বুয়েটের ডঃ এম এ রশীদ হলে আমি আসি ১৯৯৭ সালে, বুয়েটে ভর্তির শুরুতেই। অন্য সব হলের চেয়ে এটা নতুন, মাত্র বছর বিশেক আগে তৈরী। কিন্তু অন্য সব হলের চাইতে এটার রুমগুলোর আকার অনেক ছোট। চারটা বিছানা আর চারটা টেবিল গায়ে গায়ে লাগানো, বারান্দা শুধু সামনে (অন্য হলের রুমগুলোতে দুই দিকে থাকতো)। গুজব চালু আছে, এই হলের দক্ষিণ দিকের পিছনেই আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থাকাতে নাকি এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, হলের হাভাতে ছেলেপেলেদের টাংকিবাজি বন্ধ করতে ...
কথা অবশ্য মিথ্যা না। আমাদের ফ্লোরে, চার তলাতে, থাকতেন এক ভাই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই উনার কাজ ছিলো বারান্দাতে হাঁটাহাটি আর হাত নাড়ানাড়ি স্কুলের যেটুকু দেখা যায়, তার দিকে।
হলের বাসিন্দারা বেশ বিচিত্র রকমের। ক্লাস শেষে অনেকেই টিউশনিতে গিয়ে রাত দশটায় হলে ফিরতো। তার পর খাওয়া দাওয়া আর আড্ডাবাজি। বুয়েট মনে হলেই যে আঁতেল ছেলের দল ছবিটা আসে, যে কারো এই ধারণা পাল্টাতে রাতের দিকে রশীদ হলে একদিন গেলেই চলবে। অবশ্য আঁতেল ছেলে কিছু আছে। পাশের রুমের বিশিষ্ট আঁতেল এক ভাই থাকতেন, টোফেল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য জোরেশোরে “ফাইট“ দিচ্ছিলেন। একদিন দেখি রুমে হেডফোন লাগিয়ে বসে আছেন, আর সামনে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙ্গানোঃ “এখানে টোফেল পরীক্ষার লিসেনিং এর প্রেক্টিস চলিতেছে। দয়া করিয়া ডাকাডাকি করিয়া বিরক্ত করিবেন না“ (হুবুহু)। পরে একদিন এই আঁতেলকে দেখি গজগজ করতে আর জানালা দিয়ে ঢিল ছুড়তে। উনি সকালে উঠে পড়া শুরু করেন, কিন্তু কাক ও অন্যান্য পাখির ডাকে নাকি উনার পড়াতে বিঘ্ন ঘটে।
রশীদ হলের অনেক কথা গল্প করার মতো, রীতিমত একটা বই লেখা যাবে। যাহোক, বুয়েটের অন্য সব হলের চাইতে এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলোঃ এটাই একমাত্র হল যেখানে বিয়ে ও মৃত্যু - এরকম দুইটি বড় ঘটনা ঘটেছে।
মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক। মরহুম সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ছেলে সুবর্ণ আমাদের হলে থাকতেন। একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায় প্রচন্ড চিৎকার ও চিল্লাচিল্লি শুনে বেরুলাম। জানলাম, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সুবর্ণ ভাই আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর রুমমেট রুমে ঢুকতে না পেরে পিছনের দিকের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে উনাকে ফাঁস দেয়া অবস্থায় দেখে। এই ঘটনার পরে অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হলের ছেলেপেলে পরের কয়েক সপ্তাহ ভুত দেখতো প্রায়ই। হলের সেই রুমটাকে (১০৭) পরে লন্ড্রি রুম বানিয়ে ফেলা হয়।
আর বিয়ের ঘটনা? হলের এক ভাই তার ছাত্রীর সাথে বিশাল প্রেম করে, পরে কেটে পড়েছিলেন। মেয়ের বাবা মা ইঞ্জিনিয়ার জামাইকে ছাড়তে চাননি। তাই একদিন দল বেঁধে হলে এসে হাজির। ঐ ছেলেকে রুম থেকে ধরে এনে গেস্ট রুমে বিশাল আলাপ আলোচনা, অবশেষে কাজী ডেকে গেস্ট রুমেই বিয়ে পড়ানো। হলের সব ছেলেপেলে রাত ৩টার সময় ঘুম থেকে উঠে এসে বিয়ে দেখে ও মিষ্টি খেয়ে গিয়েছিলো।
এরকম হাজারো অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছি আমার রশীদ হল জীবনে। আমার দুই রুমমেট মিলে মেসের চোর ম্যানেজারের বিছানা পুড়ানো, সনি হত্যার পরে হলে পুলিশী রেইড, বিভিন্ন ধরণের চোরের উৎপাত - আরো কত কি। ঐ যে বললাম, পুরো একটা বই লেখা যাবে এর উপরে।
মন্তব্য
হা হা... হো হো... হি হি... হে হে... হই হই...
আরো আরো লেখা চাই...
---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।
---------------------------------
বাঁইচ্যা আছি
এরকম ঘটনা তো বোধহয় লাখে একটাও ঘটে না। আত্মহত্যা তাও মাঝে মধ্যে হয়। কিন্তু হলের গেস্ট রুমে বিয়ে পড়ানোর এই ঘটনা বোধহয় বাংলাদেশে এটাই একমাত্র। মজা পাইলাম।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমার হাই স্কুলে এমন ঘটনা ঘটেছিল। বালিকা বিদ্যালয়ের দুটি মেয়ে আর বালক বিদ্যালয়ের দুটি ছেলে এক সাথে নিখোঁজ হয়। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে সবাই বুঝতে পারে ঘটনা কি! কয়েকদিন পর এক জুটি ফিরে এলে মেয়েটিকে স্কুলে নিয়ে আসেন ওর বাবা মা। ছেলেটির বাবা মা কে খবর দিয়ে আনা হয়,কাজী ডাকা হয়,মেয়েটির জন্য লাল শাড়ীও আনা হয়। আর অবশেষে.........বিয়ে দেয়া হয়। এক বছর পর শুনতে পাই ওদের এক ছেলেও হয়েছে।
-স্নিগ্ধা করবী
হিহিহি ... বেশ interesting ... আরো ঘটনা বলেন
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে
শুকনা খাওয়ার কোন তথ্য আসে নি বলে মাইনাস দিলাম ।
মাইনাস দেয়ার সিস্টেম আছে নাকি?
আমারো দেয়ার ইচ্ছা ছিল
শুকনা কি? ইহা ক্যাম্নে খায়?
---------------------------------
খাইতে হলে জানতে হবে
জেবতিক ভাইরে বলতে হবে...
মজার তো !
একটা একটা করে ছাড়তে থাকেন দেখি...
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ইন্টারেস্টিং!!!
রাগিব ভাই,
বইটা লিখেই ফেলেন......
-------------------
কালবেলা
রাগিব ভাই, দারুন লিখেছেন। আমি গত চার বছর ধরে তিতুমীর হলে থাকি। আমি নিশ্চিত, রশীদ হলের অনেক ছাত্রও এ ঘটনা বা পটভূমিগুলো জানেনা...আপনার আরও লেখা আশা করছি...
আমিও রশীদ হলের, তবে সংযুক্ত। রশীদ হলের আলাদা একটা ইমেজ আছে বাকি সব হলগুলোর তুলনায়, এটা আমিও অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি।
সাম্প্রতিক কালে, দুঃখের স্মৃতি বলতে একটাই। অল্প কিছুদিন আগে ফিস্ট ছিলো, আমি ভুলে মিস করে ফেলেছি। অনেক দুঃখ।
রাগিব ভাই, চাইবো আর লিখুব এই ব্যাপারগুলি নিয়ে- কিছুদিন আগে সাপ্তাহিক ২০০০ এ একজন বিখ্যাত স্থপতির বুয়েট জীবনের ডায়েরি ছাপা হয়েছিল যা পড়ে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়েছিল। একটা তুলনা আপনা আপনি করা হয়ে যায় - এত দীর্ঘ সময়ে ছাত্রদের মূল চরিত্রের কেমন পরিবর্তন হল। তাই আপনার লেখার আশায় থাকলাম।
-----------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
আমার কাছে সব হলগুলোর মধ্যে আহসানউল্লাহকে বেশী বৈচিত্রপূর্ণ মনে হয়। আমার সিট ছিল সোহরাওয়ার্দীতে, কিন্তু কখনো থাকি নি। থাকার প্রয়োজন হলে আউল্লাতেই থাকতাম। সব হলে টিভি রুম একটা, আউল্লাতে দুই ব্লকে দুইটা। আমি যেতাম উত্তর ব্লকে, ঐখানে পাব্লিকের ভীড় কম, টিটি টেবিল সবসময় খালি পাওয়া যেত। সব হলের মধ্যে কেবল আউল্লাতেই একদিন মহিলারা গেস্ট রুম পার হয়ে অন্দরমহলে ঢুকতে পারে, স্বরসতী পূজার দিন। পোলাপানের ওই দিন থাকত আসল ঈদ :D। আউল্লায় আলম ভাইয়ের দোকানের ছানা আর সুইস বন এখনো মিস করি :(। আর ক্যান্টিন ভাল ছিল সবচেয়ে নজরুলে। রাত দশটার পর নজরুলে আমার মত বহিরাগতদের জন্য স্পেশাল ডিনারের ব্যবস্থা করত। হলের ছেলেপিলে মিল বাদ দিয়ে খেতে আসত।
আউল্লাতেও আমাদের সময় একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। সিএসইর তন্ময় তার রুমে সুইসাইড করেছিল। অথচ একদিন আগেও আমরা একসাথে ক্রিকেট খেলছিলাম! ছেলেটাকে দেখে তখন কিছুই বুঝিনি। শুনেছিলাম পারিবারিক ঝামেলার জন্য তন্ময় আত্মহত্যা করেছিল। আসলে কি হয়েছিল? সিএসই-তে পড়া একটা ছেলেও যে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করতে পারে-এটা ছিল একটা চরম ধাক্কা। বুয়েটে আরো অনেককে অবশ্য পাগল হয়ে যেতেও দেখেছি। বুয়েটের এসব অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সচেতন হওয়া উচিত। আর বুয়েটের ডাক্তারগুলার যা অবস্থা! ভাল ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ এনে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা রাখা জরুরী।
=============
"আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে"
এটা ঠিক বলেছেন ভাইয়া। বুয়েটে ভাল ডাক্তার নেই। মেয়েদের আবার মহিলা ডাক্তারের কাছে পাঠায়। সবেধন নীলমণি সেই মহিলা ডাক্তার আবার গল্পে বিশেষ পারদর্শী হলেও চিকিৎসায় তার আগ্রহ আর পারদর্শীতা (!) বলাই বাহুল্য।
ভাল লাগলো।
কাল থেকে মনটা খারাপ হয়েছিলো - মোনাজাত উদ্দিনের ছেলের ঘটনাটা পড়ে। খুবই দুঃখ জনক।
বুয়েটের সবচেয়ে বড় ধরনের ট্যাজিক ঘটনাগুলো ঘটে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহনের পর। দুই সেমিস্টার একসাথে পরীক্ষা নেবার ফলে অনেক ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলো।
সেই ইতিহাস বড়ই করুন।
লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?
সুখপাঠ্য লেখা।
সিরিজের আগামী পর্বগুলো দ্রুত চাই।
সপ্তাহে কমপক্ষে ২টা।
[আর বুয়েটের ডাক্তারগুলার যা অবস্থা! ভাল ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ এনে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা রাখা জরুরী।]
"বুয়েটের ডাক্তারগুলিও বুয়েট থেকেই পাশ করা" - এরূপ জনশ্রুতি প্রচলিত আছে
রাগিব ভাই,
দারুন লাগল...হল জীবনের কথা মনে করিয়ে দিলেন।
আহা কি দারুনই না ছিল দিনগুলি।
ধন্যবাদ রাগিব সুন্দর লেখার জন্য। মোনাজাতউদ্দিনের ছেলের ঘটনা পেপারে পড়েছি, দুঃখজনক একটা ঘটনা।
বিভিন্ন ব্যাচের ও হলের স্মৃতিচারণ চালু থাকুক, ভালো লাগে পড়তে।
তাসনীম
--------------------------------------
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ছাত্রী হলেও ১১০ নম্বর রুমে কেউ একজন আত্মহনন করেছিল। ওই ব্লকে ভূত দেখার জনশ্রুতি আছে। ইদানিং আবার ১১০ নম্বর রুমের ঠিক উপরে তিন তলার ব্লকে একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কারো কারো মতে ১১০ নম্বর রুমের ওই আত্মার প্ররোচনায় এই ঘটনা ঘটেছে!!!!
-স্নিগ্ধা করবী
এককথায় দারুণ
---আশফাক আহমেদ
আমার পুরো মনে আছে , দুপুর বেলা তন্ময় দার রুম এর সামনে গেছি চিত্কার শুনে , বিশ্বজিত দা রুম ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকলো , তান্ময়দা ঝুলে আছে সিলিং এ, কোনদিন ভুলবো না .
-----------------------
আনন্দম!
আনন্দ
সুন্দর লিখেছেন রাগিব ভাই। বড়ই হিংসে হয় হলজীবনের লেখা পড়লে। সারাজীবন বাড়ি থেকেই পড়াশুনা করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে হলে বন্ধুদের কাছে যেতাম, দারুন মজা হতো। বেশিরভাগই যাওয়াই হতো তাশ খেলতে আর ভিজে-শুকনো সেবন করতে।
রাতঃস্মরণীয়
নতুন মন্তব্য করুন