দেশ যখন পুড়ছে এবং সরকারবাহাদুর ভোটবিহীন নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতার গদিতে বসার ব্যবস্থা করছে, প্রকৃতিপ্রেমিক তখন বনে বাদাড়ে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। পত্রিকা পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠেছি, টক শো শুনতে শুনতে দেখছি সবাই একই কথা ঘুরে ফিরে বলছে এবং অদূর ভবিষ্যতে শান্তির কোন চিহ্নও দেখা যাচ্ছেনা, সেইসাথে সেমিস্টারের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে একটুখানি বেরিয়েছিলাম। গিয়ে বুঝলাম শরীরের সাথে সাথে ছবি তোলার হাতেও ভালভাবে মরিচা পড়েছে।
আমরিকার পূর্ব প্রান্তের মানুষ এই মুহূর্তে বরফের নীচে চাপা পড়ে আছে। আর কালারফুল কলোরাডোর মানুষ মাথার উপর গনগনে সূর্য রেখে শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু খোঁচা দিয়ে লিখতে ভালই লাগছে কেননা এরকম বরফের তলায় কাটিয়ে এসেছি নয় নয়টি বছর। তবে এখানেও তাপমাত্রা কমে শুন্যের নিচের নেমে যায়। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে শুন্যের নিচে ১৫ ডিগ্রীতে গিয়ে ঠেকেছিল। এ সপ্তাহের পুরোটাই ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লোকে বলে কলোরাডোর আবহাওয়া যদি তোমার খারাপ লাগে তো আধা ঘন্টা অপেক্ষা কর। যার মানে হলো আধা ঘন্টার মধ্যেই রোদ উঠে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
মধ্যাহ্নের আগেই হঠাৎ ঘুরে আসতে মন চাইল। তারচেয়েও বড় ব্যাপার হলো কিছু একটা লেখার তাগিদ। এর আগে কখনো লিখতে ইচ্ছে করেছে বলে মনে পড়ছে না। লেখার জন্য চাই উপকরণ আর আমার একমাত্র উপকরণ হলো ক্যামেরাবাজির ফাঁকিবাজি। সেজন্যই আজ রকি মাউন্টেন আর্সেনাল বণ্যপ্রাণির অভয়ারণ্যে (Rocky Mountain Arsenal Wildlife Refuge) খানিকটা সময় কাটানো হলো।
২। অভয়্যারণ্যে দাঁড়িয়ে তোলা রকি মাউন্টেনের ছবি
সময়টা ডিসেম্বরের ১৮, ২০১৩। শীতের প্রকোপ না থাকলেও এখন শীতকাল। প্রকৃতি তাই খানিকটা ন্যাড়া। গাছে পাতা নেই, মাঠের ঘাস তার সবুজ রঙ হারিয়েছে মাস দুয়েক আগেই। কলোরাডোর প্রেইরি ততটা রুক্ষ না হলেও কমনীয়তার ঘাটতি আছে। জালের মতো গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যায় রকি মাউন্টেটের চূড়ায় জমে থাকা বরফ। যেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি সেখান থেকে মাউন্টেন মাইল পঞ্চাশেক দূরে। অথচ মনে হয় কত কাছে।
এই অভয়ারণ্যে ঢুকলে প্রথমেই পড়ে বাইসনের আবাসস্থল। প্রবেশদ্বারে সতর্কবাণী দেয়া আছে--বাইসন বুনো প্রাণি এবং আনপ্রেডিক্টেবল অর্থাৎ এরা বড় আকারের গরু হলেও কখন তেড়ে আসবে তা আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই দূর থেকেই ছবি তুলতে হবে এবং গাড়ি থেকে নামা বারণ। নিরাপত্তার জন্য অনেক জায়গায় রয়েছে তারের উঁচু বেড়া। বেড়ার কাছে না যাওয়ার জন্য দেয়া আছে নির্দেশনা। গাড়িতে বসে ঘুরতে একেবারে খারাপ লাগে না। তবে অনেক্ষণ ঘুরেও যখন কোন বন্যপ্রাণির দেখা মিলল না ঠিক তখনই একটা বাইসনের পরিবারের দেখা পাওয়া গেল। ক্যামেরা রেডি করা ছিলনা। রেডি করার ফাঁকে বেচারারা ঢিবি ডিঙিয়ে ওপারে অদৃশ্য হওয়ার আগে একটা মাত্র ছবি তোলা গেল।
বাইসন বিশালাকার ষাঁড়। মহিষের দেড়/দুই গুন হবে হয়তো। মাথাটা শরীরের তুলনায় বড় এবং ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দিয়ে ঢাকা। ধারণা করি এর একটা গুঁতোই আমার গাড়ি রাস্তা থেকে ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে আশার কথা হলো এরা রাস্তার কাছাকাছি যাতে আসতে না পারে সেজন্য তারের বেড়া দেয়া আছে।
৪। ফ্রোজেন লেক।
তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও কয়েকদিন আগের ঠান্ডায় পানি জমে বরফ হয়ে আছে। আসছে সপ্তাহে আবার শীত পড়বে বলে শোনা যাচ্ছে।
রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে প্রেইরির ভিতরে যাওয়ার ট্রেইল আছে। গাড়ির ভিতর গরম লাগলেও নামার পরে ঠান্ডা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পাওয়া যায়। এটা লম্বা-ঘাসের প্রেইরি (Tall grass prairie). কিন্তু ঘাস প্রায় মরে গেছে, বুনো ঝোপঝাপড়াও মলিন। তারই ফাঁক দিয়ে দূরে রকি মাউন্টেন দেখা যাচ্ছে। ভরদুপুর ছবি তোলার জন্য ভালো সময় না হলেও একেবারে খারাপ আসেনি। খুব সকালে আর সন্ধ্যা নামার আগে আগে চমৎকার ছবি উঠবে তা আন্দাজ করতে পারছি।
৮। কানাডা গুজ
কানাডা রাজহাঁসের দেখা মিলবে সবখানেই। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। অনেক দূরে থেকে তোলা ছবিতে একপাল হাঁস লেকের উপর ওড়াউড়ি করছে। দূরে রকি মাউন্টেন দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটি আন্দাজ আধা কিলোমিটার দূর থেকে তোলা।
৯। প্রেইরি কুকুর
অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা। তার দুপাশে আফ্রিকার সাভানার মতো। এর মাঝে জায়গায় জায়গায় গর্ত খুঁড়ে বাসা করে আছে প্রেইরি কুকুর। দেখতে গিনিপিগের চেয়ে একটু বড় কিন্তু কুকুরের মতো লেজ আছে। মুখটা গিনিপিগের মতই। থাকে প্রেইরিতে। এজন্যই বোধহয় নাম হয়েছে প্রেইরি ডগ। মানুষ দেখলেই দুপায়ের উপর ভর দিয়ে দাড়িয়ে যায়। মানুষকে তেমন ভয় পায়না এরা। আমার সামনে দিয়েই দুইটা কুকুর রাস্তা পার হয়ে গেল। আমি ব্রেকে চাপ দিয়ে থেমে ক্যামেরা হাতে নিতে নিতেই রাস্তার ওপারে। গাড়ির ভিতর থেকে ছবি তুলে আরাম নাই।
ফেরার পথে কায়োটি (Coyote) যাকে বলে আমেরিকান শিয়াল--তার দেখা মিলেছিল। ছবিও তুলেছিলাম কিন্তু ক্যামেরায় ছিলো ওয়াইড লেন্স। পরে ছবি প্রসেস করার সময় পন্ডিত মশাইকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিলনা। বনে ঘুরতে আসলে দুইটা ক্যামেরা থাকা দরকার--একটাতে ওয়াইড লেন্স, আরেকটাতে টেলিফটো। একটা ক্যামেরা থাকলে এরকম অভয়ারণ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে ক্যাননের ৭০-২০০মিমি জুম।
মন্তব্য
পিপি-দাদা, আপ্নার প্রথম প্যারাগ্রাফের সাথে নাই। বাকি সবটার সাথে আছি - লেখা, ছবি দুই-ই অতি উত্তম পাইয়াছি।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ এক লহমা।
চমৎকার সব ছবি। ফ্রজেন লেক আর শালিক ভালু পাইছি।
লেখা ছবি সবই ভালো লেগেছে। ভালো থাকবেন।
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
প্রেইরি কুকুরের মত গর্তে-টর্তে ঢুকে যেতে মন চায় মাঝে মাঝে।
আর, আধঘন্টা অপেক্ষার কথা যেটা বললেন, সেটা পড়ে মনে হল: আর কতগুলো আধঘন্টা অপেক্ষা করলে সবকিছু ঠিক হবে?
ছবি আর লেখা দেখে মনে হল প্রকৃতিপ্রেমিক তার প্রেমের মর্যাদাটা রেখেছে ঠিক ঠিক।
শুভেচ্ছা
এই ছবিটি দেয়ার সময় ঠিক এমনটাই ভাবছিলাম। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলে একটু শান্তির খবর খুঁজি ঠিক প্রেইরি কুকুরটি যেভাবে সূর্যের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে সেভাবে।
ওস্তাদ আপনি কলোরাডো গেলেন কবে? জানি না তো? রকি মাউন্টেন শুনলেই তো গায়ে রোমাঞ্চ জাগে। মন্ট্রিয়লে থাকতে তো আপনার দাওয়াত রাখতে পারি নাই। এখন আমি নিউইয়র্কবাসী। আইসা পড়ুম নাকি আপনার ওখানে? দাওয়াত অব্যাহত আছে?
ছবি আর লেখা দুটোই ভালো লাগল। তবে ছবি আরেকটু বেশি আশা করেছিলাম। মরিচা ধরা হাতের ছবিই নাহয় হোক। আপনি কি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গেছেন? আমার সামনের সামারে যাওয়ার ইচ্ছে আছে!
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'
মৃদুল ভাই, আমি মুভ করেছি এই কয়মাস হল। কলোরাডো দারুণ জায়গা রে ভাই। ঘুরতে কিংবা থাকার জন্য চমৎকার। দাওয়াত বহাল আছে (সরকারী দল), আপনি এনিটাইম চলে আসেন
আপনি এখন ইয়াংকি সেটা জানি। গ্রান্ড ক্যানিয়নে যাওয়ার ইচ্ছে সামারে। আসেন একসাথে যাই মজা হবে। সেই সাথে আরো কেউ যদি যুক্ত হতে চায় সেটাও খারাপ না।
আগের দাওয়াত আবারো দিচ্ছি; পাছে দ্বিতীয়বার ডাকলো না বলে বিরোধি দলের মতো গোস্বা করে থাকেন
ভালই করেছেন, ভাইয়া। আমরাও হাঁপিয়ে উঠেছি। আপনার এই ছবি-ব্লগ সত্যি কিছুটা রিলিফ দিল।
আমার কিন্তু ন্যাড়া প্রেইরিকেই যথেষ্ট কমনীয় মনে হয়েছে! জালের মত গাছগুলিও মোহনীয় হয়ে ধরা দিয়েছে আপনার মরচে পড়া হাতের ছবিতে!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য
আপনাকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, দেখেছেন কিনা জানি না
http://www.sachalayatan.com/tareqanu/49565
facebook
কী লজ্জার কথা, দেখ দেখি। এই মাত্র দেখলাম। অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ তারেক অণু! অনেক ভাল লাগছে
৬ নম্বর ছবিটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বড় হয়া আমি আম্রিকা যামু
আসেন, তবে ইহা কিন্তু স্বপ্নের দেশ নয়। তবে যারা খাটতে পারে তারা অনেক উপরে উঠতে পারে।
বোধ হয়, এজন্যই বলা হয়, "ছবির মতো সুন্দর"।
ধন্যবাদ শিমুল।
কী সুন্দর ছবি!!
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন