সন্দেশের ডাকে সারা দিবো-দিবো করেও দেয়া হচ্ছিলো না। সুপারভাইজারের ডেডলাইনের চাপ উপেক্ষা করে কি বোর্ডের ভাষাটি বাংলা করে নিয়ে লিখতে বসলাম, ২০১৫তে আবিষ্কৃত একজন লেখকের বই নিয়ে। বইটি আবার খুলে বিভিন্ন চ্যাপ্টার বা কিছু লাইন কোট করে লিখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেভাবে সময় নিয়ে লিখতে গেলে আর লেখাই হবে না, তাই স্মৃতি থেকেই লিখছি। বইটি পড়ে ভাল লেগেছিল; সেটি জানানোটাই বই পড়ার গল্পের মূল উদ্দেশ্য।
ই-বুক রিডিং ডিভাইসটিতে অভ্যস্ত হবার পর, আগের চেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে বইয়ের দোকানে যাই। দোকানে প্রিন্টেড বই গুলো হাতে নিয়ে দেখে আসি। যেটা ভালো লাগে টুক করে ক্লিক করে কিন্ডেল থেকে কিনে ফেলি। কিন্ডেলের সুবিধা হচ্ছে, বার-বার শহর পাল্টানোর পরও বই গুলো হারিয়ে যায় না। বই কেনার জন্য সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট আছে। যখন ইচ্ছা তখন বই কেনা যায়। রাত জেগে কাউকে বিরক্ত না করে লাইট নিভিয়ে বই পড়া যায়। খুব কম না হলেও, প্রিন্টেড বইয়ের চেয়ে দাম অন্তত কিছুটা কম পড়ে।
একদিন কুপ নামের একটি বইয়ের দোকানে নেকেড স্ট্যাটিস্টিক বইটি দেখলাম। নেড়ে চেড়ে বেশ পছন্দ হলো। সাথে কিন্ডেলটি ছিলো না। বাসায় গিয়ে নাম লিখে সার্চ দিলাম। একই লেখকের, একই রকম প্রচ্ছদের এবং একই রকম নামের আরেকটি বই চলে এলো। এবং আমি বোকার মত ট্যাপ করে সেটিই কিনে ফেললাম। পড়া শুরু করে বুঝতে পারলাম। ভুল করে ফেলেছি। এই বই, সেই বই নয়। ই-বুক কিনে ফেরত দেয়ার সময়সীমাও ততক্ষণে শেষ।
কি আর করা! আক্কেল সেলামি দিয়ে এবার অধিকতর সতর্কতার সাথে নেকেড স্ট্যাটিস্টিক বইটি কিনলাম। বইটি এতটাই সুখপাঠ্য, যে শ্লথের গতি নিয়েও সম্পূর্ণটা পড়া সম্ভব; কোন বেগ পেতে হয় না। পরিসংখ্যানের বিষয়ে কৌতূহল আছে, কিন্তু ডিগ্রি নেই, এমন যে কারো বইটি ভালো লাগবে। নানারকম গবেষণার বা জরিপের কাজে ব্যবহৃত স্ট্যাটিস্টিক্যাল এনালিটিক মেথড গুলো দৈনন্দিন জীবনের খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে প্রতিটি অধ্যায় লেখা হয়েছে। খুব সহজ শব্দ দিয়ে বাক্য রচনা করা হয়েছে। তাছাড়া, কিন্ডেলে পড়ার আরেকটি অন্যতম সুবিধা হচ্ছে কোন শব্দের অর্থ জানা না থাকলে, সে শব্দের উপর আঙুল রাখলেই সহজ প্রতিশব্দ এসে হাজির হয়।
লেখক বেশ কিছু মজার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন যেগুলো পাঠকের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ধরে রাখে। যেমন, অসুস্থ মানুষ আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন। অসুখ সারাতে আসলেই দোয়ার কোন প্রভাব আছে কিনা সেটা বের করার জন্য কী ধরনের পরিসংখ্যান ব্যাবহার করতে হবে। এ ধরণের একটি এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে পরিসংখ্যানগত ভাবে কি কি ঝামেলায় পড়তে হয়, সে বিষয় নিয়েও আছে আগ্রহ উদ্দীপক অধ্যায়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারলে জীবনটাই বদলে যায়। এটা কি সঠিক ধারণা? নাকি সেখানে যারা ভর্তি হয় তারা অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন এবং সম্ভাবনাময়, যে কারণে তারা হার্ভার্ডে থেকে না পড়লেও জীবনে সাফল্য পেত। এটা পরীক্ষা করে বের করার জন্য তো গবেষকের ইচ্ছে মত এক দল ছাত্র ভর্তি করে দেখা সম্ভাবনা। তাহলে কি এই প্রশ্নের আসলেই উত্তর দেয়া সম্ভব নয়? তাৎপর্যপূর্ণভাবে জীবন পরিবর্তনে বিশেষ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলেই কোন ভূমিকা আছে কি নেই সেটা কি পরিসংখ্যানের সাহায্য নিয়ে বের করা সম্ভব?
আবার ধরা যাক কোন একজন ক্রিকেট প্লেয়ারকে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়র বলা হচ্ছে। কিভাবে বলা হচ্ছে? বাকি সবার সাথে কেমন করে তুলনা করা হয়, শুধু গড় রান সংখ্যা দিয়ে নিশ্চয়ই নয়? (বইতে বেসবলের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে।)
সিনেমা বা টিভি সিরিয়াল দেখার ওয়েবসাইট নেটফ্লিক্স কিভাবে সাবস্ক্রাইবারে পছন্দের চলচ্চিত্র বা টিভি সিরিয়ালটি খুঁজে বের করে সুপারিশ করে? কি করে দর্শকের রুচি জেনে যায়?
এরকম আগ্রহোদ্দীপক বিষয় গুলো পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে, তাই কিছু অধ্যায় পড়া শুরু করলে, শেষ না করে ওঠা যায় না।
পরিসংখ্যান ব্যাবহার করে অনেক জটিল সমস্যা সহজে সমাধান করে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করা যায়। তারপরও কেন পরিসংখ্যানের নামে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানোর অভিযোগ (lie damn lies and statistics)। কারণ, ভুল মানুষের হাতে সঠিক পরিসংখ্যানও ভুল ফলাফল দেয়। কার্যকারণ ঠিকঠাক মত না বুঝে পরিসংখ্যানের ফলাফল নিয়ে মাতামাতি পণ্ডশ্রম হতে পারে। এরকম হলে দেখা যাবে, পুরো শহর ঘুরে খেটেখুটে জরিপ করে উপসংহারে লিখেছে- যে বছর আইসক্রিম বেশি বিক্রি হয় সে বছর বেশি লোক পানিতে ডুবে মারা যায়। স্ট্যাটিস্টিক্যাল সিগনিফিকেন্স লেভেল p = ০.০০৫। এবং সেই ফলাফল পড়ে কোন পরিসংখ্যানজ্ঞানশুন্য জনহিতৈষী সংগঠন পানিতে-ডুবে-মৃত্যু ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করে এলাকার দোকানিদের আইসক্রিম বিক্রি করা বন্ধ করে দিলো। তাতে কি কোন লাভ হবে?
কোন লাভ হবে না! কেননা ব্যাপারটি তো আসলে, যে বছর গরম বেশি পরে সে বছর আইসক্রিম বেশি বিক্রি হয়। যে বছর গরম বেশি পরে সে বছর লোকজন পানিতে নেমে গোসলও করে বেশি। এবং সাতার না জেনে পানিতে বেশি লোক নামার কারণেই ডুবে মারা যাবার সংখ্যা বেশি হয়। আইসক্রিম বিক্রির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু জরিপে প্রাপ্ত উপাত্ত নিয়ে কো-রিলেশন এনালাইসিস করলে তাৎপর্যপূর্ণ মিল কিন্তু ঠিকই পাওয়া যাবে। তাতে, না ঘটনাটি সত্যি হয়ে যায়, না পরিসংখ্যান মিথ্যে হয়ে যায়।
সুপারভাইজারের ডেডলাইনটা মিট করেই পড়া শুরু করবো, 'ভুলে' কিনে ফেলা একই লেখকের নেকেড ইকোনোমিকস। দেখা যাক, সেখানে তিনি আমার জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
মন্তব্য
খুব সুন্দর পর্যালোচনা। কবে যে সময় পাবো আর একটার পর একটা বই শেষ করব!
ধন্যবাদ খালেদ।
পড়তে আরাম লাগলো খুব।
আর দ্বিতীয় ছবির আইডিয়াটা খুব পছন্দ হয়েছে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ তিথীডোর।
বাঃ! বেশ ভাল পড়লাম। (উপরে তিথীদিদির মত করে বলা হয়ে গেল, কি আর করা যাবে! )
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ দাদা।
পর্যালোচনা পড়ে বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। অনেক ধন্যবাদ বইটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
পড়া হয়নি বইটা। আপনার পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়ে আগ্রহ জাগল।
পুনশ্চঃ আসলে কোন বইটি কিনতে চেয়েছিলেন?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বইটা পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। যদিও ই-বুকের চেয়ে হার্ডকপি পড়েই বেশি আরাম পাই।
নতুন মন্তব্য করুন