০১
মাস কয়েক আগে একটা পেপার মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম, যেখানে জাপানে কাগজের বিবর্তনের ইতিহাস স্থান পেয়েছে। তারপর আছে নানা জাতের কাগজের প্রদর্শনী, আর হাতে কলমে 'হ্যান্ড-মেড' কাগজ বানানোর ডেমোনস্ট্রেশন। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম, কিন্তু বাসা, ল্যাব মিলিয়ে তিন কম্প্যুটারের কোথায় কোন ফোল্ডারে রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক কিছুই মনে নেই, তাই ছবিগুলো হাতে পেলে লেখাটাও জমত, ছবিগুলোও পোস্টে দিয়ে দিতাম। মেজাজ খারাপ করে বসে বসে ভাবলাম, বাংলাদেশের বন-জঙ্গল নিয়ে একটা কিছু হাবিজাবি লিখে অন্যদেরও মেজাজটা খারাপ করে দিইনা কেন!
০২
ছোট্ট একটা দেশে এত এত মানুষ গাদাগদি করে আছে। বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন-জঙ্গল নিয়ে কথা বলতে গেলে দেশের আয়তন আর ঘনত্বের কথা অবধারিতভাবেই চলে আসে। বিদেশীরা সাড়ে ১৪ মিলিয়ন হেক্টরের দেশে ১৫০ মিলিয়ন মানুষের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে ফেলে। তো এরকম একটি দেশের পরিবেশ বলে যে একটা কিছু আছে সে-ই অনেক বেশি, ভাল আর মন্দ কি? আমার সবসময়ই মনে হয়, অনেককে বলিও, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কমানো না গেলে পরিবেশ রক্ষার সমস্ত জ্ঞান গুলে খাওয়ালেও কোনো লাভ হবে না, বড়জোর অবধারিত পরিণতি একটু বিলম্বিত করা আর কি! বনের কথাই ধরুন। সাড়ে ১৪ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে বনভূমি ('ভূমি' কিন্তু, 'বন' না) আছে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর। গাছপালা (বন) আছে বড়জোড় তার এক-তৃতীয়াংশ ভূমিতে, বাকিটা বিরান। এখন এই বিরান ভূমিতে বনায়ন করবেন, নাকি যেটা আছে সেটা রক্ষা করবেন?
০৩
চারদিকের এত লোলুপ দৃস্টির মধ্যেও যে শালবন কিছুটা টিকে আছে সেটা সেটাই মাঝে মাঝে বেশ বিস্ময়কর লাগে। গারো আর বনের আশেপাশের মানুষরা নাকি বন ধ্বংস করে ফেলছে সব, তাই বন বিভাগ বিদেশীদের পরামর্শে অনেক জায়গায় শাল গাছ কেটে বিদেশী কিছু গাছ দিয়ে সামাজিক বনায়ন করেছে। শালবনে সামাজিক বনায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে 'বনধ্বংসকারী'দেরকে বনায়নে শরিক করে বছর দশেক পরে কিছু টুপাইস ধরিয়ে দেয়া। থিওরি ঠিক আছে, যদিও শালবনে সামাজিক বনায়ন কতটুকু কার্যকরী হয়েছে তা আপাতত এড়িয়ে গেলাম। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি যে একটি গভীর বনের ভেতর দিয়ে গেছে, এখন আর তা বিশ্বাস হয় না। বরং মনে হয় আমরা একটা নতুন ইপিজেডের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, আর গজারি গাছগুলো ইপিজেডের খালি জায়গায় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য লাগানো। গরীব মানুষদের হাত থেকে বন রক্ষা করার জন্য বনবিভাগ তাদেরকে সামাজিক বনায়নে অংশীদার করেছে, এই শিল্পপতিদের হাত থেকেও বন রক্ষা করতে ইন্ডাস্ট্রি ভেঙ্গে সেখানে তাদেরকে অংশীদার করে সামাজিক বনায়নের কথা সরকার ভেবে দেখতে পারে!
০৪
গ্রামীন বন (Village forest/Homestead forest) বলে এক ধরনের বন যে আছে সেটা কি কেউ জানেন? আমার ধারণা পরিবেশ, বন-জঙ্গল নিয়ে আগ্রহ আছে এরকম অনেকেই জানেননা। সাধারন মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমাদেরও গ্রামীন বনের কথা শুধু ১৯৯৪ সালের বননীতি পড়লেই মনে পড়ে। বাংলাদেশের সরকারি হিসেবে যে পরিমান বনভূমি ধরা হয় (২.৫২ মিলিয়ন হেক্টর) তার মধ্যে গ্রামীন বন আছে ০.২৭ মিলিয়ন হেক্টর, অথচ সরকারের কোনো নীতিই সেখানে কাজ করে বলে মনে হয় না। বননীতিতে স্পস্ঠই উল্লেখ আছে গ্রামাঞ্চলের খালি জায়গাগুলোকে বনায়নের আওতায় আনতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের কথা। সবই কি ফাঁকা বুলি? শহড়ে থাকলেও আমাদের প্রায় সবারই গ্রামের সাথে কিছুটা যোগাযোগ আছে, কেউ কি গ্রামীনবন নিয়ে কোনো সরকারি উদ্যোগের কথা জানেন (জানার আগ্রহ থেকেই প্রশ্ন করছি)?
০৫
সুন্দরবনটা মনে হয় এখনও টিকে আছে বাঘের কারনে!
মন্তব্য
মানুষ যেভাবে আস্তে আস্তে অপ্রাকৃতিক বাঘ হয়ে উঠছে তাতে প্রাকৃতিক বাঘ কতদিনই বা বাঁচবে আর সুন্দরবনই বা কতদিন ঠিকবে!
হুমম।।।
দুর্দান্ত মন্তব্য।
বাঘের স্বভাব অনেক বেশী মানবিক।
ফাহিম হাসান
আর প্রযুক্তি অতিপ্রাকৃতিক বাঘ ...
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
সুন্দরবনটা মনে হয় এখনও টিকে আছে বাঘের কারনে!
ভালো বলেছেন।
জনসংখ্যা কমানোর বুদ্ধিটাতো ভালো, কিন্তু সেটা সম্ভব কিভাবে? চিনের মত প্রত্যেক পরিবারের বাধ্যতামূলক এক সন্তান, এমন করে দিয়ে?
short run এ মনে হয় না সম্ভব। চিনের মডেলে qualitative সমস্যা আছে। তাছাড়া ভাই-বোন বিহীন একা মানুষের সামাজিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া ভিন্ন।
আপাতত redistribution করে ঘনত্ব কমানোর দিকে জোর দেওয়া যায়।
ফাহিম হাসান
এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার ধারনা, জনসংখ্যা বর্তমানে যে পর্যায়ে তাতে করে বৃদ্ধির হার শুধু কমালেই হবে না, বরং দেশের ক্যারিং ক্যাপাসিটি'তে আসার আগ পর্যন্ত নেগেটিভ রাখতে হবে।
কয়েকদিন আগে পেপারে পড়েছিলাম বাংলাদেশ নাকি পশ্চিম আফ্রিকায় জমি লিজ নেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে, আর সেখানে নাকি আমাদের কৃষকরা কৃষিকাজ করবেন। সফল হলে এটি কিন্তু একটি ভলো খবর। তাছাড়া, এ যুগে আফ্রিকায় আমাদের একটি উপনিবেশের মত হবে ভাবতেও তো ভালো লাগে ।
এঞ্জিওদের হাতে সাধিত বনায়ন তো কাঠের ব্যবসার ভদ্রলোকি নাম।
আপনার কাছ থেকে বন নিয়ে দীর্ঘতর লেখা চাই। সেগুলো নতুন আইডিয়া নিয়ে হতে পারে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতে পারে, ভবিষ্যতের প্রোজেকশন নিয়ে হতে পারে। নিয়মিত লিখুন প্লিজ।
মোটা দাগে কথাটা হয়তো ঠিকই আছে। তবে ১৯৯৪ সালে প্রণীত (এখনও সচল) জাতীয় বননীতিতে বনায়নে এঞ্জিওদের অংশগ্রহনের কথা বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে। এর একটা কারন হচ্ছে, এই বননীতির প্রধান লক্ষ্য ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ২০% ভূমি বনের আওতায় আনা। আর সেটা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব, সেরকম কনফিডেন্স হয়তো ছিলোনা (বিদ্যমান জনবল আর কাঠামোতে সরকারের পক্ষে এখনও সম্ভব না)। তবে এঞ্জিওদের উপর সরকারের নির্ভরশীলতার প্রধান কারণটা ছিলো তৃনমূলে তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সাধারন মানুষকে বনায়নে অংশগ্রহনে উদ্বুদ্ধ করা। আখেরে এঞ্জিওদের জন্য এটা একটা ব্যবসাই, তবে বনবিভাগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এটার দরকারও আছে।
সামনে ক্যারিয়ারের একটা মাঝারি টার্নিং পয়েন্ট আছে, ওটা পার হলে লেখালেখিতে মনযোগ দেব।
ধন্যবাদ।
একদম ঠিক।
আপনার কাছে এ বিষয়ে আরও লেখা আশা করছি।
ধন্যবাদ
গ্রামীন বন (Village forest/Homestead forest) বলে এক ধরনের বন যে আছে সেটা কি কেউ জানেন?
আমাদের গ্রামের বাড়ী সংলগ্ন পুকুরের অন্যপাড়ে একটা 'বাগান' ছিল। পরিচিত ফলের গাছ ছাড়াও ঘন বেতের বন আর ছিল বাশবাগান। অনেক আগে কেউ একজন মৌরী, এলাচ, গোলমরিচ আর পান লাগিয়েছিল। আমার ছোটবেলায় দেখেছি হেলাফেলার গোলমরিচ আর পানের লতায় অন্ধকার করে রেখেছিল গর্জন, কড়ই, হিজল, গাব, চালতা, ডেউয়া, কাউ, কতবেল আর কাঠবাদামের সেই গাছগুলোকে। খুব ভোরের ধোঁয়াশা কুয়াশায় পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে ওপারটাকে রহস্যময় জঙ্গল বলে ভ্রম হত। এই বুঝি কোনো ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে কোন বাঘডাস।
স্মৃতিতে দেখতে পাই আধন্যাড়া সেই বেলগাছটায় সবসময়ই একটা বক বসে আছে। পুকুরের ঐ পাড়ে সাতরে চলেছে কমলা/কালো রং এর একটা নাম না জানা সাপ। ঝরঝর করে শব্দ তুলেছে ঝিঝির দল। ওপারের একটা মরা কলাগাছের ওপরে বসে বসে ছোট ছোট গিরগিটি রোদ পোহায় আর ক্ষণে হলুদ, ক্ষণে বিলকুল টকটকে লাল হয়ে যায়। শেয়াল ছিল শুনেছি, কিন্তু দেখিনি কোনদিন।
দুই তিন বছর হয় আমার দুই সৌদিফেরত চাচাতো ভাই এসব জঞ্জাল পরিস্কার করে সেখানে পোল্ট্রি ফার্ম দিয়েছে। ভাল পয়সা।
এটাই গ্রামীন বনের সৌন্দর্য। কয়েক পাতা লিখেও আমি যেটা বোঝাতে পারতাম না, আপনি সেটা কয়েক লাইনেই কত চমত্কার করে বললেন।
এরকম অবস্থা মনে হয় এখন সব গ্রামেই। একসময় গ্রামীন বন থেকেই মানুষের কাঠ, বাঁশ, গো-খাদ্য, ফলমূল, লাকড়ি সব যোগাড় হতো, আর আজ মনে হয় এসবের জন্য অনেকেই বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। লাভজনক ফার্ম করা, পুকুর কাটা, আর পরিবারের বাড়তি সদস্যদের জন্য নতুন ঘর বানাতে গিয়ে কাটা পড়ছে এই সব জংগল, আর হুমকির মুখে পড়ছে গ্রামীন প্রতিবেশ আর জীববৈচিত্র।
চমত্কার মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমরা বোধহয় 'সুন্দরবনের নিবিড় পরিবেশে মেতে উঠুন আমোদে' টাইপের রিয়েল এস্টেট কমিউনিকেশন দেখতে পাবো শীঘ্রই
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
আপনি কি বনবিদ্যা বা পরিবেশবিজ্ঞানের ছাত্র অথবা কাজ করেন বা গবেষণায় যুক্ত আছেন বনবিভাগে বা অন্যত্র?
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
জ্বী। বনবিদ্যা'র ছাত্র ছিলাম, এখনও তাই। বস্ সন্তষ্ট হলে আর কিছুদিনের মধে্যই ছাত্রত্ব শেষ হবে বলে আশা করে আছি।
“Peace comes from within. Do not seek it without.” - Gautama Buddha
নতুন মন্তব্য করুন