গুগলপ্লেক্সের প্রধান ক্যাফেতে প্রতিদিন দুপুরে বা বিকেলে যেতাম ... ওখানকার ৫ রকমের বিভিন্নদেশী খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এই ক্যাফেটার নাম "চার্লি'স ক্যাফে" ... জানতে চেয়েছিলাম একদিন, চার্লিটা কে? জানলাম, চার্লি ছিলো গুগলের প্রথম বাবুর্চি। যখন গুগলের মোট কর্মী সংখ্যা দশ বিশ জন, তখন যোগ দেয়া চার্লি বেতনের বদলে গুগলের কিছু শেয়ার পেয়েছিলো। যখন স্টক মার্কেটে গুগল শেয়ার ছাড়লো বছর কয়েক আগে, ততদিনে সেই সব শেয়ারের দাম হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার। সেই মিলিয়নিয়ার চার্লি আজ গুগল থেকে অবসর নিয়ে নিজের রেস্তোঁরা খুলতে পেরেছে, কিন্তু তার নাম রয়ে গেছে।
গুগলে কাজের পালা শেষ হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। তিনটা চমৎকার মাস সেখানে কাটাবার পর বুঝতে চেষ্টা করলাম, কেনো গুগল এতো প্রচন্ড সফল হয়েছে দুনিয়ার সেরা সব প্রোগ্রামারদের আকর্ষণ করতে। শুধু তিনবেলা মজাদার খাবার নিশ্চয় এর কারণ না ... অথবা গুগলের মহামূল্যবান শেয়ার/স্টকও প্রধান কারণ হতে পারে না। সিলিকন ভ্যালির অনেক কোম্পানিরই স্টক/শেয়ারের দাম তর তর করে বাড়ে। তাহলে ব্যাপারটা কী?
ভেবে চিন্তে যেটা মনে হলো, গুগলের প্রধান সাফল্যের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আর কর্মীদের কাজ করার অশেষ স্বাধীনতা দেয়া। এখানে সবাই সপ্তাহে একটা পুরো দিন পায় নিজের ইচ্ছা মতো কোনো কিছু নিয়ে কাজ করার। সেটা গুগলের কাজে আসুক বা না আসুক, কোনো সমস্যা নেই। এমনকি অন্য কাজের ডেডলাইন থাকলেও সপ্তাহে ঐ এক দিন সবাই পাবেই। আরো দেখেছি, পারস্পরিক সম্মান দেয়া। দেশে থাকতে দেখতাম, কোম্পানির মালিক তো বটেই, অফিসের বড়কর্তা তাদের অধীনস্ত সবাইকে "তুমি" বলে সম্বোধন করছে, আর অন্য সবাই বড়কর্তাদের হুজুর-সালাম দিয়ে চলেছে। কিন্তু গুগলে যেদিন ক্যাফের সাধারণ কর্মীদের খাবার লাইনে আমার ঠিক সামনে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনকে অন্য সবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তখন বুঝলাম এখানে পদমর্যাদার জোর খাটানো নেই। অফিসে গ্রুপের মিটিং থেকে শুরু করে সর্বত্র এটা অনুভব করেছি ... তিন মাসের জন্য আসা শিক্ষানবিশ ইন্টার্ন বলে আমার মতামতকে কেউ অবজ্ঞা করেনি, বরং যুক্তিসঙ্গত মতামত, অভিমত - এসব সবাই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
কর্মীদের অজস্র সুবিধা দেয়া, তিনবেলা রাজভোগ খাওয়ানো, কনফারেন্স বাইকে আড্ডা - এসবের মাধ্যমে মানুষ অফিসে বসে থাকছে সারাদিন, তা সত্যি, কিন্তু আসল কাজের উদ্দীপনা আসছে কাজের পরিবেশ, আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেয়ার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। আর সেই সাথে মজা করার অসংখ্য সুযোগ তো আছেই ... দুই দিন পর পরই অফিসের সবাই হই চই করে ঘুরে বেড়াতো বিভিন্ন স্থানে। আমার এই তিন মাসের মধ্যেই ৪টা অফিস পিকনিক হয়েছে ... আর অন্য সময় একেবারে স্কি-করার ট্রিপ থেকে শুরু করে আরো অনেক চমৎকার অফ-সাইট ট্রিপ হয়ে থাকে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের কোম্পানি মিটিং এর কথা আগেই বলেছি ... সেটাও এক বিশাল পার্টি। আর গুগলে কাজ করে নানা দেশের নানা ধর্মের লোকজন ... সবার জন্যেই সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে। চীনা আর কোরীয় খাবারের উপরে আলাদা আলাদা একটা করে ক্যাফে তো আছেই, আর সেই সাথে বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন হয় মূল ক্যাফেতেও। আমি থাকার সময় ভারতের ৬০তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে চার্লি'স ক্যাফেতে বিশাল খাবার দাবারের আয়োজন হলো। আবার শুক্রবারে মুসলমান কর্মীদের জন্য বিশেষ হালাল খাবারের ব্যবস্থা দেখেছি। শুনেছি, রমজান মাসে ক্যাফে গুলোতে ইফতারের ব্যবস্থাও করা হয় মুসলমানদের জন্য।
গুগলের কর্মী সংখ্যা আজ ছাড়িয়ে গেছে ১০ হাজারের উপরে। তবে একটু মন খারাপ হলো এটা ভেবে, শিশির, সবুর, আর অল্প দুই-একজন ছাড়া এখানে বাংলাদেশী কর্মী নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই। যে কয়দিন কাজ করেছি, মনে হয়েছে, এখানে কাজ করার মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান প্রোগ্রামারের রয়েছে। আমি আশাবাদী ... ভবিষ্যতে, বছর কয়েক পরেই গুগলে বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাণবন্ত মুখের আবির্ভাব ঘটবে। ভারতের বাঙ্গালোর, দিল্লী, আর হায়দরাবাদের মতো বাংলাদেশেও গুগলের গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হবে।
---
অনেক মজার, অনেক স্মৃতির শেষে গুগলে কাজের পালা শেষ হলো আমার আগস্টের ১৭ তারিখে। শেষের দুই তিন দিন আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে কেটে গেলো, আমার হোস্ট রিচার্ড আর ব্রায়ানের সাথে পুরো অফিসের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো বিভিন্ন স্থানে। একেবারে শেষ দিনে গুগলপ্লেক্সকে বিদায় জানাতে বেশ খারাপ লাগছিলো। তবু জীবনের গান চলতেই থাকে, ঘুরতে থাকে প্রযুক্তির স্রোতে গুগলের কর্মীদের অবগাহন, এগিয়ে চলে পৃথিবী।
(ছবিতে, কোনো এক সকালে আমার অগোছালো ডেস্ক, আর শেষ দিনের পিকনিকে আমার সহকর্মী রিচার্ড ও ব্রায়ানের সাথে আমি)
মন্তব্য
গুগলে মাগনা খাওয়ার ব্যাপারটাই সবচেয়ে ভালো লাগলো ...। আমাদের দেশে সীমিত পরিসরে এমন জিনিস চালু করা উচিত।
হাঁটুপানির জলদস্যু
জীবনে কখনও কোথাও চাকরি করিনি (ছাত্রজীবনে ছুটিতে লন্ডনে বাঙালিদের রেস্টুরেন্টে কাজটা হিসেবে না আনলে), এবং চাকরি করার ইচ্ছেও কখনও হয়নি। কিন্তু আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, যোগ্যতা থাকলে এবং সুযোগ পেলে গুগলে কাজ করতাম সাগ্রহে।
পুরো সিরিজটাই সোৎসাহে পড়লাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
অপেক্ষা করছিলাম শেষ পর্বটির জন্য...ভালো লাগলো
@হিমু ভাই,
আমাদের দেশে চালু করলে লাল বাত্তি জ্বলার চান্স আছে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
সিঙ্গারা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। পাইলট প্রকল্প আর কি।
হাঁটুপানির জলদস্যু
সহমত। আমিও সিঙ্গারার কথাই ভাবছিলাম। খুবই পছন্দ হয়েছে সিরিজটা।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
গুগল জুরিখ অফিসের ভিডিও - ভাবই আলাদা।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
পুরো সিরিজটাই গোগ্রাসে গিললাম! অসাধারণ গুগলের পরিবেশ! ইস! যদি গুগলে কাজ করার সুযোগ পাই! একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে।
ফেরারী ফেরদৌস
নতুন মন্তব্য করুন