[এই লেখাটা ২০০৫ সালে হৃদয় নামে বুয়েটের কম্পিউটার কৌশলের একজন ছাত্রকে নিয়ে।এর ইংরেজি সংস্করণ দৃষ্টিপাতের ব্লগে প্রকাশ পেয়েছিলো গত বছর।]
২০০৫ সালের জুন মাসের কথা।
বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের একটা মেইলিং লিস্ট ও ওয়েবসাইট রয়েছে। ওখান থেকেই হঠাৎ জানতে পারলাম আমরা, বুয়েটের প্রথম বর্ষের একটা ছেলে, আতিকুর রহমান হৃদয় খুব অসুস্থ, হাসপাতালে আছে। ওর জন্য বি পজেটিভ রক্ত দরকার। দুই দিন পরে খবর পাওয়া গেলো, এক দিন অন্তর অন্তর ওকে ৪-৫ ব্যাগ রক্ত দেয়া লাগছে। আর তার পরের দিনেই খবর এলো, হৃদয়ের লিউকেমিয়া হয়েছে! বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত ওর বাবার পক্ষে ৪০-৫০ লাখ টাকা জোগাড় করে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন করাটা রীতিমত অসম্ভব।
খবরটা পড়ে খুব খারাপ লাগলো। ৪০-৫০ লাখ টাকা কিন্তু খুব এমন বেশি টাকা না, যে প্রবাসীদের জন্য সবাই মিলে জোগাড় করা সম্ভব না। তাই আমার পরিচিত, বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী যারা আছেন বিদেশে, সবাই মিলে আলোচনা করলাম, কীভাবে এটা করা যেতে পারে।
ঠিক হলো, এখান থেকে যা পারা যায়, টাকা তুলে পাঠানো হবে। সেজন্য বাংলাদশের সাথে সম্পর্কিত যতগুলো মেইলিং লিস্ট পেলাম, সবখানে ইমেইল করে হৃদয়কে বাঁচানোর জন্য সাহায্যের আবেদন জানালাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন বুয়েটে আমার দুই বছরের সিনিয়র তামারা আপু, উনি মাইক্রোসফট ও ইন্টেলে উনার সহপাঠিদের জানালেন।
শুরুতে চিন্তা ছিলো, আদৌ সাড়া পাওয়া যাবে কি না। কিন্তু অভাবনীয় সাড়া পেলাম অল্প কয়েক দিনেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থান তো বটেই, কানাডা, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিরা আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। এই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে বড় একটা ধন্যবাদ , পে-প্যালের মাধ্যমে আমরা সাহায্য সংগ্রহ করছিলাম। তাই অনেকেই খুব সহজে টাকা পাঠাতে পেরেছেন।
শুধু অবস্থাপন্ন চাকুরীজীবিরাই নন, হৃদয়ের চিকিৎসা তহবিলে সাহায্য দিয়েছিলেন ছাত্র থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের অনেক প্রবাসীও। আমি ৫ ডলার থেকে শুরু করে ৩০০ ডলার পর্যন্ত সাহায্য পেয়েছি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে। আর মাইক্রোসফট ঘোষণা করলো, হৃদয়ের জন্য মাইক্রোসফটে কর্মরত বাঙালিরা যে পরিমাণ সাহায্য দিবে, মাইক্রোসফট গিফট ম্যাচিং প্রোগ্রামের আওতায় তার সমপরিমাণ অর্থ সাহায্য দিবে।
প্রায় শ খানেক মার্কিন প্রবাসীর কাছ থেকে দিনে ১০-২০টা করে চেক পাওয়া, সেগুলো ব্যাংকে জমা দেয়া, পে-প্যাল থেকে সংগ্রহ, এভাবে করতে করতে আমার নিজের গবেষণার সময় থেকে দিনে ৫-৬ ঘন্টা সময় ব্যয় হচ্ছিলো। কিন্তু তবুও যতটা সম্ভব জনসংযোগ, ইমেইলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার, এসব করছিলাম, কারণ দরকারী টাকার তুলতে আরো সময় লাগবে। দেশে বিভিন্ন সংস্থা , যেমন গ্রামীণ ফোন, বাংলাদেশ ব্যাংক, একটেল, বুয়েটের ছাত্ররা - এরা সবাই সাহায্য করেছে।
যখন আমার একার পক্ষে এই কাজটা চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ালো, তখন ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক বাংলাদেশী সাহায্য সংস্থা স্পন্দন-বি এর সাথে যোগাযোগ করলাম। স্পন্দন-বি বাংলাদেশে অনেক সাহায্য প্রকল্প চালিয়ে থাকে, তবে তারা কখনো কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য এরকম সাহায্য সংগ্রহ করেনি বা করতে চায় না। কিন্তু হৃদয়ের জন্য মানবিক কারণে তারা রাজি হলো। আমিও আমার সংগ্রহ করা সব অর্থ ওখানে পাঠিয়ে দিলাম। বাংলাদেশে প্রথম আলোতে আনিসুল হক বেশ কিছু নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেগুলো পড়ে আরো অনেক বাঙালি স্পন্দন-বি কে সরাসরি সাহায্য প্রদান করলেন। অবশেষে আমার সংগ্রহ করা আর এই সাহায্য মিলিয়ে মোট সংগ্রহের পরিমাণ দাড়ালো ৪৫ হাজার ডলার।
হৃদয়কে চিকিৎসার জন্য নেয়া হলো সিঙ্গাপুরে। সেখানে চিকিৎসা চললো, এবং ওর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য অপারেশন হলো, কেমো থেরাপি চলতে লাগলো। এটা বেশ সময়ের ব্যাপার, তার পরেও সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় হৃদয় অবশেষে সুস্থ হয়ে উঠার পথে এসেছে। এবারে দেশে গিয়ে খবর নিলাম, হৃদয় ভালো আছে। মাঝে মাঝে কেমোথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসাজনিত কাজের জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে হচ্ছে। তার পরেও ওর জীবনটা রক্ষা পেয়েছে।
হৃদয়ের চিকিৎসা তহবিল সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক বাঙালি আমাকে ফোন করে আধা ঘন্টার মতো রীতিমত জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করতে চেয়েছেন, এটার সত্যতা কতটুকু। পে-প্যাল এ এতো টাকা অর্থ সাহায্য আসছে দেখে আমাকে ফোন করে এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখেছে। (আমার ধারণা এতো টাকা পয়সা আসা দেখে হয়তোবা মার্কিন বিভিন্ন সংস্থাও খবর নিয়েছে, আমার অজান্তেই )।
কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি আমি, মানুষের ভালোবাসা ও মমতা দেখে। অজানা অচেনা একটা ছেলের জীবনকে বাঁচানোর জন্য সবার প্রচন্ড মায়া, আর আগ্রহ দেখেছি। অস্ট্রেলিয়া থেকে স্টিভ ওয়াহ (হ্যাঁ, ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহ!!) হৃদয়কে চিঠি লিখেছিলেন। আর আমাকে চিঠি লিখেছিলেন টেক্সাস থেকে এক মার্কিন মহিলা। উনি বাংলাদেশী প্রতিবেশীর কাছে হৃদয়ের কথা শুনে আগ্রহ ভরে ৫০ ডলার পাঠিয়েছিলেন, আর একটা চিঠি লিখে হৃদয়কে বিধাতার উপরে বিশ্বাস রেখে আশার আলোয় থাকার কথা বলেছিলেন। এসব মহানুভব দাতাদের কথা ভোলার মতো না।
(প্রথম প্রকাশ - সামহয়ারিনব্লগ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭)
মন্তব্য
এইসব জানতে পারলে পৃথিবীটাকে কতো সুন্দর মনে হয়!
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এখন কি অবস্থা হৃদয়ের? কোন আপডেট জানেন কি?
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
হৃদয়ের গল্প অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো ...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
আমার জীবনের অন্যতম স্মরনীয় ঘটনার নাম "হৃদয়"। হৃদয় আমার ব্যাচমেট, যদিও আমি ওকে ব্যক্তিগত ভাবে এখনো চিনি না, তার উপর ও কম্পিউটার আর আমি ইলেকট্রিক্যাল।
আমার এখনো খেয়াল আছে সেইদিনের কথা যেইদিন শুনলাম সি এস ই এর এক সহপাঠী অসুস্থ। সেইসব দিন এর কথা টাকা সংগ্রহের। সারা দিন ক্লাস করে সারা বিকাল সন্ধ্যা যেত ওর জন্য টাকা সংগ্রহে।বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই কত রাত। আমার উপর দায়িত্ব ছিলো একটা মেগা সাইজ কনসার্ট করার। ব্যান্ডগুলোর সাথে যোগাযোগ করা, তাদের বিনা টাকায় গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করা,ইভেন্ট ম্যানাজমেন্টের সাথে কথা বলা----সব মিলিয়ে অন্য রকম ব্যস্ত এক সময় আমার জীবনের। যদিও পরে পলিটিক্যাল হস্তক্ষেপে ৯০% কাজ হয়ে যাওয়ার পর ও আমি কনসার্টটি করতে পারিনি, করেছিল ছাত্রদল , অবশ্য টাকাও উঠেছিল অনেক। কিন্তু তার কতটা হৃদয়ের পরিবার পেয়েছিল জানি না ।
পারি বা না পারি, সেই সময় অদ্ভুত একটা বিশ্বাস এসেছিল আমার মধ্যে। হেরে যেয়েও হারটাকে স্বীকার না করার। হৃদয় তাই আমার জীবনের এক অন্যরকম মাইলফলক।
-------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
অসম্ভব ভাল লাগল কথাটা।
ফেরারী ফেরদৌস
বাঃ, শুনেই কি ভাল লাগছে ...
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পড়েছিলাম।
নতুন মন্তব্য করুন