ডাক-২

সাফি এর ছবি
লিখেছেন সাফি (তারিখ: শুক্র, ০৯/০৫/২০১৪ - ১০:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্বের পর...

২।

“ও ও ও, সামার ওয়াইন"

গাড়ি চালাতে চালাতে চিৎকার করে রেডিওর সাথে গলা মিলায় সমু। আজকে মনটা খুবই ফুরফুরে। খুব ভাল একটা কাজ পেয়ে গেছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার হিসেবে এতদিন একটা বড় ফার্মে কাজ করলেও মাত্র কিছুদিন হলো বের হয়ে এসে নিজেই নতুন কোম্পানি খুলেছে। এই এরিয়ায় নাম আর পরিচিতি হওয়াটাই আসল - এটা বোঝার পরেই নিজের কোম্পানি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। আজকে পাশের শহরে এসেছিল ক্লায়েন্টের সামনে প্রেজেন্টেশন দিতে। প্রথমদিন প্রেজেন্টেশনের পরে, পরের দিন ওদের সিদ্ধান্ত নিয়ে মিটিং করার কথা। কথা ছিল আরেকটা দিন থাকবে। কিন্তু প্রথম প্রেজেন্টেশনেই ক্লায়েন্ট পছন্দ করে ফেলল। তাই সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাতেই বাসায় ফেরার। গাড়ি চালাতে চালাতে সমু আরচোখে ড্যাশবোর্ডের ঘড়ি দেখে, এখনও ঘন্টা দুয়েক এর পথ বাকী। পথ মোটামুটি নিঃসঙ্গ। হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার ওপাশ দিয়ে হুশ করে একটা করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। দুপাশে কী আছে, অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখে, অন্য হাতে মোবাইল নিয়ে সাজিয়াকে কল দেয় সমু। কিন্তু ও পাশ থেকে কেউ ফোন ধরেনা। হয়ত সামিয়াকে ঘুম পাড়াচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে বাসাটার কথা চিন্তা করে। এই বাজারে এত সস্তায় যে বাড়িটা পেয়ে যাবে, ভাবতেও পারেনি। তাই রিয়েলটর বাড়িটার কথা আর দাম বলা মাত্রই সাথে সাথে রাজি হয়ে গেছিল। তার উপরে শহরের এক কোণায় বাসা, পাশেই বন শুরু হয়ে গেছে। নিচতলায় একটা ঘরকে নিজের অফিস বানিয়ে নিয়েছে। এরকম ছিমছাম আর চুপ্চাপ জায়গাই ডিজাইনের জন্য মনে মনে খুঁজছিলো। সাজিয়া অবশ্য একটু খুঁত খুঁত করছিলো। বাড়িটা দেখার পর থেকেই ওর বলে ভয় ভয় করছিল। সমু নিজের মনেই হেসে ওঠে। এরকম ভাল দাম আর বাসা যে পাবেনা এটা সাজিয়াও জানে। তাই ঝটপট কিনেই ফেলে ওরা। সামিয়ার ও নতুন ঘর হয় - ও বড় হচ্ছে, আজ হোক কাল হোক ওদের বড় বাসায় যেতেই হত। হঠাৎ সব স্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়ে মোবাইল বেজে ওঠে। এক হাতে স্টিয়ারিং আরেক হাতে মোবাইল নিয়ে, দেখে সামিয়া।

- কী খবর তোমাদের?
- উফ্ফ আর বলোনা। সামিয়া তো ঘুমাতেই চায়না। অনেক কষ্টে এতক্ষণ পর ঘুমালো। তোমার কাজ কতদূর?
- হয়ে গেছে। কাজটা তো পেয়ে গেলাম, তাই রাতেই চলে আসছি
- ওহ ওয়াও! এই তুমি গাড়ি চালাচ্ছ?
- হু
- আই তাহলে রাখি, সাবধানে চালাও। আর কতক্ষণ লাগবে তোমার?
- এইতো আর ঘন্টাখানেক।
- আচ্ছা শোন আজকে কিন্তু আমার স্পেশাল আদর চাই, হাসতে হাসতে বলে সমু।
- তোমার মাথা। গাড়ি চালাও তুমি, সাবধানে আস।

ফোন রেখে দেয় সামিয়া, আপন মনে হাসতে হাসতে বাড়ির পথে যেতে থাকে সমু।

৩।

"সামিয়া"

সামিয়া অবাক হয়ে ডাক শোনে। আম্মুর দিকে তাকায়। আম্মু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। ছোট্ট সামিয়াকে কী বলবেন ভেবে পায়না। নিচতলা থেকে খুট্খাট কাজ করার আওয়াজ আসতে থাকে। অবিকল আম্মুর মতন করে কে যেন গুণগুণ করে সুর ভাঁজছে। সামিয়ার হাত ধরে সাজিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে ওকে বিছানায় নিয়ে যেয়ে, শুইয়ে দেয়। নিজেও পাশে শুয়ে পরে।

- নিচতলায় কে আম্মু?
- তুমি বুঝবেনা মা, আরেকটু বড় হও তারপর বুঝতে পারবে।
- নতুন বুয়া এসেছে নাকি আম্মু?
- হ্যা মা, সাজিয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

সামিয়ার বেশ খুশী খুশী লাগে। আগের বাসায় বুয়ার সাথে ওর অনেক বন্ধুত্ব ছিল। বাসার কাজ না থাকলেই বুয়া ওর সাথে খেলতে বসত। সামিয়া যখন রান্না রান্না খেলত তখন সত্যিকারের হাড়িকুড়ি বের করে দিত খেলার জন্য। আম্মু একবার দেখে বুয়াকে সে কি বকা - সামিয়া খেলতে যেয়ে হাড়িতে দাগ ফেলে দিবে তাই। সামিয়ার খাওয়া গোসল থেকে সবকিছুই বুয়া করত। সামিয়ারা যখন বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় আসবে, তখন বুয়ার কান্না দেখে কে। মনে হয়েছিল যেন নিজের আত্মীয় কেউই চলে যাচ্ছে। বুয়া কেন সামিয়াদের সাথে আসলনা এটা সামিয়া এখনও বোঝেনা। বড়দের অনেক কিছুই ওর কাছে অর্থহীন লাগে। আসার সময়ে আম্মু বলেছিল সামিয়াকে যে নতুন বাসায় গেলেই নতুন বুয়া ওর বন্ধু হয়ে যাবে - তখন আর এই বুয়াকে ওর মনে পরবেনা। কিন্তু এই বাসায় আসার পর থেকেই আর কোন বুয়ার দেখা নাই। আম্মু সেদিন আব্বুকে বলছিল এই বাসায় বলে কোন বুয়াই কাজ করতে রাজি না - কী নাকি অদ্ভূত ব্যাপার! সামিয়া অবশ্য বুঝতে পারেনা। এখন যে তাহলে নতুন বুয়া এসেছে এই খবরেই ও খুশী হয়ে যায়, সামিয়া তাহলে আব্বু আম্মু অফিসে গেলে সারাদিন ওর সাথে খেলতে পারবে।

জানো মা, বুয়ার না একদম তোমার মতন গলা। আমি তো ভেবেছি তুমি আমাকে ডাকছিলে নিচতলা থেকে।

তাই নাকি। ভারী বোকাতো তুমি। আম্মু এবার একটু হাসে। বার বার দরজার দিকে তাকায়। কী করতে হবে বুঝতে পারেন না। আবার উঠে দরজার সামনে থেকে হেঁটে আসে। দরজার ছিটকিনিগুলো দেখে আসে মনে হয়।

পশ্চিমদিকের খোলা জানালা দিয়ে এক দমকা হাওয়া ঘরে ঢোকে। সামিয়া শীতে কেঁপে ওঠে। বাতাসের শব্দে কী এক করুণ হাহাকার! মনে হয়ে যেন কারো দীর্ঘশ্বাস। এর সাথে তাল মিলিয়ে যেন সামিয়ার মা নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

তুমি ঘুমাও মামণি। অনেক রাত হয়েছে। আবার সকালে উঠতে হবে - বলতে বলতে পায়ের কাছ থেকে চাদর নিয়ে সামিয়ার গায়ে দিয়ে দেন। পাশে শুয়ে সামিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চাপা গলায় অদ্ভূত করুণ সুরে ঘুমপাড়ানি গান শুরু করেন। ঘুমে সামিয়ার দুচোখ বুজে আসতে থাকে। এই নতুন গানটা আম্মু আগে কখনও গায়নি। কিছু একটা বলতে যেয়েও আর বলতে পারেনা। ঘুমে ঢলে পরে। সামিয়ার মা চাদরটা ভাল করে সামিয়ার গায়ে দিয়ে দেয় আবার। কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে।

একটু পরেই দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়।
"সাজিয়া, আমি চলে এসেছি" বলে বাইরে থেকে চাপা স্বরে ডেকে ওঠে সমু। নীচতলার গুনগুণানি থেমে যায়। পায়ের শব্দ রান্নাঘর থেকে ধীরে ধীরে দরজার দিকে যেতে থাকে। দরজার লক খোলার আওয়াজে সামিয়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাজিয়া, ফিসফিস করে বলে ওঠে- "এবার আর তোমাকে নিতে দিবোনা, মা"

দূর থেকে একটা কুকুরের কান্নার শব্দ আসতে থাকে.... অবিকল মানুষের মত।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ফোন রেখে দেয় সামিয়া, আপন মনে হাসতে হাসতে বাড়ির পথে যেতে থাকে সমু।

ফোন রেখে দেয় সামিয়া নাকি সাজিয়া হবে?

সাফি এর ছবি

মনযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। সাজিয়া হবে। ঠিক করে দিচ্ছি।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভয় দেখান কেনু?

"এবার আর তোমাকে নিতে দিবোনা, মা"
-বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, এরকম কি কয়েকবার হয়েছে আগে এদের সাথে?

শুভেচ্ছা হাসি

সাফি এর ছবি

হতেও পারে চোখ টিপি আগামী পর্বে দেখা যাবে।

আয়নামতি এর ছবি

ছমছমে গল্প ভালু হয়েছে চলুক
সাফির গল্পে 'স' এর ছড়াছড়িতে প্যাচ লেগেছে তাই।
শিমুলভাই একটা বলেছেন।

দেখে সামিয়া।

সাজিয়া হবে হে!

সুবোধ অবোধ এর ছবি

নিজের নাম 'স' দিয়ে শুরু বলে সাফি ভাইয়ের এই অক্ষরের প্রতি বিশেষ দুব্বলতা আছে মুনে কয়! খাইছে

সাফি এর ছবি

একদম

সাফি এর ছবি

সামিয়া সাজিয়া নিয়ে নিজেই গেঞ্জামে পরে গেছি দেখা যায় খাইছে

সুবোধ অবোধ এর ছবি

এইটাও ভালৈছে, তবে প্রথম টা আমার কাছে বেশি ভাল্লাগছিল। ভৌতিক গপ্পো আরও চলুক ...

সাফি এর ছবি

এইটা অবশ্য ফিলার, দেখি পরের পর্বে কী হয়।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হ্যাঁ, রহস্যময় বটে! চলুক

সাফি এর ছবি

চলুক

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

ভূতের গল্প ভালু পাই !!!
চলুক, চলুক। দেঁতো হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

সাফি এর ছবি

হাসি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আগ্রহ নিয়ে পড়ে যাচ্ছি কিন্তু - আর প্রত্যাশার পারদটাও কিন্তু চড়ে যাচ্ছে!!!

____________________________

গান্ধর্বী এর ছবি

পরের পর্ব কবে ছাড়বেন মশাই? পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।