আমি একটু পেটুক প্রকৃতির আছি। আসলে একটু নয়, অনেকটা। তো আজ গুছিয়ে একটা ডিনার সারার পর আমার এক সহপাঠিনীর দেয়া চমৎকার একটা দেশ-থেকে-আনানো মিষ্টি খেয়ে মনে মনেই তাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। দেখা হলে আবার জানাবো এমনটাও ভেবে ফেললাম। খেজুরের ওপর রূপোর তবক দেয়া, পানের গন্ধ আর নানা মশলা, মিষ্টিও হলো আবার মুখশুদ্ধির কাজও। কৃতজ্ঞতা উথলে উঠলে আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের তা হলো এই উপহার বাবদ ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছে হলেও যিনি আমার জন্য সবচেয়ে বেশি করেছেন তাঁকে কখনো কেন ধন্যবাদ জানানো হয় নি সেই রহস্যটা। আর এ কথা মনে পড়লো যখন তার একদিন বাদেই সারা পৃথিবী উদযাপন করবে ফাদার্স ডে। আশ্চর্য নয়?
ফাদার্স ডে বলে নয়, এটা নিয়তই সত্যি যে আমার মধ্যে সামান্য কিছু ভালোত্ব যা আছে তার অনেকটাই সরাসরি বাবার থেকে কপি করা। টুকতে টুকতে অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। বাবা খুব ভালো গান করতো, আজকাল আর শুনি না, শরীরের কারণেই। "যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কতো আর", এই গানটা বাবা গাইলে একবার রেকর্ড করেছিলাম। সে রেকর্ডিং আজ কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে, আগলে রাখা হয় নি। আমার সঙ্গীতপ্রেম বাবার গাওয়া টুকতে গিয়েই শুরু। আমার গান প্রশংসার বস্তু নয়, বাবা যে শুনেওছে তা আশা করি নি। তবে একবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে একটা ক্যাসেট খুব শুনছিলাম, পরে বাবা বললো যে ওই হেমন্তের গানটা, "শুধু অবহেলা দিয়ে বিদায় করেছো যারে", ওটা তোর খুব পছন্দের, না? শুনে আমি ভয়ানক অবাক হয়েছিলাম, আমি যে গান শুনি সেটা বাবা শুনেছে এবং মনেও রেখেছে এতে অবাক লেগেছিলো খুব। বাবা পুরোনো বাংলা ছবির একেবারে ছোটো চরিত্রের অভিনেতাদের নামও টপাটপ বলে দিতো যখন সবাই মিলে সাদাকালো টিভিতে দূরদর্শনের চ্যানেলে পুরোনো সিনেমা হাঁ করে গিলতাম। মানে নীতিশ জীবেন নৃপতি কমল মিত্তির কি ধীরাজ ভটচায এঁদের কথা বলছি না, এঁদের নাম জেঠিমারাও জানেন, কিন্তু আরো এক্সোটিক লেভেলে পৌছে যেতো বাবা। অনেক বছর পর বিলেতে আমার ফ্লাটমেটের বাবা-মাকে এমন ভয়ানক ক্ষমতার ডেমো দিতে দেখেছি, অন্ধ ভিখারি কিম্বা বদমেজাজি বাড়িওয়ালার চরিত্রাভিনেতার নাম বলে দিলেন নিমেষের মধ্যে। কাজেই ছোটোবেলা থেকেই সিনেমা যে পাগলের মতো আকর্ষণ করেছে আমায় সে আর আশ্চর্য কী।
পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে যেতাম বাবার সাথে একদিন, সব কাসিনরা মিলে। বাবা সবচেয়ে যার বাজার খারাপ সেই রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া করবে, তারপর কোনো ভীড়ওলা মণ্ডপের কাছাকাছি গিয়ে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে টাকা ধরিয়ে দেবে টিফিন করার জন্য, আর নিজে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবে। এখনো ভীড় দেখলে আমার বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানার ইচ্ছেটাই হয়। রিক্সাওয়ালাদের বরাতে অবশ্য সবসময় শিকে ছঁেড়ে না। আর বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কৃতজ্ঞতাবোধ আছে ভদ্রলোকের, তার খানিকটা পেলেও বর্তে যাই। বাড়ির বড়োরা তো বটেই, পুজোপার্বনে মাসিরা আমাকে জামাটামা উপহার দিতো বছর-বছর। আমি বড়ো হয়ে ওঁদের বাড়ি গেলেই বাবা খোঁজ নিতো, কী নিয়ে যাচ্ছি উপহার সবার জন্য। টাকাপয়সার ব্যাপারটাও ওঁর মাথায় ঢুকলো না কোনো কালেই। এবং তাই নিয়ে যে গর্ব করা যায় এটা শিখেছি বাবার কাছেই। এখন যখন আমার সঞ্চয়ের ভাঁড়ারে মা ভবাণীর বাস, এবং আমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে বাবা যখন মাঝেমাঝেই চিন্তিত হয়ে পড়ে তখন খুব মজা লাগে। এর অবশ্য আরেকটা ভালো দিক আছে। আমার যৎসামান্য ফাইনান্সের জ্ঞান নিয়ে আর কাউকে কিছু গল্প শোনাতে পারি না, কিন্তু বাবাকে বলা যায়, আমার থেকেও অজ্ঞ এ বিষয়ে একজন আছে এই বোধটা খুব কমফোর্টিং। বলাই বাহুল্য, ভদ্রলোকের সঞ্চয়ের দশাও অনুরূপ, তবে সে নিয়ে পিতাপুত্র দুজনেই যাকে বোম্বাইয়া ভাষায় বলে বিন্দাস, তাই থাকি দু বেলা।
কিন্তু এ সব ছাড়াও কৃতজ্ঞ থাকার একটা বিশাল কারণ আছে। যদিও কখনো আমাকে বলেন নি নিজে, কিন্তু আমার জন্যই তিনি জীবনে একটা বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেছেন। পাবলিক ফোরামে এ নিয়ে বিশদে বলতে সংকোচ হচ্ছে, কিন্তু এটুকু বলি, আমি ঐ অবস্থায় বাবার মতো কিছু করতে পারতাম কিনা সে কথা অনেক ভেবে দেখেছি। কিন্তু জীবনের অর্ধেকের অনেক বেশি সময় একা কাটানোর সাহস আমি দেখাতে পারতাম বলে মনে হয় নি একবারও। কিন্তু এ নিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে একটা মহা কমেডি সীন হবে। যতোই স্নেহশীল হোন, জীবনে বকুনি প্রায় কখনোই না দিয়ে থাকুন, কিম্বা বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো নরম হয়ে থাকুন, এই আহা-উহু ব্যাপারটা এখনো তাঁর পছন্দ নয়, বিশেষতঃ নিজেকে নিয়ে হলে তো আরোই নয়। কাজেই এমন কী কেঠো থ্যাংকস বলারও উপায় নেই। তার চেয়ে এই জাতীয় একটা কথোপকথন করা যেতে পারে:
- শরীর কেমন?
- আর শরীর, ছাড় তো, এ তো লেগেই আছে। শুনেছিস তো, নতুন শিক্ষাব্যবস্থায়.....
(এইখানে সম্মিলিত ভাবে গত বত্রিশ বছরের কথা ভেবে দ্বিপাক্ষিক ক্ষোভপ্রকাশ হবে, আপনাদের আর শুনিয়ে বোর করছি না)।
- যাক, শোনো, টিভিতে দেখেছো, আজ নাকি ফাদার্স ডে? (মৃদু হাসি)
- হাঃ হাঃ, সেই তো, মজার জিনিস! (এবার সম্মিলিত উচ্চস্বরে হাসি)
- হ্যাঁ, আজকে আমার তোমাকে ফর্মালি থ্যাংকস বলার কথা।
- সত্যি, এরা পারেও বটে!
- যা বলেছো!
এর বদলে হলমার্কের কার্ড কিম্বা ফুলের তোড়া পাঠানোই যায়। কিন্তু কী গিফ্ট কিনবো তোমার জন্য এই প্রশ্নের একটা সদুত্তর আজ অবধি যিনি দিয়ে উঠতে পারেন নি, তিনি ঐ ফুল দেখলে ভির্মি খাবেন না? তার থেকে এই না-বলা কথাটাই অনেক নিরাপদ নয়, আপনারাই বলুন?
মন্তব্য
এই লেখার মন্তব্যে কোন আলোচনা-সমালোচনা করার চেষ্টা করা বোকার মত কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে।
আপনি আমি তো কোন ছার, গুরুদেবের মত কাউকে দিলে পরেও এই অনুভূতিগুলোর কথা, এই অনুধাবনগুলোর কথা ঠিক ঠিক ফুটিয়ে তুলতে পারতোনা বলেই বিশ্বাস হয়।
উনারা আপনার-আমার ধন্যবাদের তোয়াক্কা করেন না। তারপরও আপনি বাত-চিত যতদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন আমি হলে তাও পারতাম না। আপনার এই বাত-চিতেই উনি যা বোঝার বুঝে গেছেন, আপনি আশ্বস্ত থাকতে পারেন।
উনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাবেন।
পুনশ্চঃ ছবিটি কি উনার?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রণাম জানানোও একরকম বারণ, শ্রদ্ধাটদ্ধার কথা তুললে সে আরো চিত্তির হবে। সবটাই টেলিপ্যাথিক লেভেলে রাখতে হবে। তবু আপনার কথা শুনে ভালো লাগলো।
ছবিটা বাবারই, কয়েক বছর আগে তোলা।
ফাদারস ডে কবে? আজই নাকি?
জুন মাসের তৃতীয় রবিবার।
মূলোদা তুমি কেঠোই রয়ে গেলে, কাকা কে কার্ড ফুল সবই পাঠাও, মুখে বলতে সংকোচ বোধ হওয়া স্বাভাবিক, চিঠিতে শ্রদ্ধা -ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিও। উনি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশী হবেন।
সংকোচটা সব কিছুতেই, তবে ভালো কথা কিছু বলবো এবার আশা করি, পদ্ধতিটা যাই হোক।
আমার তো মনে হয় এই বাক্যটিই অনেক কথা বলে দিলো ....
তবে, 'মৃদু হাসি'টি দিতে ভুলবেন না যেন - ওটা ইম্পরট্যান্ট
ভুলবো কী, আমি তো ভাবছি ঐখানে অট্টহাস্য দেবো দু জনে মিলে, সেই মু হা হা হা স্টাইলে।
ভালবাসার কথা মাঝে মধ্যে প্রকাশ করা প্রয়োজন।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।
_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)
ইচ্ছে যে হয় না তা নয়। কিন্তু একে তো দেশ ছেড়ে এতো দূরে আছি স্বেচ্ছায়, বাবাকে বোঝানো যায় না কেন। তার উপর আর ভালোবাসা দেখাতে ভয় হয়, বৃথা আশা দেওয়ার মতো হবে।
মূলত পাঠক,
লেখাটা ভারী চমৎকার হয়েছে।
আমাদের বাড়ীতেও একেবারে চলে না। খুব পুর্বী আমরা। ধন্যবাদ তো দূরের কথা, কাছের মানুষের কিছু প্রশংসার কথা টথা নাকি একেবারে নো নো। তাইলেই নাকি সব গুবলেট হয়ে যাবে। এসব যত নিরুচ্চার রাখা যাবে তত ভালো।
কয়েকবছরের বিদেশবাসের অভ্যাসবশে একবার বাড়ী গিয়ে এক কান্ড হয়েছিল। মায়ের কাছে জল চাইলাম, মা এনে দিলে গেলাসটা হাতে নিয়ে রিফ্লেক্সে মাকে বলে ফেলেছি থ্যাংক ইউ। আর মায়ের কি হাসি! মাকে থ্যাংকস দিচ্ছে মেয়ে! শেষে আমিও খুব হাসলাম!
পরে আমাদের কালচার বিষয়ে সাহেব বন্ধু জানতে চাইলে এই জায়গায় এসে সে ভারী চমৎকৃত হলো!
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ তুলিরেখা।
কোথাও একটা পড়েছিলাম (সুনীল গাঙ্গুলি বোধ হয়), আমরা ধন্যবাদের জায়গায় যে হাসিটা দিই, তা নাকি আরো চমৎকার। হবেও বা। সব সময় সেটাও তো জোটে না, তবু ধন্যবাদের প্রথা থাকলে কিছু একটা জোটে। অবশ্য বিলেতে অনেককেই দাঁত খঁিচিয়ে থ্যাংক্স বলতে দেখেছি, সেটাও যে খুব ভালো ব্যাপার তাও বলা মুশকিল।
আজকাল অবশ্য বাড়িতে থ্যাংক্সের রেওয়াজ চালু হয়েছে, তবে সেটাও একটু হাল্কা ব্যঙ্গার্থে বলা হয়, অনেকটা "হুঁঃ ভারি এক কায়দা হয়েছে আজকাল" অনুক্ত রেখে।
কত কথা অনুচ্চারিত রয়ে যায় জীবনে, মনে হয় মুখ ফুটে বলবার দরকার নেই বলেই।
-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি
[অনুচ্চারিত ধন্যবাদ]
বিদেশে আমার এক পরিচিত বড় ভাই তাঁর বাচ্চাদের ছোট ছোট কাজে ‘থ্যাংকিউ’ বলা শেখান। তাঁর ধারণা, বাংলাদেশে আমরা কেউ কাউকে থ্যাংকস দেই না, কারণ কেউ কিছু করলে আমরা ধরে নেই এটা পাওয়া তার অধিকার। কাজেই থ্যাংকিউ দেবার কোন দরকার নেই। এরকম হীন মানসিকতা নিয়ে আমরা চলি। ওনার সাথে একমত বা দ্বিমত কোনটিই করতে পারি নি, কারণ বাস্তবে এমন হতে অনেকবারই দেখেছি। ‘আমার এটা তোমাকে করে দিতে হবে’- এরকম ‘দিতে হবে’ সুর আমরা প্রত্যেকেই হয়তো শুনেছি। বিনিময়ে কোন সৌজন্যবোধ এখানে আশা করা বৃথা। কিন্তু তারপরও এর চাইতে বেশিই হয়তো আমরা দেখি ছোট ছোট কাজের বিনিময়ে আন্তরিক হাসিমাখা মুখ, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ বা কোন স্নেহমাখা বাণী- মুখে শুধু শুকনো ‘থ্যাংকিউ’ তার জায়গা কখনো নিতে পারে না। দ্বিমত তাই এইখানেই। বাঙালি অনেক জায়গায় ছোট হলেও, আরো অনেক জায়গায় অনেকের চেয়ে বড় এবং বর্ণিল। আর সম্বল বলতে তো শুধু এটুকুই।
সত্যি কথা।
বাবার প্রতি আমার অধিকাংশ প্রকাশই অনুচ্চারিত...
লেখাটা
অনেক ধন্যবাদ শিমুল।
অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। স্রেফ অসাধারণ! স্নিগ্ধাপুর মন্তব্যটা একদম আমারও মনের কথা।
অনেক ধন্যবাদ অতন্দ্র প্রহরী।
নতুন মন্তব্য করুন