প্রায় দশ বছর পর গত ২৮ নভেম্বর ২০১০ এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় আইভরি কোস্টে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট লোরঁ বাগবো এ নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলাসান উয়াত্তারার কাছে পরাজিত হন। নির্বাচন কমিশন আলাসান উয়াত্তারাকে জয়ী বলে ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘ এই রায় সমর্থন করে। কিন্তু লোরঁ বাগবো দেশের উত্তরাঞ্চলে কারচুপি হয়েছে এই অজুহাতে আলাসান উয়াত্তারার জয়কে মেনে নিতে অস্বীকার করেন (উল্লেখ্য, দেশের উত্তরাঞ্চলে উয়াত্তারার সমর্থন বেশি, দক্ষিণে বাগবোর)। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল বাগবোকে সরে যেতে অনুরোধ জানায়। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নানাভাবে চাপপ্রয়োগের পরেও বাগবোকে টলানো সম্ভব হয় না। উয়াত্তারার সমর্থক সন্দেহে সেনা হামলায় প্রচুর বেসামরিক জনগণ মারা যায়। ওদিকে বাগবোর সমর্থকদের উপর উয়াত্তারা-বাহিনী হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন লোরঁ বাগবো। আমাদের ক্যাম্পের পাশেই অবস্থিত জাতিসংঘের হাসপাতালে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই গুলিবিদ্ধ নিরীহ আইভরিয়ানদের ভিড় লেগেই আছে। ইদানিং উয়াত্তারা-অনুগত সেনারাও আহত হলে কাছেপিঠে থাকলে এ হাসপাতালেই আসে।
নির্বাচন পরবর্তী ক’মাস জাতিসংঘ বাহিনীর উপরে মুক্ত চলাচলে বাধাপ্রদান করেছে বাগবো-অনুগত সেনারা। বাগবোর বেসামরিক জঙ্গি সমর্থকদের দ্বারা জাতিসংঘের গাড়ি ভাংচুর ও পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশী কারো গুরুতর কিছু হয় নি।
কয়েক মাস এই অচলাবস্থা চলার পর আলাসান উয়াত্তারার অনুগত বাহিনী FRCI (এরা সাবেক বিদ্রোহী সেনাদল, আগের নাম ছিলো FAFN) উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে শহরগুলো দখল করতে করতে নামতে থাকে, তেমন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই। আবিদজান আইভরি কোস্টের বাণিজ্যিক রাজধানী ও বাগবোর সবচে’ শক্ত ঘাঁটি। এখানে এসে তারা পৌঁছায় ৩১ মার্চ, এবং এখানেই তারা প্রথম বড় কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এ ক'দিনের যুদ্ধ শেষে বাগবো-অনুগত সেনাদের মনোবল ও প্রতিরোধ কমে এখন তলানিতে। কিন্তু বাগবো তার আগের অবস্থানেই এখনও অটল।
এ ক’মাস শান্তিরক্ষীদের উপর কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসেনি, হলেও বিচ্ছিন্ন। কিন্তু উয়াত্তারার অনুগত বাহিনী আবিদজানে ঢোকার দ্বিতীয় দিন থেকে জাতিসংঘ বাহিনীর উপর বিচ্ছিন্ন আক্রমণগুলো বাগবোর অনুগত সেনারা বাড়িয়ে দেয়। ২ এপ্রিলে জর্ডানিয়ান ব্যাটালিয়নের একটা কনভয় টহল করার সময় এমন একটা আক্রমণে তাদের ৪ সৈনিক গুরুতর আহত হলে জাতিসংঘ হার্ডলাইনে যেতে বাধ্য হয়। ঘটনাটা ঘটে আমাদের ক্যাম্প তথা জাতিসংঘ মিশন হেডকোয়ার্টারের খুব কাছে। এই ক্যাম্পের পাশেই বাগবোর অনুগতদের একটা ক্যান্টনমেন্ট আছে (ছবি নিচে), সেটার দখল নেয়ার চেষ্টা করছে উয়াত্তারার বাহিনী। গত ৩১ মার্চ থেকে আমাদের ক্যাম্পের খুব কাছে দু’পক্ষের খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে থেকে থেকে। বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর, মাঝেমধ্যে বোঝা অসম্ভব হয়ে পড়ে আমাদের ক্যাম্প দু’দলের ক্রসফায়ারে, নাকি আমরাই লক্ষ্য। বাংলাদেশের সেনারা কোন ঝুঁকি না নিয়ে বাগবোর অনুগত বাহিনীকে সশস্ত্র জবাব দিচ্ছে, মিশন হেডকোয়ার্টার থেকেও অনুমতি আছে। সুখবর এই যে এখনও বাংলাদেশীদের মধ্যে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আমাদের ক্যাম্প ও জাতিসংঘ মিশন হেডকোয়ার্টারের জন্যে সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাপার ছিলো যখন আর্টিলারি শেল এ অঞ্চলের আশেপাশে পড়তো দু’দিন আগেও। এখানেও বিভ্রান্তি কাজ করছিলো যে এগুলোর লক্ষ্য জাতিসংঘই কিনা। জাতিসংঘ এই ধরণের আকস্মিক আর্টিলারি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে ফ্রান্সের কাছে হেলি-অ্যাটাকের জন্যে সাহায্য চায়, কারণ এর সাথে আইভরিয়ান বেসামরিক ও জাতিসংঘের বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জড়িত। গত পরশু সন্ধ্যায় ফ্রেঞ্চ অ্যাটাক হেলিকপ্টার আর জাতিসংঘের গানশিপ হেলিকপ্টার (ইউক্রেনিয়ান পাইলট দ্বারা চালিত) দিয়ে আক্রমণ চালানো হয় বাগবো-অনুগত বেশ ক’টি সেনাক্যাম্পে। এ আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো বাগবোর সেনাদের আর্টিলারি অ্যাটাক পয়েন্টগুলো নিষ্ক্রিয় করা, যা সফল হয়।
গতকাল (৫ এপ্রিল) গুজব ছড়ালো বাগবো নাকি আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছেন এবং জাতিসংঘের কাছে তার ও তার বাহিনীর জন্যে নিরাপত্তা চেয়েছেন। তার জেনারেলরাও আর যুদ্ধ করতে চাইছেন না এবং তাদের সেনাদের অস্ত্র জমা নেয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের সাথে কথা বলেছেন। দ্বিতীয় খবরটা গুজব নয়, কিন্তু বাগবোর কাছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি আবারও নানা শর্ত জুড়ে দেন, এমন কি আলাসান উয়াত্তারাকেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিতে এখনও অস্বীকৃতি জানিয়েই যাচ্ছেন তিনি।
গতকাল থেকে খানিকটা ঠাণ্ডা পরিস্থিতি (টুকটাক গুলির শব্দ সারাক্ষণই আসে, ওগুলো পাত্তা দিলে চলে না) আর বাগবোর আত্মসমর্পণের গুজবে বেশ খোশমেজাজে ছিলাম। সকালে বাসার সাথে কথা বলার জন্যে স্কাইপে লগিন করেছি। হঠাৎ কাছেই কোথাও তুমুল গুলিবিনিময়ের শব্দে প্রিফ্যাব কেঁপে উঠলো। অভ্যাসমতো লাফ মেরে উঠে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেট চড়িয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে গেলাম। পরে জানা গেল, সেনেগালের একটা মিলিটারি কনভয় যখন জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারের নিকটবর্তী, পাশের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাগবো অনুগত সেনারা কনভয়ের উপর গুলি চালায়। সেনেগালিজ সৈন্যরা প্রায় সাথে সাথেই আরো ভারী অস্ত্র দিয়ে জবাব দেয়। একই লক্ষ্যে বাংলাদেশী সৈন্যরাও গুলি চালায়। এর একটু পর মিশন হেডকোয়ার্টারে সিদ্ধান্ত হয় ইউক্রেনিয়ান পাইলটদের দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আবার হেলি-অ্যাটাক করানোর। উল্লেখ্য, এই ক্যান্টনমেন্টেই (ছবি নিচে) দু’দিন আগে ফ্রেঞ্চ আর্মির হেলিকপ্টার গাইডেড মিসাইল ছোঁড়ে। শেষমেষ ইউক্রেনিয়ান দু’টো হেলি ক্যান্টনমেন্টের উপরে অনেকক্ষণ চক্কর মারলেও গুলি করার মতো কোন টার্গেট পাওয়া যায় নি বলে পাইলটরা জানায়।
আজ উয়াত্তারার অনুগত সেনারা বাগবোর প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস আক্রমণ করেছিলো, বিবিসি থেকে মাত্র জানলাম তারা তা দখলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দ্বিতীয় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানা গেছে বাগবো সেখানে একটি বাংকারে অবস্থান নিয়েছেন (যা বিবিসিতে অস্বীকার করেছেন বাগবো)। আপাতদৃষ্টিতে বাগবোর আত্মসমর্পণ বা ধরা পড়া এখন সময়ের ব্যাপার। দেখা যাক কী হয়।
আজ একটা পোস্টে উঠে মুঠোফোনে কিছু ছবি তুলেছিলাম। স্পষ্ট আসেনি, তারপরও দিচ্ছি কিছু।
১। ক্যান্টনমেন্টের (টিলার ওপাশে) উপরে চক্কর দিচ্ছে জাতিসংঘের হেলিকপ্টারঃ
২। আক্রমণের সম্ভাব্য উৎসের দিকে অস্ত্র তাগ করে রেখেছে শান্তিরক্ষীঃ
৩। আমাদের ক্যাম্পের একাংশ, দূরের হলুদ বাড়িটা UNOCI হেডকোয়ার্টারঃ
মন্তব্য
কামনা করি আপনি এবং আমাদের বাংলাদেশী সৈনিকেরা সুস্থ্য ও নিরাপদ থাকুন। আরো কামনা করি বহু বছর ধরে চলা গোষ্ঠীগত সহিংসতার হাত থেকে নিরীহ আইভরিয়ানরা মুক্তি পাক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে। এই সময়টার উপরেই আইভরিয়ানদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে।
কদিন আগেই বইমেলায় দেখা হলো তোমার সাথে। আর এখন তুমি রীতিমত যুদ্ধক্ষেত্রে!
এসব ঝামেলা শেষ হলে চলে সোজা চলে এসো দেশে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
সব ঠিক থাকলে জুলাইয়েই আসতে পারব আশা রাখি।
আশে পাশে আস্তেসি সামনে, ঘানাতে। চলে আসিস পারলে...
ধন্যবাদ আপনাকে। তবে আইভরিয়ানদের সমস্যাটা ঠিক গোষ্ঠীগত না বরং রাজনৈতিক।
এটা পাণ্ডবদা'র মন্তব্যের জবাব ছিলো। এখানে আসলো কিভাবে বুঝতে পারছি না।
তাই নাকি? কবে? এফবিতে জানায়েন।
আপনার না এবছর সব ক্ষ্যান্ত দিয়ে দেশে ফেরার কথা ছিল? যাই হোক সুস্থ থাকুন।
সব মানুষ ভালো থাকুক...
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
জুলাইয়েই ফেরার কথা। ধন্যবাদ অনার্য ভাই।
সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন।
...........................
Every Picture Tells a Story
শুভকামনার জন্যে অনেক ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।
টিভিতে ও রেডিওতে এই বিষয়ে খবর শুনছি। পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ।
সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন এই কামনা করছি।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনারা সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদে ফিরে আসুন, এটাই প্রত্যাশা।
শুভকামনার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ আপু।
কী অবস্থা!
নিজের খেয়াল রাখবেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
আপডেট দিও নিয়মিত।
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
আচ্ছা।
আপনারা সবাই সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন এই কামনা করছি।
love the life you live. live the life you love.
শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ, তাপস ভাই।
ভাল লেগেছে । ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন