তারিফ এজাজের স্বপ্ন, আর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: মঙ্গল, ১৭/০৭/২০০৭ - ৬:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
তারিফ এক কিশোর, ঢাকার এক কলেজে সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা পেরুনো। বছর খানেক আগে ওর সাথে ইমেইলে আমার পরিচয়। বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে বিস্তর ইমেইল চালাচালি, লেখালেখির পর মুনির ভাইয়ের কল্যাণে প্রথম আলোতে এই নিয়ে কিছু নিবন্ধ বেরিয়েছিলো ২০০৬ সালের মার্চ আর এপ্রিলে।

সেই লেখার দৌলতে বেশ কিছু উৎসাহী তরুণ যোগ দেন বাংলা উইকিপিডিয়া প্রকল্পে, বিপুল উদ্যমে কাজ শুরু করেন। আর বাংলা উইকিপিডিয়ার পাশাপাশি ইংরেজি উইকিপিডিয়াতেও বাংলাদেশের উপরে নিবন্ধের কাজ শুরু করেন অনেকে।

এর মধ্যেই একদিন তারিফ ইমেইল করে আমাকে। তখন কলেজে এইচএসসিতে পড়ুয়া তারিফ জানায় তার স্বপ্নের কথা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দুনিয়ার সব মানুষের কাছে জানানোর স্বপ্ন। এই স্বপ্ন নিয়ে তারিফ কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো সর্বত্র ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়েনি, তাই ওকে প্রশ্ন করেছিলাম ওর ইন্টারনেট সংযোগের কথা। ওর জবাব শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেলাম - তারিফের কোনো কম্পিউটার নেই। গ্রামীণের মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে মোবাইল ফোন দিয়েই ও ইন্টারনেট ব্যবহার, এবং উইকিপিডিয়াতে লেখালেখি করে থাকে। এতো প্রতিকূলতার পরেও নানা বইপত্র ঘেঁটে, অনেক তথ্য যোগ করে তারিফ কাজ করে চলে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ভাষা আন্দোলনের নিবন্ধটির উপরে। মাঝে টেস্ট পরীক্ষা, ও অন্যান্য ব্যস্ততার মধ্যে একটু বাঁধা পড়ে এই কাজে।

ডিসেম্বরে আমি দেশে যাই এক মাসের ছুটিতে। ঐ সময় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির আয়োজিত বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতামালায় উইকিপিডিয়ার উপরে বক্তব্য রাখি। অনুষ্ঠান শেষে এক তরতাজা কিশোর ছুটে আসে আমার কাছে। এতোদিন ইমেইলে পরিচয় ছিলো, সেদিন মুখোমুখি হলাম তারিফের। অনেক উৎসাহের
সাথে ও বলে গেলো, ভাষা আন্দোলনের নিবন্ধটিকে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার ফীচার্ড আর্টিকলে উন্নীত করা।

এইচএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসলে আমিই তারিফকে বারণ করি, কিছুদিন পড়ার দিকে মন দিতে। পরীক্ষা শেষে মাস দুয়েক আগে, তারিফ আবার কাজ শুরু করে নিবন্ধটার উপরে। বাংলাদেশের অনেক নিবন্ধের উপরে কাজ করা ভারতীয় বন্ধু উইকিপিডিয়ান নীরব মৌর্যের চমৎকার সম্পাদনা, আর তারিফের তথ্য যোগাড় - এই দুই নিয়ে নিবন্ধটা তরতর করে আগাতে থাকে। নীরব মাঝে ডানপন্থী ভারতীয় ট্রোলবাহিনীর চরম আক্রমণে অভিমান করে উইকিপিডিয়া ছেড়ে যায়। তখন তারিফকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসি আমরা অন্যান্যরা। ঢাকার আদিত্য কবীর, কলকাতার দ্বৈপায়ন ও রিয়ানা, এবং খুঁটিনাটি সম্পাদনায় অভিজ্ঞ অনেক বিদেশী লেখক। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ঘেঁটে অনেক জার্নাল ও অন্যান্য বইপত্রের রেফারেন্স বের করি। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় তারিফের চরম উৎসাহ, আর সারাদিন ধরে লেগে থাকা।

উইকিপিডিয়াতে ফীচার্ড আর্টিকেল হিসাবে নির্বাচিত হতে হলে কঠিন এক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দাড়ি-কমা, বাক্য, তথ্যসূত্র - সবকিছুকেই যাচাই-বাছাই এর মধ্য দিয়ে পেরুতে হয়। প্রায় মাস খানেক ধরে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছিলো নিবন্ধটা। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি সুসংবাদ - নিবন্ধটা ফীচার্ড আর্টিকেলের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে - এখন ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সেরা সব নিবন্ধের তালিকাতে এটাও যুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে, আমাদের ইতিহাস নিয়ে দুনিয়ার মানুষের কাছে তথ্য যায় খুব কমই। আমরা নিজেরা না জানিয়ে অন্য বিদেশীদের সেই দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকি, আর সত্যের বদলে অপপ্রচার, মিথ্যা সব কথা প্রচার করে এই সব বিদেশীরা। আমাদের ইতিহাস, আমাদের জীবন-ঐতিহ্যের কথা প্রকাশের চেষ্টা করতে হবে আমাদেরকেই। তারিফ এজাজের মতো উদ্যমী তরুণেরা এগিয়ে আসবে, এসব সোনার ছেলেদের চেষ্টাতে আমাদের দেশের কথা

দুনিয়ার সব মানুষ জানতে পারবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে তারিফের যেমন স্বপ্ন ছিলো, আমাদের দেশের সোনার ছেলেদের নিয়ে এটাও আমার নিজের স্বপ্ন।

(তারিখটা আজ ১৬ই জুলাই। ইমেইল ঘেঁটে দেখলাম, ঠিক এক বছর আগে, ১৫ই জুলাই, ২০০৬ তারিখে তারিফ তার ভাষা আন্দোলন প্রজেক্টের কথা বলেছিলো বাংলা উইকিপিডিয়ার মেইলিং লিস্টে)।

(তারিফ এখনো ওর সেই মোবাইল ফোনেই উইকিপিডিয়াতে লেখালেখি করে থাকে। আসলে চেষ্টা থাকলে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেক কিছু করা সম্ভব।)

(তারিফের মতো উদ্যমী তরুণেরা দেশে বসেই দেশকে দুনিয়ার সবার সামনে আনতে যা অবদান রাখবেন, আমেরিকায় বাড়ি গাড়ি হাঁকানো, মাসে হাজার দশেক ডলার কামানো, সাপ্তাহিক দাওয়াতে রাজা উজির মারা অনেকে তার সিকিভাগও রাখবেনা।

এজন্যই অনেক সময় মনে হয়, ভালো ছাত্রদের দিয়ে দেশের উপকার কমই হয়। তাই ভালো ছাত্র নয়, দেশের দরকার ভালো মানুষ।)


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

বুক ভরে গেলো। তারিফের তারিফ কীভাবে করা যায়?

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তাই ভালো ছাত্র নয়, দেশের দরকার ভালো মানুষ।

হাসান এর ছবি

খুব ভালো লাগল, আমাদের সবার পক্ষ থেকে তারিফকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দেবেন।

ধন্যবাদ।

--------------------------
আমার রুজি রোজগার

অপালা এর ছবি

লজ্জা লাগে ,নিজের কাছে

নজমুল আলবাব এর ছবি

খুব ভালো লাগলো।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

তারিফ এজাজকে অভিনন্দন ।

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

তারিফ এজাজের জন্য শুভকামনা।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

ঝরাপাতা এর ছবি

অভিনন্দন তারিফকে। দ্বৈপায়ন ভাই-এর পুরো নাম এবং একটু বর্ণনা কি দেয়া যাবে রাগিব ভাই।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অতিথি লেখক এর ছবি

তারিফ এজাজের মত ভালো মানুষকে অভিনন্দন!

ফেরারী ফেরদৌস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।