"অ্যাফেয়ার অফ দ্য নেকলেস" মুভি দেখে লিখতে বসেছি ঠিকই, কিন্তু এই লেখা ফিল্ম রিভিউ নয়। বরং ছবির মূল চরিত্র ইতিহাসের পৃষ্ঠার যে সাহসিনী নারী তাঁকে নিয়ে লেখাই মূল উদ্দেশ্য। Jeanne of Valois-Saint-Rémy বা সংক্ষেপে জিন, শৈশবে হারিয়ে যাওয়া বাড়িঘর পারিবারিক উপাধি ও সম্মান পুনর্দখল করতে যা সব দুর্ধর্ষ কাণ্ডকারখানা করেছিলেন সে যুগে, উইকি খুলে তার বিবরণ না পড়লে সন্দেহ হতো গোটাটাই ফিকশন কি না! গল্প কিছুটা বলতে হবে যেহেতু লেখা জিনকে নিয়ে, যাঁরা সিনেমাটি দেখার ইচ্ছা রাখেন তাঁদের জন্য স্পয়লার অ্যালার্ট দিয়ে দিই এখানে।
এই জিন এক উঁচুদরের বাটপাড়। সতেরোশো সত্তরে ঠগিনীর আবির্ভাব, এমন কি ফরাসি মুলুকেও সোজা ব্যাপার নয়। ছবিতে হিন্দি সিনেমার মতো এই নারীর বাটপাড়ির সমর্থনে এক দুখভরি কাহিনী রয়েছে, তার ঐতিহাসিক সত্যতা প্রশ্নাতীত কি না আমার জানা নেই। তবে কারণ যাই হোক, ঘোল খাওয়ানোয় তিনি যে রকম পটুত্ব দেখিয়েছেন তাতেই আমি মুগ্ধ। এক সৈনিকের সাথে বিয়েথা হলেও তিনি কার্ডিনাল ডি রোহানের পোষ্য হয়ে গিয়েছিলেন। তো এই কার্ডিনালের সাথে রাণীমার একটা ঝামেলা বেধে গিয়েছিলো, যার জন্য কার্ডিনাল হাত কামড়াচ্ছিলেন। রাণীমার নেকনজরে না থাকলে রাজসভায় মন্ত্রী হওয়ার সাধ কি আর পূর্ণ হয়? এদিকে জিনের খাতির ছিলো রাণীমার মহলের এক জিগোলো (বাংলা কী হবে, বেশ্য?) রেতু দে ভিলে'র সাথে যে রাণীর প্রিয়পাত্র। কার্ডিনাল জিনকে ধরলেন, রেতুর হাত ধরে এই রাহুকেতুর গ্রাস থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায় সে আশায়।
জিন দেখলো এই সুযোগ! রেতুর সাথে হাত মিলিয়ে জিন জোগাড় করলো রাণীর শিলমোহর, তারপর রেতুকে দিয়ে রাণীর লেখা নকল করে একটার পর একটা চিঠি কার্ডিনালকে লেখা শুরু করলো। কার্ডিনাল তো শিলমোহরের ছাপ্পা মারা রাণীর অমন নরম সুরে লেখা চিঠি দেখেই গলে জল! কিছু চিঠি চালাচালি হতে চিঠির রাণী কার্ডিনালের প্রেমে পড়ে গেলেন। কার্ডিনালকে আর পায় কে! জিন এইবার এক বেশ্যাকে ভাড়া করলেন যাকে দেখতে খানিকটা রাণীর মতো। তাকে পোষাকটোষাক পড়িয়ে এক রাতে ভার্সেই প্রাসাদের বাগানে কার্ডিনালের সাথে একটা অভিসার গোছের ব্যাপারও ঘটিয়ে দিলেন। গোলাপ বিনিময় হতে কার্ডিনাল একেবারে গদগদ! এমন সুযোগ জিন কি আর ছাড়ে? রাণীর সমাজসেবার বাহানা দেখিয়ে সে কার্ডিনালের থেকে টাকাপয়সা নিতে শুরু করলো, এবং সে টাকায় নিজে সোসাইটির পার্টি-টার্টিতে গিয়ে বেশ একটা অভিজাত লেডি টাইপ বনে গেলো ফাঁকতালে। কিন্তু অল্পে কী সুখই বা আছে? অতএব এবার একেবারে মারি তো গণ্ডার! সে এক ভয়ানক গল্প ফাঁদলো। রাণীমার নাকি সেই মহামূল্য কণ্ঠহারটা নিয়ে বিশাল লোভ, কিন্তু দেশের এই দুর্দিনে খোলাখুলি সেটা কিনলে জনগণের কাছে প্রেস্টিজের আকুপাংচার হয়ে যায়, তার উপর আছে পার্লামেন্ট। কাজেই কার্ডিনাল যদি চুপিচুপি টাকাপয়সা দিয়ে হারগাছা কিনে দেন তো রাণী গলায় পরে প্রাণ জুড়োন। বিশ লক্ষ সোনার মোহর দেবেন এই শর্তে স্বর্ণকারের থেকে কার্ডিনাল কিনলেন সেই কন্ঠহার, রাণীর হাতে লেখা চিঠি দেখে স্যাঁকরা মেনে নিলো সব। কার্ডিনাল সেই হার জিনের হাতে দিলেন রাণীর কাছে পৌছে দিতে। জিন তার পতিদেবকে দিয়ে হার পাঠিয়ে দিলো লন্ডনে, হারটা ভেঙে সব জহরত বেচে টাকা জোগাড় করার উদ্দেশে।
এদিকে ইনস্টলমেন্টের টাকা না পেয়ে স্যাঁকরা দৌড়লো রাণীর কাছে। তখন সব কথা ফাঁস হলো শেষমেশ। অ্যাসাম্পশন ডে'র উৎসবে রাজা ডেকে পাঠালেন কার্ডিনালকে, সব কথা শুনে ফাটকে পুরে দিলেন তাকে। ধরা পড়লো সেই ডামি রাণী-সাজা বেশ্যা ও জিনের কুকীর্তির সঙ্গী বেশ্য, এবং স্বামীসহ জিন স্বয়ং। কার্ডিনাল চাইলেন পার্লামেন্টের দরবারে বিচার হোক। সাংসদরা বিচার করে কার্ডিনালকে মুক্তি দিলেন, বেশ্যটিকে দূর করে দিলেন, বেশ্যাটিকেও ছেড়ে দিলেন, কিন্তু জিনের পতিকে ঘানি টানতে পাঠালেন। একেই বলে সব কটাকে ছেড়ে বেড়ে ব্যাটাকে ধর! জিনের শাস্তি হলো চাবুক-পিটুনি আর ছ্যাঁকা দিয়ে গায়ে ঠগিনীর শিলমোহর এঁকে দেওয়া। কিন্তু জিন অতি ঘোড়েল মাল, ফন্দি করে সে চাবুক আর ছ্যাঁকা দুইই এড়ালো, তারপর বালকের ছদ্মবেশে জেল থেকে পালিয়ে সোজা পৌছলো বিলেতে। সেখানে গিয়ে এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা বই লিখে বেশ নামডাকও হলো। কাজেই জীবনটা তার মন্দ কাটলো না। মাঝখান থেকে আঁতোয়ানেতের পাবলিক ইমেজের ভর্তা হয়ে গেলো, বিক্ষুব্ধ জনতা বেটিকে ধরে কুচ করে গলাটা দিলো কেটে! কন্ঠহারের বদলে গিলোটিন, নট ফেয়ার!
যাক সব গল্প শোনার পরেও কেউ সিনেমাটা দেখতে চাইলে দেখুন। পিরিয়ড ড্রামা, বাজারে নানা রকম রিভিউ পড়লেও সব মিলিয়ে মন্দ নয়। হিলারি সোয়াঙ্ক যথারীতি ভালো অভিনয় করেছেন। জনাথন প্রাইসও ভালো। তাছাড়া রয়েছেন সাইমন বেকার ও এড্রিয়ান ব্রোডি।
মন্তব্য
ভালো লাগল। সিনেমাটা দেখতে হবে
দেখতে হবে তো। খাসা গল্প।
ধন্যবাদ, মামুন হক ও ফকির লালন।
'স্পয়লার অ্যালার্ট' সত্ত্বেও পড়লাম কাহিনীটা। এবং সিনেমাটা দেখার জন্য আগ্রহ বরং বেড়ে গেল। হিলারি সোয়াঙ্ককে আমার কাছে ভালোই লাগে। দারুণ অভিনয় করে।
আপনাদের আড্ডাবাজির পোস্ট কই?
হিলারি সোয়াঙ্কের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই আর, সত্যিই ভালো অভিনয় করেন তিনি। খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন এই অভিনেত্রী।
আড্ডা নিয়ে কী পোস্ট দিই ভেবে পাচ্ছি না। ভালো খেলুম আড্ডা দিলুম এর পরে আর কী লিখি? আর আমাদের সচলাড্ডা তো ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছে, কাজেই সে আড্ডার গল্প লেখার প্রশ্ন নেই।
গল্পটা ভাল। তবে হিলারিকে কেন যেন আমার এইরকম রমনীয় চরিত্রে ভাল লাগে না। তাকে একটু পুরুশালী চরিত্রগুলোতে বেশী খাটায়।
ফিলিমটা বেশ ভাল করে বানানো। কি বলেন?
--
ফরাসী পোষাকি ছবি ভাল লাগলে লা রেইন মারগো আর লো পাক্ত্ দ ল্যুপ দেখতে বলবো। খিডিকিউল ও বেশ ভাল করে বানানো।
সিনেমাটা আমার তো ভালোই লাগলো দেখে, যদিও কাহিনীকার বেশ কিছু স্বাধীনতা নিয়েছেন গল্প ফাঁদতে বসে। পোষাকি ছবি গতিময় হলে মন্দ লাগে না।
এই কন্ঠহার নিয়ে ফরাসি গোয়েন্দাদ্বয় ব্লেক আর মর্টিমারের (কমিক্স, টিনটিনের প্রকাশকেরা ছাপান) একটা বই আছে, তার প্রচ্ছদ দিলাম এখানে।কন্ঠহার
স্পয়লার অ্যালার্ট দেখে আর আগে বাড়লাম না। দেখে তারপর পড়ে নেবো আশা রাখি।
হিলারি সোয়াঙ্ককে "P.S. I Love you" তে আমার বেশ ভালো লেগেছে, দেখার আগে আশা করিনি এতটা ভালো লাগবে।
দুর্দান্তের দেয়া ফ্রেঞ্চ মুভিগুলো লিস্টিতে অ্যাড করে নিলাম, ধন্যবাদ।
পি এস'টা ভীষণ মাখো মাখো প্রেম, আমার ততোটা হলে এট্টু বদহজম হয়ে যায় । আপনার ওঁকে ভালো লাগলে ফ্রিডম রাইটার্স দেখতে পারেন, সোজাসাপটা গল্পভিত্তিক সিনেমা, দেখে মন ভালো হয়ে যায়।
হাহাহা, তা যা বলেছেন!
আমার আবার মোটামুটি সবই সয়ে যায়, হররটাই যা একটু কম দেখি। ফ্রিডম রাইটার্স -টা দেখি দেখি করেও দেখা হয়নি। দেশে বসে হবেনা জানি, বৈদেশে গিয়ে দেখবো আশা রাখি।
Grazie!
আমিও সুযোগ পেলে দেখে নেবো। গল্পটা চমৎকার লাগলো।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ, তুলিরেখা।
ছবিটি কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানিনা, তবে আপনার লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো আর সেই সাথে জানলামও অনেককিছু। আজকাল খুব বেশী লেখা দেখছিনা আপনার, ঘটনা কি?
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।
অনেক ধন্যবাদ এমন প্রশংসার জন্য। আজকাল বন্ধুসঙ্গে আড্ডাখানাপিনায় 'ব্যস্ত' আছি বড়োই, লেখার সুযোগ হয় না সে এমন ব্যস্ততা।
তবে শিগগিরই চাকরি জীবন শুরু হবে, তখন না চাইলেও লেখা কমে যাবে জানি।
দেখার জন্য কতো যে ছবি জমে আছে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন