গ্রীষ্মের ভরা দুপুরে পৃথিবীটা কেমন যেন মরা-মরা লাগে। হাতঘড়ির কাঁটা অনবরত ঘুরে চলছে, - টিক্ - টিক্ - টিক্-। দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট। এতক্ষণ গাড়ির ভেতর চাপা আক্রোশে ফুঁসছিল আবীর। এবার ধৈর্য্যরে শেষ বাধটিও ভেঙে পড়ে। উদভ্রান্তের মত হর্ণ বাজানো শুরু করে সে- একবার- দুবার- পাঁচবার-। সামনের মালবোঝাই ট্রাকটিতে নড়াচড়ার কোন লক্ষনই নেই। মরা হাতির মত রাস্তার মাঝখানটা জুড়ে সেটি- তেমনই নিষ্পন্দ; তেমনই নীরব। সে নীরবতার আড়ালে কে যেন মুচকি হাসে, কটাক্ষ দৃষ্টি হানে, আবীরের দূর্ভোগ দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। অস্বস্তিতে আবীরের বুকের ভিতর হাঁসফাঁস- একটুকরো ভাবনা মনের আকাশে ঝলকে উঠে; ফিরে গেলে হয় না? কোন দরকার আছে এইসব অহেতুক পাগলামোর! প্রায় সাথে সাথেই মনের অন্য অংশটা সচকিত হয়ে উঠে- না। -এসব কি ভাবছে সে! এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে হয়!
এই যাওয়া না-যাওয়ার দ্বন্দ্বে পড়ে আবীরের মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। মনের অজান্তে চোখ চলে যায় হাতঘড়ির ডায়ালের দিকে। তখনো সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে; অবিরাম ঘুরবে। চলতে চলতে মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে, গাড়ির চাকা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়- ঘড়ির কাঁটার বিরাম নেই। তার বুকের ভিতরের কোন এক অন্ধ-প্রদেশে ভয়ঙ্কর নৈশব্দের মাঝে বিশাল এক ঘড়ি চাপা কান্নার মত শব্দ করে উঠে- ঢং- ঢং-। বারটা বেজে গেছে! সবকিছু নূতনভাবে শুরু হবে। সব শমশীর লেকে খাড়া হো যাও ভাই; কেয়ামত আ গেয়া-। কেয়ামত আসে না; আবীর চেতনায় ফিরে আসে। দুটো বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। না! আর বুঝি পৌঁছানো গেল না। চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়ে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পকেটের ঘামে-ভেজা রুমাল মুখে চেপে প্লাস্টিকের বোতল থেকে একঢোঁক পানি গলায় ঢালে এবং শেষমেষ প্রচন্ড বিরক্তিতে অনেকটা গায়ের জোরে অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পড়ে। একরাশ ধুলো সেখানে; পায়ের চারপাশে সিগারেটের ধোঁয়ার মত পাকিয়ে উঠা সাদা সাদা ধুলো। কালো প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত সাদা হয়ে উঠে। ধুলোগুলো যেন অপেক্ষা করছিল তার জন্য। হ্যাঁ-। হ্যাঁ-। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, বর্ষার প্যাঁচপ্যাঁচে জলে কাদা হয়ে, শীতের কুয়াশায় ডানাভাঙা পাখির মত র্নীজিব পড়ে থেকে তারা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করেছিল আবীরের জন্য। নাহলে অমনভাবে তাকে জড়িয়ে ধরবে কেন? ফিসফিসে স্বরে পথের ধুলো কথা কয়ে উঠে - এস। মায়ের ছেলে মায়ের বুকে এস। উচ্চাশার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছ আমাদের কথা। দেখে যাও; শত শতাব্দী ধরে আমরা লিখে চলেছি পথের ইতিহাস- ধুলোর অক্ষরে পথের বুকে পথের পাঁচালী। তুমি এস আমাদের কাছে। মেঘের বুক থেকে উদ্ধার কর সে সোনালী সূর্য। -সে হাহাকার পথের বুকেই চাপা থাকে- আবীরের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।
তবে, পথের ধুলি মানুষ চিনতে ভুল করেনি। আবীরের সে ক্ষমতা আছে। লেখক সে- নাগরিক জীবনের রূপকার। লেখার গন্ডিটা নগরেই সীমাবদ্ধ ওর। ইটের পাঁজরে আটকে থাকা উচ্চাভিলাসী মানুষগুলোর ভাসাভাসা অনুভূতি, হাসি-কান্নার দ্বন্দ্ব, জন্ম-মৃত্যুর আগোছালো হিসেব, যান্ত্রিক ভালোবাসা- এতটুকু নিয়েই তার লেখালেখির জগত। ধুলো ওড়ানো গেয়োঁ পথের ক্রন্দন কিংবা সাঝেঁর মায়ায় সদ্য স্বামী হারানো কোন এক গ্রাম্য ষোড়শীর ছলছলে চোখ সেখানে অর্থহীন। যে লোকটা মাত্র একটাকার জন্য হাতাহাতি করতে গিয়ে প্রাণ হারাল- কে বা শুনতে চায় তার মনের কথা, জীবনের দুঃখ-ব্যাথা, দারিদ্রের নীপিড়ন-গাঁথা। যারা বছরের পর বছর উচ্চাশার সাগরে নৌকা ভাসিয়ে চলে, গ্রামটা তাদের কাছে শুধুই গ্রাম- সেটা সেভাবেই থাক। মাকাল ফলের উপরটা বেশ সুন্দর; কি লাভ তার ভিতরের রসায়ন ঘেঁটে-!
মাথার উপর সূর্য আগুন ঢালছে। আবীরের কানের দুপাশ দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম নামে। ঘামের বন্যায় নীল গায়ের সাথে লেপ্টালেপ্টি; আবীর রাস্তা থেকে ক্ষেতে নেমে প্যান্টের ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করে- ধুলো আরো ভালভাবে লেপ্টে যায়। না! তারা কিছুতেই ছাড়বে না তাকে। সে যে তাদের কোলের সন্তান। যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করুক; তারপরও- সে যে এই ধুলোর বুকে একদিন গড়াগড়ি যেত। কিভাবে ভুলবে তারা সেই স্মৃতি! -ভুলে যায় আবীর। বিরক্তিতে তার ঠোঁট কুচকে আসে। চারিদিকে শূন্য ক্ষেত; অস্থি-চর্মসার শতবর্ষী বৃদ্ধেও বুকের পাঁজরের মত উচিয়ে থাকা ফাঁটলগুলোর অবিরাম ফোঁসফোঁস। সে নিঃশ্বাসে কালনাগিনীর বিষ; সে ভাষায় অসুস্থতা; দৃষ্টিতে স্থবিরতা; প্রতিটি ভঙ্গীতে আর্ত হাহাকার। আবীরের মেডুসার কথা মনে পড়ে যায়। গ্রীক পুরাণের মেডুসা- তিন গর্গেনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। তার মাথায় চুলের বদলে কিলবিল করত সাপ। আর, চোখের দৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর রকমের শীতলতা। সে চোখে যে তাকাত সেই পাথর হয়ে যেত। হাজার হাজার বিষাক্ত ফণার মাঝে অপূর্ব একটি মুখ- এ ধরণের একটি ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠে একবার- দুপুরের নির্জনতায় সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না; খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে।
আবীরের গলা শুকিয়ে আসে। রাস্তায় উঠে সে ট্রাকের ড্রাইভিং সিটের দিকে এগিয়ে যায়। স্থানে স্থানে কাপড় ছেঁড়া ফোমের সর্বদন্তবিকশিত নরকঙ্কাল-হাসি সেখানে। রাগটা অকারণেই- হঠাৎ করে বেড়ে যায় অনেকগুণ। প্রচন্ড আক্রোশে ট্রাকের বনেটে সজোরে লাথি হাঁকায় সে- একটা চিনচিনে ব্যাথা পায়ের হাঁড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটে যায়। ব্যাথায় মুখ বিকৃত করে মাটিতে বসে পড়ে আবীর- দূর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ছে না। দূর্ভাগ্য হল শয়তানের ছোট বোন; অন্ধকারে তার কুতকুতে চোখ অঙ্গারের মত জ্বলে। সেই চোখে লাল জিঘাংসা। সে যখন আসে, সবদিক দিয়েই আসে। একা আসেনা; চ্যালা-চামুন্ডা নিয়েই আসে।
কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকে সে। ব্যাথা একটু কমলে পরে বাম পায়ের উপর ভর রেখে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ডান পায়ের উপর একটু একটু চাপ দিয়ে দেখে নেয় হাঁড়-টাড় ভাঙল কি-না। আশ্বস্ত হয়- একটু কষ্ট হলেও বেশ হাঁটতে পারবে। রোদের তেজ কমতে থাকে। এক হলকা বাতাস বয়ে যায়- তিরতিরে বাতাস। রাস্তার একপাশে অবহেলায় বেড়ে উঠা খেজুরগাছটি কেঁপে উঠে; মাথা দুলিয়ে আবীরকে সমবেদনা জানায়। হাওয়াটা অন্যরকম- নারীহস্তের কোমল স্পর্শ যেন। কেউ কি কোনদিন এভাবে তাকে স্পর্শ করেছিল? প্রমা অথবা অন্য কেউ? -নাহলে তার অমনটা মনে হবেইবা কেন! পুরানো স্মৃতিগুলো মনের পর্দায় ঢেউ খেলিয়ে যায়। ভাসাভাসা ঘটনাগুলোর কোনটাকেই সে ভালভাবে মনে করতে পারে না -মন এক আশ্চর্য ভাললাগায় ভরে উঠে। অ্যাম্বুলেন্সের জানালা দিয়ে ভিতরে উঁকি দেয় একবার। প্রমা ঘুমাচ্ছে। তার শান্ত মুখে জানালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। সেই রোদে মুখের লাবণ্য তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে ফণাতোলা সাপের মত মুখিয়ে আছে। বড় বড় ভাসা-ভাসা দুটি চোখ এবং প্রায় সেরকম দুটি চোখের পাতা আবীরের চোখে ভাসে। কতদিন স্বপ্নের ভিতর ঐ চোখজোড়া তাকে তাড়া কওে বেরিয়েছে; এল ডোরাডোর খোঁজে ছুটে চলা অভিযাত্রীর মত তাকে ছুটিয়েছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, সাগরের অতলান্তিকতায়, গহীন বনের নির্জনতায়। কি ছিল সে চোখে! আকাশের বিশালতা; না-কি বন্য হরিণীর চপলতা! -আবীর অনেক ভেবেছে। -রাতের পর রাত জেগে ভেবেছে; কেন সমাধান পায়নি কখনো। সবসময় তার চোখের সামনে ছায়ার মতন ভেসে বেরিয়েছে একজোড়া চোখ। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে- সবসময়। -না! আবীর কাউকে বলেনি সে কথা। যার চোখ তার চোখের নদী জুড়ে থাকত- তাকেও না। কি বলবে সে! -কিভাবে! তার কাছে কি চাইবে? -সে দুটো চোখের মালিকানা! ব্যাপারটা যে হাস্যকর- অসম্ভব রকমের ছেলেমানুষী। সমাজটা তো সেভাবে গড়ে উঠেনি। সে আবীর রায়হান; স্বনামধন্য লেখক। মিডিয়া তার পিছে সার্চলাইটের মত ঘুরছে; সামান্যতম ফাঁক পেলে তিলকে তাল করে ছাড়বে। কিভাবে সে প্রমা ব্যাণার্জীর দখল চাইবে! -মনের পাখি মনের খাঁচায় ডানা ঝাঁপটে মরে; বাইরের পৃথিবীতে তার আভাসটাও এসে পৌঁছায় না।
হাতের তালু দিয়ে সূর্যকে আড়াল করে চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানে সে। যতদূর দৃষ্টি যায়; ফসলহীন শূন্যক্ষেত। আরো দূরে দু-চারটা টিনের ঘর পদ্মার জালে আটকে পড়া ইলিশের পেটের মত সূর্যালোকে ঝলকে উঠে।সেখানে কোথাও ধুলো ওড়ে- ঝড় হচ্ছে হয়তো। এত দূর থেকে কিছুই বোঝা যায় না- শুধু একটি ঘূর্ণি। ঘূর্ণি সবখানেই এক। জলের ঘূর্ণি, বায়ুর ঘূর্ণি, মহাকালের আবর্তেপাক খেতে থাকা মানুষের ঘূর্ণি- সব ঘূর্ণিই এক। কাকে কোথা থেকে উড়িয়ে নিয়ে কোথায় যে ফেলে, তা ঘূর্ণিই ভাল বলতে পারে। চরকির চারপাশে পাক খেতে থাকা তুলোর মত সাদা ধুলো ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠে- যেন বা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। আকাশ আকাশেই থাকে; ধুলোগুলো মাঝপথে পড়ে যায়। বায়ু লোভ দেখায়- গাধার সানে মলো ঝুলিয়ে রাখে। গাধা খালি ছুটে; খালি ছুটে বেড়ায়- কখনো মুলার নাগাল পায় না।
সূর্যের তেজ অনেকটা কমে আসে। চারপাশ তখনো নির্জন। সময়টা গ্রীষ্মকাল- কোন কাজকর্ম নেই। দুপুরের খাওয়া শেষে লোকজন ভাতঘুম ঘুমাচ্ছে। আবীরের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়।এরকম দুপুরে তারা কখনোই ঘুমাতনা। -মা জোর করে বিছানায় শুইয়ে রাখত; মন ঠিকই চৌধুরীদের আমবাগানে। চোখ তক্কে তক্কে থাকত; কখন মা ঘুমায়। তারপর, আস্তে আস্তে উঠে পা টিপে টিপে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ছিটকিনি খুলে এক দৌঁড়ে বুড়ো তেঁতুলগাছটার নিচে। ততক্ষণে সবাই চলে আসত। -সুমন, তমাল, বাদল -সবার নামও ঠিকমত মনে পড়ে না। তাদেও কেউ হয়তো এখন গাঁয়ের চাষা, কেউ চা-পোষা কেরাণী; দু-একজন মধ্যপ্রাচ্যে- কারো খোঁজখবর নেওয়া হয়না কখনো। -তারা সবাই আসত। জনি ছিল তাদের লিডার; ক্ষুরধার বুদ্ধি তার। কোন গাছে আম হলুদ হয়ে এসেছে আর কোন বাড়িতে কাঁঠালে পাক ধরেছে- সবই তার নখদর্পণে। কপালে বাঁজ ফেলে ফন্দি আটত সে। তারপর দলবল নিয়ে চৌধুরীদের সাদা পাঁচিলে। কয়েকজন গাছে উঠত; কয়েকজন নিচে- জনি পাহাড়ায়। পাঁচিলের উপর থেকে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলোত সে- কেউ দেখে ফেলল না-তো! এতকিছুর পরও একদিন তারা প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। জনিকে দোষ দেওয়া যায় না; দারোয়ান ছিল হাস্নাহেনা ঝোপের আড়ালে। আবীর তখন গাছের মগডালে। পড়িমড়ি করে নেমে সে কি দৌড় তার। পিছন থেকে দারোয়ান চিৎকার করছে- ধর! -ধর! এই বুঝি সে ধরা পড়ে গেল।
-একি! -এসব কি হচ্ছে! আবীর কি সত্যি সত্যিই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল! চোখমুখ এমন করছে কেন তার? -আবীর শৈশবে হারিয়েছিল। ততক্ষণে দমকা হাওয়া দক্ষিণ দিক থেকে একরাশ ধুলো বয়ে এনেছে; গ্রীষ্মের চরিত্রটাই এমন -কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখমুখ কচকচে বালিতে ভরে উঠে। হাতড়ে হাতড়ে গাড়ির ভিতর থেকে পানির বোতল বের করে নিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে নেয় আবীর। মনের রাগটা এতক্ষণ মনের ভিতর চাপা ছিল- এবার উথ্লে উঠে। ক্রূর চোখে একবার পথের দিকে তাকায় সে। এমন সময় লোকটাকে দেখতে পায়; পরনে নীল চেকের লুঙ্গি, হলদে হয়ে আসা সাদা ফতুয়া, কোমড়ে মোটা চামড়ার কালো বেল্ট, থুতনিতে কাঁচাপাকা দাড়ি, কালো গায়ের রং- চোখগুলো অসম্ভব রকমের কুতকুতে। লোকটার ঠান্ডা-গরমের অনুভূতি আছে বলে মনে হয় না; কি অবলীলাক্রমে খালি পায়ে তপ্ত বালির উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। ট্রাকের কাছাকাছি এসে দরজা খুলতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ায় সে। বিষ্মিত চোখে আবীরের দিকে তাকায় একবার। আবীর এগিয়ে যায়।
ট্রাকটা কি আপনার?
লোকটা প্রথমে বুঝতে পারে না। অবাক চোখে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়- কাউকে তো আশেপাশে দেখা যায় না! তবে কি, তাকে কিছু বলল?
আমারে কিছু জিগাইলেন?
এতে কাজ হয়। প্রচন্ড রাগে আবীর কালবৈশাখীর ঝড়ের মত ফুঁসে উঠে। আক্রমণের ভঙ্গীতে সে প্রায় তেড়ে যায়।
ঐ মিয়া। কানে কম শোন না কি? আমি জানতে চাইলাম ট্রাকটা তোমার কি না-
ভয়ে লোকটা মাটির সাথে মিশে যায় যেন। -বাপরে! সে কি বাঘের মত চোখ -এখনই গিলে ফেলবে যেন! অনেক কষ্টে তার গলা দিয়ে একটা মাত্র শব্দ বের হয়ে আসে
জেঁ-
আবীর চরমে উঠে।
পেয়েছ কি তুমি! পুরো রাস্তা দখল করে রেখেছ। রাস্তাটা কি তুমি কিনে নিয়েছ? আহাম্মকের দল-
আবীর ক্ষেপেছে। সে সত্যি সত্যিই ক্ষেপেছে। সকাল থেকেই ক্ষেপেছে সে। তখনো নাস্তা শেষ করেনি- এমন সময় ফোনটা এল; প্রমাকে বুঝি বাঁচানো গেলনা আর। -এতটুকুই যথেষ্ট; ঘটনার আকষ্মিকতায় আবীর পাথর যেন এক। তার সামনে পেন্ডুলামের মত ফোনের রিসিভার দুলতে থাকে- প্রমাকে এত ভালবাসে; আগে তো কোনদিন বুঝেনি! ছাড়া-ছাড়াভাবে দু-একটা কথা তার কানের সামনে বাজতে থাকে-
তুমি কবিতা লিখনা কেন?
দেখ; আমার রাগটা কিন্তু খুব বেশি। আর যদি কোনদিন এমনটা কর; আমি তাহলে কথাই বলব না।
না! এই লেখাটা খুব একটা ভাল হয় নি। কেমন যেন-
আবীর; ছাদে যাও। চাঁদ উঠেছে-
কত কথাই না বলত মেয়েটা। -সেই প্রমা বাঁচবেনা। কিভাবে এটা মেনে নিবে আবীর। রিসিভার দুলতে থাকে; খাবার টেবিলে আধখাওয়া খাবার- আবীর বেরিয়ে যায়। তার কানের কাছে তখন একটিমাত্র কথা; বুকের দামামায় মেঘের গর্জনের মত একটিমাত্র ধ্বনি- প্রমা বাঁচবেনা। হাসপাতালের করিডোর ধরে যখন সে উদভ্রান্তের মত ছুটছিল (হাসপাতালের সাদা দেওয়াল, ময়লা পর্দা, লোহার বেড, সাদা বিছানা, ডাক্তার-আয়া-নার্স, বিছানায় কাৎরানো রোগী- সবাই হয়তো ছুটছিল) তখনো তার কানের পাশে অযুত কন্ঠের নিযুত হাহাকার- প্রমা বাঁচবেনা। আবীর ছুটতে থাকে। দুহাতে কান চেপে সে ছুটতে থাকে। বুকের গহীনে আর্ত-হাহাকার; করিডোরটা কত লম্বা! এ পথ কি শেষ হবে কখনো!
(চলবে......)
মন্তব্য
চলুক, একসাথে পড়ব
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
নতুন মন্তব্য করুন