শেষ পর্যন্ত পথ শেষ হয়। বত্রিশ নাম্বার কেবিনের সামনে সে যখন পৌঁছায়- ভিতরে ভয়ঙ্কর রকমের কাশি। যখন সে পর্দা ঠেলে ভিতরে পা রাখে- রক্তের বন্যা সেখানে; প্রমার বুক ভেদে বেরিয়ে আসা কালচে রক্ত। চার বছর ধরে মেয়েটি যে বুকের ভিতর এত বড় একটি রোগ পুষে এসেছিল; আবীর কি তার সামান্যতম আভাস পেয়েছিল কখনো! মাত্র একমাস আগে; যেদিন প্রমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল- আবীর স্তম্ভিত। মাঝে মাঝে প্রমা কাশত- ভয়ঙ্করভাবে। আবীর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ত।
না! এভাবে আর চলে না। কালকেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
ও কিছু না। শুধু-শুধুই চিন্তা করছ। কিছুই হয়নি আমার। বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম না গতকাল- ঠান্ডা লেগেছে।
গতকাল বৃষ্টি হল কখন।
কি বলতে কি বলি! বৃষ্টি না তো; কুয়াশা। কি যে হচ্ছে আমার- খালি ঠান্ডা লাগে।
হ্যাঁ। মেয়েটার সত্যি সত্যিই ঠান্ডা লেগেছে। ভয়ঙ্কর সে ঠান্ডা; লিউকোমিয়া তার সমস্ত শরীর ঠান্ডায় ভরে ফেলেছে। শরীরের সাদা চামড়া নিষ্পাণ-ফ্যাকাসে। রক্ত ঝড়তে ঝড়তে কিছুই অবশিষ্ট নেই সেখানে। মেয়েটা যেন নির্বাসিত তুষারকন্যা; ডিজনির স্নো-হোয়াইট। আবীরের ভিতরের মনটা কথা কয়ে উঠে-
তুষারকন্যা! তুমি কি অপেক্ষা করে আছ কোন এক রাজপুত্রের জন্য? দেখ; আমি এসেছি। আর ভয় নেই তোমার-
তুষারকন্যার মুখ দিয়ে অবিরাম রক্তপাত। একজন নার্স তাকে শক্তভাবে ধরে আছে। প্রমার মা বেডের খুঁটি ধরে দাঁড়ানো, বাবা পায়ের কাছটায় মাথা নীচু করে বসা। পদশব্দে একবার আবীরের দিকে চোখ তুলে চাইলেন তাঁরা- আবার পূর্ববর্তী। বহুবছর ধরে একটু একটু করে যে সম্পদ তারা গড়ে তুলেছেন- তা রক্ষা করতে পারছেন না তারা। শিল্পির সামনে একটু একটু করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তঁ াদের নিজের হাতে সবটুকু দরদ ঢেলে গড়ে তোলা শিল্প; কোথায় রাখবেন তারা সে লজ্জ্বা। স্তম্ভিত তাঁরা- পাথর-নীরব। সে নীরবতার অন্তরালে বুকের ভিতরের এক চাপা কান্না অসহ্য ব্যাথায় গুমড়ে মরে।
প্রমার রক্তপাত বন্ধ হয়। লাউয়ের ডগার মত নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটি। কি ধকলটাই না গিয়েছে তার শরীরের উপর। ঝর্ণার সুরের মত একটানা কথা বলে যেত মেয়েটি। আবীর মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে পড়ত-
এত কথা বল কেন! একটু চুপ থাকা যায় না?
অমনি একরাশ কালো মেঘ এসে ভর করত তার স্নিগ্ধ চাঁদমুখে। আবীর ভয় পেয়ে যেত। গলার স্বর যতটা সম্ভব নরম করে বলত-
তুমি রাগ করেছ প্রমা?
না! আমি কারো উপর রাগ করি না।
দীর্ঘশ্বাসের মত কথাটা। আবীরের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। অপরাধীর মত সে বলত
আমি জানি তুমি রাগ করেছ। রাগ কোরোনা প্রমা। সত্যি বলছি- তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য কথাটা বলেছিলাম।
আরে না। আমি আসলেই রাগ করিনি।
কিভাবে বুঝব?
কিভাবে বেঝাব বল?
একটু হেসে-
অমনি বাধভাঙা জলের মত খলখলিয়ে হেসে উঠত মেয়েটি। মুক্তোর মতো দাঁতগুলো ঝিলিক দিত। আবারো কলকল- কথা কয়ে উঠত মেয়েটি। -এ কথা যেন কোনদিনও ফুরোবে না। অনেক কিছু বলত মেয়েটি-
তোমাদের গ্রামে একবার আমাকে নিয়ে যাবে? তোমার বাড়ির পাশের সেই পাহাড়ে -জান; আমি পাহাড় দেখিনি কখনো- সূর্যাস্ত দেখিনি। কতদিন ভেবেছি; পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে লাল হয়ে আসা সূর্যকে দেখব- কোনদিন দেখা হয়নি। আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?
আবীর নিয়ে যাবে।সে অবশ্যই প্রমাকে নিয়ে যাবে। মেয়েটা পাহাড় দেখতে চেয়েছিল- তাকে অবশ্যই পাহাড় দেখাবে সে। -একটা তীব্র উন্মাদনা তাকে পেয়ে বসে। প্রমার বাবা-মার সামনে যখন সে প্রমাকে স্ট্রেচারে তুলে করিডোর ধরে ছুটছিল; দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে প্রমাকে তুলে ড্রাইভারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে রাজপথে নেমে পড়েছিল; তখনো সে বুঝে উঠতে পারেনি সে কি করতে চলেছে। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। উন্মাদ হয়ে পড়েছে আবীর- ভয়ঙ্কর রকমের উন্মাদ।
সত্যি সত্যিই সে উন্মাদ হয়ে পড়েছে। নীরিহ ট্রাক ড্রাইভারটি কে সামলে উঠার সুযোগ দিচ্ছে না সে। ট্রাক ড্রাইভারটি তখনো বুঝেনি তার দোষটা কিসে! কতবার সে এভাবে রাস্তার উপর ট্রাক রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা বাইওে কাটিয়েছে- কেউ তো কখনো কিছু বলেনি! গ্রামের রাস্তা- গাড়ি-ঘোড়া খুব একটা নেই; মাঝেমধ্যে রিক্সা চলে। সে কিভাবে বুঝবে এমন অসময়ে এতবড় একটা গাড়ি এখানে চলে আসবে! অপমান নীরবে সয়ে মাথা নীচু করে লোকটি গাড়ি স্টার্ট দেয়। একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় রেয়ার ভিউ মিররে একবার চোখ রেখে দেখে নেয়- শহরের লোকটা তেমনই হিংস্র; তেমনই একরোখা। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার- সাথে সাথেই সচকিত হয়ে উঠে সে; এই বুঝি লোকটা তেড়ে এল।
কাঁচামাটির পথে ধুলো উড়িয়ে যখন আবীর পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছল, সূর্য তখন সৌম্যদর্শন। অগ্নিদৃষ্টির বদলে সে মুখে স্নিগ্ধ হাসি। সে মুখপানে চেয়ে আকাশ লজ্জ্বায় লাল হয়ে উঠেছে। বুড়ো বটগাছটার কাছাকাছি এসে রাস্তা শেষ হয়ে যায়। আধমাইল দূরে সবুজ পাহাড়। গাড়ি থেকে নেমে আবীর বুকভরে শ্বাস টানে। -এই তার শৈশবের গ্রাম; কৈশরের পাহাড়। কতদিন এই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছুটে বেরিয়েছে সে; ছড়ার জলে পা ডুবিয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা। কত আগে- মনে হয় এই তো সেদিন। বাইরের সবকিছুই বদলায়- সেকেন্ডে সেকেন্ডে; পাহাড়টা তেমনই আছে। তার আসা সার্থক। প্রমাকে পাহাড় দেখাতে পারছে সে।
অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে ভিতরে গেল আবীর। প্রমার কপালে আলতোভাবে হাত রেখে আস্তে করে ডাকল ’প্রমা’। -প্রমার কোন ভাবান্তর নেই। কাঁধ ধরে আস্তে করে ঝাঁকুনি দিল আবীর। ঘুমকুমারী এবার চোখ মেলে চাইল। স্নিগ্ধ দুটি চোখ অপলক তাকিয়ে রইল আবীরের দিকে। সে চোখে যন্ত্রণা নেই- প্রশান্তির ছায়া। আবীর নিচু গলায় বলে-
তুমি পাহাড় দেখবে বলেছিলে না! আকাশের বুক ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড়কে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলে না! দেখ প্রমা- তোমার সামনে সবুজ পাহাড়। এইখানে- এই পাহাড়ের বুকে লুকিয়ে আছে আমার প্রথম পনেরটি বছর। এইখানে জড়িয়ে আছে আমার কান্না, আমার হাসি; আনন্দ-অভিমান- আমার বর্ণমালা; আমার স্বপ্নের রাজহাঁস, ভালোবাসার নীল বেলুন- আমার জীবনের স্পন্দন। দেখ প্রমা; একটিবার চোখ মেলে দেখ!
প্রমা তেমনই নীরব। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি- যেন বা কোন এক মা তার সন্তানের অহেতুক পাগলামি দেখে পশ্রয়ের হাসি হাসছে। আবীর তখনো বলে চলছে- বিরামহীন; যেন তার সমস্ত কথা; আটাশ বছর ধরে স্মৃতিভান্ডারে জমা হওয়া সবকয়টি শব্দ; পাতার পর পাতা ভরে লিখে চলা মিথ্যার মধ্যে যতটুকু সত্য- তার সবই সে উগরে দিবে। আবীর তখনো বলছে-
আমি জানি, তুমি প্রচন্ড অভিমানী। কিন্তু, কেন তুমি অভিমান করে থাকবে! একবারও কি ভেবে দেখেছ- এটা সম্ভব কিনা? হ্যাঁ! আমি চাইলেই এটা পারতাম। তারপর- । তরপর কি হত?
প্রমার ভাবান্তর নেই। তার স্নিগ্ধ চোখজোড়া তখনো তেমনভাবে আবীরের চোখে। দিনের পর দিন ধুঁ ধুঁ মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর পর আকষ্মাৎ মরুদ্যানের দেখা পেয়ে সে চোখজোড়া স্তম্ভিত। আবীরের চোখের সরোবরে প্রাণভরে সাঁতার কাটছে তারা।
আবীরের উন্মাদনা আরো বেড়ে যায়। প্রমার দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয় সে। কান্নার সুরে বল-
তুমি কি কিছুই বলবে না প্রমা। আমি জানি তুমি কি বলতে চাও। কিন্তু, অহেতুক পাগলামি করছ তুমি। সমাজ পৃতি পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াত। কিভাবে সেই বাধার দেওয়াল অতিক্রম করতাম আমরা!
প্রমার মুখে সেই স্নিগ্ধ হাসি; চোখজোড়া তেমনই অপলক। হঠাৎ করে আবীর নির্বাক হয়ে পড়ে। ভাবান্তও ঘটে তার; সে কি কোন ভুল করল- বড় রকমের ভুল! প্রমা তো কোনদিন তাকে এ ধরনের কথা বলেনি। যে মেয়েটা একটু পর মরে যাবে, কেন সে তাকে এসব শোনাচ্ছে! সে কি হেরে যাচ্ছে? দিনান্তের প্রান্তে তার নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে কোন এক মৃতপ্রায় মেয়ের কাছে সে কি হেরে যাচ্ছে?
প্রমা নড়ে উঠে। দু-হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে সে। আবীরের সবকয়টি স্নায়ু সচকিত হয়ে উঠে। প্রমার পিঠের নিচে হাত দিয়ে আবীর তাকে তুলে ধরে। শুকনো ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠে একবার। -কিছু বলতে চায় সে। প্রমার কষ্ট হচ্ছে- ভীষণ কষ্ট। চোখের পাতা যেন ভারী পাথর; আর বুঝি কোনদিন সে চোখে সবুজ ভাসবেনা। আবীর নির্বাক। কানদুটো সচকিত তার- এই বুঝি প্রমা কিছু বলল-
অবশেষে প্রমা কথা বলে। প্রায় বন্ধ হয়ে আসা চোখের পাতা মেলে আবীরের চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে ’ভালোবাসি’! এতটুকুই- তারপর এলিয়ে পড়ে আবীরের কাঁধে। একরাশ কালচে রক্তে ভরে উঠে আবীরের পিঠ। -আবীর হেরে গেছে। নিজের কাছেই হেরে গেছে সে- ।
সূর্যটা লাল হয়ে আসে; একসময় হারিয়েও যায়। দিনান্তের প্রান্তশেষে বহুদূরের মাটির ঘরে একটি একটি করে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠে। প্রমাকে কাঁধে নিয়ে তেমনই বসে থাকে আবীর- অনন্তকাল ধরে বসে থাকবে সে। তার বুকের ভিতর এখন ঝড় নেই- শুধু একটি ঘূর্ণি; গ্রীষ্মের দুপুরে পাক খেয়ে উঠতে থাকা সাদা ধুলোর ঘূর্ণি।
মন্তব্য
১ম পর্ব পড়া হয়নি। ২য় পর্ব পড়ে ১ম পর্বটা পড়ার ইচ্ছা জাগলো।
আপনার লেখার হাত কিন্তু দারুন।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
নতুন মন্তব্য করুন