বুয়েটে ভর্তির পর, প্রথম যেই টিউশানি পাই, সেইটা ছিল বাপ্পীকে পড়ানোর। কলাবাগানের স্টাফ কোয়ার্টারে ছোট্ট একটা দুই বেডরুমের বাসা, সেখানে যেয়ে আমি বাপ্পীকে পড়াতাম। বাপ্পী আমার এক বছরের ছোট, তখন তার ঢাকা কলেজে টেস্ট পরীক্ষার কিছু বাকী। প্রি-টেস্টে বা কোন একটা পরীক্ষায় প্রচন্ড খারাপ করার পরে ফিজিক্স আর ম্যাথ পড়ানোর জন্য শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পেলাম।
বাপ্পীকে পড়াতে যেয়ে প্রথম দিন ই যেটা বুঝলাম, সেটা হলো এই ছেলেকে দিয়ে কিছু হবেনা। ইন্টার পরীক্ষার যেখানে মাস ৬-৭ বাকী সেখানে তার বই ঝা চকচকে নতুন। রাখ ঢাক না করে, সরাসরিই ওকে বললাম যে, এই অবস্থা চললে পাশ করা মুশকিল আছে। বাপ্পী এক গালে হেসে আমাকে বলে - ভাইয়া আপনি কাজ দেন, আমি করে রাখ্বো। বাপ্পীকে পড়ানো শুরু করলাম। অল্প কিছুদিন যেতেই তার চরিত্রের একটা অদ্ভূত দিক আবিষ্কার করলাম! তারে যাই বলা হোক, সে খালি হাসে। আমি তখন নতুন নতুন ছাত্র পড়াই, রক্ত গরম। সহজ জিনিস বুঝতে না পারলে, তাকে গরু গাধা সম্বোধন করা নিয়মিত ব্যাপার। আমি যখন মাথা গরম করে বলি, এইটা কী করস? গাধা নাকি তুমি? সে তখন দাঁত বের করে হাসে, আর বলে আপনি দেখায় দেন আমি ঠিক করে ফেলব। এই রকম মানুষের সাথে বেশীক্ষণ রাগ করে থাকাও মুশকিল। আবার পড়ানো শুরু করতাম।
বাপ্পীর বাবা মা কেউই প্রথম শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন না। সচিবালয়ে কোন একটা মন্ত্রনালয়ে তারা কাজ করতো। আমি বাপ্পীকে বুঝাতাম - তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সেই অবস্থায় আমাকে বেতন দেওয়া কতখানি কষ্টের ব্যাপার হতে পারে। এই পর্যায়ে বাপ্পী হাসতোনা, গম্ভীর হয়ে যেত, এক দেড় মিনিট মাথা নীচু করে কিছু একটা চিন্তা করে আবার দাঁত কেলিয়ে হেসে বলতো ব্যাপার না ভাইয়া, আপনি দেখায়ে দেন আমি পারবো।
বাপ্পীর খুব শখ ছিলো বুয়েটে পড়ার। আর আগ্রহ ছিলো ইলেক্ট্রনিক্সে। মাঝে মাঝেই ড্রয়ার খুলে আমাকে দেখাত সে কী বানিয়েছে। কোনদিন টর্চ, কোনদিন মটর দিয়ে কিছু একটা। বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল এ পড়তে হলে কী করতে হবে, এইটা নিয়ে মাঝে মাঝে আমার সাথে আলোচনা করতো। আমি তেমন পাত্তা দিতাম না, ঐ সময়ে তার ইন্টার পরীক্ষা মোটামুটি ভালভাবে পাশ করাটা জরুরী ছিলো। তাকে সেইটা বুঝানোর চেষ্টা করতাম, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হলে নম্বরের ভিত্তিতে একটা বাছাই হয়, সেই বাছাই এ টিকতে হলে তাকে ইন্টারমিডিয়েটে ভালো করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। বাপ্পী দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসতো।
বাপ্পীকে প্রচুর বাড়ির কাজ দিতাম। অদ্ভূত ব্যাপার ছিলো, সে এই কাজটা খুব মন দিয়ে করতো এবং কখনওই ফাঁকি দিতোনা। বলা ছিলো যে, গাইড বই যেন না দেখে, সে এইটা খুবই সততার সাথে মেনে চলতো। যদি কোনটা না পারতো, চেষ্টা করতো, খাতায় স্ক্র্যাচ রেখে দিতো বা অনেক অঙ্ক অর্ধেক করে রেখে দিতো। আমি বুঝায়ে দিতে গেলে, মাঝে মাঝে যখন গাইড বই থেকে সমাধান দেখে নিতাম, তখন বাপ্পীর আনন্দ দেখে কে। বলা বাহুল্য এই আনন্দের উপলক্ষ্য প্রায়ই আসতো।
যাই হোক, বাপ্পীর ইন্টার পরীক্ষার সময় চলে আসে। আমার পড়ানোও শেষ হয়। বাপ্পীদের ফোন ছিলোনা। তাই পরীক্ষার খবর ও নেওয়া হয়নাই। হঠাৎ একদিন বাপ্পী ফোন করে, সে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়তে চায়। কিন্তু ঐ সময়ে আমার পুরোদমে সেমিস্টার চলে, তাই তাকে বলি যে এখন পড়ানো সম্ভব না। তার উপরে আমার অতটা আস্থাও ছিলোনা সে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা আদৌ দিতে পারবে কি না। কিন্তু সে না পড়ে ছাড়বেনা। তখন একটা ব্যাবস্থা করি, ভর্তি কোচিং এ পড়বে আর মাঝে মাঝে সে আমার বাসায় এসে পড়া দেখে যাবে। বাপ্পী হাসি হাসি মুখে ঝাড়ি খেতে খেতে বুয়েটের জন্য তার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়, তাই পড়ানো বন্ধ করতে হয়।
এরপরে অনেক্দিন আবার যোগাযোগ নাই। হঠাৎ বাপ্পীর সাথে দেখা বুয়েটে, ক্যাফের আশেপাশে। জানায় সে ন্যাভাল আর্কিটেকট এ সুযোগ পেয়েছে, বুয়েটেই। আমার জন্য অবিশ্বাস্য একটা খবর। ইন ফ্যাক্ট খবরটা শোনার পরেও বিশ্বাস করতে পারিনাই। কিন্তু চেষ্টা এবং অধ্যাবসায় দিয়ে বাপ্পী সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলো। বুয়েটে মাঝে সাঝে দেখা হতো, ঐটুকুই কিন্তু আর যোগাযোগ ছিলোনা, একদমই। বছর খানেক আগে, ফেসবুকে হঠাৎ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলাম, ওমর ফারুক। ছবি দেখে বুঝলাম বাপ্পী। প্রোফাইলে দেখলাম, হাল্কা কথাও হলো। তখন সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোন একটা ফার্ম এ চাকরি করে। খুবই ভাল লাগলো।
আজকে সন্ধ্যায়, ইফতারের আগে আগে, হঠাৎ শুনলাম লুইজিয়ানাতে একটা ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, নাম ওমর ফারুক। শুনে ঘুনাক্ষরেও ভাবিনাই এই ওমর ফারুক ই আমার ছাত্র ওমর ফারুক বাপ্পী। এর পর বিডিনিউজের খবরে দেখি বাপ্পী, সেই মিটিমিটি হাসি।
গাধা ছেলে, এইভাবে হেরে গেলি?
[১] বিডিনিউজের খবর
[২] ছবি বিডিনিউজ থেকে নেওয়া, এই ছবি বাপ্পীর ফেসবুক প্রোফাইলেও ছিলো।
মন্তব্য
লেখা পড়তে পড়তে একগাদা ফিচলে মন্তব্য রেডি করতেছিলাম... শেষটা থামায়ে দিল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
উফ, গড।
চোখ ফেটে জল আসতে চাচ্ছে! খুব কষ্ট পেলাম।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
শেষটাতে এরকম কাদাবে ভাবিনি
মানকচু
ছেলেটার সফলতার খবর পড়তে পড়তে যেই ভালা শুরু হয়েছে ওমনি মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সো সরি টু হিয়ার দ্যা নিউজ!!!
হায় হায়!!
ব্লগবাড়ি । ফেসবুক
-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।
এই ধরনের লেখা পড়তে গেলে কেন যেন আজকাল শুরুতেই একটা খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে চলে আসে। এটার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু পড়তে গিয়ে একদম প্রায় শেষের দিকে পৌঁছে যেয়ে মনে হচ্ছিল এটা শুধুই সফলতার কথা। কিন্তু না...
শেষটা আসলেই খুব কষ্ট দিলো।
আশা করছিলাম ইলেক্ট্রনিক্সের ভাল কিছু আবিষ্কার বা এই রকম কিছু একটা পাবো, কিন্তু শেষে এসে যে এভাবে থমকে যাবো, ভাবিনি! আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে বাপ্পীর কোলের ছোটটাকে দেখে!!
____________________________
দেবদ্যুতি
মন খারাপ করা লেখা
- উদ্দেশ্যহীন
এমনটা যেন আর কারও সাথে না হয়।
মনটাই খারাপ করে দিলেন
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
সড়ক দূর্ঘটনা ও তাতে নিহত আহত আমাদের বিগত এক যুগে উদয় হওয়া নতুন বাস্তবতা। এখন আমার পরিচিত অর্ধশত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব, পরিচিত ইত্যাদিকে জানি যারা এর সরাসরি ভিক্টিম।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
বেশ কয়দিন পর ঢুকলাম সচলে। ভাবছি নতুন কি লেখা এলো পড়ি এক এক করে।
এত্তো খারাপ লাগছে লেখাটা পড়ে আর ছবিটা দেখে।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আহারে, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো!
**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।
মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।
নতুন মন্তব্য করুন