যাঁরা ন্যাসভিলের প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট দেখলেন তাঁদের সে গল্প আরেকবার বলে বিরক্ত করতে চাই না। তার পরিবর্তে শোনাই জনতার কথা। আমার এম বি এ ক্লাসে যারা আছে, যদি ধরে নিই তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি গড় মাপের থেকে বেশি তাহলে তাদের দু জনের বক্তব্য শোনা যাক। তবে শুরুতে একটা পুরোনো কথা বলে নিই।
যখন দেশে ছিলাম (ভারত), ছুটির শেষে যখন কলেজে ফিরতাম, ট্রেনে বিহার পার হওয়ার সময় স্থানীয় লোকেদের দেখতাম সব্বাই তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদকে গালাগাল করে। আশ্চর্য এই যে তার পরেও তিনি বারবার জিতে ফিরে আসতেন। একই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি। এদেশে এসে প্রথমে নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা খুব চেনা ঠেকতো, কেউ চায় না কিন্তু বুশ জিতেই চলেন। এখন যখন ঘোর দক্ষিণে থাকি তখন দেখতে পাই আসল ছবি। বাইবেল এখানে চালিকা শক্তি, জীবন অপেক্ষাকৃত মন্থর, দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি রক্ষণশীল। এবং সেটা শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে, অন্তত আমার তাই অভিজ্ঞতা। তা এই পপুলেশন থেকেই আমার ক্ষুদ্র স্যাম্পেল নেওয়া।
প্রথমজনের নাম হল জশুয়া ওরফে জশ। মাসলম্যান, পঁচিশ বছর বয়স, ঘোর ভক্তিমান ও চার্চে নিয়মিত যাতায়াত আছে। বন্দুক খুব জরুরী জিনিস এর মতে, সঙ্গে থাকা অত্যাবশ্যক, আমার সাথে প্রায়ই তর্ক বেধে যায়। তো তার কী মত এ প্রসঙ্গে? তার বক্তব্য (না, ধারণা নয়, বক্তব্য) হল ওবামা একজন কম্যুনিস্ট। আর কে না জানে কম্যুনিস্টরা সক্কলেই শয়তানের দূত। ঠিক এই ভাষায় বলে নি, শিক্ষিত লোক আবর্জনাও সুন্দর করে বলে। তবে আমি কোথাও শুনিনি ওবামা নিজেকে কম্যুনিস্ট বলেছেন। শেষে বুঝলাম গন্ডগোলটা কোথায়। ওবামা নিজেকে লিবেরাল বলেন, এবং মার্কিনি অভিধানে লিবেরাল = 'কমি'। সারা প্যালিনের বাটখারাও তাকে টলাতে পারলো না।
নিক, অপরপক্ষে অনেক বেশি মুক্তমনা। নিউ ইয়র্কে ডে ট্রেডার ছিল, কাজেই দক্ষিণজাত হলেও 'এক্সপোসড'। তার চোখেও ওবামা বোকা লোক। তার মূল কারণ অবশ্য ভিন্ন, সে ওবামার অর্থনৈতিক নীতির বিরোধী (অবশ্য ম্যাকেইনকেও সে খাতে নাম্বার দেওয়া বেশ কঠিন)। আমার নিজেরও খানিকটা সেই রকম লাগলো ওবামার নীতি, তবে জনতোষী রাজনীতি আমরা এতো দেখেছি যে আমাদের প্রথমেই মনে হয় ওটাই আসল কারণ এমন নীতির পেছনে। অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ থাকলেই বোঝা যায় আউটসোর্সিং স্রেফ গলাবাজি করে আটকানো যায় না। এবং আরো বড় কথা হল এই যে ও বস্তুটা আমেরিকার পক্ষে খুব খারাপ কিছু নয়, সাধারণ জনতার বেকারত্ব-জনিত দুর্গতির জন্য আউটসোর্সিংকে ঠিক দায়ী করা যায় না। কিন্তু ওবামার এই প্রসঙ্গে যা বক্তব্য তা অনেকাংশেই বেঠিক। এমন সরল সমাধান অর্ধশিক্ষিত নাগরিকের হাততালি পেতে সফল হতে পারে কিন্তু তাতে করে কাজের কাজ কিছু হবে কি?
মোদ্দা কথা হল, পপুলারিজমের হাওয়ায় পাল তুলে নাও ভাসিয়েছে দু দলই। তবে আমার আশা ছিল এই খুশি করার ব্যাপারটা সীমিত থাকবে ইরাক, উত্তর কোরিয়া, বিন লাদেন বা পাকিস্তানের প্রসঙ্গে। কিন্তু সাবপ্রাইমের গুঁতো খাওয়া আমেরিকা এখন সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের দ্বিতীয় ধাক্কায় কাত। এখন দু পক্ষেরই তুরুপের তাস হল ট্যাক্স। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল ট্যাক্স নেওয়ার পরিবর্তে পারলে এঁরা জনতার পকেটে চাট্টি ডলার গুঁজওে দিতে পারেন। এই যে নিষ্পাপ জনতা যাদের সাতাশি খুনও মাফ (বিশেষত ভোটের বাজারে),ঋণ সহজলভ্য হওয়া মাত্রই দলে দলে সব্বাই কেন নিজের পকেটের মাপ ভুলে গলা অবধি ধার করেছেন সে কথা কারোর মনে নেই। ওয়াল স্ট্রিট চিরকালই লালসার তীর্থক্ষেত্র, ওদের দুষে খুব লাভ নেই। কিন্তু যে নিম্নবিত্ত শ্রেণী এখন আর্তনাদ করছে তাদের দু এক জনকে চিনি। নিয়মিত রোজগার থাকলে তবেই যে নিয়মিত ঋণশোধ করা যায় এই সামান্য সত্যটা তারা কেন যেন সুবিধে বুঝে ভুলে মেরে ছিলেন। এখন হাঁড়ির হাল হয়েছে তাদের, যদিও দেশে আমরা ব্যাংকরাপ্টসি বলতে যা বুঝি অবস্থা ততটা খারাপ নয়। এ তো গেল সাবপ্রাইম। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ধস নিয়ে দুই নেতার যা বক্তব্য তা এত জেনেরিক যে বুঝলাম না কোনটা ঠিক, এঁরা এই প্রসঙ্গে কিছু ভেবে উঠতে পারেন নি, নাকি সোজা করে বলার লোভে কিছুই বলা হল না। অথচ এর চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আজকের আমেরিকায় আর কী আছে!
স্বাস্থ্যবীমা তো বায়ুভূক কিছু নয়, অর্থনীতিতে গলদ থাকলে ওপর থেকে মলম মাখালেই যে রোগ সারবে না তা বলাই বাহুল্য। অথচ ট্যাক্সেশন নীতির বাইরে বিশদ কোনো নীতির কথা শোনাই গেল না, বড় হতাশ হলাম তা দেখে।
এই প্রসঙ্গে সকলের মতামত শোনার আশায় রইলাম।
[আগেও দেখেছি, টাইপ করার সময় সব ঠিকঠাক দেখায় কিন্তু প্রকাশ হওয়ার পর লেখার অক্ষর কিছু কিছু ঘঁেটে যায়। এবারও নির্ঘাত তাই হবে। চেষ্টা করলাম য়, ড় ইত্যাদি অক্ষরে ে-কার লাগানো শব্দ বাদ দেওয়ার । তবু কিছু গোলমাল হলে সেই বাবদ আগাম দু:খপ্রকাশ করে রাখলাম।]
মন্তব্য
চট করে মন্তব্যটা করি। ডিবেইট দেখলাম, এখনও ফলোআপ করছি। আমার মনে হয় এই নির্বাচন পুরো পৃথিবী একটা বড়ো পরিবর্তন আনবে।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আবার যদি রিপাব্লিকানরা জেতে তাহলেও পরিবর্তন হবে বলছেন? এমনকি সারা প্যালিন নাম্নী ধীমতি উপরাষ্ট্রপতি (বা -পত্নী) হলেও?
ভোটের রাজনীতিতে আসলে জিততে পারাটাই মূল কথা। যে নীতি রাজনৈতিক দলগুলোকে জেতাবে, তারা সেই নীতির পেছনেই যে দৌড়াবে তা বলাবাহুল্য। কাজেই এ ক্ষেত্রে দু'নেতার বক্তব্য জেনেরিক হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
জেতা অতি উপাদেয় জিনিস, দরকারি তো বটেই, তবে একটা পরিষ্কার ফাইন্যান্সিয়াল পলিসি থাকবে না? চিন্তার কথা!
একটা পরিষ্কার ফাইন্যান্সিয়াল পলিসি হয়তো থাকবে, কিন্তু দেখা যাবে, সেই পলিসির মধ্যে আছে কতভাবে ভোটের রাজনীতিতে জেতাটাকে নিশ্চিত করা যায়। এইজন্য ট্যাক্সটাকে কত কমিয়ে দেয়া অথবা আপনার কথাই পারলে পাবলিকের পকেটেই ডলার গুঁজে দেয় আর কি।
আমি এগুলো খুব একটা বুঝি না, তবে আমার ধারনা কোন স্পেসিফিক ফিনান্সিয়াল পলিসি দিতে পারছে না কারণ ওরা নিজেরাই স্থির করে উঠতে পারছে না ঠিক কি করলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যাবে। আর আউটসোর্সিং, ইমিগ্র্যান্টদের অবৈধ রোজগার এসবকে দোষারোপ করা হচ্ছে সস্তা সেন্টিমেন্টকে হাতিয়ার করে রেটিং বাড়ানো কিন্তু আসল সমস্যায় না ঢোকা। ট্যাক্স নিয়ে কথাবার্তাও তাই। এ বলে 'আমি মধ্যবিত্তদের পক্ষে বেশী', তো ও বলে 'আমি আরও বেশী'! তবে ম্যাকেইন এর 'মধ্যবিত্ত' সম্পর্কে কদ্দূর ধারনা আছে আমার সন্দেহ হয়!
'লিবারেল' শব্দটা দেশে থাকতে প্রশংসা হিসেবে জানতাম, আমেরিকায় গিয়ে দেখলাম সেটা প্রায় গালির ধার ঘেঁষে যায়! আর 'কমি' তো সুনিশ্চিত গালি!
ভারতের অবস্থা তেমন জানি না। তবে আমার হিসাবে বাংলাদেশ আর আমেরিকায় রাজনীতি একই রকম কলুষিত। অর্থাৎ কেউই ভাল না।
শুধু আমেরিকায় মাথাপিছু রিসোর্স বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে ঢের বেশি বলে ওখানকার জনগন এটা ঠিক টের পায় না। দুই জায়গাতেই ম্যাংগো জনতারে আরামে চাপা খাওয়ানো যায়।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
ঠিকই বলেছেন, সহমত, তবে ওরই মধ্যে থেকে মন্দের ভালো খোঁজার চেষ্টা আর কি। আমাদের ওদিকে (ভারত/বাংলাদেশ) প্রাকনির্বাচন প্রমিস ও নির্বাচনোত্তর রিয়ালিটির মধ্যের দুরত্বটা আরো কিছুটা বেশি, এই যা।
বুঝা গেলো দৈশিক ব্যাপারটাই আসলে আপেক্ষিক। ভুদাই পাবলিক সব জায়গাতেই ভুদাই। রামছাগলের কদর শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই নয়, আমেরিকাতেও দেখছি যথেষ্ট রয়েছে !
মার্কস কি আর এমনি এমনি ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনায় টেনেছিলেন !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রন'দা, মার্ক্স সাহেবের জন্মদেশ,কর্মদেশে ও ম্যাঙ্গোপিপল ভুদাই ছিলো এবং আছে ।
তাহলে কি সমীকরনটা এরকম যে- সকল তান্ত্রিক পৃথিবীই শাসন করছে মুলতঃ সংখ্যায় লঘু কতিপয় অভুদাই?
ম্যাঙ্গো পিপলের মুক্তির পথটা কি তাহলে? শ্রেনীচ্যুতি? ভুদাই থেকে অভুদাই হয়ে উঠা? কিন্তু সবাই অভুদাই হয়ে উঠলে যে ভুদাই সংকট সৃষ্টি হবে কিন্তু শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য( সে যে কোন তন্ত্রেই হোক- সমাজ থেক পুঁজি হয়ে ধর্ম পর্যন্ত) যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভুদাইয়ের কোন বিকল্প এখনো মানবজাতি আবিস্কার করতে পারে নাই?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
যারা ভোট দিয়ে দ্বিতীয়বার বুশকে জেতায়
তাদের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে কোন কৌতুহল নেই।
আপনার লেখার ধরন ভালো লাগলো।
শেষ পর্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়লাম।
আরো বেশী লিখুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
খুবই, খুবই সত্য। সেদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসে এই আর্টিকেলটা পড়ে বুঝলাম।
পুরোনো লেখা যে কেউ পড়ে ভাবি নি। মন্তব্যটা হঠাৎই চোখে পড়লো।
ভালো নিবন্ধ।
নতুন মন্তব্য করুন