সারনাথ ব্যানার্জির নাম শুনি কোনো একটা পত্রিকায়, তাঁর প্রথম বই করিডোর-এর প্রকাশ প্রসঙ্গে, ২০০৪ সালে। দেশে কমিকস প্রকাশিত হলেও যাকে বলে গ্রাফিক নভেল, তার অস্তিত্ব ছিলো বলে জানতাম না। কমিকস জিনিসটা একান্তই শিশুকিশোরপাঠ্য, আর এই বস্তুটা বড়োদের জন্য, শুধু বিষয়েই নয়, অনেক ক্ষেত্রে আঙ্গিকেও, কাজেই ছবির পর ছবি সাজিয়ে তরতর করে গল্পের খেয়া বাইয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ এখানে কম। আজ সারনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে জানলাম এর আগেও একটি গ্রাফিক নভেল লেখা হয়েছিলো ১৯৯৪ সালে, অরিজিৎ সেনের কলমে ('রিভার অফ স্টোরিস')। তার একটি পৃষ্ঠা তুলে দিলাম এখানে। এর বেশি আমিও পড়িনি, কাজেই মন্তব্য করা মুশকিল, তবে সুন্দর ছবি দিয়ে সাজানো প্রথম পাতাটি যদি কিছু সঠিক ইঙ্গিত দেয় তো মনে হয় বিষয়ে পরিণতবয়স্কদের জন্য হলেও হতে পারে কিন্তু আঙ্গিকে যথেষ্ট সোজাসাপটা এই বইটি।
যাক করিডোর প্রসঙ্গে আসি। ব্যাঙ্গালোরে এক বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে দেখি বইটা। জানা গেলো সারনাথ আমার এই কলেজবন্ধুর স্কুলজীবনের সহপাঠী। হাতে যখন পেলাম বইটা তখন গোগ্রাসে না গেলার কারণ আছে কি? পড়ে আমি মোটামুটি চমৎকৃত। না, নিঁখুত কিছু মনে হয় নি, গল্পটা যেন শেষে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে শেষ করা হলো এও মনে হয়েছে, হয়তো পাতার সংখ্যা বঁেধে দেওয়া ছিলো, কর্পোরেট প্রকাশযুগে সে অসম্ভব নয়। কিন্তু তার মধ্যেও গল্প যে গল্প ছেড়ে আনপথে ঘুরেছে কতবার, কীভাবে মূল আখ্যানে উপপ্লট জুড়ে দেওয়া হয়েছে, আর মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়েছে চরিত্রদের মগজের ভেতরে, সেইটা খুব নতুন এবং এই মাধ্যমের পক্ষে বেশ দুঃসাধ্য কাজ। ভাষাসাহিত্যে আপনি মনের সুখে বিরহাতুরা নায়িকার মনোবেদনা ফুটিয়ে তুলতে পারেন তিন পাতার বর্ণনায়, এখানে সে সুযোগ ও পরিসর কোনোটাই থাকে না। চিত্রনাট্য বা নাটক লিখতে গেলেও খানিক এই জাতীয় সমস্যা হয়, কারণ শুধু সংলাপের ভিত্তিতে সেখানে বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়। চলমান ছবিতে তবু মুখের এক্সপ্রেশন দেখানো যায়, গ্রাফিক নভেলে সে পথও বন্ধ। সারনাথ দেখলাম সে সব সামলেছেন ভালোই।
এর পর ২০০৭-এ বেরোয় সারনাথের পরের বই The Barn Owl's Wondrous Capers, যার বাংলা নামটা সবার জানা, হুতোম পেঁচার নকশা। খবরটা শুনেই লাফ দিয়ে উঠলাম প্রায়, সত্যিই তো, এ বইটার মধ্যে গ্রাফিক নভেল হওয়ার যেমন পোটেনশিয়াল রয়েছে তেমন খুব কম বইয়েই আছে! তবে এই বইটি আসলে কাহিনীতে ব্যবহৃত হয়নি, উপক্রমণিকার মতোই এর ভূমিকা কিম্বা আরো কম। সারনাথের বইয়ে কাহিনী কয়েক ধাপে এগোয় (লেখকের ওয়েবসাইট থেকে কাহিনীসূত্র নেওয়া হয়েছে)। গল্পের শুরু অষ্টাদশ শতকে, রাণীমার রাজত্বের দু নম্বর মহানগর কলকাতায় যার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানারকমের গুজব আর রগরগে কেচ্ছা। এক ইহুদি বণিক সেখানে দিনের বেলায় সওদাগরি করে দোস্তি পাতিয়ে ফেলে ব্রিটিশ অফিসারদের সাথে, আর সেই সুবাদে সঙ্গী হয় তাদের নিশীথ অভিসারের। সেই অভিজ্ঞতা সে লেখে এক চামড়াবাঁধানো জার্নালে। অনেক হাত ঘুরে জীর্ণহাল সেই জার্নাল আরেকবার দিবালোকে আসে ১৯৫০এর প্যারিসে, মঁমার্তের এক অ্যান্টিকশপে।২০০২ সালের লন্ডনে পরের দৃশ্য। ইস্ট এন্ডের এক গৃহে ফোন বেজে ওঠে মাঝরাত্তিরে, এক মৃত্যুসংবাদ এবং উত্তরাধিকারের হস্তান্তরের খবর জানিয়ে। এর পরে শুরু হয় ঘটনার ঘনঘটা। অথচ সরলরৈখিক কাহিনীবর্ণনার পথ সারনাথ নেন নি। ওঁর গল্পের চরিত্রেরা যেমন, গল্পের কাঠামোও সেইরকম পুরোনো শহরের গলিঘুঁচির মতো, বিশেষত্বপূর্ণ, অদ্ভুত ও জটিল। গ্রাফিক নভেলে সেটা ফুটিয়ে তোলা একদিকে যেমন কঠিন, তেমনি এই চরিত্রগুণই সারনাথের লেখাকে নিজস্বতা দিয়েছে। তাঁর ছবি নিখুঁত সুন্দর হবার চেষ্টা করে না, বরং মোটাদাগের সাদাকালো হিজিবিজিতেও ভরে যায় সময় সময়। আমার নিজের পর্যবেক্ষণের ফল এটা, কিন্তু আমার মনে হয় গ্রাফিক নভেল যেমন অনেক সময় চলচ্চিত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তার পরিবর্তে সারনাথের ছবি অনেকটা স্টিলশটের মতো, খন্ডমুহূর্ত গেঁথে বানানো ধারাভাষ্য। তবে এই কাঠামোর বাইরেও অনেক জায়গা আছে, যার ভালো উদাহরণ 'লিটল জিজু' সিনেমায় ব্যবহৃত তাঁর কাজ। সেখানে আঁকা ছবি মিশে যায় চলচ্ছবিতে, ক্যামেরা আর কলম পাশাপাশি গল্প বলে চলে। পুরোনো শহর, লংপ্লেয়িং রেকর্ড, টানা রিকশা, হেকিমি জড়িবুটি, ভ্রমণজার্নাল, নাগরিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ মোটিফের মতোই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে গল্পের পথে। এবং এরা শুধু প্রপ্স নয়, এরাও গল্পের চরিত্র। আবার যারা চরিত্র সেই সব মানুষেরাও উদ্ভট ও বিচিত্র, এদের আমরা চিনি। আমরা যারা শহরে বড়ো হয়েছি, তাদের স্টকে খুঁজলে নিশ্চিত পাওয়া যাবে পাড়ার বারোয়ারি এক পাগলা জগাই, মোড়ের মাথায় ডাক্তারখানার বুড়ো হোমিওপ্যাথ, উকিলবাবুর খ্যাপা ড্রাইভার, কি রেকর্ড কালেক্টার খগেন জ্যাঠা। এই জাতীয় লোকেদের নিয়েই সারনাথের জগৎ। তাঁর ডিজিটাল দত্তের কথাই ধরুন। আঠারো বছর আগে পাড়ার পার্কে ফুটবল খেলতে গিয়ে গুঁতো খেয়ে পড়ে তাঁর এক নবোপলব্ধি হয়। দেশভ্রমণ যে কতো অর্থহীন সেইটে তাঁর কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ইব্ন বতুতা নানা দেশ ঘুরে শেষমেশ বুঝেছিলেন যে মরক্কোয় তাঁর জন্মস্থানের মতো সুস্বাদু খরমুজা আর কোথাও মেলে না। অতএব ডিজিটাল দত্ত তাঁর ঘরবন্দি হয়ে থাকেন, আর মনে মনে ভূপর্যটনের আস্বাদ নেন। এই রকম খেপচুরিয়াস জনতার লাইন সারনাথের কাহিনীতে। এরা নিজেরাই এক একটা গল্প, তাই মূল কাহিনী উপাখ্যানে ঢুকলেও পাঠক বিরক্ত হয় না, মোড় ঘুরলেই তো আরেকটা মজাদার ছিটেল লোকের সাথে আলাপ হবে, জানে সে।
ছবির হিসেব:
১) সারনাথের হুতোম প্যাঁচার নকশা
২) সারনাথের করিডোর থেকে
৩) লেখক স্বয়ং
সারনাথের ইন্টারভিউ পড়তে পারেন এখানে।
সারনাথের নিজের ওয়েবসাইট এখানে, গেলে ওঁর কাজকর্মের কিছু নিদর্শন দেখতে পাবেন।
মন্তব্য
আগ্রহ জাগলো। হুতোম প্যাঁচার নকশাটাই বেশী ইন্টারেসটিং মনে হলো। এর কথা জানতাম না। বাংলাদেশে মনে হয়না এর বই পাবো বলে। তারপরও খুঁজে দেখবো। ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
করিডোরের কিছু পৃষ্ঠা অনলাইনে দেখলাম, একটা আইডিয়া পাবেন।
লেখকের ওয়েবসাইট থেকে হুতোম প্যাঁচার নকশার কিছু পৃষ্ঠা দেখতে পাবেন।
...........................
Every Picture Tells a Story
হা হা, না এইটা সারনাথেরই ছবি। আমার ছবি এখানে নেহাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে বোধ হয়
নতুন বিষয় সম্পর্কে জানা হলো।
'লিটল জিজু' দেখার আগ্রহ আরো পোক্ত হলো।
দারুণ লিখেছেন পাঠক ভায়া। আপনার গদ্য খুব চমৎকার।
ধন্যবাদ প্রহরী ভাই। দেখে ফেলুন আর লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা।
ভালো লাগছে।
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু
ধন্যবাদ, পলাশ।
হুম, ইন্টারেস্টিং। আকার স্টাইলটা অনেকটা এ্যালান মুরের 'ফ্রম হেল' এর মত!
মাথায় রইল। হাতের লিস্ট শেষ করে সুযোগ পেলেই ধরবো!
নতুন মন্তব্য করুন