উইন্টার, ২০১৫
পেন কানাডার কানাডায় নির্বাসিত লেখকদের ই-মেইল লিস্টে থাকার সুবাদে নির্বাহী পরিচালক তাসলীম থরের মেইল পেলাম UNHCR কানাডা প্রধানের এর সাথে মিটিং এর জন্য টরোন্টো থেকে রাজধানী অটোয়া যাবার পথে। কানাডিয়ান লেখক ও কবি জয় কোগাওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ছোটবেলার বাসায় তিন মাসের রাইটার্স ইন রেসিডেন্ট প্রোগ্রামের জন্য আবেদনের ইমেইল ফরোয়ার্ড করেছে তাসলীম। জয় কাগাওয়া ও তার পরিবারকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী কানাডিয়ান হবার কারণে বসতভিটা ছেড়ে অন্তরীন ক্যাম্পে যেতে হয়েছিলো। কাগাওয়ার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ‘Obasan’, যেখানে কাগাওয়া তার ছয় বছর বয়সের চোখে দেখা নিজ দেশে অনাহুত হবার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন উপন্যাস আকারে। আবেদন করার জন্য কানাডায় চিরস্থায়ি বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে, পূর্ব প্রকাশিত দুইটা বই থাকতে হবে, কাগাওয়ার ভ্যাঙ্কুভারের বাসায় তিন মাস থাকার সময়টায় এমন কিছু একটা লিখতে হবে যেটা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করা যায়। কানাডা আমাকে আর সামিয়াকে চিরস্থায়ি কানাডায় থাকার অনুমতি দিয়েছে, আগের লেখা দুইটা বইও আছে আর মাথার মধ্যে একটা বই লেখার চিন্তাও আছে।
সেন্টার ফর ইঙ্কোয়ারি কানাডার সিইও এরিক এন্ড্রিয়ান ভাড়া গাড়ি চালিয়ে অটোয়া নিয়ে যাচ্ছিলো, পাশে ওর স্ত্রী। পেছনের সিট থেকে ওকে বললাম যদিও বাংলায় বই লিখেছি, আগের লেখালেখিও সব বাংলায়, কাগওয়া হাউসের আবেদন করে দিব। এরিক বললো, টরোন্টো এসে ওদের সাথে যোগাযোগ করবে আমার পক্ষ থেকে। এরিকের ফোন পেয়ে কাগাওয়া হাউসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ম্যারি-এন জানালো অবশ্যই আমি আবেদন করতে পারবো। আরও জানালো, কাগাওয়া হাউস বছর জুড়ে অনেক সময় খালি থাকে, ভ্যাঙ্কুভারে থাকা খাবার খরচ কোনো সংস্থা থেকে জোগাড় করা গেলে তারা বাসা তিন বাসের জন্য ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। শুনেছি ভ্যাংকুভারের দেখতে সুন্দর, ঠান্ডা কম, বৃষ্টি বেশি। এরিক ড্রাইভ করতে করতে গ্যাজ মারলো অটোয়া পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা রাজধানী।
অটোয়া থেকে ফিরে প্রথম কাজ ছিলো ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে অভিজিৎ দার স্মরণে অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারে এরিকের সাথে বসা, বাংলাদেশি আয়োজকদের সাথে মিলে ভ্যেনু নির্বাচন, বুকিং, অনুষ্ঠানে অভিজিৎ রায়ের বই প্রদর্শনী, ছবি প্রদর্শনীর বাইরে কিভাবে একটি প্যানেল ডিসকাশন করা যায় বাংলাদেশের রক্তাক্ত ২০১৫ সালে নাস্তিক লেখকদের উপর আক্রমণ নিয়ে এবং ফেব্রুয়ারির আগেই অবিশ্বাসের দর্শনের চতুর্থ সংস্করণের জন্য ভূমিকা লেখা। শুদ্ধস্বরের আক্রান্ত প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল অন্তরিন অবস্থা থেকে বইমেলায় শুদ্ধস্বর পরিচালনা করছেন অদম্য উদ্দীপনায় তিনি চিঠি লিখে জানিয়েছেন বইটার চতুর্থ সংস্করণ করতে চান, আমি আর বন্যাপা অনুমতি দিলে। অবিশ্বাসের দর্শন বইটির তৃতীয়, দ্বিতীয়, প্রথম প্রতিটা সংস্করণই মুক্তমনা এবং বই দ্বীপে আমরা বিন্যামূল্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছি আগেই সুতরাং যে কেউ এই বই ছাপানোর অধিকার রাখেন। কিন্তু সাহস রাখে শুধু শুদ্ধস্বরই। আমি তাই শুদ্ধস্বর প্রকাশক টুটুল ভাইয়ের প্রস্তাবে সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলাম। টুটুল ভাইয়ের কাছে চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা লেখার জন্য তিনদিন সময় চাইলাম।
অবিশ্বাসের দর্শনের তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছি তো খুব বেশিদিন আগে নয়। অভিজিৎ রায়ের সাথে ২০১১ সালে এই শুদ্ধস্বর থেকেই বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো। বইটা সম্পাদনা করেছিলেন অনন্ত বিজয় দাশ। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো ২০১২ সালে। ২০১৪ সালে অভিজিৎ রায়ের তাড়ায় বইটার বেশকিছু তথ্য, অধ্যায় আপডেট করে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়েছিলো জাগৃতির ফয়সাল আরেফীন দীপনকে। নতুন করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অভিজিৎ রায়ের সাথে লিখেছিলাম বইটির তৃতীয় ও জাগৃতি সংস্করণের ভূমিকা। ভূমিকা শুরু করেছিলাম, সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশের বই সম্পর্কে একটা উক্তি টেনে-
সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘যুক্তি’ পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি সম্পর্কে ফ্ল্যাপে লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে লেখা অবিশ্বাসের দর্শন বইটি বাংলাভাষী ঈশ্বরবিশ্বাসী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, নিরীশ্বরবাদী কিংবা মানবতাবাদী এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক সবার মনের খোরাক জাগাবে। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে আগামী দিনের জাত-প্রথা-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেনিবৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষের গণজোয়ারকে এই বই প্রেরণা জোগাবে’। সে প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে আমরা জানিনা, তবে বইটি যে বহু পাঠকের হৃদয়ে একটি স্থায়ী আসন তৈরি করে ফেলেছে সেটি বলাই বাহুল্য।
অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালের সূচনা করেছিলেন, অবিশ্বাসের দর্শন প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে। তার পাঠকদের জানিয়েছেন বিভীষিকাময় ২০১৪ পেরিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন ২০১৫ এর দিকে, যেই বছরটা শুরু হলো একটা খুশীর ঘটনা দিয়ে, অবিশ্বাসের দর্শনের তৃতীয় প্রকাশ বের হয়েছে। বছর সূচনার বার্তা তিনি শেষ করেছিলেন-
মুক্তি আসুক যুক্তির পথ ধরে! জীবন হোক বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্ত”।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আনন্দ দিয়ে শুরু হলেও ২০১৫ অকল্পনীয় বিভিষিকাময় বছর হতে বেশি দেরি লাগে নি। ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখে বইমেলায় মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন অভিজিৎ রায়। অবিশ্বাসের দর্শন উৎসর্গ করা হয়েছিলো, বিবর্তনের পথ ধরে বইয়ের লেখক এবং অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদকে। কুপিয়ে আহত করা হয় তাকেও। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউ তে যখন ভর্তি বন্যা আহমেদ, তখন তাকে এক নজর দেখার জন্য সিলেট থেকে ছুটে এসেছিলেন বন্যা-অভিজিৎ এর প্রিয় মানুষ অনন্ত বিজয় দাশ। স্কয়ার হাসপাতালের নিচে ২৭ তারিখে যখন দেখা হয় তার সাথে তখন অনন্ত দার সাদা মুখটা রক্ত বর্ণ, আমাকে দেখে বল
লেন- “দাদাকে মেরে ফেললো ওরা। আমার দিদি বাঁচবেন তো!”
অনন্তদাকে স্বান্তণা দেবার ভাষা আমার ছিলো না, আমাদের কাররই ছিলো না, আমাদের অনেকেরই অভিজিৎকে হারানোর হতভম্বত এখনও কাটেনি। হামলার পর পর আমরা আতংকিত ছিলাম বন্যাআপাকে নিয়েও। অনন্তদাকে বললাম, আপনার এখানে আসাটা উচিত হয় নি এভাবে, আপনি অবশ্যই সাবধানে চলাফেরা করবেন। অনন্ত দা নিজেকে নিয়ে কোনো রকম চিন্তা করছেন বলে মনেই হলো না, আমি তবুও জোর করে জিজ্ঞেস করলাম, রাতে কোথায় থাকবেন, কবে সিলেট ফিরে যাবেন। অনন্ত দার সাথে তখন তার সহকর্মী সিদ্ধার্থ ধর ছিলো, অনন্ত দা জানালেন তারা সাবধানে ফিরে যাবেন।
সেই অনন্ত বিজয়ও সাবধানে থাকতে পারেন নি, সাবধানে থাকা মানেটাই বা কী!। জীবিকা নির্বাহে অফিসে যেতেই হবে তাকে, দেখাশোনা করতে হবে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। মে মাসের ১২ তারিখে সকালে জানতে পারলাম অফিস যাবার পথে বাসার সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনন্ত বিজয় দাশকে। অভিজিৎ দার বাবা পদার্থবিজ্ঞানী অজয় রায় ফোন দিলেন-
রায়হান অনন্তকে তো ওরা মেরে ফেলেছে
। বন্যাপা ফোন দিলেন- রায়হান গত কয়েক মাসে একটু যেনো উঠে দাঁড়িয়েছিলাম- এখন আবার সেই অতলে তলিয়া গেলাম। এবার তো তোমাকে মেরে ফেলবে।
বাবু মারা যাবার পরেই আমি কানাডার ভিসিট ভিসার জন্য আবেদন করে রেখেছিলাম। আবেদনটা আমি করলেও বাধ্য হয়েছিলাম মূলত পরিবার, কাছের বন্ধুদের কারণে। মাত্রই ছোটভাই হারিয়েছি, তাই কেউ চাচ্ছিলেন না বাবা-মারও আরেকজন সন্তানও বছর না ঘুরতেই বিদায় নেক। নিজের নামে লেখালেখি, আন্দোলন করে গেছি এতোদিন স্বাধীনভাবে কিন্তু অভিজিৎ দা এবং বাবুর মৃত্যুর পর বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে এবং যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের স্বীকার হবো, অবিশ্বাসের দর্শনের বইয়ের লেখক পরিচিতি এবং বিভাগের কাজের কারণে সবাই জানে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখন কোথায় পাওয়া যাবে। বাবুর মৃত্যুর পর তাই রাব্বানী স্যার আমার ডিপার্টমেন্টে আগমন একেবারে নিষিদ্ধ করে দিলেন, বললেন বাসা থেকে কাজ করতে। একই সাথে আমাদের ডিপার্টমেন্টের অর্থের যোগানদাতা উপসালা ইউনিভার্সিটির যেই প্রোগ্রাম থেকে আমরা টাকা পাই তাদের লিখে জানালেন, উনি আমাকে সাথে করে টরোন্টোর বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কনগ্রেসে নিয়ে যেতে চান, আমার টিকেট টিকেট কেটে দিতে হবে একই সাথে রেজিস্ট্রেশন করে দিতে হবে। উপসালার অধ্যাপক সাহেবকে স্যার আমার পরিস্থিতিও খুলে বললেন। আমাকে কনফারেন্সে নেবার জন্য যদিও স্যারের ইচ্ছাটাই প্রধান এবং ফান্ডিং এর টাকা কিভাবে খরচ হবে সেটাও তিনি নির্ধারণ করেন, তবুও সুইডিশদের জানানো প্রয়োজন ছিলো, কারণ ভিসা আবেদনের জন্য রিটার্ন টিকেট কাটতে হবে, এবং আমি যদি কানাডায় থেকে যাই তাহলে সেই টিকেটের দিন বদল বা ফেরত দিতে হবে। সুইডেনের সেই ফান্ডে তখন আমাদের জন্য বরাদ্দ টাকা প্রায় শেষ, টরোন্টোর কনফারেন্স সময় আমাদের থাকা-খাবার খরচের জন্য স্যার লিখলেন WHO এবং ACCE কে। বায়োমেডিক্যাল কনগ্রেসের পাশাপাশি এই দুইটি অর্গানাইজেশন ‘Health Technology Management’ সেমিনার আয়োজন করছে, তৃতীয় বিশ্ব, উন্নত বিশ্বর প্রতিনিধিদের নিয়ে। সেমিনারে যারা অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হবে তাদের কনফারেন্স চলাকালীন টরোন্টো ইউনিভার্সিটির নিউ কলেজ রেসিডেন্টে থাকা এবং সারাদিনের খাবার দাবারের খরচ প্রদান করা হবে। মূল সমস্যা যদি হয়ে গেলো, সেমিনারে অংশ গ্রহণের আবেদনের দিন শেষ। তবুও আমি আবেদন করতে চাই জানতে পেরে সেমিনারের কো-অর্ডিনেটর টমাস জুড আমাকে আবেদন করতে দিলেন। রাতারাতি সব কাগজপত্র রেডি করে, রাব্বানী স্যারের রিকমেন্ডেশন নিয়ে তাদের কাছে আবেদন করলাম, এবং সপ্তাহ পেরোতেই বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সেমিনারের যোগ দেবার জন্য মনোনীত হলাম। কানাডায় ভ্রমন ভিসার আবেদনের জন্য ইনভাইটেশন, বিমান টিকেট, WHO এর ফান্ডিং এর চিঠি, বিমান ভাড়া এবং কনফারেন্স রেজিস্ট্রেশনের ফান্ডিং এর জন্য ডিপার্টমেন্টের ফান্ডিং চিঠি সব জমা দিলাম বাবু হত্যাকান্ডের এক মাসের মাথায় মে মাসের পাঁচ তারিখে।
যদিও তখনও আমার একদমই দেশ ছাড়ার ইচ্ছা ছিলো না। বিশ্বাবিদ্যালয়ের অফিসে নিয়মিত রুটিনে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও তখন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র এবং মুক্তমনার সাথে মিলে অভিজিৎ রায়কে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেখানে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ করছি, সামিয়া সহ। অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়ের সাথে নিয়মিত দেখা করছি, মিডিয়া, সাংবাদিক, পুলিশের সাথে মিটিং। এসব করতে যেয়ে স্লিপিং সেলের সামনে পড়ে গেলাম একবার বিশ্ববিদ্যালয়েই যদিও যার সামনে পড়েছিলাম তার কাজ ছিলো আমাকে শুধুই ফলো করা। দুরন্ত সাহসী ছিলো সে অবশ্যই, আমাকে এসে হুমকি দিয়ে গেলো, যেনো দীপন ভাইকে বলি অবিশ্বাসের দর্শনের বিক্রি বন্ধ করতে, অভিজিৎ রায়ের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে।
যদিও ভিসার আবেদন প্রস্তুত করে রেখেছিলাম, তবুও সিদ্ধান্ত নেই নি আমি সত্যিই কানাডা যাবো কিনা। আমরা তখন প্রেগন্যান্ট এবং কিছুতেই সামিয়া ও অনাগত সোফিকে ফেলে দূর দেশে চলে যাবার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না। মে মাসের বারো তারিখে বন্যাপার ফোন পেয়ে সত্যিই মনে হলো এরপর তাহলে আমিই। সামিয়া মিনতি করলো ভিসা হলে অবশ্যই চলে যেতে। অনন্ত দাকে সুইডেন ভিসা না দিলেও কানাডা আসার জন্য আমি ভিসা পেয়ে গেলাম তার মৃত্যুর তেরো দিন পরে। জুনের চার তারিখে অধ্যাপক রাব্বানীর সাথে টরোন্টতে চলে আসি আমি। মনে আছে বন্যাপা, একের পর মেসেজ পাঠাচ্ছেন সামিয়াকে, রায়হান কী প্লেনে উঠেছে, প্লেন কী আকাশে উড়েছে। আমি নিরাপদে দেশ ছেড়েছি জেনে শান্ত হলেন তিনি। লেখক, সম্পাদককে হারিয়ে কানাডায় এসে হারালাম অবিশ্বাসের দর্শনের তৃতীয় সংস্করণের প্রকাশক জাগৃতির স্বত্তাধিকারী ফয়সাল আরেফীন দীপনকে ৩১ শে অক্টোবরে। সেই একই দিন হামলা হয় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের উপর, টুটুল ভাই প্রাণে বেঁচে যান চাপাতির আঘাত স্বত্তেও, গুরুতর আহত হন আমার এবং সামিয়ার খুব কাছের বন্ধু কবি তারেক রহিম এবং রনদীপন বসু।
অটোয়া থেকে ফিরে অনুষ্ঠানের ভেন্যু নির্বাচন শেষে বুকিং করা হলো সেন্টার ফর ইনকোয়ারির মাধ্যমে। প্যানেল মেম্বার কারা হবে এ নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটি এবং সেন্টার ফর ইনকোয়ারির সাথে কথা হলো। প্যানেল মেম্বারদের সাথে কথা বলে তাদের আগ্রহ এবং সময় সম্পর্কে জেনে, লিখতে বসে গেলাম অবিশ্বাসের দর্শনের চতুর্থ ভূমিকা, অভিজিৎ, অনন্ত, দীপন ছাড়া প্রথম। শুরুটা করেছিলাম আমার ছোট ভাই জান্নার কথা বলে। জান্না ওর ষোলবছরের জন্মদিনের পরেরদিন মৃত্যুর মাত্র বিশদিন আগে জানতে চেয়েছিলো বিগ ব্যাঙ্গ থেকে যদি মহাবিশ্বের সূচনা হয় তাহলে বিগ ব্যাঙ্গের আগে কি ছিলো। অবিশ্বাসের দর্শন বইতে আমরা ঠিক এই প্রশ্নকে উদ্দেশ্য করে ‘শুরুতে?” নামে একটা অধ্যায় রেখেছিলাম সেখানে বিগব্যাঙ্গের আগে কী ছিলো বৈজ্ঞানিক গবেষণার সর্বশেষ তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিকে আলোচনা ছিলো। আমি ছোটভাইকে বোঝালাম এবং ওকে বললাম আমার বইয়ের অধ্যায়টা পড়ে দেখতে, ও মজা পাবে। জান্না ছিলো বইয়ের পোকা, কিন্তু নন-ফিকশন পড়ার মতো পরিণত হয় নি তখনও তাই আমার বইটাও পড়ে দেখেনি আগে। আমি নিজের রুমে গিয়ে জান্নাকে পড়ার জন্য অবিশ্বাসের দর্শন বইটা খুজতে গেলাম। দুঃখের বিষয় হলো, আমার নিজের কাছ কোনো কপি ছিলো না, বন্ধু জামানের একটা কপি এনে রেখেছিলাম একটা কাজে, সেইটাই খোজা শুরু করলাম জান্নাকে দেবার জন্য এবং যথারীতি খুজে পেতে ব্যর্থ হলাম। জান্নাকে যেয়ে বললাম, পরে দিবো, যদিও সেই পরে আর আসে নি। অবিশ্বাসের দর্শন তৃতীয় সংস্করণের কপি যখন দীপন ভাইয়ের কাছ থেকে হাতে নিলাম তখন মনে হলো, ইশ জান্নাকে যদি দিতে পারতাম বইটা …
ভূমিকায় তারপর লিখলাম অভিজিৎ রায়ের কথা, কেমন করে জন্ম থেকে যুদ্ধ করে চলছেন তিনি ধর্মান্ধদের সাথে, কেমন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, নাস্তিকদের নেতা, লিখলাম মুক্তমনার কথা, লিখলাম কেমন করে মুক্তমনা, বই দিয়ে অভিজিৎ রায় আলকিত করেছেন আমার মতো অসংখ্য তরুণকে। আঠারো পৃষ্ঠার ভূমিকা লিখে সামিয়াকে পড়তে দিলাম, ঐতিহাসিক এই ভূমিকা আমি ঠিকঠাক লিখতে পারলাম কিনা না জানতে। সামিয়া পড়ে জানালো ভূমিকাটা নাকি ওর পড়া আমার সেরা লেখা, যদিও একটানে পড়ে শেষ করার মতো নয় চোখের পানির কারণে।
ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরুর আগেরদিন সকালে প্রকাশককে ভূমিকাটা পাঠালাম। এবার বাকি কাজ উনার। রাতে বাসায় বেড়াতে এলো সেন্টার ফর ইনকোয়ারির মাইকেল ডি ডো এবং সিএফয়াইসির এর স্বেচ্ছাসেবক সুযি। মাইকেল যখন বাসায় এসেছে তখন বাংলাদেশে বইমেলার প্রথম প্রহর। মাইকেল বাংলাদেশ সম্পর্কে সব প্রায় জেনে গেছে এখন, সব না জানলেও জেনে আমাদের বইমেলার কথা, আমাদের প্রাণের মেলার কথা, শত হুমকি থাকা স্বত্তেও যে প্রাণের মেলায় অংশ নিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন আমাদের অভিজিৎ রায়। অভিজিৎ, বাবু, নীল, দীপনকে ছাড়া আবার বইমেলা শুরু করেছে বাংলাদেশ, এক নতুন বই মেলা। যেই বইমেলা শুরুর আগেই সংবাদ সম্মেলন করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক লেখক প্রকাশকদের উস্কানীমূলক বই প্রকাশ না করতে হুমকি দিয়েছেন একই সাথে গর্ভ ভরে ঘোষণা করেছেন দশটি বইয়ের লেখক এবং শতাধিক বইয়ের প্রকাশক মৌলবাদীদের হামলায় নিহত অভিজিৎ, দীপনকে স্মরণের জন্য বইমেলায় কিছুই করা হবে না। মাইকেলের মন বিষাদে ছেয়ে গেলো, অভিজিৎ দার মৃত্যু আমাদের মতো ওকেও নাড়া দিয়েছিলো খুব এবং সে কারণেই পুরো বছর বাংলাদেশের লেখকদের জন্য কাজ করে গেছে ও। অথচ যেই বাংলাদেশ তাদের লেখকদের হারালো, সেই বাংলাদেশ মৌলবাদ তোষণের পথেই আছে।
মাইকেল, সুজি, আইসিএফএস এর আরমান রশীদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে রাত গভীর করলাম, আগামীকাল আমার কোগাওয়া হাউসের আবেদন জমা দেবার শেষ দিন। এখনও কিছুই প্রস্তুত করি নাই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে ছুটলাম। কি কি ফাইল লাগবে সেগুলো পড়লাম, একে একে ড্রাফট প্রস্তুত শুরু করলাম ফেব্রুয়ারির এক তারিখে, রাত বারোটায় আবেদন জমা দেবার শেষ সময়। নেদারল্যান্ডসের বই মেলার জন্য অভিজিৎ রায় কে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। বইটা ইংরেজিতে হবে বিধায় প্রথমবারের মতো নিজের একটা লেখা ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য সাহায্য চাইতে হলো প্রিয় সুব্রত শুভ’র কাছে, শুভ ২০১৩ সালে আটককৃত চার ব্লগারের একজন, যার মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপি জনমত তৈরি করে সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। শুভ রাশেদ উল্লাহ নামে কানাডা প্রবাসী এক বাংলাদেশির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, ও লেখাটা নিয়ে সাতদিনের মধ্যে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিবে বললো। অফিসে বসে কাগাওয়া আবেদনের বই প্রপোসাল লেখার সময়ই রাশেদ মোল্লার ইমেইল পেলাম,অসুস্থতা স্বত্তেও সে অনুবাদটা করে পাঠিয়ে দিয়েছে। আবেদনের সাথে নিজের লেখার স্যাম্পল পাঠাবার কথা ছিলো, ওর অনুবাদটা পেয়ে স্বস্তি পেলাম, তাও ভালো বিচারকদের বাংলা লেখা পাঠাতে হচ্ছে না। রেসিডেন্সি প্রপোজাল, সিভি, কি কি বিষয়ের উপর লেখালেখি করবো তার তালিকা, আমার বই দুইটার রিভিউ, তিনজন রেফারেন্স, ইংরেজিতে অনুবাদ করা দুইটা লেখা যার একটা সামিয়া করে দিয়েছেন একত্র করে এরিককে পাঠালাম দুপুর একটার দিকে। জানালাম শেষ সময় আসতে আর বেশি দেরি নেই। এরিক তখন খুব অসুস্থ, আর তাছাড়া আমি ওকে পর্যাপ্ত সময়ও দেই নি। তবুও অসুস্থতার মধ্যে ও ফাইলগুলো পড়ে ফোনে মতামত জানালো, একই সাথে কোগাওয়া হাউসের সাথে কথা বললো, দুই দিন পরে রিভাইজড ফাইলগুলো পাঠানো সম্ভব হবে কিনা। এন ম্যারি রাজী হয়ে গেলো সাথে সাথেই। আমি এরিকের পরামর্শ মোতাবেক ফাইলগুলো আরেকটু ঠিকঠাক করে শেষ সময়ের আগেই আবেদনপত্র জমা দিলাম কোগাওয়া হাউসের ওয়েবসাইটে। অসুস্থতার স্বত্তেও রাত দশটা পর্যন্ত এরিককে জাগিয়ে রাখলাম, কারণ আবেদনপত্রের সাথে পাঁচ ডলারের একটা এপ্লিকেশন ফি পাঠানো প্রয়োজন, আমার ক্রেডিট কার্ড নেই, এরিক সিএফআই এর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টাকাটা পাঠাবে বলে আমার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। সোফিকে রাখতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম আবেদনগুলো নিয়ে বসতে, এরিককে বললাম ঘুমিয়ে যেতে। পাঁচ ডলার বিল দেবার জন্য আমার ভার্চুয়াল ক্রেডিট কার্ডের উপর নির্ভর থাকলাম, যদিও মনে সংশয় অনেক জায়গাতেই এই ভার্চুয়াল ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্ট গ্রহণ করা হয় না। কাগাওয়া হাউসে গিয়েছিলো অবশ্য।
পরেরদিন এরিক আমার ফাইল, লেখাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে কারেকশন জানালো, আমি একে একে ঠিক করতে থাকলাম। দুপুরে হঠাৎ ফোন আসলো অপরিচিত নাম্বার থেকে, কানাডার চ্যাম্পিয়ন দার্শনিক এবং পেন ইন্টারন্যাশনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন রালস্টোন সউলের সহকারী রবার্তো ফোন দিয়েছে জানাতে, পরেরদিন জন এবং প্রাক্তন গভর্ণ জেনারেল রাইট অনারেবল এড্রিয়ান ক্লার্কসনের বাসায় আমি, সামিয়া এবং সোফির আমন্ত্রণ। বাসার উপরের সোফিকে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে যদি ও নিচে সবার মধ্যে সস্তি না পায়।
আমি অবশ্য রবার্তোর ফোন পেয়ে আকাশ থেকে পড়লাম। কারণ আগামীকাল যে এমন দুইজন মানুষের সাথে দেখা করতে যাবার কথা আমার সেইটাই আমি জানি না! আসলে তাসলী ফোনে বলেছিলো, অনুষ্ঠানের কথা আমি সাথে সাথেই রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ইমেইল ইনভাটেশন ইনবক্সের কোথাও লুকিয়ে ছিলো বলে আমার চোখে পড়েনি। রবার্তোর ফোন রেখে সাথে সাথে তাসলীমকে ফোন দিলাম, তিন তারিখে জন আর এড্রিয়ানার বাসায় কিসের প্রোগ্রাম এবং কখন প্রোগ্রাম। তাসলীম সাথে সাথে ইমেইলটি ফরোয়ার্ড করে দিলো। জন, এড্রিয়ানার বৈঠকখানায় পেন কানাডার পৃষ্ঠপোষকদের ছোট মিলন মেলা, সাথে ফ্রি হিসেবে এই টেকনোলজি যুগে ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের নানা অবস্থা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস কলামিস্ট ফরহাদ মানজু এবং স্টিফেন মার্সির বৈঠকী আলোচনা, আলোচনা মডারেট করবেন কানাডার খ্যাতনামা সাংবাদিক রেচেল গিজ।
৩ তারিখে খুব সকালে উঠে গেলাম। কফি বানিয়ে বসে গেলাম, এরিকের পাঠানো কাগাওয়া হাউসের এপ্লিকেশনের ফাইলগুলো মধ্যে থেকে নিজের লেখার অনুবাদটা ঠিকঠাক করে সব রিভিশন ফাইল কাগাওয়া হাউসকে পাঠালাম। বারোটা থেকে সোফির সাথে থাকা, শেখার জন্য লিভিং এন্ড লার্নিং উইথ বেবি ক্লাস। সোফিকে দেখে মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না ও আসলে আমাদের মেয়ে না কানাডার মেয়ে। ওর জন্মানোর সময় হাসপাতালের খরচ থেকে ওর চিকিৎসা, ওষুধপত্র ফ্রি তো বটেই, একই সাথে প্রতি সপ্তাহে পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে হোম ভিজিট, নানা ধরণের সেমিনার, ক্লাস, ওয়ার্কশপ, সব ফ্রি। যাই হোক, ওর সাথে কিভাবে খেলতে হবে, কি করলে ওর মস্তিষ্ক ডেভেলোপমেন্টে সহায়তা হবে, কিভাবে খাওয়াতে হবে, কি খাওয়াতে হবে এসব জানার আগের ক্লাসটা আমি মিস করেছিলাম অটোয়া থাকায়। কাগাওয়া হাউসের আবেদনের কাজ শেষ করে দ্রুত সোফিকে রেডি করে ফেললাম ক্লাসে যাবার জন্য। ফিরে এসেই রওনা হতে হবে জন এড্রিয়ানের বাসার উদ্দেশ্যে। সামিয়া ঠিক করলো ও শাড়ি পরবে, বেচারি একটাই শাড়ি নিয়ে আসতে পেরেছিলো দেশ থেকে, সেটা ঠিকঠাক করে আমরা সোফিকে নিয়ে সোফির সাথে কিভাবে থাকবো তা জানতে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ক্লাসটা আমাদের দুইজনের চেয়ে সোফিই বেশি মজা পেলো। ক্লাসে আসা অন্যান্য বাচ্চাদের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো, খেলাধূলার সময়ে খিল খিল করে হাসবো বাবা-মার দিকে তাকিয়ে। ক্লাসের শেষ করে দুপুর চারটার দিকে বাসায় ফিরে আসলাম। ছয়টায় থাকতে হবে জনের বাসায়। সারাদিন খাওয়া হয় নি ঠিকমতো তিনজনেরই, আমি আর সামিয়া খেয়ে নিলাম, তারপর সোফি। সময় যেনো ফুরাবার গতি বাড়িয়ে দিলো, দেখতে দেখতে সাড়ে পাঁচটা। সাবওয়তে করে যেতে ত্রিশ মিনিটই টাইম লাগার কথা, কিন্তু সাবওয়ে স্টেশনে যেতে হবে, আবার স্টেশন থেকে জনের বাসায় যেতে হবে। আমরা যখন সাবওয়ে স্টেশনে যাচ্ছে তখন দেখলাম, সারিবদ্ধ ট্রেনের সারি, টরোন্টোর বিখ্যাত সাবওয়ে জ্যাম। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে আমাদের ট্রেনটা ছাড়লো, সেই ট্রেনে সেন্ট জর্জ যেতে যেতে বেজে গেলো সাড়ে ছয়টা, সেখান থেকে আরও দশ মিনিট পর গিয়ে দাঁড়ালাম জন এড্রিয়ানার বাসার সামনে, আমি আর সামিয়া একে অন্যের দিকে তাকাই, এতো দেরি করে আসায় আমাদের ঢুকতে দেবে তো!
বাসায় ঢোকার জন্য সিড়ি ভাঙ্গতে হবে, সেটা আমাদের জন্য সমস্যা না হলেও সোফিকে স্ট্রলারে বসিয়ে ওঠাবার উপায় নেই, আমি স্ট্রলার থেকে কার সিট আর সোফি সহ রুমের ভেতরে রওনা দিলাম, ফিরে এসে স্ট্রলারের বাকি অংশ তুলে নেবো। সেটা অবশ্য করতে হলো না, একজন ভদ্রলোক নিজে থেকে স্ট্রলারটা ভাজ করে জনের বাসার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের কোট রাখার জন্য দুইজন স্বেচ্ছাসেবী দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের হাতে কোট দিয়ে আমি আর সামিয়া বাসায় ভেতরে ঢুকতেই দেখা পেলাম তাসনিমের। তাসলীমের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো গত বছরের শেষে পেন কানাডার বর্ষপূর্তি পার্টিতে, আর ওর সাথে সামিয়া আর সোফির এখনও দেখা হয় নি। আমাদের সাথেও দেখা হয় নি, তাসলীমের অনাগতের, যিনি এখন মায়ের পেট থেকে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবার জন্য বড় সড় হয়েছেন। তাসলীম সামিয়াকে আর সোফিকে হেলো বলে আমাদের নিয়ে গেলো বসার ঘরে, যেখানে একটা সোফায় বসে জন কথা বলছিলেন- ইথিওপিয়ান তিন জন আক্রান্ত লেখকের সাথে। তাসলীমের ডাকে জন উঠে দাঁড়ালো এবং দেরি করার জন্য আমাদের বের করে না দিয়ে সোফিকে কোথায় রাখা যাবে তা দেখিয়ে দিলো। একই সাথে জানালো, সোফি এখানে স্বস্তিবোধ না করলে উপরের একটি রুমে ওকে রাখা যাবে। আমাদের সোফি একটা লক্ষ্মী মেয়ে, অযথা কাঁদে না একেবারেই, বরঞ্চ কোনো পার্টিতে তাকে নিয়ে সে সবাইকে দেখে, চুপচাপ, হ্যালো বলতে চায় হয়তো সবাইকেই কিন্তু এখনও সে বয়স তো আসে নি। আমরা সোফিকে লিভিং রুমের এক কোণায় কার সিটে বসিয়ে দিলাম, জনের সাথে পরিচিত হলো সোফি, সামিয়া আর আমি।
আমরা কেমন আছি, কিভাবে আছি জানতে চাইলো জন। জানালো রক্তাক্ত ২০১৫ শুরু হবার একদম প্রাক্কালে ২০১৪ সালের নভেম্বরে তার ঢাকা ভ্রমণের কথা। ‘দ্য চ্যাম্পিয়ন অফ ওয়ার্ড’ এবং তখন পেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট নভেম্বরের ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব, হে ফেস্ট এ অংশ নিতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। ঢাকা ভ্রমণ শেষে জন ইন্টারন্যাশনাল পেনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে সেই ভ্রমণ নিয়ে চিঠিতে লিখেছিলেন-
There is a remarkable writing and journalistic community in this country of 160 million. Virtually any literate Bangladeshi knows by heart the most famous verse of their national poet, Kazi Nazrul Islam: “I am a Rebel.” It is curious how authorities can recite these lines without understanding that they have become part of the same problem Kazi Nazrul Islam was addressing 90 years ago.
যে বাংলা একাডেমিক প্রাঙ্গণে এই চিরবিদ্রোহী জাতিকে নিয়ে কথা বলেছিলেন জন তার দুই মাস পরেই সে প্রাঙ্গণে বইমেলায় অংশ নিতে এসে মৌলবাদীদের হাতে প্রাণ হারান মুক্তমনা সম্পাদক, মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক অভিজিৎ রায়। তার মাথায় ছিলো মৃত্যু পরোয়ানা, মৌলবাদীরা হুমকি দিয়ে রেখেছিলো, দেশে আসা মাত্রই তাকে হত্যা করা হবে, কোনো কিছুর পরোয়া না করে বিদ্রোহী অভিজিৎ এসেছিলেন বাংলাদেশে, বাংলাদেশ তার এই সোনার সন্তানকে বাঁচাতে চেষ্টা করে নি, আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের পুলিশ এগিয়ে আসে নি, প্রধানমন্ত্রী গোপনে অভিজিৎএর বাবাকে ফোন করেছে দায়িত্ব সেরেছেন, কারণ ইসলামী ভোট তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই গুরুত্বপূর্ট ভোট কেনো হারাবেন তিনি নাস্তিকদের মৃত্যুর সমালোনা করে। অভিজিৎকে দিয়ে শুরু হলেও বছর জুড়ে বাংলাদেশ হারিয়েছে তার আরও চার আলোকিত সন্তানকে। নিহত হয়েছেন অভিজিতের প্রকাশক প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন, আক্রান্ত হয়ে দেশ ছেড়েছেন আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল। সেই বছরকে বিদায় জানিয়ে আবার মেলা শুরু করেছে বাংলা একাডেমি, ফেব্রুরারি মাস জুড়ে, কিন্তু দ্রোহের আগুনে যে একাডেমির উত্থান জনের মতো করেই বলবো সেই দ্রোহের কথা ভুলে গিয়ে বাংলা একাডেমি মৌলবাদীদের তোষণকেই নিজের পথ হিসেবে গ্রহণ করেছে, মেলায় গেলে বোঝাও যাবে না কখনও অভিজিৎ আর দীপন নামে কেউ বেঁচে ছিলো। জন এরপর বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাৎএর কথা। একটু আফসোসও ঝরলো তার কণ্ঠে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সামনে লেখক-সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ এর সঠিক বিচার ও হুমকিতে থাকা লেখক ব্লগারদের নিরাপত্তা ব্যাপারে আরও জোর দিয়ে বলতে পারতেন। তার ঢাকা ত্যাগের পর ক্রমাগত লেখক হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেন ইন্টারন্যাশনালের একটা চিঠি লিখে যেটায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি লিখেছিলেন-
‘Since my time in Dhaka late last year, I have seen the situation slip steadily downhill. The government, and the Prime Minister in particular, have the responsibility and the ethical obligation to stop this violence and to ensure that Bangladesh meets acceptable standards of both democracy and the rule of law, which are needed to protect the citizens’ right to free expression.’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ জনের সাথে কথা হলো আমার আর সামিয়ার। বাবুকে হত্যা করার পর জনতার কাছে আটক দুইজন মাদ্রাসা ছাত্রের কথা বলে দুঃখ ভারাক্রান্ত হলেন তিনি- “ওরা তো কোনোদিন বাবুর লেখাও পড়ে নি!” আসলেই তাই, তৃতীয় লিঙ্গের দুইজনের সাহসীকতায় আটক মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ, আরিফুর পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলো, তারা বাবুকে চিনতো না, তার লেখাও কোনোদিন পড়েনি, তারা হুমুকের দাস হিসেবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
মন্তব্য
কী মন্তব্য করব বুঝতে না পেরে ৩য় চেষ্টায় ফিরে এলাম।
একদিন অন্ধকার কেটে যাবে বলতে পারছি না।
তবে বিদ্যমান ঘোলা আলো কিছুটা সাফ হৈতেও পারে নাও হৈতে পারে।
অজ্ঞাতবাস
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা/সেথা শির। ভালো থাকবেন। Prost!
সেই সব অন্ধকার সময় এবং এখনো চলমান অবরুদ্ধ কাল, সবই দুঃস্বপ্নের মতো, এখনো
facebook
ঠিক বলেছেন অনুদা। দাড়িহীন এখনো
এই লেখাটা পড়তে পড়তে আতঙ্ক লাগল, কান্না লাগল, ক্রোধ জাগল তারপর খুব অসহায় লাগতেছে এখন। এই অসহায়ত্বের অনুভূতি থেকে বেঁচে চলার জন্যে হাল ছেড়ে দেয়া। এইসব লেখা, এইসব স্মৃতি এড়িয়ে চলা। আপনি না লিখলে এই লেখাটাও হয়ত এড়িয়ে যাওয়া হতো!
ভালো থাকুক আমাদের শেষ মুক্তমনারা। দেশে এখন আর কোন মুক্তমনা জন্মায়না সম্ভবত।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ভীত মানুষের ভীড়ে বাসভূমি অস্থির
এই মুহূর্তে।
"কি লাভ বলো আর এই লিস্ট লম্বা করে "
আমরাও মহাসুখে আছি। তোমরাও ভালো থেকো।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
যেকথাগুলো গাথলো জীবন। ধন্যবাদ ওডিন।
হ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
"সাবধানে থাকা মানেটাইবা কী!" তবু, যতটুকু পারেন ...
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পড়লাম, আর পড়তে পড়তেই সেই সময়টা তখনকার অন্ধকার নিয়ে যেন আবার ফিরে এলো। লেখা পড়লেও অভিজিৎরায়কে ব্যক্তিগতভাবে চিনতামনা কখনওই,অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও তাই। তবু হত্যাকাণ্ডগুলো সেসময় নির্বাক করে দিয়েছিলো। সময়টা বিশেষ বদলায়নি কিন্তু এখনও মুক্তমনারা আছে, মুক্তমন নিয়েই চিন্তা করে যাচ্ছে। ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
হ
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
নতুন মন্তব্য করুন