আমেরিকার বড় বড় সুপারমার্কেটগুলোর দোকানে লোক টানার একটা জনপ্রিয় আইটেম হলো রোটিসেরি চিকেন। জিনিসটা আর কিছুইনা আমাদের দেশের মুরগীর গ্রিল। মার্কেটের ডেলি অংশে গেলে বড় বাক্সের মধ্যে যদি মুরগীকে শিঁকে গাঁথা অবস্থায় ঘুরতে দেখেন, তাহলেই বুঝলেন আপনি পাইলেন তাহাকে পাইলেন। এদের সবখানেই পাওয়া যায়, ওয়ালমার্ট হোক, ক্রোগার হোক কিংবা কস্টকো/স্যাম্স ক্লাব। দোকানে লোক আনার বঁড়শি হিসেবে এই জিনিস অতুলনীয় কারণ, এরকম (প্রায়) রান্না করা মুরগী মোটামুটি রেগুলার মুরগীর দামেই প্রায় দোকানে বিক্রি করে। আমরা যেমন কস্টকো গেলেই একটা কিনে নিয়ে আসি। কস্টকোতে একটা আস্ত রোটিসেরি চিকেনের দাম যেখানে ৫ ডলার, সেখানে ফ্রোজেন মুরগীর দাম ৬ ডলারের উপরে। আকারে উভয়ই প্রায় সমানে সমান। কিন্তু কিনলেই তো হবেনা - খেতেও হবে। দেশীয় মাল মসলা ছাড়া এই রোটিসেরি চিকেন খেতে অনেকটা মালঞ্চ বা ছায়ানীড়ের মুরগীর গ্রিলকে সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিলে খেতে যেমন লাগা উচিৎ সেরকম। আর তাই নেসেসিটির যন্ত্রনা থেকেই এই রেসিপির জন্ম।
প্রথমেই বলে নেই। এই রেসিপি নতুন কিছুনা। কোরবানীর মাংস পুরানো হলে বাসায় পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে উত্তমভাবে কসে যেই গরুর মাংসের ঝুড়ি বানায়, এইটার সাথে তার ব্যাপক মিল। তবে পার্থক্য হলো, ঐ ক্ষেত্রে আমরা মাংস বাসী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, আর এই রান্নায় দোকান থেকে এনেই টাটকা রেঁধে ফেলব। যেহেতু এইটা আমি এবং আমার মতন ফাঁকিবাজ মানুষজন রাঁধবে তাই উপকরণগুলো সবই মোটামুটি হাতের নাগালে কিনতে পাওয়া যায় এমন। যা লাগবে -
এর সবকিছুই ওয়ালমার্ট থেকে শুরু করে পাড়ার মুদির দোকানে পাওয়া যাবে। সুতরাং মাথায় কোন চিন্তা না রেখে মনে ফুর্তি ফুর্তি ভাব রেখে, প্রথমে
একটা রোটিসেরি চিকেন কিনে আনুন বাসায়। তারপর চাকু বা কেঁচি অথবা হাত দিয়ে ছিড়ে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলুন। বড় হাড়গুলো না রাখাই ভাল, কারণ হাড়গুলো দেখা যায় কয়েকদিন ফ্রিজে থাকলে কেমন গন্ধ গন্ধ হয়ে যায় - মনে হয় মুরগির খামারে বসে খাচ্ছি। তবে ছোট চিকন হাঁড়, যেগুলো কুড়মুড়িয়ে খাওয়া যায় সেগুলো রাখা যেতে পারে। টুকরাগুলো দৈর্ঘ্য প্রস্থে আধা ইঞ্চি জাতীয় হলেই ভাল হয়। আমি যেটা করি হাঁড় থেকে মাংসগুলো আলাদা করে চাইনিজ ছবির কসাইয়ের মতন করে আল্লাহর নামে চাকু চালিয়ে দেই - প্রথম আড়াআড়িভাবে এরপর লম্বালম্বিভাবে। তাতেই মোটামুটি কাটা হয়ে যায়। কাটার ব্যাপারে আনাড়ি হলে নিচের ভিডিও ফলো করা যেতে পারে। তবে চোখ না বাঁধলেও হবে -
মুরগী কাটা হয়ে গেলে, একটা বড় কড়াই চুলায় রাখুন। চুলা জ্বালাতে ভুললে চলবেনা। মাঝারি আঁচে দিলেই হবে। কড়াই একটু গরম হলে, তাতে তেল ঢেলে দিন। তেল গরম হতে এক থেকে দেড় মিনিট সময় লাগবে। এই সময়টা মোবাইলে ফেসবুক গুঁতাগুতি করুন। উপরে দেওয়া লিঙ্ক থেকে ওরচেস্টারশায়ার সসের ইতিহাস পড়ে আসতে পারেন। কাহিনী ইন্টারেস্টিং। আবার চাইলে রান্নাঘরে ল্যাপটপ নিয়ে এসে তাতে গান সিনেমা চালিয়ে রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে এই রান্নার জন্য প্রায় মিনিট পনেরো ধরে ঘুঁটা দিতে হবে। সুতরাং প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।
এবার তেল গরম হয়ে যাওয়া মাত্র তাতে মুরগী ছেড়ে দিন। সাথে আদা, রসূন আর মরিচ গুড়া/পেস্ট দিয়ে ভাল করে নাড়ুন যেন মুরগী, তেল আর মসলা মেখে মুখে একাকার হয়ে যায়। ব্যাস রান্নার প্রথম ধাপ শেষ। এইবার একটু পর পর নাড়ুন আর পাশাপাশি পেঁয়াজ আর মরিচ কুঁচিকুঁচি করে কেটে ফেলুন।
নাড়তে নাড়তে মুরগীর ধীরে ধীরে ভাজা ভাজা হয়ে আসবে। চেহারা অনেকটা নিচের ছবির মতন হয়ে আসলে এর মধ্যে সয়া সস দিয়ে দিন। এবার চুলার জ্বাল বাড়িয়ে প্রায় সর্বোচ্চ জ্বালে দিয়ে দিতে হবে। নাড়ানো থামালে তলায় লেগে যাবে। সুতরাং এই ব্যাপারে নো ফাঁকিবাজি। এক মিনিট মতন ঘুটাঘুটি হলে, কাটা পেঁয়াজ আর হালাপেনো মরিচ মুরগীর মধ্যে দিয়ে দিন। আবার নাড়তে থাকুন। নাড়ার সময়ে যে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, এমন কোন নিয়ম নাই। সুতরাং ল্যাপটপে ছাড়া মুভি বা গানে মন দেওয়া যেতে পারে।
আরো খানিকক্ষণ নাড়াচাড়ার পরে একটু শক্ত হয়ে আসলে (বিভ্রান্ত হবেন না, মুরগীর কথা বলা হচ্ছে), দেখা যাবে পেঁয়াজের রং হালকা বাদামী বাদামী হওয়া শুরু হয়েছে। তখন হটডগে মাস্টার্ড দেওয়ার মতন করে মুরগীর উপরে মাস্টার্ড দিয়ে দিন। মাস্টার্ড এর কারণে খেতে একটু ঝাঁঝালো হবে। অনেকের মাস্টার্ড পছন্দনা সেক্ষেত্রে এই অংশ বাদ দেওয়া যেতে পারে। তবে তখন স্বাদের ব্যাপারে রেসিপি কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেনা। ঘুটাঘুটি বন্ধ করলে যেহেতু পুড়ে যেতে পারে তাই নাড়ানো অব্যাহত রাখতে হবে।
মিনিটখানেক নাড়ানোর পরে, এইবার কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করতে হবে কী কী দেওয়া বাকি আছে। এই তালিকায় প্রথমেই আসবে শুকনা মরিচ। আস্ত দিলে হবেনা। হাত দিয়ে ছিড়ে ছিড়ে প্রতিটা মরিচ তিন/চার টুকরা করে মুরগীতে দিয়ে দিন। শুকনা মরিচ দেওয়ার এক মিনিট মতন পরে ওরচেস্টারশায়ার সসটা দিয়ে আরো এক মিনিট নাড়ুন। ব্যাস রান্না প্রায় শেষ। চুলা বন্ধ করে দিয়ে মিনিট পাঁচেক রেখে দিন। রান্না প্রস্তুত।
রান্না শেষ হওয়া মাত্র প্রথমে আপনার রান্নার ছবি তুলুন তারপর এইটার একটা জ্বালাময়ী নাম দিন। আপনার মুঘল প্রীতি থাকলে মুরগীয়ে আজম বা এরকম কিছু একটা নাম দিতে পারেন। অথবা ঈদের কাপড়ের মতন বেবিডল মুরগ বা কামলিম মুরগ জাতীয় নাম দিতে পারেন। তবে ভুলেও থাই নাম দেওয়া যাবেনা (একবার থাই রেস্টুরেন্টে খেতে যেয়ে শুনি ওদের জনপ্রিয় আইটেমের নাম "পাদ কাঁপাও", ফ্রাইড রাইসের নাম "খাও পাদ"! )। যাই হোক পাদাপাদি বাদ দিয়ে ফেসবুকে রান্নার ছবিসহ স্ট্যাটাস দিয়ে দেন। মুরগী ভাত বা রুটি দিয়ে খেতে পারেন অথবা শুধু শুধুও খেতে পারেন। একদিনের রান্নায় ৩-৪ বেলা চলে যাবে। গ্যারান্টি সহকারে রেসিপি দিলাম বিফলে মূল্য ফেরত। রেসিপি নিয়ে গবেষণার সময়ে ওরচেস্টারশায়ার সসের মতন উত্তরাধূনিক জিনিসপাতি আমদানী করায় আমার বৌরে ধন্যবাদ। হ্যাপি কুকিং।
মন্তব্য
worchestershire = উস্টার। কেন? জানিনা।
গুড। আমার মতো অলস লোকের দরকার এমন রেসিপি। দেখি আসছে সামারে এইটা রাইন্ধা কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারি নাকি
অলমিতি বিস্তারেণ
রুটিছাড়া চিকেন আমার খুবই অপছন্দের। এইখানে এক বড়ভাই আছে, কোন পটলাকের প্ল্যান থাকলে সে কোন রান্না বান্নার ঝামেলায় না গিয়ে সুপারস্টোর থেকে এই অখাদ্য রুটিছাড়া চিকেন কিনে নিয়ে আসে। এই চিকেনের যে অবস্থা এইটা আসলেই রুটি দিয়ে খাওয়া একেবারেই সম্ভব না। সেই হিসাবে রুটিছাড়া চিকেন নামটা ঠিকই আছে। নেক্সট কোন পার্টি থাকলে দেখি না খাওয়া চিকেন টা নিয়ে আইসা আপনার রেসিপি প্রয়োগ করা যায় নাকি।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ফার্স্টওয়ার্ল্ড রেসিপি
দেখতে কিন্তু জম্পেস হইসে। রুটিসেরি চিকেন এর বদলে নরমাল চিকেন দিলেও তো এই মশলাপাতি-ভাজাভাজির পর একই রকম আউপুট আসতো মনে হয়।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
রোটিসেরি চিকেন নেওয়ার মূল কারণ হলো মুরগী ছিলা, কাটা পরিষ্কার করার কোন ঝামেলা নাই। ঝট করে কিনে এন পট করে রান্না করে ফেল।
রেসিপি পইড়া এত আনন্দ আগে পাই নাই । খাইতে আশা করি সম পরিমান আনন্দ পাইব। এই জিনিশ রন্ধন করার জন্য ইনিশিয়াল একটা প্ল্যান আমি নিছি । থাই খাবারের নাম শুইনা হা হা কইরা ইকটু হাসলাম । কথা পুরাই সত্য। একবার বাংলাদেশ থেকে আগত এক অভিজাত পরিবারের সম্মানে থাই রেস্টুরেন্টে দেয়া ডিনার খাইতে গিয়া আমিতো পুরাই টাশকি খাইছিলাম যখন দেখলাম মেনুতে লেখা "পাদ খাই" কিম্বা "গুয়ে টুয়ে পাদ খাও" ।
সোহেল লেহস
পোস্ট ভাল লেগেছে। কিন্তু চিকেন আমার ভাল লাগে না।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
-এর রহস্যটা কি? আমার ধারণা এরা একটা মুরগিকে যখন শিকে বেঁধে ঘুরায়, তখন ভয়ে অন্য মুরগিরা এসে আর ৩-৪ ডলার দিয়ে যায়; তাই গ্রিল করার পরে ৫ ডলারে বেচলেও দোকানের লোকসান হয় না।
শুভেচ্ছা
ঘটনা তো সুবিধাজনক মনে হইতেসে না, হিমায়িত মুরগির চেয়ে তাজা ঝলসানোটার দাম কম ক্যান??
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে
রেসিপি দেখে খেতে ইচ্ছা করছে। তবে এরকম জিনিস তো এখানে মার্কেটে পাইনি এখনো। আস্ত মুরগি গ্রিল খেতে ইচ্ছা করছে এখন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন