শিরোনামটা 'বইঠক' দেবো কিনা ভাবছিলাম, কিন্তু আজকাল আমরা এমনিতেই বইটই পড়ি কম, তার উপর প্রবঞ্চনার কথা শুনিয়ে শুরু করলে আরো বাজে ব্যাপার হবে ভেবে বানান নিয়ে আর কিছু কেরামতি দেখালাম না।
ঘোরাঘুরির মাঝে আজকাল কয়েকটা বাংলা ইংরিজি বই পড়া হলো, (সবগুলো শেষ করতে পেরেছি এমন না, অভ্যেস একেবারেই বিগড়েছে) কিন্তু আনন্দের কথাটা ভাগ করে নিই এখানে যাতে আগ্রহী পাঠক চাইলে জোগাড় করে পড়তে পারেন।
১
আরো নানা বিষয় আছে, মহাকাব্যের অলিগলিতে নানা আখ্যান-উপাখ্যান নিয়ে আলোচনা আছে অনেক। চরিত্রেরা জীবন্ত হয়ে ওঠে অনেক জায়গাতেই, বাল্মীকি ও ব্যাসদেবের লেখার কারুকৌশলের কথাও আসে। লক্ষ্মণ কীভাবে রামের অল্টার ইগো হয়ে বাল্মীকিকে পূর্ণনায়কের ছবি আঁকতে সাহায্য করেন, রামায়ণ কীভাবে গীতার কাউন্টার-পয়েন্ট হয়ে ওঠে সে সব বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পড়ে প্রচুর আনন্দ পেলাম।
২
আমি বিল মাহরের বিশাল ভক্ত, নানা কারণে। ওঁর শো রিয়েল টাইমে একদিন অতিথি ছিলেন গোর ভিডাল, যাঁকে বিল দর্শকদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন এ যুগের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যক্তিত্ব বলে। 'ওয়ান অফ দ্য মোস্ট' নয়, 'দ্য মোস্ট'। এ হেন শংসাপত্রের ফল হাতেনাতে ফলাতে ভদ্রলোকও সুরসিক ও মহা ফিচেলের মতো উইটের স্রোত বইয়ে দিলেন সারাক্ষণ। প্রায় পঁচাশি বছর বয়সের এই বর্ণময় চরিত্রের নাম আমি আগে শুনি নি, কিন্তু ঐ অনুষ্ঠান দেখে আগ্রহী হলাম খুবই। অতএব বর্ডার, এবং বেশ কয়েকটা বই দেখে কিনে ফেললাম ওঁর স্মৃতিচারণ (মেমোয়ার) প্যালিম্পসেস্ট (ভূর্জপত্র বলতে পারেন, বানানটা কি ঠিক লিখলাম?)। পড়তে পড়তে খুশবন্ত সিংয়ের "ট্রুথ, লাভ অ্যান্ড আ লিটল ম্যালিস"-এর কথা মনে হচ্ছিলো যেখানে মহা মহা সেলিব্রিটিরাও চেনা লোকের মতো এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়ায়।
গোর ভিডাল স্রেফ লেখক নন, তিনি সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, অনেক সিনেমা ও টিভির কাহিনী চিত্রনাট্য ইত্যাদি লিখেছেন, এবং অভিনয়ও করেছেন। কাজেই কেনেডি রুজভেল্টের সাথে পল নিউম্যান বা টেনেসি উইলিয়ামসের মতো চরিত্ররাও এ বইয়ের পাতায় পাতায় রক্তমাংসে ধরা দিয়েছেন। লেখক তাঁদের নিয়ে ভাবগম্ভীর আলোচনা ফাঁদেন নি, বরং মন ভরে পিএনপিসি বা কুটনামি করেছেন খোলাখুলি। এবং নিজেকেও বাদ দেন নি সেই আলোচনায়, যদিও কোথাও কোথাও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুর টের পেলাম, অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের ব্লগের মতো। বিশ্বযুদ্ধ, এবং আমেরিকার রাজনীতির বিবর্তনের ছবি মেলে একটা সুদীর্ঘ সময়কালের প্রসঙ্গে, লেখকের রাজনৈতিক বিচারও কীভাবে গড়ে উঠেছে টের পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত জীবনের কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে, বিতর্কিত বিষয়াদি তিনি সামলেছেন ভালোই। সব মিলিয়ে বেশ ঝরঝরে লেখা, সুখপাঠ্য। বইটির একটি রিভিউ পাবেন এখানে।
৩
এই বইটার কথা খুব বিশদে বলবো না একটাই কারণে, এটা এতো অসাধারণ একটা বই যে ঊদ্ধৃতি দিতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই ছত্রের পর ছত্র তুলে দিতে হবে। বিল ব্রাইসন আমার প্রিয় লেখক একজন, সিরাতেরও, মূলত তাঁর রসবোধ ও উইটের জন্য। ভ্রমণকাহিনী তিনি যা লেখেন পড়ে হেসে অস্থির হয়েছি অনেকবার (বিশেষতঃ 'নিদার হিয়ার নর দেয়ার' পড়ে)। এবার পড়লাম শেক্সপিয়ারকে নিয়ে লেখা তাঁর বইটি। আমি মহাকবির জীবনী বিশদে জানতাম না, সে তো জানলামই, সাথে পরিবর্তনশীল ইউরোপের সমাজ জীবনের কথা জানলাম, এবং জানলাম মন খুলে হাসতে হাসতে পড়ে। শেক্সপিয়ার পরোক্ষভাবেও রসের উৎস হয়েছেন আগে, শেক্সপিয়ার সমগ্র নামে একটি নাটক দেখেছিলাম বিলেতে, সেটি একটি হো হো হাসির জিনিস। এই বইয়ে ব্রাইসন প্রচুর পড়াশোনা করে তার ফলাফল আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন ফূর্তির মেজাজে, আর সেখানেই তিনি আমার মতো পাঠককে ভক্ত বানিয়ে ছেড়েছেন। শেক্সপিয়ারের স্বহস্তলিখিত শব্দ কটা পাওয়া গেছে জানেন? মাত্র চোদ্দটি, যার মধ্যে ছয়খানা স্বাক্ষরেই বারোটা শব্দ হয়ে গেছে। এবং আরো মজার ব্যাপার, এই স্বাক্ষরের কোনোটাতেই কবির পদবীর বানান আজকে যে বানান আমরা লিখি তার সাথে মেলে না। মোট ছবি পাওয়া গেছে তিনটি, যার কোনোটিরই সত্যতা সন্দেহাতীত নয়। এই যখন অবস্থা তখন মহাকবিকে নিয়ে প্রতি বছর দিস্তা দিস্তা লেখা ও গবেষণা হয়ে চলেছে, যার অধিকাংশই গবেষকের কল্পনাপ্রসূত। অ্যাকাডেমিসিয়ার এই জয়ঢাক ফাঁসিয়ে দিতে ব্রাইসন সামান্যও দ্বিধা করেন নি। কিন্তু সবটাই এমন মজাদার ভঙ্গীতে লেখা যে সারাক্ষণ হাসতে হাসতে অস্থির হতে হয়। ছোটো বই, দুশো পৃষ্ঠারও কম, সুযোগ থাকলে কিনে ফেলুন (কথা দিচ্ছি পস্তাবেন না) এবং পড়ে নির্মলানন্দ উপভোগ করুন।
১) "নীতি, যুক্তি ও ধর্ম: কাহিনী সাহিত্যে রাম ও কৃষ্ণ", লেখক: বিমলকৃষ্ণ মতিলাল
২) "Palimpsest: a memoir", by Gore Vidal
৩) "Shakespeare -The World as a Stage", by Bill Bryson
মন্তব্য
আরো জানার আগ্রহ থাকল।
ভাল থাকুন।
সৈয়দ আফসার
পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আরো কিছু পড়লে অবশ্যই আনন্দ ভাগ করে নেব।
তমিজ উদদীন লোদী
বইগুলো সম্মন্ধে জেনে ভালো লাগলো।এক সময় নানা রকম বই পড়তে আগ্রহের কমতি ছিলনা।এখন আর ওরকম পারিনা।যারা পারেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে।আপনি এখনো এই চমৎকার অভ্যেসের মধ্যে আছেন বলে মনে হচ্ছে।বইগুলোর সংক্ষিপ্তসার পড়ে আগ্রহ জাগলো।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ!
তমিজ উদদীন লোদী
আরে মশাই আমার অবস্থাও তথৈবচ, কিছুই পড়া হয় না। এ বইগুলো অনেক দিন পরে আবার পড়া হলো। কাজেই শ্রদ্ধা আপনার নেহাৎ অপাত্রে গেলো।
মূলোদা, আপনার লেখাটা পড়ে বইগুলোকে কেমন "শুকনো" টাইপ মনে হচ্ছে।
দুয়েকটা "রসময়" বই সম্পর্কে লেখা দিন। ড্যান ব্রাউনের "দ্য লস্ট সিম্বল" পড়তে শুরু করেছি। ঈদ উপলক্ষ্যে জামাই দায়িত্ব পালনের ঠ্যালায় বই-ই হাতে নিতে পারছি না।
অভ্যাস রয়েই গ্যালো দ্রোহীদা
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
তেমনটা লাগলে একেবারেই লেখার দোষ, শুকনো টাইপ হলে কি আর আমিই পড়ে উঠতে পারতাম!
প্রথমটা সিরিয়াস বই, সে কথা সত্যি। কিন্তু গোর ভিডাল মোটামুটি গড়গড়িয়ে এগোয়, আর ব্রাইসনেরটা তো ভয়ানক মজার। যদি একটা পড়তে চান তো ৩ নং টাই পড়ুন, ভালো লাগবে গ্যারান্টি।
রসময় বই তো কিছু পড়া হয় নি সম্প্রতি, আপনি বরং ঐ ড্যানবাদামিটাই পড়ে লিখুন আপনার অনুভূতি।
আরে কী আশ্চর্য, গোর ভিডালের পরিচয় আমিও পেয়েছিলাম রিয়েল টাইম থেকে!
ভদ্রলোকের "সিটি অ্যান্ড দ্যা পিলার" বেশ বিখ্যাত একটা বই। আমার বই পড়ার অভ্যাস একদম গেছে, তাই শেষ করতে পারি নাই।
উইলিয়াম এফ বাকলির সাথে এর বিতর্ক এবং লেখা চালাচালি গুলো ঘেঁটে দেখতে পারেন (যদি না দেখে থাকেন আর কি )
সিটি অ্যান্ড পিলার খুব বিতর্কিত হয়েছিলো, তার পরে ওঁকে কিছু দিন বেনামে বই লিখতে হয়েছিল কারণ প্রকাশকরা আর ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলেন না।
বিতর্ক তো দেখিনি, লিঙ্ক থাকলে পাঠান না। ইউটিউবে আছে তো?
আজকে কেবল তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পাচ্ছি... পাঠুদা, আপনার লেখার উইট এ লেখায় দেখিলুম না যে ?? দ্রোহী ভাইয়ের মত বলি-একটু রসযুক্ত বই রেকমেন্ড করুন না
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!
হা হা খুব যে রসলোভ দেখি, এতো রস মাখলে পিঁপড়া ধরবো নে।
এরপর কিছু ঝাকানাকা বইয়ের নাম প্রস্তাব করবেন তো!
নাম প্রস্তাব করতেই পারি, তবে না পড়েই করতে হবে যে। চলবে?
আপনার পাঠানো গান নামিয়েছি, শুনেছি, ভাল্লেগেছে। ধন্যবাদ।
আহ্ হা, ওগুলো আপনি নিজে না পড়লে কীভাবে হবে বলেন?
আমিও আপনার পাঠানো গানদুটো নামিয়েছি, শুনেছি, ভালোও লেগেছে বেশ। ধন্যবাদ আপনাকেও
মুগ্ধ করলো আপনার লেখা।
http://www.youtube.com/watch?v=WOrAIqaXPzM
এই হলো পার্ট ১। এর লেজ ধরে বাদ বাকী পার্টও পাবেন।
অনেক ভিডিও দেখছি, তবে বেশীরভাগ বোধহয় একই ভিডিওর উচ্চ বা নিম্ন সংস্করন।
থাঙ্কু
সন্ধেবেলা দেখতে বসবো।
ভালো লাগলো আপনার বই পরিক্রমা!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
অনেক ধন্যবাদ, তীরুদা।
আ:, চমৎকার!
-----------------------------------------------
কোন্ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ
এই লেখাটা এত কম হিট পাইলো ক্যান আর পাঁচ পাইলো না ক্যামনে? যাহোক আমি পাঁচাইলাম। ওয়ার্ল্ড এজ স্টেজ জইমা আছে, পড়ুম।
এরকম আরো লেখেন। আপনার রিসেন্ট লেখার ধরনধারন আমার সুপার লাগতেসে।
সে নিয়ে ভেবে বৃথা কালক্ষয় না করে বরং ঐ শেক্ষপিয়র পড়ে ফেলুন, দিল খুশ হয়ে যাবে একবারে!
কোনো লেখাই সব্বার ভালো লাগে না, কাজেই কারোর কারোর ভালো লাগলেই আমি সন্তুষ্ট হই।
প্রথম বইটা ইন্টারেস্টিং লাগল৷ খুঁজতে হবে তো৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
এটা একেবারে নতুন বই নয়, তবে আনন্দ'র দোকানে পাবেন আশা করছি। মহাকাব্য প্রসঙ্গে আমার তো নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির চেয়ে এঁর লেখা ভালো লাগলো বেশি।
নৃসিংহপ্রসাদের "মহাভারতের ছয় প্রবীণ" পড়ে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। খুবই রসিয়ে লিখতে জানেন তিনি। একটাই সমস্যা, অনুবাদ ছাড়াই সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেন, ফলে সংস্কৃত-অজ্ঞ পাঠককে হোঁচট খেতে হয়।
বিমলকৃষ্ণ অনুবাদ করে দিয়েছেন অধিকাংশ জায়গাতেই। এই বিষয়ে সমস্যা হবে না।
বালক বয়সে একবার বাৎস্যায়নের বিখ্যাত বইটির এক কপি হাতে পেয়ে ভীষণ উত্তেজিত বোধ করেছিলাম। কিছু পড়ে মনে হলো, এমন নীরস বই আমি কমই পড়েছি। মনে হলো, লেখক বোধহয় কোন লাইব্রেরীর ক্যাটালগার।
এখনো আমার মনে হয় মুণি কখনো কাজটি করেন নি তো বটেই, স্বচক্ষেও দেখেন নি। সব তাত্ত্বিক চিত্র, যার মধ্যে কিছু শারীরিকভাবে অসম্ভবও আছে।
যাঁরা প্রাচীন ভারতীয় মীথ বা সাহিত্যে খুব গভীর কিছু খোঁজেন, আমার মনে হয় তাঁরা নিজেদের আধুনিক জ্ঞান ও ধারণা দিয়ে সেই লোকজ সরল ঐতিহ্য অনাবশ্যকভাবে মহিমান্বিত করেন।
মহাভারতকে আমার খুব সহজিয়া ভাবের সরল লোকসাহিত্য লাগে না। তবে যে বইটির কথা বলেছি, তাতে রামায়ণ ও মহাভারতের সমাজচিত্র, সে যুগের নৈতিকতার সংজ্ঞা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা আছে, মহিমান্বিত করার খুব কিছু প্রচেষ্টা নেই।
ধনুবাদ, বইগুলো পড়ার আগ্রহ জন্মানোর জন্য।
********************************************************
এক মৎস্যকন্যার কথিকা
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
আপনাকেও ধন্যবাদ জানাই।
নতুন মন্তব্য করুন