নতুন চাকরি বাবদ ঘোরাঘুরি হচ্ছে কিছুটা, সে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয় সিরাতের হিল্লি-দিল্লি বৃত্তান্তের কায়দায়। কিন্তু সে গুড়ে বালি, গত এক সপ্তাহ সেই যে গিয়ে গুহায় ঢুকলাম, বেরোলাম একেবারে ফেরার ফ্লাইট ধরতে। ছোটোবেলায় আমাদের ভায়েদের সবার অভিভাবক জেঠামশাই সক্কালবেলা ঘুম থেকে তুলে দিয়ে সদভ্যাস গড়ার একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সুযোগ মেলা মাত্রই ঐ সদবস্তুটি সযত্নে ত্যাগও করেছিলাম যথা সময়ে। এখন তার ফল ভুগছি হাতেনাতে। তিন তিন খানা অ্যালার্ম লাগিয়ে রাখি, তাও নিজেকে শুতে যাবার আগে পই পই করে বোঝাই, ভোরবেলা ঘুমের ঘোরে ঐ যে মনে হবে 'আরেকটু ঘুমাই, ইক্টুখানি', ঐ মরীচিকাকে যেন খবরদার বিশ্বাস না করি! তাতে করে এখনো অবধি কাজ হচ্ছে, তবে আতঙ্কে আছি খুবই, কবে এই তুক ফেল মারে সেই ভয়ে। তো সেই সকালে উঠে টিপটপ ফুলবাবুটি সেজে গিয়ে বসতে হত রোজ, ভাষণ চলতো একের পর এক (কিছু কিছু অবশ্য ইন্টার-অ্যাকটিভও ছিলো)। গাড়ি চলে পেট্রলে, আর আমরা চলি কফির জোরে। ঘটি ঘটি কালো কফি গিলে চোখের পাতা খুলে রাখতে হয়, ল্যাপটপটি খুলে টুকটাক চ্যাটিয়ে যে একটু তরতাজা থাকবো এই হতচ্ছাড়া ট্রেনিংয়ে তার জো নেই।
এই এলাকায় লাতিনো মানুষজনের সংখ্যা অনেক বেশি, এবং অ্যাফ্রো অ্যামেরিকান বেশ দুর্লভ, বাকিরা সবাই প্রায় শ্বেতাঙ্গ। আমাদের দলটি বিশাল, শ'খানেক লোক প্রায়, আর তার মধ্যে আদ্ধেকই ভারতীয়। সেটা অবশ্য আশ্চর্য নয়, টেকগন্ধী জিনিসে এদের আগ্রহ একটু কমই দেখেছি, কিছু নিবেদিতপ্রাণ 'গীক' বাদ দিলে। যাক আমরা তো অতিথি, এই এলাকায় মানবশ্রম সুলভ হওয়াতেই বোধ হয়, রুম সার্ভিস এতো ঘন ঘন হচ্ছিলো যে আতঙ্কে দরজায় 'ডু নট ডিস্টার্ব' লাগিয়ে যেতাম অনেকেই। নইলে দু ঘন্টা পরে এসে দেখবো বাথরুমে নতুন তোয়ালেটোয়ালে আবার ভাঁজ করে রাখা, কী যন্ত্রণা! এদিকে সবুজের অভিযান নিয়ে জয়ঘোষে কান পাতা দায়, তোয়ালে মেঝেতে না ফেললে নাকি বদলানো হবে না যাতে জল সাশ্রয় হয়। সবই কথার কথা, এক সপ্তাহে এক বারও সুযোগ পেলাম না এক তোয়ালে দু বার ব্যবহারের। ডু নট ডিস্টার্ব থেকে মনে পড়লো, এর স্পানিশ অনুবাদটা মজার, নো মলেস্টে। ট্যাগে অবশ্য জাপানি (কাঞ্জি নয়, হিরাগানা, কাজেই চীনাদের কাজে লাগবে না), ফরাসী ইত্যাদি আরো কয়েক ভাষায় সে কথা লিখে নিখরচায় একটা আন্তর্জাতিক গন্ধ আনার চেষ্টা হয়েছে।
আমাদের ঐ বিশাল দলে অনেকগুলো চৈনিক, থাই ইত্যাদি জাতের ছেলেমেয়েও ছিলো, ওদের ইংরিজির দুর্বলতা নিয়ে সাধারণভাবে যে ধারণাটা চালু আছে কোনো অজ্ঞাত কারণে এরা সবাই তার ব্যতিক্রম। অবশ্য একেবারে অজ্ঞাত নয় কারণটা, যে কাজে এদের (এবং আমাদেরও) নেওয়া হয়েছে তাতে কথা বেচে খেতে হবে, কাজেই টুটাফুটা ইংরিজিওয়ালারা হয়তো বাদ পড়ে গিয়ে থাকবে। মজার ব্যাপার হলো এই যে ভারতীয়দের কয়েকজন কিন্তু সে তুলনায় অনেক বেশি খারাপ ইংরিজি বলছিলো। ভাষার দখল স্মার্টনেসের পথে পাথেয়, কাজেই তাদের সমস্যাটা হেলায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর সাথে থাকে বাইরের সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহ। এটা একটা স্টিরিওটাইপ, কিন্তু ভারতীয়রা (বাঙালি নিয়েই বলছি) এ বিষয়ে অনেকেই একেবারে আগ্রহশূন্য। ডিনার টেবিলে পার্টনার ভদ্রলোক বিশ্বভ্রমণের ঝুলি থেকে মজার গল্প শোনাচ্ছিলেন, এবং আমরা ঠেকা দিচ্ছিলাম তাতে (প্রজেক্ট চাই না? তেলতামাক দেওয়া মহাজরুরী!)। তো যারা একটু চুপচাপ তাদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনিই যেচে জিজ্ঞাসা করছিলেন কে কোথায় ঘুরেছে এই সব। একটি ভারতীয় ছোকরা মেমফিস, টেনেসিতে ছিলো অনেক দিন, স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে গ্রেসল্যান্ড তার কেমন লেগেছে, বা কথাপ্রসঙ্গে সে একআধটা অ্যানেকডোট ঝাড়বে সে প্রসঙ্গে এমন আশাও থাকে শ্রোতাদের। দেখা গেলো সে জানতোই না কী বস্তু সেটা। এর পাশে সেনেগালের লম্বু ছোকরা তাসলিম পটপট করে বলে গেলো নানা দেশ ঘুরে তার কী কী মহা মহা উপলব্ধি হয়েছে, তখন সে পার্থক্যটা আরো প্রকট হয়ে চোখে পড়লো। শেষদিন দেখলাম সেই ভারতীয় ছেলেটি আরেক দক্ষিণ ভারতীয় একটু সিনিয়ার একজনকে দুঃখের কথা বলছে। ভাষার ব্যবধান পেরিয়ে যতটুকু কানে (ও মর্মে) ঢুকলো তাতে বুঝলাম তার দুশ্চিন্তা দূরীকরণে দাদাভাই প্রবোধ দিচ্ছেন। দিবাশেষে কে কেমন কাজ করে তার উপরেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এটা ঠিক, কিন্তু এই দক্ষতার জন্য অতিরিক্ত মূল্যও পাওয়া যায়, স্রেফ ভালো কাজ করে তার ঘাটতি পোষানো সোজা কথা নয়।
যাওয়ার সময় পাশের আসনের সহযাত্রী ছিলো এক বিজনেস স্কুলের ছোকরা লুইস লোপেজ, সে ল্যাপটপে পারচেসিং তত্ত্ব পড়তে পড়তে এবং আইফোনে সিনেমা দেখতে দেখতে রাস্তা কাবার করলো (জয়তু বিমানে-সুলভ ইন্টারনেট)। আমি গুছিয়ে ঘুম দিলাম, চার ঘন্টা সুমধুর কেটেছিলো। আর ফেরার পথে পাশে এক ধর্মপ্রাণা মহিলা পকেট-সাইজ বাইবেল খুলে পড়তে পড়তে এলেন, ঝোলা থেকে তসবী বেরোবে কি না সেই নিয়ে দোলাচলে এবার আর আমার ঘুমই এলো না। নির্দিষ্ট সময়ের আধ ঘন্টা আগে পৌঁছে অবতরণের ঠিক আগে বিলম্ব-করার-জন্য-বিখ্যাত ডেলটা'র সুরসিকা ঘোষিকা আমাদের এই আধ ঘন্টা জমিয়ে রাখতে বললেন, যাতে পরের বারের দেরী হলে পুষিয়ে নিই। যাত্রা শেষের এই মৃদু হাসিটুকু মন্দ লাগলো না।
মন্তব্য
পাঠ করা হলো।একেবারে মুগ্ধ পাঠ যাকে বলে।
আপনার গদ্যের হাত চমৎকার।
লিখুন,অফুরন্ত।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনার নামটাই জানা হলো না যে।
আমার নাম তমিজ উদদীন লোদী
পাঁচালাম! আরো, আরো!
আরে এইটা তো আপনার ভারত সফর থেকে টুকে মারা, আপনে পাঁচাইলে ক্যাম্নে কি?
১.
আপনার ঘুমের কথা শুনে মজা পেলাম। আগে আমি, মাঝে মাঝে, মোবাইলে অ্যালার্মের পাশাপাশি চার পাঁচটা রিমাইন্ডার সেট করে রাখতাম, একেকটা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে, যাতে করে কোনোভাবেই মিস না হয়ে যায়। তবে এখন আর ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না। প্রায়ই অ্যালার্মের আগেই জেগে যাই। দেহঘড়ির ব্যাপার হয়তো।
২.
ট্রেনিং নিয়ে আরেকটু বিশদে লিখতে পারতেন। অবশ্য যদি না তাতে চাকরির কনফিডেনশিয়ালিটির কোনো ক্ষতি হয়।
৩.
শিল্পের প্রতি অনীহা আমিও খেয়াল করেছি, আমার চারপাশের মানুষজনের মধ্যে। বন্ধুদের সাথে কোথাও বেরিয়ে যদি হঠাৎ চোখে পড়া কোনো পেইন্টিংয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাই, অথবা এমনকি যদি কোনো বই নিয়েই কথা বলি, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায়, তাদের কোনো আগ্রহ নেই এতে। অনেক সময় তো নানান কটূক্তিও শুনতে হয়। সবাই অবশ্য এক রকম না। তবে বেশিরভাগের মধ্যে এমন মনোভাব দেখলে খারাপই লাগে তাতে।
৪.
আমারও মনে হয়, চাকরিতে ভালোভাবে টিকে থাকতে হলে শুধু কাজের দক্ষতাই যথেষ্ট নয়। এর সাথে আরো অনেক কিছুরই প্রয়োজন আছে।
৫.
শেষটাতে ঘোষিকার কথা শুনে মজা পেলাম।
লেখাটা ভালো লেগেছে। এজন্য লম্বাচওড়া একটা মন্তব্য করে ফেললাম। এ ধরনের লেখা পড়তে বেশ লাগে। আরো আসুক।
ভাল্লেগেছে জেনে ভাল্লাগ্লো।
ট্রেনিং বিশেষ কিছু আলাদা নয়, তাই বিশদে যাই নি। পড়ে খুব মজা পেতেন না বোধ হয়।
"এজন্য লম্বাচওডা় একটা মন্তব্য করে ফেললাম": বেশ করেছেন।
নামার সময় ঘোষিকার মুখের ওপর একটা ঢেকুর তুলে বললেনা কেন- এয়ার ইন্ডিয়া!!!
হা হা
ঢঁেকুর আর ওঠে না যে, কিচ্ছুটি খেতে না দিলে সে বস্তু আসবে কোত্থেকে বলেন!
আহা, শিল্পের কথা শুরু না হতেই শেষ করে দিলেন ?? একটূ ছবি-টবি যদি দিতেন পাঠুদা- ফিনিক্সের মজাটা আরো ভাগ কর্তে পারতাম...
------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
শিল্পের তো ঝলকদর্শন করেছিলাম, বিশদ আর পাই কোথায়। ছবিও তুলি নি, জানতাম সুযোগ হবে না, তাই ক্যামেরাই নিই নি এই সফরে।
আমার কাছে বেশি ভাল লাগেনি, আত্মকেন্দ্রিক মনে হয়েছে। কিছু টাইপিং মিসটেক আছে, খুব তারাহুরুর মধ্যে ছেড়েন লেখাটা সেটা পড়লেই বুঝা যায়। তবে নূতন দেশ সম্পর্কে জানতে খারাপ লাগে না।
ধন্যবাদ।
দলছুট
==========
বন্ধু হব যদি হাত বাড়াও।
আত্মকেন্দ্রিকতার কথাটা ভুল বলেন নি, লেখার সময় আমারও সে সন্দেহ ছিলো, পড়ে খানিকটা শো-অফ মনে হবার অবকাশ আছে। কিন্তু সমাধান ভেবে পাই নি। যেমন ধরুন রিসর্টে ছিলাম এই তথ্যকে নম্রভাবে কী উপায়ে দেখাই, নিজের বাড়ি হলে গরীবখানা বলতাম কিন্তু একে কী বলি? আপনি বিশদে জানালে আরো কথা বলা যেতো কিন্তু তা তো খোলসা করেন নি।
তবে টাইপোর কথা থাক না হয়? আম্মো যে তিন বাক্যের মন্তব্যে দুটি শব্দ ভুল দেখলাম।
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
টাইপো কী দেখলেন বলেন তো, আমি তো খুঁজে পেলাম না একটি ছাড়া (পথাচারী), সেটাও ঠিক করে দিয়েছি।
টাইপো নিয়ে কিছু বলার আগে মনে হয় নিজের মন্তব্যের দিকে মন দেওয়াটা একটু শোভন হতো।
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ভাই, রাজর্ষিদারে এই গালি দিলে আমারে কি কইবেন?
খুব ভালো লাগলো পড়ে।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
অনেক ধন্যবাদ, সুজনভাই।
রাজর্ষি দা, বাঙালের ঘুম ছাড়া আর আছে কী, কন ? একঘুমে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে তো বাঙালের জীবনটাই ধন্য হয়ে যেতো ! হা হা হা !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কী যে কন, বাঙালের খানাখাদ্য আছে না? তরিবৎ করে রঁেধে খেয়েই তো আদ্ধেক জীবন কাটাই আমরা, শুধু ঘুমালে চলবে?
আপনার লেখা আর চন্দ্রবিন্দুর লিরিক। পাঁচতারা টাইপ জিনিস। চমৎকার লেখার জন্য ধন্যবাদ গ্রহন করুন ...
পুচ্ছে বেঁধেছি গুচ্ছ রজনীগন্ধা
বলেন কী, এ তো ভয়ানক প্রশংসা, নিজের লেখা আম্মো খুউব ভালো পাই তাই টপ করে বিশ্বাসও করে ফেললুম।
অনেক ধন্যবাদ।
আহা ফিনিক্স থাকলে দেখা করা যেত। স্কটসডেলের কোথায় কোথায় গেলেন? একটা চমৎকার ক্লাসি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল সেখানে। টেম্পি লেকে গিয়েছিলেন? কিংবা সেডোনা, গ্রান্ড কানিয়ন, টুম্বস্টোন?
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির
আহা কত কী নাম বললেন, আমি গেছি শুধু রিসোর্টের নিজের রুম থেকে কনফারেন্স হলে আর হল থেকে নিজের রুমে। লোকজন সুইমিং পুলের ধারে বসে জলবাষ্পে ঠান্ডা হলো, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, সেখানেও যাওয়া গেলো না সময়াভাবে।
যাক, হবে কোনো এক দিন।
আজ রাতে এলএ দৌড়োবো, জানি সেখানেও সেই একই হাল হবে। এক পুরোনো বন্ধু বলেছে নিজে এসে দেখা করে যাবে, শুক্কুরবারে রাতে ফেরার উড়ানের আগে, সেইটাই রৌপ্যরেখা হয়ে ঝুলে আছে আকাশে।
দারুণ লাগলো দিনলিপি স্টাইল ভ্রমণকাহিনি। পরেরটার জন্য অপেক্ষা।
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
থাংকু তুলিরেখা।
খুব নিয়মিত হবে না হয়তো, তবে চেষ্টা করবো।
নতুন মন্তব্য করুন