এটি বড় একটি ছবির অংশবিশেষ। আজ থেকে প্রায় আঠার/বিশ বছর আগে ছোট মামার ঘরে তোলা। ফেইসবুকে দেখলাম মামা স্মৃতিকাতর হয়ে সেই ছবিতে কমেন্ট করেছে। এই ঘরটা ছিল তার লিটল ওয়ারল্ড! ছবিটি থেকে কেটে এখানে শুধু শোকেসের অংশটা দিলাম কারণ এই শোকেস ঘিরে আমার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি। ছোটবেলার স্মৃতি আমার কথা বলার প্রিয় বিষয়। তার উপর আজকে ছোট মামার জন্মদিন তাই ভাবলাম সবার সাথে স্মৃতি-কথা গুলো ভাগ করে নেই। সেই ফাঁকে ছোট মামা কে জানাই তাঁর গোছানো প্রিয় ঘরটি নিয়ে এক অজানা কাহিনী!
এই ঘর নিয়ে আমাদের কাজিনদের মধ্যে আগ্রহের কোন কমতি ছিল না। আমরা প্রায়ই তার গোছানো ঘর এলোমেলো করে ফেলতাম বলে ঘরের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তারপর বাইরে যেতেন। মাঝে মাঝে তালাও লাগাতেন। যদিও তালা দেয়া না থাকলেও সিটিকিনি খোলার সাহসই আমাদের ছিলো না! তবে আমি যেহেতু বয়সে বাকিদের থেকে কিছুটা বড় ছিলাম তাই মামা বাসায় না থাকলে নানুর কাছ থেকে চাবি নিয়ে সেই ঘরে ঢোকার অনুমতি পেতাম।
ঘরের ভেতর এই শোকেসটাই ছিল আমার সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে হাত বদল হয়ে নিয়মিত নতুন বই জমা হতো। আর মামার নিজের সংগ্রহের তো কিছু ছিলই। আমি তখন মামার মালিকানাধীন বই গুলো পড়ে ফেলেছি। আর হাত বদল হওয়া বই গুলো পড়ে শেষ করে সারতে পারতাম না। কারণ লুকিয়ে পড়তে হত; পড়ার গতি ছিলো কম। শেষ করার আগেই তাঁর বন্ধুরা এসে ফেরত নিয়ে যেত। পড়া শেষ হবার আগে কেউ বই নিয়ে গেলে খুবই মন খারাপ লাগতো। কাউকে বলতেও পারতাম না। কারণ স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে বড়দের বই পরছি শুনলে তো আর রক্ষা নাই; এই ঘরে ঢোকাই বন্ধ হয়ে যাবে। এই শোকেসটা নিয়ে আমার স্মৃতিশক্তির একটা পরীক্ষা দিতে পারি। আমার ধারণা আমার যা যা মনে আছে তার অনেক কিছুই হয়তো ছোটমামার নিজেরও এখন মনে নেই। অবশ্য নিজের ঘর বলে কথা; মনে না থাকারও কোন কারণ দেখি না। সে যাই হোক, আমার আগ্রহের বিষয়টুকু তো আর কেউ জানে না, সেটাই এখন বলছি।
শোকেসের ভেতরের লাল গাড়িটা ছোট রেসিং কারের রোডপ্লেটের উপর রাখা। গাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে ঠিক মনে হলেও এটার ভেতরের মোটরটি আর নেই। কারণ মোটর বের করে চকবার আইসক্রিমের কাঠির সাথে লাগিয়ে একটা ব্যাটারি চালিত ফ্যান বানানো হয়েছিলো।
শোকেসের একেবারে পিছনে যে একটি কাগজের মত দেখা যাচ্ছে সেটি মামার পর্যটনের উপর কোর্সের সার্টিফিকেট। সামনে সেন্টমার্টিন থেকে আনা একটি প্রবাল। বড় একটা শৈবালও ছিল। দুটোর একটাও কিনে আনা না। নিজে সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন। মামার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম, এগুলো বিক্রেতার কাছ থেকে কিনলে পরিবেশের ক্ষতি কিন্তু নিজে ঘুরতে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে আসলে তেমন কোন অসুবিধা নেই। যদিও কেন এটা বলেছিলেন সেটা বোঝার মত বয়স তখনও হয়নি।
শৈবালের গায়ে কালচে দাগ উঠানোর জন্যে এসিড দিয়ে ধুতে হবে। এসিড যোগার হচ্ছিলো না তাই সেটা বইয়ের পেছনে রেখে দিয়েছিলেন। প্রবালের পাশে পেপার ওয়েটের ভেতর সবুজ লিকুইড, পুতি আর চুমকী ছিল। গোল যে স্টিকারটি, সেটা বাংলাদেশ পর্যটনের প্রমোশনাল স্টিকার। এটার মাঝখানে ফাঁকা অংশটা আসলে ফাঁকা ছিলো না। এখানে লাগানোর আগে ব্লেড দিয়ে গোল করে কেটে ফাঁকা করা হয়েছে, নইলে যে শোকেসের অনেক কিছু ঢাকা পরে যায়। ভেতরে থরে থরে সাজানো বই গুলোর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের বই ছিল বেশ কয়েকটি। তবে কবিতার বই ছিলো সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা ছিল। নজরুলের সঞ্চিতাও ছিল। সুকান্তের কবিতা সমগ্র ছিল। ময়মনসিংহ গীতিকা ছিল। জসিম উদ্দিনের কবর বইটা ছিল। এই বইটার মলাট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাই বইটির নাম মামা লাল মার্কার দিয়ে হাতে লিখে রেখেছিল। তসলিমা নাসরিনের কলাম ছিল, হুমায়ুন আজাদের সব কিছু ভেঙ্গে পরে বইটি ছিল। পুর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন সম্পূর্ণ সিরিজটা ছিল। সে বইটির প্রচ্ছদের ঝাকড়া চুলের বাবরি ওয়ালা মাথা দেখে মামা একদিন কাপড়ে আঁকার রঙ আর তুলি কিনে এনে সেটা তাঁর একটি টি-শার্টে একে ফেলেছিলেন।
জাফর ইকবালের প্রথম বইটাও এই ঘরে বসেই পড়া। বইটা কয়েকদিন ধরেই খাটে পরে ছিল। নাম আধডজন স্কুল। আমি ভেবেছিলাম চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের লেখা বই বোধহয়। তার কিছুদিন আগে টিভির খবরে দেখেছিলাম তিনি মারা গেছেন। ভাবলাম হয়ত মারা যাবার আগে তার ছেলেবেলা নিয়ে বই লিখে গেছেন। বই পড়ে বুঝতে পারলাম উনি আসলে হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই। আমার বাগান নামে একটি বই ছিল কিভাবে বাগান করতে হয় সে বিষয় নিয়ে লেখা। আমি যখনই কোন গাছ লাগাই, আমার সেই বইটার কথা মনে পরে!
ক্ষুদে বিজ্ঞানীর প্রজেক্ট নামের একটা ছোটদের বিজ্ঞানবিষয়ক বই ছিল। এটা দেখে বাতাসের দিক নির্দেশক যন্ত্র বানিয়েছিলাম, বাসায় পাখি আসার জন্য একটা পাটাতনে কিভাবে খাবার আর পানি রেখে গাছে আটকে দিতে হয় সেটা শিখে আমাদের আম গাছে এরকম একটা পাখির বাসা বানিয়েছিলাম।
রাশিয়ান অনেক গুলো বইয়ের বাংলা অনুবাদ ছিল, তার মধ্যে ´টেলিস্কোপ কি বলে´ আকৃতিতে সবচেয়ে বড়সর বই। আরেকটা খুবই ইন্টারেস্টিং বই ছিলো নাম মনে পরছে না (বুড়ো হয়ে যাচ্ছি!), সেখানে অনেক ইনট্রিগিং থট এক্সপেরিমেন্ট ছিল যেমন পৃথিবীর মাঝখান দিয়ে এমাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছিদ্র করে সেই ফুটা দিয়ে একটা বল ফেলে দিলে শুধু অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে কী ঘটতে পারে, এর সাথে বাতাস থাকলে কী ঘটবে এসব।
একদম নিচের তাকে কিছু একাডেমিক বই ছিল। সেগুলোও পড়া শুরু করেছিলাম। আধুনিক রাষ্ট্রের দর্শন, আর মনোবিজ্ঞানের জনপ্রিয় কিছু এক্সপেরিমেন্টের সাথে প্রথম পরিচিত হই এই ঘরে বসে। আমেরিকার কালোদের উপর অত্যাচারের কাহিনী নিয়েও একটি বই ছিল; নাম ভুলে গেছি।
বাম পাঁশের একদম নিচের খোপটাতে আছে মিশরের প্যাপিরাস পাতা দিয়ে বানানো কাগজে আমুন, আতেন আর ক্লিওপেট্রার ছবির রেপ্লিকা। এগুলো অবশ্য আব্বু এনেছিল কুয়েত থেকে। মামা এখানে রেখেছে ফ্রেমে বাঁধাই করবেন বলে।
গানের ক্যাসেট গুলোর কথা বলার তো অপেক্ষাই রাখে না। নতুন ব্যান্ড ডিফারেন্ট টাচ আর বেশ কিছু আবৃত্তির ক্যাসেট রেগুলার বাজতো এই ঘরে। মাইকেল জ্যাকসনের প্রায় সব গুলো এ্যালবামই মামার কাছে ছিল। সুইডিশ ব্যান্ড অ্যাবা আর দ্যা কার্ডিগানের গানও মামা শুনতেন, যে কারণে আমরাও শুনতাম। বনিয়েমের শোঁ মি ইউর মৌশন শা লা লা লা গানের তালে আমার মামাতো ভাই পাপ্পু যে কী নাচটাই না নাচত, সেটাও মনে পরলো এখন! গান গুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল, রিভারস অফ ব্যাবিলন। এখনও এই গানটার শুরুর হু-হু-হু সুরটা শুনলে ম্যাজিকের মত ছোটবেলার অনেক স্মৃতি আমার মনে পরতে থাকে! অদ্ভুত সুন্দর ছিল আমার ছোট বেলা। এখন মাঝে মাঝে যখন ভাবি মনে হয় এটা বুঝি আমার ছেলে বেলা না; এটা উপন্যাসে পড়া কোন লেখকের বানানো গল্প।
ও! লাল গাড়িটার পেছনে মুন্ন সিরামিকের প্লেটে আঁকা নজরুলের ছবিটার কথাই তো বলা হল না। প্লেটের লেখাটা আমার এত প্রিয় ছিল যে, তখনই ঠিক করেছিলাম যেদিন আমি টাকা উপার্জন করবো সেদিন আমিও এরকম একটা প্লেট কিনে আমার ঘরে সাজিয়ে রাখব। প্লেটের গায়ে লেখা ছিল-
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না।
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না।
ছবি তে দেখা যাচ্ছে না, একই ধরণের প্লেটে রবীন্দ্রনাথের যুবক বয়সের একটি ছবিও ছিলো। সেখানে কী লেখা ছিলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
হঠাৎ সেদিন বাসায় স্কাইপে ভিডিও চ্যাট করার সময় দেখলাম, বাড়ি বদলের চক্করে শোকেসটা এখন আমার ফেলে আসা ঘরে শোভা পাচ্ছে। সে ঘরটি এখন অবশ্য আর আমার নয়। আমার ছোট ভাই রিয়েলের। তাই শোকেস ভর্তি এখন রিয়েলের পছন্দের বই। এই শোকেসটি এলোমেলো করার জন্য যারা এখন বকা খায় তারা হচ্ছে নিহিম আর নিবিড়। রিয়েল নিহিম এবং নিবিড়ের ছোট মামা। নিহিম-নিবিড় বড় হবার পর হয়তো তাদেরও এই শোকেসটা ঘিরে তাদের ছোট মামার অজানা কোন গল্প থাকবে! সে গল্পটি কেমন হবে কে জানে!
মন্তব্য
এত্তো ভালো লাগলো! একটা শোকেস ঘিরে কতো গল্প।
পিচ্চিদের নিয়ে আরো লেখা চাই।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
অনেক ভালো লাগলো, আমারো ছোট বেলা নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে, ঘন্টার পর ঘন্টা বলতে পারব।
এখন মনে হলে, মনে হয় এত অদ্ভুত ছিল সময়, অদ্ভুত ছিলাম আমি, কিন্তু সেই অদ্ভুত টা অনেক তীব্র সুন্দর। বই পড়া নিয়েই যে কত গল্প, আহারে!
অনন্যা
বাহ! আপনিও আপনার ছোট বেলা আর বই পড়ার গল্প আমাদের জানান।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এটার কোন সিকুয়েল নেই তো!
আমার ছোটবেলাতেও এমন একটা আলমারি ছিল
আমার নানুর আলমারি। ওই আলমারিতে থাকা বইগুলি দিয়েই আমার পাঠক জীবনের শুরু। এখনও আছে আলমারিটা। কিন্তু বইগুলি নেই।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”
অলীক জানালা _________
আপনার নানুর আলমারি নিয়ে গল্পটা লিখে ফেলুন।
ছোট মামা টু ছোট মামা শোকেস ট্রান্সফারের বিষয়টা জটিল ঠেকল!
..................................................................
#Banshibir.
শোকেসটাকে রিয়েলের ঘরে দেখে আমিও অবাক হয়েছি।
নবম শ্রেণীতে পড়বার সময় আমার বাবা আমাকে একটা চাবি দিয়ে বলেছিলেন আজ থেকে এই শোকেজটা তোর, সেই শোকেজ ভর্তি ছিল বই আর বই। নজরুলের সঞ্চয়িতা, সুকান্ত সমগ্র অরিজিনাল, তারাশঙ্করের গণদেবতা, কুয়াশা সিরিজের প্রথম বই, মাসুদ রানা'র প্রথম দিককার অনেকগুলো বইয়ের অরিজিনাল কপি ইত্যাদি ইত্যাদি। আহ, সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সময় করে লিখব একদিন। লেখাটা ভালো লাগলো।
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
লিখে ফেলুন।
সিটকিনি > ছিটকিনি। মুক্তধারা থেকে বের হওয়া 'ক্ষুদে বিজ্ঞানীর প্রজেক্ট' বইটা ডঃ আলী আসগরের লেখা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বানান ঠিক করে দিয়েছি। ধন্যবাদ। বইটির লেখকের নাম মনে ছিলো না। ছোটদের জন্য বাংলায় এটি চমৎকার একটি বই।
কমল অামাকে জে গিফট লিখার মাঝে করল the best one.
When i left Jurain I gave my precious shocase to Real, Hope he is the perfect one to preserve my memory this is the main reason to hand over the shocase.
sorry I am not use to write Bangla easily.
শুভ জন্মদিন মামা। আপনার লাইফ স্টাইল সারা জীবন আমাদের কাজিনদের মাঝে এরকম আকর্ষণীয় থাকুক।
ভালো লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ।
ইনট্রিগিং থট এক্সপেরিমেন্টের বইটা কি সকলের জন্য পদার্থবিদ্যা?
এত চমৎকার লেখা! আহা!
____________________________
মনে হয় বইটার নাম সকলের জন্য পদার্থবিদ্যাই ছিলো। যতদূর মনে পড়ে, নীল রঙ্গের পেপারব্যাক কাভার ছিলো বইটার।
সকলের জন্য পদার্থবিদ্যার চার খন্ডের বই ছিল- রাশান বইয়ের অনুবাদ। তার মধ্যে প্রথম পর্বটা বোধহয়। অনেক মজার মজার থট এক্সপেরিমেন্ট ছিল ওখানে, আর সাথের কার্টুনগুলোও ছিল মজার।
____________________________
ঠিক বলেছেন। আমি পড়ের খন্ড গুলো আর কোথাও দেখিনি।
কী সুন্দর স্মৃতিমাখা লেখা।
আমারও এরকম একটা খুব আকর্ষনের জায়গা ছিল। আমার নানার রুম। উনি নিজের ছোট্ট একটা রুমে থাকতেন ঘরের সামনের দিকে। সবার যাবার অনুমতি ছিলনা সেই রুমে। মাঝে মাঝে ঢুকতে পারতাম। অদ্ভুত একটা গন্ধ রুমজুড়ে। খাটের নীচে রাখা মুড়ির মোয়া, নাড়ু। কোণায় রাখা নানার বিখ্যাত হুক্কা।
কতকিছু মনে করিয়ে দিলেন।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
স্মৃতি গুলো সবার ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু কেমন করে যেন একই সুতোয় গাথা!
নতুন মন্তব্য করুন