঙালী'র সাথে যায় না।

ঋণম ঘৃতম খাতম ক্লাবে পদার্পনে পরম এবং চরম অভিনন্দন হাসি
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আমি প্রথম যখন দেশের বাইরের বন্ধুবান্ধবদের খবর জানতে থাকলাম তখন অবাক হয়ে জানলাম তাদের প্রায় সবাইই নাকি বাড়ি কিনে ফেলেছে । এদিকে বাংলাদেশে মাস পেরুলে আমাদের তো বাড়ি ভাড়া দেয়ার টাকাই হয় না ।

তারপর একবার গিয়ে দেখে এলাম তরিকাটা । সবাই মর্টগেজ মর্টগেজ বলে চিল্লাচ্ছে ।

ব্যস , শিখে ফেললাম রহস্য ।
দেশে ফিরে একসপ্তাহের মাঝেই গাড়ি কিনে ফেললাম একটা । চারবছর ধরে সেটার ঘানি টেনে যাচ্ছি ...।

এখন ধান্দায় আছি ব্যাংকের টাকায় বাড়ি করে ফেলব । দেখা যাক , কই যায় , দুই দিনের দুনিয়া ।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আপনি ঠিকই বলেছেন। বিদেশে অধিকাংশ মানুষই সেই ক্ষুদ্রঋণের বাঁধনে জড়ানো, যা নিয়ে আমার দেশের মানুষ নোবেল প্রাইজ পেল। এরা কীভাবে ঋণের ভারে জর্জরিত তা এস্কিমো ভাইয়ের সামহয়্যারের একটা পোস্টে পড়েছিলাম। এই মুহুর্তে লিংক দিতে পারছিনা, তবে লাগলে বলবেন, খুঁজে বের করব।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বস্ কি নিজেই গাড়ি চালান নাকি তার জন্য গাড়োয়ান ভাড়া করতে হয়েছে?

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

ঘিয়ের গন্ধ ভুলেছি সেই কবে, স্ট্যানচার্ট ভোলে নাই। প্রতিমাসের শুরুতেই শুরু তাগাদা মন খারাপ


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

গৌতম এর ছবি

আমাদের দেশে যেভাবে শিক্ষাখরচ বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে শিক্ষার্থীদের এভাবেই শিক্ষাঋণ যোগাড় করে পড়ালেখা করতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু বেসরকারি ব্যাংক নাকি শিক্ষাঋণ দেওয়া শুরুও করে দিয়েছে। যদিও মৌলিক অধিকার হিসেবে শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেদেশের সরকার কেন এই মৌলিক অধিকারটি পালন করছে না, সে ব্যাপারে কিছু জানালে উপকৃত হবো।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কিন্তু জনাব, এর বিপরীতে নতুন প্রশ্ন এসে যাবে। শিক্ষা মৌলিক অধিকার; কিন্তু সেই শিক্ষা কোন শিক্ষা? সাধারণ শিক্ষা কিন্তু রাষ্ট্রই যুগিয়ে যাচ্ছে। অনেকের মতেই উচ্চশিক্ষা কোন মৌলিক অধিকার নয়। সে যাই হোক। আপনার মন্তব্যের মূলসূরের সাথে একমত।

রায়হান আবীর এর ছবি

তাই তো। আজকে যদি ঘি খাওয়া যায় তাহলে কালকে কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তায়া লাভ কি?

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ঠিক

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

আইবিএ'র টিচারের নামটা কি ছিল?
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বস আপনি এই প্রশ্ন সরাসরি করলেন? আমার প্রিয় শিক্ষকদের একজন উনি। এই একযুগ পরেও ওনার ক্লাসে ব্যবহৃত টার্মগুলো মাথার মধ্যে বিঁধে আছে।
শিক্ষক হিসেবে খুব স্বার্থক তা বলতেই হবে।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

আহা! মফিজ! বিবিএ-তে আমাদের ম্যাক্রো ক্লাস নিতো। তবে তার কিছু বুঝতাম না তখন। বহুকাল আগের কথা। গত বছর তারে একদিন হঠাত দেখলাম লন্ডনের ব্রিক লেনে এক রেস্তোরায়। একটু অবাক লাগছিলো। কিন্তু আগায় গিয়া আর কথা বলি নাই।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আ, তাই নাকি? দেশে আছেন নাকি উনিও দেশান্তরী? আমাদের যখন পড়ান তখন সম্ভবত ১৯৭৫ মডেলের দুই-দরজার লাল একটা টয়োটা গাড়িতে আসতেন। উনি কিভাবে ড্রাইভারের সীটটাকে বাঁকা করে পেছনে গিয়ে বসতেন তা দেখে বেশ মজা পেতাম।
...............................
আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ঠি............................ক
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

হিমু এর ছবি

ধার করেছিলাম ঘি খাওয়ার মতলবে, কিন্তু পরে দেখলাম ঘি-টা আসলে ধার দেনেওয়ালাই খাচ্ছে দুই বছর ধরে!


হাঁটুপানির জলদস্যু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।