ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে যদি কয়েকদিন একটু ঢুঁ মারেন, প্রশাসকদের আলোচনা সভাতে যদি নজর বোলান, তাহলে দেখতে পাবেন সকপাপেট (sock puppet) শব্দটা। মোজার উপরে চোখ মুখ লাগিয়ে, আর তার ভেতরে হাত দিয়ে যে ধরনের পুতুলের কাজ দেখানো হয়, ইংরেজিতে সেটাকেই সক পাপেট বলে। (এসো গান শিখির মিঠু মন্টির কথা মনে আছে? ওরকমই আরকি)
ইন্টারনেটের জগতে শব্দটার অর্থ একটু আলাদা। সকপাপেট বলতে ইন্টারনেটে বোঝায়, কোনো ব্যক্তির ছদ্ম পরিচয়গুলো (বা নিক), যা ঐ ব্যক্তির আদর্শকে প্রচারের জন্য তৈরী করা। সক পাপেট গুলো দিয়ে সাধারণত নিজের মন্তব্যে অন্য অনেকে সমর্থন জানাচ্ছে, এরকম ভাব করা যায়। যেমন ধরুন, দবির এবং ছবির। দবির প্রকৃত ব্যক্তি, উইকিপিডিয়াতে বিতর্কিত কিছু লিখতে যাচ্ছেন, যার জনসমর্থন নেই। তিনি তাই নিজেই ছবির নামে একটা সক পাপেট নিক রেজিস্টার করে ঐ নিবন্ধের আলাপ বা ডিসকাশন পাতায় গিয়ে বলা শুরু করলেন, দবিরের মতকে আমি সমর্থন জানাই, উনার মতই আসল মত। অথবা নিবন্ধে অন্যদের সম্পাদনা আনডু করার যে ৩ বারের বাধানিষেধ আছে, তা এড়ানোর জন্য দবির দুইবার আনডু করার পর ছবির পর পর দুই বার আনডু করলেন।
এ হলো প্রথম প্রকারের সক পাপেট। এদের বোঝা যায় আচরণ দেখে, বলা নেই বার্তা নেই, আকাশ থেকে পড়ে যখন কেউ কোনো নিবন্ধে হাজির হয় এবং কোনো ট্রোলের মতবাদ সমর্থন করতে থাকে, বোঝা যায়, এটা ঐ ট্রোলের সকপাপেট।
দ্বিতীয় প্রকারের সকপাপেটকে বলা হয় স্ট্রম্যান সকপাপেট (strawman sock puppet)। খুব চতুর ট্রোলেরা এই রকম সকপাপেট বানিয়ে থাকে। সমর্থন করার বদলে বিরোধিতার ভাব করাটাই এই সকের কাজ। ধরা যাক, দবির কোনো নিবন্ধে বিতর্কিত কোনো মত নিয়ে ট্রোলিং করে চলেছেন। এমন সময় ছবির নামের কারো উদয় হলো, সুস্থ মনের মানসিকতার লোকদের সাথে সুর মিলিয়ে দবিরের বিরোধিতা করে ছবির কথা বলতে শুরু করলেন। এভাবে বলতে বলতে হঠাৎ ছবির এমন সব আচরন শুরু করলো, যেন ভাবখানা, দবির বিরোধী লোকজন ওরকমই খারাপ। হয়তো দবিরের বিরুদ্ধে গালাগাল বা জাতিগত বিদ্বেষী কথা দিয়ে বসলো, যাতে দবির বলতে শুরু করতে পারে, দবির বিরোধী লোকেরা এতই খারাপ। কিংবা, খুব হালকা যুক্তি দেখানো শুরু করলো, যা সহজেই দবির খন্ডন করতে পারে।
আর শেষ ধরণের সকপাপেটকে বলা হয় মিট পাপেট (meat puppet)। ধরুন, হাবিজাবি যুক্তি দেখিয়ে দবির কোনো নিবন্ধের আলাপ পাতায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তখন দবির তাঁর বন্ধু বান্ধবকে ইমেইল করে জানালো। দবিরের বন্ধু সালেহা তখন উইকিপিডিয়াতে রেজিস্ট্রেশন করে শুরুতেই ঐ নিবন্ধে দবিরের সপক্ষে কথা বলা শুরু করলো। এরকম গোটা কয়েক নতুন ইউজার যখন হঠাত করে এসে কোনো নিবন্ধে শুরুতেই কোনো ট্রোলের সাফাই গাইতে থাকে, তখন তাদেরকে বলা হয় মিট পাপেট।
উইকিপিডিয়াতে সকপাপেট একেবারেই নিষিদ্ধ। কাউকে সকপাপেট বানাতে হাতে নাতে ধরতে পারলে সাথে সাথে সকপাপেট অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়। সকের চালককে (যেমন উপরের উদাহরণের দবির) সপ্তা খানেক থেকে শুরু করে মাস কয়েকের জন্যও বহিষ্কার করা হয়। সকপাপেট ধরা যায় আচরণ দেখেই, তবে তা চুড়ান্ত প্রমাণ না। বরং চুড়ান্ত প্রমাণের জন্য আইপি অ্যাড্রেস দেখা হয়। উইকিপিডিয়া ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপারে খুব কড়া, তাই এই আইপি চেক করাটা খুব অল্প কিছু প্রশাসক, যারা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের সাথে জড়িত, তারাই কেবল পারে। আইপি অ্যাড্রেস কতো, তা অবশ্য প্রকাশ করা হয় না, সে সক পাপেট হোক, বা যাই হোক।
দক্ষিণ এশিয়ার নিবন্ধ গুলোতে ট্রোলের ছড়াছড়ি। বিশেষ করে পাকিস্তানী ও ভারতীয় ট্রোল দিয়ে ভর্তি। বিভিন্ন নিবন্ধে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা চালাতে এদের শ শ সকপাপেট গজিয়ে উঠে। এদের মধ্যে চরম কুখ্যাত হলো মার্কিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন ভারতীয় ছাত্র, মুসলিম, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সমাজতন্ত্রী ইত্যাদি সব বিষয়ে যার তীব্র ঘৃণা, তাই ডজন খানেক সকপাপেট বানিয়ে দিনের পর দিন বিভিন্ন নিবন্ধে ট্রোলিং করে গেছে। অবশেষে তার জ্বালায় টিকতে না পেরে শালিশি বৈঠক বসিয়ে তাকে বছর কয়েকের জন্য ব্যান্ড করা হয়েছে। এখনও প্রতি সপ্তাহে তার দুই একটা করে সক পাপেট আসতে থাকে।
তবে উইকিপিডিয়ার প্রশাসকেরাও সচেতন। জনমানুষের বিশ্বকোষ গড়তে হলে এরকম ট্রোল আর সক বাঁধা দিবেই। এদের এই বাঁধা পেরিয়েই গড়ে উঠবে সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার, উইকিপিডিয়া।
(ছবিটি মুক্ত মিডিয়ার ভান্ডার উইকিমিডিয়া কমন্স থেকে মুক্তি লাইসেন্সের অধীনে নেয়া)।
(উদাহরণে ব্যবহৃত দবির-ছবির, সালেহা নামগুলো চিনতে পারছেন? "আইন আদালত" অনুষ্ঠানে গাজী শামসুর রহমান উদাহরণ দিতে ব্যবহার করতেন।)
মন্তব্য
পড়ে বেশ মজা পেলাম। ব্যাপারগুলো দেখেছি কিন্তু ফর্মাল কোন নাম আছে তা জানতাম না।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
বুঝলাম, পৃথিবীতে অনেক লোকের কোনো কাজ নেই আর তাদের গঠনমূলক কাজ করার কোনো ইচ্ছাও নেই। তবে জিতবে গঠনমূলক কাজই, সে ছবির আর দবির যতই উতপাত করুক।
ননটেকি লোক হিসেবে পড়ে মজা পেলাম। ধন্যবাদ।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'
মরা হাতি লাখ টাকা। - রাগিব = প্রজন্ম ফোরামের একজন মৃত মডারেটর হিসেবে
-- জাঝা তথ্যমূলক এবং কাজের প্রবন্ধের জন্য।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
দারুণ লাগলো পড়ে।
অদ্ভুত!
ব্যাপারটা এইভাবে জেনারালাইজ করা যায়, জানতাম না।
-- দবির এর সক পাপেট
চমৎকার লাগল পড়ে। এসব বিষয় জানিয়ে ব্লগিং অব্যাহত থাকুক। আমাদের তাতে অনেক লাভ। আচ্ছা... হ্যাকিং সম্পর্কে লেখা যায় না? মজাদার সব লেখা!
..................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
valo laglo ... choltey thakuk. Avro uninstall koresi, bangregi tey type korlam.
pura ekta biplob dilam!
--------------------------
আমার রুজি রোজগার
ভাল লাগলো পড়ে। ই-বাউন্সার জীবন আপনার...
চমৎকার লেখা! কত কিছুই জানি না!
কি মাঝি? ডরাইলা?
নতুন মন্তব্য করুন