এক মেয়েলি কন্ঠস্বর আকাশের সর্বনাশ ডেকেছিল। প্রতি রাতে ফোন করত মেয়েটি। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেত; সারারাতভর-। কত কথাই না বলত তারা-
আমাদের কলেজ হোস্টেলের নিয়মকানুন তো খুব কড়া ছিল। একবার হল কি; মাঝরাতে আমরা পাঁচজন বারান্দায় হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলাম। এমন সে চিৎকার -সুপার স্যার কাঁচা ঘুম ভেঙে ছুট্ । এসে হতবাক; কোথাও কেউ নেই। বারান্দায় নেই, রুমে নেই, এমনকি ছাদেও নেই। এত অল্প সময়ে পালিয়ে যাওয়া; অসম্ভব! বলতো- আমরা কোথায় ছিলাম?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
টয়লেটে! এক টয়লেটে পাঁচজন। ভাবতে পার!
রিনরিনে গলায় ঝংকার তুলে হেসে উঠত মেয়েটি। কি হাসিটাই না হাসত সে! সে হাসির স্রোত বয়ে যেত আকাশের শিরায় শিরায়। অদ্ভুত এক ভাললাগা! হাসি থামলে পরে আকাশ বলত-
বৃষ্টি, তুমি মেঘ হবে?
কেন!
দেখনা; বৃষ্টি সবসময় আকাশকে ছেড়ে চলে যেতে চায়। কি স্বার্থপর দেখেছ! আকাশের উষ্ণতায় তার জন্ম, আকাশের নির্ভরতায় তার বড় হওয়া; আর, যখন সে পরিপূর্ণ- না বৃষ্টি! আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তুমি মেঘ হও। আকাশের বুকে ভেসে-ভেসে থাক । আকাশ সারাজীবন তোমার স্পর্শ নিয়ে বেঁচে থাকবে।
আমার কিইবা করার আছে বল? আমি যে বৃষ্টি-
না বৃষ্টি ! তুমি, প্লীজ- মেঘ হয়ে যাও।
ভয় নেই আকাশ; বৃষ্টিরা ফিরে ফিরে আসে। বৃষ্টিরা খুব দুঃখী; জান! আকাশে গেলে পৃথিবী টেনে নিয়ে আসে- প্রবলভাবে। তুমি ভাবতেও পারবে না কি ভয়ঙ্কর সে আকর্ষণ। বৃষ্টির কিছুই করার থাকে না আকাশ! নিরুপায় সে-। আর যখন সে পৃথিবীতে মিশে; অস্তিত্বহীন! তুমি কেন তাকে স্বার্থপর বল? যার নিজস্বতা বলে কিছুই নেই তার স্বার্থ কিসে!
বলতে বলতে গলাটা ধরে আসত ওর। সেই বিষণœতা ছুঁয়ে যেত আকাশকে। কিছুক্ষণ নীরব সময় কাটিয়ে সে বৃষ্টিকে গান শোনাত
”আকাশের সব তারা ঝরে যাবে তবু- তোমাকে দেখার সাধ মরবে না”
ততক্ষণে আকাশের সব তারা একে একে ঝরে গিয়ে পূর্বাকাশে আবীরের খেলা। আকাশের চোখে রাজ্যের ঘুম; হৃদয়-সাগরে থেমে আসা ঘূর্ণিঝড়।
চারমাস পর এক চাঁদনী রাতে সত্যি সত্যিই ঝড় উঠল। মাঝরাতে চাঁদের বর্ষণে ভিজতে ভিজতে বৃষ্টিকে হয়তো চাঁদের মোহ পেয়ে বসেছিল। অনেক কথার পর আবেগী গলায় সে বলল
তোমাকে আমি খুব জ্বালাই; তাই না।
তা ঠিক।
আর কিছুদিন সহ্য করা যাবে?
যদি বলি, না?
আমি তাহলে কল করা বন্ধ করে দিই।
সেটাই ভাল।
তোমার কষ্ট লাগবে না?
কেন!
মজার কথা কি জান; একদিন তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা এই নাম্বারে ট্রাই করে যাবে - আমাকে আর পাবে না। সেদিন তোমার প্রচন্ড মন খারাপ হবে।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। ভয়ঙ্কর রকমের মন খারাপ করা কান্না। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, এই পূর্ণিমাই হয়তো ওর জীবনের শেষ পূর্ণিমা। ব্রেন ক্যান্সারের বন্দী সে।
এরপর আকাশের সত্যি সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল। সে খায় না, ঘুমায় না; লেখাপড়া, ক্রিকেট, কম্পিউটার- কিছুই না। সারাক্ষণ কানের কাছে মোবাইল;”দুঃখিত, এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।” -তবে কি, বৃষ্টি এখন পূর্ণিমার চাঁদ! -প্রথমে কেউ বুঝে উঠেনি। যখন বুঝল; ততদিনে দুরন্তপণা হাস্যোচ্ছল ছেলেটি কমপ্লিট ভেজিটেবল। কি এক বিষণ্নতা ওকে ভর করেছিল সে নিজেও হয়তো জানে না। কারো সাথে কথা বলে না সে। অনুভূতিহীন পাথরখন্ড এক; পুরো পৃথিবীর সাথে আড়ি ওর।
পাথরটিতে ফুল ফুটিয়েছিল ঝুমুর- আকাশের কাজিন। বয়সে তিনবছরের বড়। ছোটবেলা থেকে জটিল সম্পর্ক ওদের। দেখা হলেই ভেংচি কাটা, হাতাহাতি, কথায় কথায় ক্ষেপানো- ফলাফল; মুখভার সারাদিন। পরে ওদের সম্পর্ক এতই ভাল হয়েছিল; যাকে বলে- হরিহর আত্মা। মাস চারেক তাদের যোগাযোগ ছিলনা। ঝুমুর প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি। ভেবেছিল- এটা একধরণের রসিকতা। যখন দেখল এ আকাশ অন্যরকম
অপরিচিত একজন; খুব কষ্ট পেয়েছিল সে। এক আত্মবিশ্বাস ওকে ভর করেছিল তখন; আকাশকে ফিরিয়ে আনবেই-। অনেকটা চ্যালেঞ্জ দিয়ে আকাশকে নিয়ে এসেছিল নিজের বাসায়। সেই থেকে আকাশ ওর সাথে।
ইদানিং স্রোতধারা অন্যমুখী। আকাশ এখন অনেকটা সুস্থ (কঁচি ডাবের ভিতরের শাঁসটুকু বের করে নিলে যেমনটা হয়)। একটা কাজ খুঁজে পেয়েছে সে; হঠাৎ করেই। ক্রেডিট ঝুমুরের-। এমনিতে ঝুমুরের চেহারাটা মোটামুটি; ফর্সা গোলাকার মুখ, পাতলা ঠোঁট, অনুন্নত নাক, দু-চারটি ব্রণের দাগ, বাম গালে তিল - সবমিলিয়ে আহামরি কিছু নয়। তবে, ওর এক অতুলনীয় ঐশ্বর্য আছে- একজোড়া চোখ- ধবধবে সাদা; তাজমহলের চেয়েও উজ্জ্বল (তাজমহল তো নিষ্পন্দ পাথর। কিন্তু, এ- জীবন্ত! কৃষ্ণগহ্বরের সর্বগ্রাসী আকর্ষণ )। মাঝখানে ব্ল্যাক পার্ল- গ্রীষ্মের দুপুর-দিঘির থমথমে গভীরতা। নিখুঁত সে চোখজোড়া। প্রতিটি চাহনিতে, প্রতিটি ভঙ্গীতে, প্রতিটি ইশারায় আদি-অকৃত্রিম-অমিমাংসিত রহস্য। দুই সপ্তাহ্ ধরে সেই রহস্য আকাশকে ফাঁদে ফেলেছে। আকাশ এখন পুরোদস্তুর শিল্পী। ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লান্তিহীন- একের পর এক স্কেচ করে সে; এক জোড়া চোখের; একটি মুখের- অনেক অনেক স্কেচ। স্কেচের মাত্রাতিরিক্ততায় সেই মুখের প্রতিটি বিন্দু তার মুখস্ত হয়ে যাওয়ার কথা- বিরক্তি ধরে না। তার একটি কারণ হতে পারে চুল। চোখের ধরণ বদলানো যায় না, মুখের শেইপ পাল্টানো যায় না, তিলগুলোকে ইচ্ছেমত বিউটি স্পট বানানো যায় না- বদলানো যায় চুল; চুলের স্টাইল। কখনো দু-একটা চুল বাতাসে উড়ে, একটা নাকের পাশ দিয়ে ঠোঁটের প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। মাঝেমধ্যে জ্বলন্ত সর্পিণী। আবার, পিঠময় ছড়িয়ে দিলে পতেঙ্গা বিচের মরা-মরা ঢেউ। -আকাশের এমনটাই মনে হয়। নরম বিছানার উষ্ণ কোমলতায় গা টেনে সে অফসেটে পেন্সিল বুলোয়; ঝুমুর বিছানার লাগোয়া সোফার কিনারায় পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে পা টেনে মোবাইলে কথা বলে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে কথা বলে যেতে পারে; ক্লান্তিহীন- রাউন্ডে রাউন্ডে কথা। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে এলে পরে চার্জার লাগিয়ে সে কথা বলে। রাউন্ডের দীর্ঘসূত্রতায় আকাশের তন্দ্রামতো চলে আসে। বিছানার উষ্ণ কোমলতায় ভারী-ভারী চোখে ঘুম-ঘুম; নিদ্রাদেবীর স্নেহচুম্বন। ঘন্টাখানেকের স্বপ্নবিচরণ শেষে আলস্যভরা আঙ্গুলের সচলতায় হলুদ পেন্সিলের কাগজবিচরণ। ধীরে ধীরে একটি মুখের ছত্রছায়ায় একজোড়া মায়াবী চোখ পুরো ঘরজুড়ে রহস্য ছড়াতে থাকে। ঝুমুরের তখনো একই স্টাইল। কলারের অভাব হয় না ওর। রয়েল বেঙ্গলের এই দেশে ছেলেরা সব বাঘ; নরখাদক নয়- নারীপিয়াসী। নারীকন্ঠ ওদের পাগল করে তোলে। উন্মাদের মত তারা ফোন করে চলে; ধার করে- এমনকি সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে হলেও। এ এক নেশা-। ঝুমুর বিষয়টা বেশ ভালভাবেই বুঝে। আরো অনেককিছু বুঝে সে- ছেলেদের দূর্বলতাটা কোথায়? -রাতের মোহময়তায় কাকে ঠিক কোন কথাটি বললে তার কমপ্লিট ভাইব্রেটিং সিস্টেম ধ্বংস হয়ে পড়ে? এ একধরণের মজা; দূর্বলতাগুলোর হান্ড্রেড পার্সেন্ট বেনিফিট নেয় সে। অবশ্য, নেওয়ার মত অনেককিছু আছে ওর মধ্যে। কথা বলতে পারে ভাল। আর- কন্ঠ আছে! বুকের ভিতরে ভীতু-ভীতু শিহরণ তোলা রিনরিনে কন্ঠস্বর। গলায় একধরণের কম্পন তুলে সে কথা সাজায়-
গেইজ করুন তো আমি কে? -উঁহু, হল না। -আপনার গেইজ এত খারাপ! -আপনার জায়গায় আমি হলে কিন্তু ঠিকই চিনে নিতাম। -বিশ্বাস হচ্ছে না! -আচ্ছা, আরেকটু সহজ করে দিচ্ছি-
অনর্গল রোমান্স বর্ষে সে; ওর সে ক্ষমতা আছে। প্রতিদিন এই ঘরে অনেক ঘটনা ঘটে- অনেক কথা, অনেক ধরণের খেলা; অনেক অভিনয়। কতিপয় উন্নততর মস্তিষ্কের বিকারগ্রস্থতায়; এক রহস্যময় নারীকন্ঠের ইন্দ্রজালে অবিরাম অর্থহীন অসংলগ্নতা। হয়তো ঝুমুরের মায়াজালে অথবা অন্য কারো ধ্বংসকাব্যময়তায় এখানে দিগ্ভ্রষ্ট বসন্তের আনাগোনা। কবে এর শুরু; আকাশ ঠিক মনে করতে পারে না। তবে ঝুমুরের রাজ্যপট ইতিমধ্যে মোবাইলের গন্ডি ছাড়িয়ে ইন্টারনেটে শাখা মেলেছে। বিভিন্ন নামে তার অনেকগুলো ই-মেইল এড্রেস আছে। প্রতিনিয়ত হৃদয় কাঁপানো মেইলগুলো বিভিন্ন লোকের মেইলবক্সে ফণা মেলে; প্রতিনিয়ত হৃদয়জলে ভো আকুতিপূর্ণ সব উত্তর আসে। মিডিয়াটিতে ঝুমুর সবচেয়ে বেশি মজা পায়। ক্রিয়েটিভিটি আছে; কষ্টের কথা লাল কালিতে, ভালবাসার নীল। আরো কত কিছু; গিটিং কার্ড, পিকচার মেসেইজ-।
ইতিমধ্যে ঝুমুর এক রাউন্ড শেষ করে উঠে; অবিরাম একঘন্টা চল্লিশ মিনিট। পরবর্তী ভঙ্গীগুলো আকাশের বেশ পরিচিত; দু-বাহু টানটান করে জড়তা ভাঙানো, কিছুক্ষণ গা মোড়ামুড়ি- সবশেষে সেই পরিচিত উক্তি
আমার চেহারা খুব একটা ভাল না রে -। ঠিক না?
খুব বেশি খারাপ না কিন্তু। এই ধর, মুখভর্তি ব্রণের দাগ, বোঁচা নাক-
আমার এত খুঁত!
খুঁত আরো আছে। তবে-
তবে!
স্বয়ং চাঁদেরও খুঁত আছে।
প্রশংসার মাত্রাটা হয়তো বেশিই ছিল। ঝুমর লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। খুশিও হয়। বেশ বিগলিত কন্ঠে আকাশকে বলে
তুই ভাইটা না খুব ভালো। মাথায় বুদ্ধির অভাব নেই। কথাবার্তাওতো ভালই পারিস। হঠাৎ এমন হয়ে গেলি কেন!
কেমন হয়েছি?
তুই জানিস; তুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভেঙে পড়া একজন মানুষ।
তাহলে বলব; তুমি কিছুই দেখনি।
কি দেখিনি।
ভেঙে পড়া মানুষ। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষ। আমাদের ক্যাম্পাসে একজন আছে। ওর এতদিনে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা; সারাদিন হলে হলে ঘুরে বেড়ায় । নিয়ন্ত্রণহীন একজন-
ঝুমুর একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা মনে পড়ে যায় ওর; একটা ঘুণে ধরা কাহিনী। সাবধানে এক অতি চাপা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে সে আকাশের কথায় সম্মতি জানায়
রাইট ইউ আর। তোর চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভেঙে পড়া মানুষ আমি দেখেছি; পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষ। বাই দা বাই, তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।
আবার কে?
নেট।
আরিয়ান হামিদ!
পাগল হয়ে গেছে।
এতক্ষণ ওর সাথে কথা চলছিল?
হুঁ। ওর কার্ড শেষ। নূতন কার্ড কিনে আবার কল করবে।
এটা কি ফেয়ার?
আমি তো কারো ক্ষতি করতে যাচ্ছি না। ছেলেগুলো কত আশা করে বসে থাকে নারীকন্ঠের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। আমি জাস্ট ওদের কিছু সময় দিই।
ঐ যে বললে, আরিয়ান পাগল হয়ে যাচ্ছে।
ও তো আস্ত পাগল। প্রথম কয়েকদিন সে কি আকুতি! -হোয়াই ডোন্ট ইউ কন্টাক্ট মি? -প্লীজ সেন্ড ইওর নাম্বার। প্রথমে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। পরে এত মায়া লাগল; পাঠিয়ে দিলাম।
বেশ ভাল করেছ!
তবে, আমার মনে হয় সে আমাকে বেশ পছন্দ করে। আর কিছুদিন দেখি। তারপর
তারপর!
ইয়েস বলতে পারি।
কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই বেশ কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার কথা আকাশের মনে পড়ে যায়। মনের পর্দায় একটি ছবি- তন্ময়। ঝুমুর সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন ওর মুখে ব্রণ ছিল না; মুখ অনেক উজ্জ্বল। ছিল অহংকার -ভয়ঙ্কর রকমের। হয়তো তা রূপের; হয়তো পূর্ববর্তী রেজাল্টের- এখনকার ঠিক বিপরীত। কাউকে পাত্তা দিত না সে। কথাবার্তা যৎসামান্য- তাও ভাব দেখানো। এর মাঝে এক ক্লাসমেটের সাথে ওর সখ্যতা; হতে পারে বন্ধুত্ব, অথবা অন্যকিছু। এমনও হতে পারে; ছেলেটার পক্ষ থেকে প্রেম- ঝুমুরের একধরণের মজা। তন্ময় ঝুমুরকে ভালবাসত- প্রচন্ডভাবে। পাগলের মত ফোন করত; নিজের কাজ ফেলে ওর সাথে ঘুরে বেড়াত- সবসময়- সবখানে-। ঝুমুরও তন্ময়ের কথা খুব বলত। সবকিছু ঠিকই ছিল। ঝড় উঠল আচমকা। কিছু একটা ঘটেছিল ওদের মধ্যে। কি ঘটেছিল কেউ জানে না- ওর ক্লাসমেটরা, এমনকি আকাশ। ঝুমুরের চোখে তখন অন্য ভাষা। কিছু একটা বলার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তন্ময়; ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা ফোন করত সে- ঝুমুর রিসিভ করত না। ক্লাসে কিছু বলতে চাইলে পাশ কাটিয়ে চলে যেত। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি! কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় ছেলেটি ছাদ থেকে পড়ে মারা গেল। সবাই তা জানত। কথাটাও সত্যি। -অন্তরালে অন্যরূপ। সেই সন্ধ্যায় চূড়ান্ত রকমের আবেগে পেয়ে বসেছিল তন্ময়কে। অনেক্ষণ ধরে একটানা কল করেছিল সে; ঝুমুর রিসিভ করেনি। একসময় ঝুমুরের মোবাইলে একটা ম্যাসেজ; তুমি যদি এই কল রিসিভ না কর, আমি সবকিছু এখানেই শেষ করে দিব। দুই মিনিট পর আরেকটা কল; রিসিভ করেনি ঝুমুর- প্রয়োজন মনে করে নি। অনেক্ষণ পর তার মন হয়তো একটু নরম হয়েছিল। ততক্ষণে সব শেষ।
ভার্সিটির স্টুডেন্টরা অসাধারণ! বন্ধু হারানোর বেদনায় মর্মাহত ওরা একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল; চাঁদা তুলে। সেই সমব্যাথী জনসমুদ্রে ঝুমুরও ছিল। ঝুমুরকে ক্ষমা করেছিল ওরা (ট্রয় ভেস্তে যাক; হেলেনের জয়-জয়কার)। তন্ময়ের অতৃপ্ত দুঃখবোধের সামান্যতম স্পর্শও ওরা ঝুমুরের গায়ে লাগতে দেয় নি। কত আগে- এতদিনে সবাই ভুলে বসেছে। ভুলেনি তন্ময়ের বাবা-মা (একমাত্র সন্তান তাঁদের) আর আকাশ (অপ্রয়োজনীয় মনে রাখা)। ঝুমুর তখনো একটানা বকে চলছে
তুই বলতে পারবি না কারো ক্ষতি আমি করেছি। ওরা যদি-
ঝুমুরের পরবর্তী শব্দগুলো মুখেই আটকে থাকল। ততক্ষণে উদভ্রান্তের মত চিৎকার শুরু করেছে আকাশ।
ইউ আর নট সাপোজড টু ডু সো। ইউ আর অ্যা মার্ডারার।
ঝুমুর স্তম্ভিত। হঠাৎ কি হল আকাশের। এমন শুরু করেছে কেন সে! ওদিকে শব্দঝড়-
তুমি কিছুই করনি। শুধু একটা ছেলেকে সুন্দরভাবে মৃত্যুর দ্বারে ঠেলে দিয়েছিলে। সে তোমাকে ভালবাসত- সত্যিকারভাবে। তুমি বুঝতে পার; কি পরিমাণ কষ্ট নিয়ে মরেছিল ছেলেটি! কিছুই করনি তুমি। শুধু একটি লাইফ ধ্বংস করেছ।
বলতে গিয়ে প্রচন্ড আক্রোশে ঝুমুরের মোবাইল মেঝেতে ছুঁড়ে টুকরো টুকরো করতে থাকে আকাশ। হতবিহ্বল ঝুমুর কম্পমান চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এরপর- আকাশ ভেঙে পড়ে। সামনের ভাঙা মোবাইলের টুকরোগুলো তখন ওর চোখে ভালবাসার চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া তন্ময় অথবা অন্য একজন। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সে। ওর কান্নাভরা গলা ভেদে ধর্মীয় সঙ্গীতের মত অস্পষ্ট আকুতি- বৃষ্টি, তুমি মেঘ হবে!
Written By: Protyai, BUET
Mail:
মন্তব্য
সচলায়তনে আমরা লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে সকলেই একই সাথে বা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একই লেখা একাধিক ব্লগ কমিউনিটিতে প্রকাশ না করার নর্ম পালন করে থাকি।
অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্য একটি ব্লগ সাইটে প্রকাশিত হওয়ায় এই লেখাটি আপনার নিজের ব্লগে প্রকাশ করা হলো। এটা ব্যক্তিগতভাবে আপনার প্রতি কোন বিদ্বেষ নয়, নিতান্তই সচলায়তনের নীতিমালার অনুসরণ।
ঈশ্বরাসিদ্ধে:
অজ্ঞাতবাস
নতুন মন্তব্য করুন