প্রিয় এনএসইউ, তুমি কেমন আছ?

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি
লিখেছেন জেবতিক রাজিব হক [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৮/০২/২০০৯ - ৮:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেখতে দেখতে প্রায় দশ বছর কেটে গেল। ২০০০ সালের জানুয়ারীর কোন এক শীতের সকালে কিছুটা ভয়, কিছুটা শংকা নিয়ে পা রাখি বনানীর খুব উঁচু এক ভবনে। তার আগে চার মাস প্রি-ইংলিশে আমার মস্তিস্কে গুতিয়ে ইংলিশ ভরার চেষ্টা। পরের চার বছর এটাই আমার ঠিকানা, আমার ভার্সিটি।

মফস্বল থেকে উঠে আসা আমি ফটফট ইংরেজী বলতে পারিনা, কার ড্রাইভ করতে জানি না, ইউ.এস. টপ চার্টের পজিশন হাতড়ে মরি আর ভিতরে ভিতরে ছটফট করি। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে স্কুলের বিস্তৃত মাঠে দলবেঁধে দৌড়ঝাপ করে, তারুন্যের শুরু এম.সি. কলেজের বিশাল ক্যাম্পাসে মিছিল করে – আর এখানে মাত্র আড়াইখানা বিল্ডিং (ষ্টার, এসপিজি, আর বিটিএ’র কয়েকটা ফ্লোর)! একতলা, দুতলা, পাঁচতলা – সিঁড়ি ভেংগে ভেংগে ক্লান্ত হই।

এনএসইউ সম্পর্কে আমার ধারনা ছিল এখানে শুধু বড়লোকের পুতুপুতু ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে, সারাক্ষন ইংরেজীতে কথা বলে আর কিছুদিন পর ক্রেডিট ট্রান্সফার করে আমেরিকা অথবা কানাডাতে পাড়ি দেয়। সময় যায়, ধীরে ধীরে অনেকের সাথে পরিচয় হয়, বন্ধুত্বও হয়। একসময় আমি টের পাই, এই ইউনিভার্সিটিতে তিন ধরনের ষ্টুডেন্ট আছে। প্রথম গ্রুপে আছে খুব সিরিয়াস টাইপের ষ্টুডেন্ট, যাদের গ্রেড কখনই A বা A- নিচে নামে না। এরা সবসময় ক্লাসের প্রথম সারিতে বসে আর প্রশ্নে প্রশ্নে স্যারদের মাথা ধরিয়ে দেয়। পরের গ্রুপের ষ্টুডেন্টরা দামি গাড়িতে চড়ে আসে, এরা বাংলার চাইতে ইংলিশে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। এরা আর কি করে সেটা আমি জানিনা, কারন ঐ গ্রুপে ঢোকার যোগ্যতা আমি কখনই অর্জন করতে পারিনি। শেষ ভাগে (এই গ্রুপটাই সংখ্যা গরিষ্ঠ) আছে যারা বাধ্য হয়ে ক্লাস করে, ক্যান্টিনে ধুমায়া আড্ডা মারে, যখন তখন হেড়ে গলায় গান ধরে আর হঠাৎ করে A/A- পেয়ে গেলে লজ্জিত ভাবে আশেপাশে তাকায়, যেন বড় ভুল হয়ে গেল। আমি সেই শেষ ভাগে মিশে যাই।

এনএসইউ তখনো এতো বড় হয়নি। ষ্টার টাওয়ারের পাঁচ তলায় আমাদের ছোট্ট কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট। হক স্যার, পার্থ স্যার(দি গ্রেট পিপিডি), মোরসালিন স্যার, জিএমকিউ স্যার সহ গুটিকয়েক টিচার। নয় তলায় ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট, বারো তলায় বিবিএ’র অফিস। আর বিটিএ টাওয়ারে এনভায়রন্মেন্ট এবং ইকোনমিক্স। এইতো। ষ্টার-বিটিএ’র মাঝের রাস্তাটা খুব ভাঙ্গাচুরা। বৃষ্টির দিনে হাটাচলা দায়।তারউপরে রাস্তা জুড়ে গাড়ি। এই হাঁপধরা পরিবেশেও স্বস্তি পাই যখন দেখি এখানে কোন দলবাজী নেই, খালেদা-হাসিনা কে ভালো সেটা নিয়ে কোন রেষারেষি হয়না কিংবা ফার্ষ্ট ক্লাস পাবার লোভ দেখিয়ে কোন শিক্ষক তার ছাত্রকে দিয়ে বাসার বাজার করাননা।

এখানে এক্সট্রা-কারিকুলার এক্টিভিটি বলতে কয়েকটা ক্লাব।সেগুলো আবার অথরিটির পারমিশন নিয়ে কঠোর নিয়ম কানুনের মধ্যে চলে। কিন্তু সেই আইন কানুন তারুন্যের উচ্ছলতায় কখনই বাধা হয়ে দাড়ায়নি। ২০০১ সালের শেষের দিকে আমরা গঠন করি এনএসইউ মিডিয়া ক্লাব (ক্লাবটি এখন আর নেই, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে)। বের হয় ভার্সিটির প্রথম নিউজ লেটার – এনএসইউ নিউজ। আমি, ফয়সল, বাসু, আন্তা, রুশমি, সাব্বির – এক একটি সংখ্যা যেন দেশের প্রধান দৈনিক পত্রিকা বের করার আনন্দ! ক্লাবের সুত্রেই পরিচয় হয় ভিসি হাফিজ জি এ সিদ্দিকী স্যারের সাথে – নম্র, ব্যাক্তিত্ববান একজন মানুষ। অসংখ্য সীমাবদ্ধতার মাঝেও ক্লান্তিহীন। পরিচয় হয় প্রফেসর হারুনুর রশীদ স্যারের সাথে – যার কাছে জীবনের অনেক কিছু শেখা। আরো কতো যে স্মৃতি।

এনএসইউ-এর ক্লাবগুলা বেশ অদ্ভুত। এদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা হয়না। বরং একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে পারলেই যেন খুশি। ক্লাবের ভিতরেও চেয়ার নিয়ে কোন টানাটানি নেই। তাইতো কোন খেলাতেই কোনদিন জিততে না পারা সালেহীন হয়ে যার ষ্পোর্টস ক্লাবের হর্তাকর্তা, গান-নাচ-অভিনয় না জানা রিফাত কালচারাল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, আর যে আমি দুলাইন ইংলিশ লিখতে কলম ভেঙ্গে ফেলি, আমাকে করে দেয়া হয় এনএসইউ নিউজের সম্পাদক। এসব নিয়ে কারো কোন আপত্তি নেই, বরং নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে সবাই একজোট।

একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। ২০০১এর নির্বাচনের আগেরদিন। ঢাকা শহর থমথমে। ৪-২০এর ক্লাসটি আগে আগে ছুটি দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলায় আমরা মঞ্জুর টং দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। প্রক্টর শাহরিয়ার স্যার (SAC sir) এসে আমাদের বাসায় চলে যেতে বললেন। শহরের অবস্থা ভালোনা। কিন্তু আমাদের আড্ডাতো আর শেষ হয়না। স্যারও আমাদের ফেলে যাননা। ষ্টার টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেক্ষন পর যখন আমাদের আড্ডা ভাঙ্গে, স্যার এসে বলেন, ‘রাস্তায় কোন সমস্যা হলেই আমার মোবাইলে ফোন করবে।’ আর যাদের বাসা দূরে তাদের পৌছে ফোন করতে বললেন। ‘আমি শিওর হতে চাই যে তোমরা নিরাপদ।’ এতো মমতা কিভাবে ভুলি। টের পাই মাত্র আড়াই হাজার ষ্টুডেন্ট নিয়ে ছোট্ট ক্যাম্পাসটা একটা পরিবার, আমাদের এনএসইউ ফ্যামিলি।

তবে এর মাঝেও ছন্দপতন হয়। খুব সম্ভবত ২০০২ এর মাঝামাঝি হঠাৎ নোটিসে আমাদের টিউশন ফি দশ হাজার সাতশ থেকে বাড়িয়ে বারো হাজার টাকা করা হয়। ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনা। হয়তো ভয়, হয়তো শংকা, হয়তো গা ছাড়া অভ্যেস, জানিনা। একটা গ্লানি থেকে যায়। টপ লেভেলে বসে থাকা ব্যাবসায়ীরা মনে হয় টাকা বানানোর নতুন উপায় খোজে পায়। তাই ২০০৯এর লাফটা হয় আরো বড়। বারো হাজার থেকে একেবারে সাড়ে ষোল।কিন্তু এবার আমাদের ছোট ভাইবোনের বসে থাকেনা। তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে কতৃপক্ষ পিছু হটে। ফোনে এই খবর পেয়ে আমার খুব ভালো লাগে। তাই আজ হাজার মাইল দূর থেকে আমি সেই কমরেডদের সালাম জানাই।

বর্তমানে নেটইউজারদের মধ্যে ফেইসবুক ক্রেজ চলছে। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন গ্রুপ খোলার হিড়িক। কে সকালে নাস্তা করেনা, কে রিকশায় চড়তে পছন্দ করে, কারা প্রেমে ছ্যাক খাইছে, সবারই একটা করে গ্রুপ আছে। সেই ফেইসবুকে দেখলাম আমার এক ছোট ভাই জুবায়ের একটা গ্রুপে জয়েন করেছে। গ্রুপটার নাম – ‘We HATE NSU Rajakars( SOME of the--Club members & TAs)’। টের পাই, পরিবার বড় হচ্ছে। আস্তে আস্তে ফাটল দেখা দিচ্ছে। মাত্র কয়েকটা বছরে কি এনএসইউ এতোটাই বদলে গেল? যে ক্লাবগুলো একসময় সাধারন ষ্টুডেন্টদের সাথে অথরিটির সেতুবন্ধন ছিল, তারাই ধীরে ধীরে তল্পিবাহক হয়ে পড়েছে? এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ‘রাজাকার’ গালি দিচ্ছে! কিভাবে সম্ভব? নিশ্চয়ই কোন ভুল বোঝাবুঝি। গ্রুপটা হয়তো কোন ক্ষুব্ধ ছাত্রের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। নিজেকে স্বান্তনা দেই।
গ্রুপে কিছু ছবি। তার মধ্যে একটা ছবিতে একটা কোমল হাতে স্যান্ডেল উঁচু করে ধরা। প্রতিবাদী ষ্টুডেন্টের ভিতরের ক্ষোভ কিছুটা হলেও টের পাই। শান্তিপূর্ণ এ প্রতিবাদে এটা কোন বড় ব্যাপার না। ছবির নিচে একজনের কমেন্ট, মেয়েটা নাকি বলছে-‘ভিসি তুই কই? দুশ্চরিত্র, লম্পট।’ সিদ্দিকী স্যারকে খুব কাছে থেকে বেশিদিন দেখিনি। যতটুকু দেখেছি, গালিদুটো মনে হয় তাঁর প্রাপ্য ছিলনা। বুঝতে পারি, ফাটলে এবার ইঁদুর ঢুকেছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।

প্রিয় এনএসইউ, কিছুদিনের মধ্যেই তুমি তোমার ঠিকানা বদলে বসুন্ধরায় চলে যাবে, আইডি নেই বলে সেখানে হয়তো আমি ঢুকতেও পারবোনা, তবে তোমার বনানীর সেই ইঁটকাঠের খাঁচার মধ্যেই আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময় কাটিয়েছি, সুমন, রায়হান, ফয়সল- পেয়েছি সত্যিকারের কিছু বন্ধু, হারুন স্যার, জিএমকিউ স্যারের মতো মহান মানুষের সান্নিধ্য, তোমার মাঝেই জীবনের প্রথম এক মায়াবতীর হাত ধরে বলা – ভালোবাসি।

প্রিয় এনএসইউ, তুমি যেখানেই যাও, যেভাবেই থাকো, তুমি থাকবে অন্তরের খুব গহীনে, খুব প্রিয়তম কোন স্থানে।


মন্তব্য

গৌরীশ রায় এর ছবি

মন খারাপ করা লিখা ।
তোর মজার স্মৃতিচারণ গুলো কবে লিখবি?

রেনেট এর ছবি

লেখাটি ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------------------------------
If your father is a poor man, it's not your fault ; but If your father-in-Law is a poor man, it's definitely your fault.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অনিকেত এর ছবি

ভাল লাগল।

লীনা ফেরদৌস এর ছবি

Lina Fardows

খুব সাবলীল লেখা , পড়তে গেলে এক নিঃশ্বাষে পুরোটা শেষ করতে ইচ্ছে হয়। আরো চলুক

Lina Fardows

রায়হান আবীর এর ছবি

লেখাটা ভাল্লাগছে...

=============================

নিঝুম এর ছবি

সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন । আপনি কি ইংল্যান্ডের ,নিউক্যাসেল শহরে থাকেন ?
---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

থাকতাম।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

লেখাটা ই প্রত্যয় যুক্ত ভালো হয়েছে ।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুন লেখা। ভাল্লাগল।

তানবীরা এর ছবি

সব প্রিয় জিনিস গুলোই সময়ের আর্বতে ঘুনে খেয়ে যায়।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

নজমুল আলবাব এর ছবি

সচলে স্বাগতম।

তোর কাছ থেকে এমন লেখা চাইনা রাজু। সেইসব সময়ের মতো তুই মন ভালো করা লেখা দে। ঝরঝরা করে দে গুমোট পরিবেশকে।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

রানা মেহের এর ছবি

দোস্ত
NSU চারনে কার কথা বাদ পড়ে গেল মনে হয় দেঁতো হাসি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।