কানাডিয়ান ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস (CFS) আয়োজিত দুই দিনের এক সিম্পোজিয়ামে গিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো'র মিসিসাগা ক্যাম্পাসে। সিম্পোজিয়ামে গিয়ে দেখে এলাম একটি ছাত্র সংগঠন কিভাবে আগামীর লিডার তৈরী করে। যাহোক, সেটা নিয়ে পরে পোস্ট দেয়ার আশা রাখি। তবে সিম্পোজিয়ামের সেশনের পাশাপাশি চলেছে আমার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। সেখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে দুই পর্বের ছবিভিত্তিক ব্লগের প্রথম পর্ব এটি। লেখাটা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছোট করতে পারলাম না বলে দু:খিত। বর্ণনার সাথে নীচে ছবি দিয়ে দিলাম। শুধু ছবি দেখে ভালো লাগলেও কষ্টটা স্বার্থক হবে।
গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট সোসাইটির আমরা তিন কাউন্সিল-সদস্য পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক গাড়ি ভাড়া করে শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় টরন্টোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মিশরীয় আহমেদ গাড়ি চালাবে। আমি আর সাজ্জাদ ভাই সময়মত এসেক্স বিল্ডিং এর সামেন হাজির হলাম। যাত্রা শুরু হলো।
ছবি ২: হাইওয়ে ৪০১। আসলে এগুলো ফ্রিওয়ে।
ঠিক ঠিক চার ঘন্টা পরে ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর মিসিসাগা ক্যাম্পাসে পৌঁছুলাম। তখন সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু আলো আঁধারিটা কাটেনি। ইউনিভার্সিটির চারপাশ দিয়ে রিং রোড, তার মাঝখানে বিশাল এলাকাজুড়ে ক্যাম্পাস। রাস্তার দুপাশে ঘন ঝোপ আর তার পেছনে লম্বা লম্বা গাছের সারি। আহমেদ আস্তে আস্তে চালাচ্ছে গাড়ি। আমাদের ঠিক সামনেই ক্যাম্পাস পুলিশের প্যাট্রল এসইউভি। হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই পুলিশের গাড়িটা আস্তে আস্তে থেমে গেল। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি পুলিশের গাড়ির সামনে দিয়ে একটা হরিণ পার হচ্ছে। সাদা লেজ দেখেই চিনতে দেরি হলোনা, সাদা-লেজ হরিণ (White tailed deer)। হরিণ দেখে আমার হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠল। ঠিক করলাম কাল খুব ভোরে ক্যাম্পাস দেখতে বের হবো। সকালের নাশতা দেবে সাড়ে আটটায়, এর আগেই যা দেখার দেখে ফেলতে হবে। এরকম জায়গায় এসে হরিণ দেখার আশা কখনোই করিনি। কিন্তু তখনো কি জানতাম টরন্টোর মত শহরে একটা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে হরিণ এত সহজলভ্য হবে আর তার পিছনেই কেটে যাবে শ্বাসরুদ্ধকর একটা সকাল।
সাউথ ভবনে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে রুমের চাবি নিয়ে নিলাম। তখন রাত ১০টা। দেরিতে পৌঁছায় ডিনার পাওয়া গেলনা। ক্ষুদায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কী করা যায় সেটা ভাবতেই একজনের সাথে দেখা হলো। সে বলল স্টুডেন্ট সেন্টারে Wet and dry সোস্যাল হচ্ছে, সেখানে স্ন্যাক্স পাওয়া যেতে পারে। Wet সোস্যাল মানে হলো মদের আড্ডা, আর dry মানে হলো মদহীন আড্ডা। মদহীন আড্ডায় গিয়ে চিপস, শশা, গাজর যা আছে সেগুলো দিয়ে আগে পেট ভরালাম। তারপর ভাবলাম wet social দেখে আসি। সেখানে ঢোকার পথেই সিকিউরিটি আমাদের বয়স প্রমাণের আইডি দেখতে চাইল। আহমেদ আইডি দেখালে ওর হাতে লাল ব্যান্ড পরিয়ে দিল। লাল ব্যান্ড মানে হলো সে চাইলে মদ নিতে পারবে, ফ্রি। আমি আইডি দেখালাম না, বললাম, আমি ড্রিংক করিনা। সেটা শুনে আমাকে হলুদ ব্যান্ড পরিয়ে দিল। হলুদ ব্যান্ড মানে হলো মদ ছুঁয়েও দেখা যাবেনা। সেখান থেকে দ্রুতই বেরিয়ে এলাম, কারণ আমি সেখানে অচল। এরপর দ্রুত রুমে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে শোয়ার আয়োজন করি। শোয়ার আগে জানালার স্ক্রীন সরাতেই পেছনের বিল্ডিংএর অপরূপ রূপ চোখে পড়লো। সেটাকে ক্যামেরায় ধারণ করলাম।
ছবি ৪: অসকার পিটারসন হল থেকে রয় আইভর হল রাতের বেলায় যেমন দেখায়। ৩০-সেকেন্ড এক্সপোজার দিয়ে রাত ১২টায় তোলা হয়েছে (আইএসও ১০০)। ছবিটি আমার খুব প্রিয়।
পরদিন ভোরে ৪টয় ঘুম ভাঙলেও উঠতে ইচ্ছে করছিলনা। তাই একটু দেরি করে উঠলাম। সকালের ঘুমটা সবচেয়ে আরামের ঘুম। মোড়ামুড়ি করতে করতে দেরী করেই উঠলাম। দেখি ৭টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বের হলাম।
ছবি ৫: শনিবার সকালে অসকার পিটারসন হল। এই বিল্ডিংএর ৩য় তলায় আমি ছিলাম।
ছবি ৬: ডেমস্ রকেট ফুল (Dame's Rocket)
ছবি ৮: সাউথ বিল্ডিং এর সামনে ফুল। এরা বলে অক্স-আই ডেইজি। (Ox-Eye Daisy)
ছবি ৯: সাউথ বিল্ডিং এর সামনে, যে সাইনটাকে আমি সবচেয়ে ভয় পাই।
ছবি ১০: You can see this only in Canada! সাউথ ভবনের বাইরের দেয়ালে।
ছবি ১১: শনিবার, সাউথ ভবনের ভিতরে, একেবারে খালি ফুডকোর্ট।
দুপুরের খাবারের পরে আবার সেশন শুরু হলো। এবারের সেশনে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দিয়ে একটা এ্যাসাইনমেন্ট ধরিয়ে দিল। কী এ্যাসাইনমেন্ট সেটাতে যাচ্ছি না। আমরা বাইরে এসে একসাথে বসলাম আলোচনা করার জন্য। আলোচনা শেষে একজনকে দায়িত্ব নিতে হবে সবার সামনে সেটা উপস্থাপন করার।
ছবি ১৩: আলোচনা চলছে, তা লিপিব্দ্ধ হচ্ছে।
ছবি ১৪: সবাই খুব সিরিয়াস, কেবল আমি ছাড়া। শূন্যস্থানটা আমার।
উপরের ছবিটা তুলে জায়গায় ফিরতেই সামনে যে ঝোপ দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা হরিণের বাচ্চা। আমার তো শ্বাস বন্ধ হওয়ার অবস্থা। দ্রুত গতিতে ক্যামেরা তাক করতেই ওটা ততোধিক দ্রুতগতিতে আড়ালে হারিয়ে গেল। জীবনের প্রথম ওয়াইল্ড লাইফ ছবি তোলার উত্তেজনায় গ্রুপের কথা ভুলে গেলাম। উঠে ছুটলাম হরিণের পিছনে। হরিণ খুবই সংবেদনশীল প্রাণি, সামান্য শব্দেও ওরা দৌড়ে পালায়। কিন্তু এখানকার হরিণের সংবেদনশীলতা বেশ কম। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়েই দেখি বাচ্চা সহ ঘাস খাচ্ছে। এত সুন্দর দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি। কিন্তু সামনে ঝোপঝাড় থাকার কারণে ফোকাস করতে অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ ক্যামেরা ছিল অটোফোকাস মোডে। (ঝোপের মধ্যে লুকানো ওয়াইল্ড লাইফের ছবি তুলতে জীবনেও কেউ এই ভুল করবেন না)। উত্তেজনায় আমার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেল। ভুলেই গেলাম ফোকাস মোড ম্যানুয়ালে নিতে। যাহোক, হরিণটা এবার আমাকে দেখে ফেলল। চট চট করে কয়েকটা ছবি তুলে নিতেই দৌড়ে পালিয়ে গেল। বাচ্চা হরিণটা মায়ের পিছু পিছু দৌড়। পুরা ব্যাপারটা ঘটে গেল এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে।
ছবি ১৫: সাদা-লেজ হরিণ ৫০-৬০ মিটার দূরত্বে। বাচ্চাটা ওর পেছনেই আছে, নীচু হওয়ার কারণে দেখা যাচ্ছেনা।
ছবি ১৬: সাদা-লেজ হরিণ রাডারের মত কান তাক করে আছে আমার দিকে।
উল্লেখ্য যে, সাদা-লেজ হরিণের গায়ের রং বাদামী। এদের লেজের ডগায় সাদা রং থাকে বলে এমন নামে ডাকা হয়। গায়ে কোন তিল বা স্পট নেই। কিন্তু বাচ্চা হরিণের গায়ে স্পট থাকে। নিচের ছবিতে তাদের পালিয়ে যাওয়াটা ধরতে পেরেছি। কিন্তু কপাল খারাপ; বাচ্চাটার মাথার জায়গা একটা শুকনা ফুলের আড়ালে পড়ায় দেখা যাচ্ছেনা। তবে ভালো করে লক্ষ্য করলে বাচ্চা হরিণের গায়ের স্পট দেখা যায়।
ছবি ১৭: বাচ্চা সহ মা হরিণের পালিয়ে যাওয়া।
আজকে এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে থাকবে বরিবারের সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত কিভাবে কাটলো হরিণ আর ড়্যাকুনের পিছনে ছুটে তার সচিত্র বর্ণনা।
(শেষপর্ব)
মন্তব্য
বস মনে কষ্ট পাইলাম আপনার নিজেকে এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য, ছবি দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম, হাইওয়ে ৪০১ এর ছবি গুলায় আকাশের নীল দেখে আমি পাগল। ৬নং আর ৮নং কি অটো ফোকাসে তোলা? তাহলে আপনার ক্যামেরার সেন্সরটা অসাধারণ, আর যদি ম্যানুয়ালি ফোকাস করে থাকেন ট্রাইপড ছাড়া, তাহলে এই মূহুর্তে আপনাকে গুরু মেনে নিলাম। হরিণের চবি দেখে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। আর ৪নং ছবিটা আমার ডেস্কটপে দিতে মন্চায়, অনুমতি ছাড়া দিলাম না। সবগুলো ছবি অসাধারণ হয়েছে।
পরের পর্বের জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করব।
প্রিয় সাইফ,
বুঝতেই পারছেন, এধরনের একটা পোস্ট তৈরী করতে কমপক্ষে ৩ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। ছবি প্রসেস করা, সেগুলোকে পোস্টের সাথে জায়গামতো বসানো, হাইলাইট করা। তাই ওভাবে বলেছি।
৬ আর ৮ কিন্তু অটোফোকাস, ট্রাইপড ছাড়া। তবে কাছের ছবি ম্যানুয়ালি ফোকাস করাটা আমার কাছে তেমন কঠিন কাজ মনে হয়না। বরং মাঝ দুরত্বের ছবি ম্যানুয়ালি ফোকাস করা কঠিন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমার ক্যামেরায় হাতে খড়ি কিন্তু সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল ক্যামেরায়, ১৬ বছর আগে। গুরু না মানাই ভালো, তাহলে সমালোচনা করার সুযোগ কমে যায়।
৪ নম্বর ছবিটা ১০০ আইএসও দিয়ে তোলা, বড় করলে খারাপ লাগবেনা। ট্রাইপড ছিলনা, ব্যাগ আর তোয়ালে দিয়ে টেম্পোরারি একটা বানিয়ে নিয়েছিলাম। নিয়ে নেন। সমস্যা নাই। ভালো লেগেছে জেনেই খুশি লাগছে।
পরের পর্বে সকালের অন্ধকারে ড়্যাকুনের পেছনে অনুসরণের ব্যাপারটা কিছুটা দুর্ধর্ষ বটে, কিন্তু বর্ণনায় সেটা তুলে আনার মতো লেখক আমি নই। প্রকৃতি মনে হয় মাঝে মাঝে একটু উদার হয়, যে কারণে হরিণের পেছনে প্রায় এক ঘন্টা ব্যয় করতে পেরেছিলাম।
বস, আপনে যেমন গুনি, তেমনই রসিক
আপনার ছবি তোলা দেখলে হিংসা লাগে। কবে যে এমন ছবি তোলা শিখব!
ফটুক সহ বর্ণনা ভাল্লাগছে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি। পাঁচ তারা হাকিয়ে গেলাম শুধু।
ফাটাফাটি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
এইসব ছবি দেখলে হিংসায় ছবি তোলা ছাইড়া দিতে ইচ্ছা করে
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...
বেশি জোস! খুবই দুর্দান্ত লাগল। লেখা ও ছবি।
বিশেষ করে ২,৪,৬,৮ তো মারাত্মক সুন্দর লাগল।
পেট ভরে হিংসা করলাম
হিংসার কিছু নাই, এগুলা তেমন আহামরি কিছু নয়
একেবারে মোহিত।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
দূর্দান্ত!!!
চা খেতে গেলেন?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
লেখা রেডি আছে, সময়মতো পোস্ট দিবো। প্রথম পাতায় দুটা লেখা কখনোই দিতে ইচ্ছুক না।
হরিণের বাচ্চার ছবি অপূর্ব। লাঞ্চ ঠিকাছে ঃ কিন্তু সাত নম্বর এর জবাব নেই
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
৪ নংটা ডেস্কটপ বানাইতে মঞ্চায় ... ...
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
মিয়া ভাই, ফ্লিকার থেকে নিয়ে নেন।
আপনাকে দেখে কি তাহলে ১৮ বছরেরও কম মনে হয় নাকি পিপিদা ? ব্যাপারটা কিন্তু পড়ে মজা পেলাম। ডেম'স রকেট ফুলটা ভাল লাগছে খুব। আর আপনার থাকার জায়গাটাও বেশ ছিল। অন্য ছবিগুলোও ভাল তুলেছেন।
--------------------------------------------
--------------------------------------------------------
ফেসবুকের কথা বলছেন?
নতুন মন্তব্য করুন