যে বলে ভুত নেই, সে মিথ্যে বলে

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: রবি, ১৩/০৭/২০০৮ - ২:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কৈশোরে ভুতের বিশ্বাস প্রবল ছিলো, না কি বিশ্বাসের সারল্যে ভুতের আছরটাই তীব্র ছিলো তা বলতে পারবো না। তবে সুনসান দুপুরে বা ভর সন্ধ্যায় হাছন নগর পয়েণ্টের কোণাটায় সতীশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের গাছপালাময় নির্জন ছায়াচ্ছন্ন এলাকাটা নির্বিবাদে পার হয়ে যাওয়া যে কত দুঃসাধ্য ছিলো, তা কি বলতে হয় ? তা ছাড়া দিনটা যদি শনি-মঙ্গলবার হয় তাইলে তো কথাই নেই। দৈবক্রমে বেঁচে-বর্তে ফিরে আসাটাও যে কী সৌভাগ্য আর অসম্ভব বীরত্বের ব্যাপার ছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গার্লস স্কুলের লাগোয়া পেছনটায় সাক্ষাৎ অমঙ্গলের প্রতীক হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা দু’মাথাঅলা বিশাল তালগাছটার চূঁড়ায় স্থায়ীভাবে ঠাঁই নেয়া রোমহর্ষক ভূত-পরিবারের অশরীরী শক্তির কাছে অসহায় মানুষের লৌকিক অস্ত্র-শস্ত্র অহেতুক অকার্যকরই শুধু নয়, হাস্যকরও, তা একটা গাধাও জানতো। কিশোর বয়সের ইচ্ছে-স্বাধীন চলাফেরার মাঝখানে জলজ্যান্ত একটা প্রতিবন্ধকতা এতোবড়ো হুমকী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমোন অশরীরী শক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তার তাগিদে অলৌকিক অস্ত্র না হলে কি চলে ! কিন্তু সে অস্ত্র পাই কোথায় ? অবশেষে তারও সন্ধান পাওয়া গেলো। পাড়ার দাদী সম্পর্কের চলচ্ছক্তিহীন থুত্থুড়ে জ্ঞানদা ওরফে জ্ঞানী বুড়ি আমাদেরকে তাঁর বহু বাঘা বাঘা ভূত কাবু করার পূর্বেতিহাস বয়ান শেষে একান্ত দয়াপরবশ হয়ে সেই অলৌকিক অস্ত্রের অব্যর্থ সন্ধান দিলেন। অস্ত্র যে ব্যর্থ ছিলো না, একেবারে অব্যর্থ, তা আর প্রমাণের অপেক্ষায় থাকলো না। দাঁত মুখ খিচড়ে ড্যাবড্যাবে চোখ বুঁদে দম আটকে ভোঁ দৌঁড়ের মধ্যে সেই অলৌকিক অস্ত্রের সশব্দ ব্যবহার করতে করতে যখন এলাকা পার হয়ে হাঁফাতে থাকতাম, স্বস্তি ফিরেই নিজকে জীবিত আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অস্ত্রের অব্যর্থতার সাথে ভূতের বিশ্বাসটাও ক্রমে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠলো।

বেঁচে থাকলে লেখাপড়ার জন্য বহু সময় সুযোগ পাওয়া যাবে। আগে তো জীবনের নিরাপত্তা দরকার ! তাই ভূতের অত্যাচার প্রতিরোধক অস্ত্র হিসেবে দাদীর দেয়া মন্ত্রটাকে সঙ্গি সাথিসহ আমরা সবাই এমনভাবে টুটস্থ করে নিয়েছিলাম যে, কী জানি মন্ত্রের উচ্চারণে সামান্যতম ভুল থেকে যাওয়ার হঠকারিতায় শেষ পর্যন্ত মন্ত্রটাই অকার্যকর হয়ে যায় ! সে ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী ছিলাম। ‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি/ রাম লক্ষণ বুকে আছে, করবে আমায় কী !’ এই মন্ত্রের গুণাগুণ যে কতো তীব্র, পরবর্তীকালেও তা হরহামেশা অনেকের মুখেই অসম্ভব অবিশ্বাস্য কথার প্রেক্ষিতে ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ শীর্ষক উক্তির বহুল বর্ষণে বারবার প্রমাণিত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। অর্থাৎ রামের নাম শুনলে যে ভূত শব্দকম্পিত এলাকা ছেড়ে প্রাণ নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়, তার মুখেই রাম নাম শোনা অসম্ভব বৈ কি।

সে যাক্, এভাবেই ভূতের বিরুদ্ধ-অবস্থানে থেকে গোটা কৈশোরটা কেটে গেলো একদিন। ভূতটা হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রয়ে গেলো আরো কিছুকাল সেখানে। আমিই উচ্চতর শিক্ষার জন্য এলাকা ছেড়ে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আর অনেক অর্থহীন অবিশ্বাসের সাথে সাথে ভূতের অস্তিত্বেও অবিশ্বাসী হয়ে ওঠলাম। এভাবেই যৌবনের স্বর্ণালী সময়টুকু পার করতে করতে আবার একটু একটু করে আত্মগত হতে লাগলাম, যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানোর তরিকা আবিস্কৃত হয়েছিলো, সেই সরিষাতেই শেষ পর্যন্ত ভূতের অস্তিত্ব থেকে যায়। অর্থাৎ ভূতের অস্তিত্বে আমার এতোকালের অবিশ্বাস ভুল ! দীর্ঘ আড়াই যুগ অতিক্রান্ত হয়ে ফের আমি ভূতের অস্তিত্বে প্রবল বিশ্বাসী এখোন !

এটা আমার কোন কৌতুক নয়। এখন আর আমি কোন কৌতুক করছি না। অত্যন্ত সিরিয়াসলি বলছি, যে বলে ভূত নেই, সে মিথ্যে বলে ! এই তো ক’দিন আগে আমাদের মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা তাঁর প্রবীনত্ব ডিঙ্গিয়ে যদি বলতে পারেন- শায়েস্তা খাঁ’র আমল আর নেই। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম কমার বিষয়টি চিন্তা করাটাও অবাস্তব। ব্যবসায়ীরা সহযোগিতা না করলে বাজার পরিস্থিতি সহনীয় রাখা সম্ভব নয়। তাহলে নিত্যনৈমিত্তিক ছিনতাই খুন রাহাজানি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সামনে রেখে যদি একদিন হঠাৎ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভৌতিক বাণী শুনি আমরা- ‘ ......এর আমল আর নেই, দেশে হত্যা খুন ছিনতাই রাহাজানি কমার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে হত্যা খুনের প্রাবল্য কমার বিষয়টি চিন্তা করাটাও অবাস্তব। সন্ত্রাসীরা সহযোগিতা না করলে দেশের সন্ত্রাসী পরিস্থিতি সহনীয় রাখা সম্ভব নয়।’ তা কি খুব বেশি আশ্চর্যের হবে ? রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মুখে এমন উক্তি শোনা এর আগ পর্যন্ত আমার ধারণায় ভৌতিকভাবেই সম্ভব ছিলো। আর তা যে এখন আর ভৌতিক বা অসম্ভব কিছু নয় এর সর্বশেষ প্রমাণ নিশ্চয়ই দেশবাসী ইতোমধ্যে আজই পেয়ে গেছেন, এবং শরীরে চিমটি কেটে যাচাই করে নিচ্ছেন হয়তো, এটাও কি সম্ভব ! ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সব পত্রিকার হেডিং আজ (১২ জুলাই ২০০৮) - ‘জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের সম্মেলনে মুত্তিযোদ্ধা লাঞ্চিত !’

জামাতের মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ ! ভুতের সাথে রামের এতোই গলাগলি সম্পর্ক হয়ে গেলো ! যারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইবার অপরাধে এক প্রবীন মুক্তিযোদ্ধাকে পদাঘাত করতে করতে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের করে দিয়েছে ! তিনি লাঞ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর অসমাপ্ত বক্তব্যে বলে যাচ্ছিলেন-‘ জামায়াতের এ সমস্ত নেতারা পিস কমিটির (শান্তি কমিটি) সদস্য ছিল। যারা রাজাকার আলবদর ছিল তারা গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ করেছে। এখনই তাদের বিচার করতে হবে। আমার বিবেচনায়, তাদের এখনই ফাঁসি দিতে হবে।’

তার বক্তব্য শেষ হয়নি। সাংবাদিকরা তার নামটিও জানার সুযোগ পাননি। এর আগেই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে থেকে বর্ষীয়ান এ মুক্তিযোদ্ধাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন তাঁর পিঠে লাথি বসিয়ে দেয়।

মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা, সেক্টর কমাণ্ডারদের নিয়ে কটাক্ষ করা এই জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের প্রতিনিধি সম্মেলনে (১১ জুলাই ২০০৮, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন) প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেন। আর যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান, বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান, উইং কমাণ্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খান, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক রেজোয়ান সিদ্দিকী, নিউ নেশনের সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন গাজী, সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধে মা, ভাই ও বোন হারানো এই চিতাগ্নি বুক নিয়েও আজ লজ্জায় অপমানে মাথা হেট করে কোথায় দাঁড়াবো ? এই রক্তস্নাত মাটিতে কি আর একটাও মানুষ নেই ? সব জীবন্ত মৃতদেহ !

এই দেশে যদি জামাতের মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ হতে পারে, তবে, যে বলে ভূত নেই, সে শুধু মিথ্যুকই নয়, আত্মপ্রতারকও !
(১২/০৭/২০০৮)


মন্তব্য

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমাদের গ্রামের বাড়িতে সামনের দিকে বেশ বড়সড় মাঠের মত সরকারি খাসজমিতে একটি অতিকায় ঝাকড়া তেতুল গাছ ছিলো। বেশিরভাগ সময় দুপুরের দিকে ওই গাছে চড়ে বাঁশী বাজাতাম। একদিন তারাবীর নামাজ পড়ান এক হুজুর বললেন যে, ওই গাছে অনেক জ্বিন আছে। একদিন সুযোগ পেলে আমার হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে দেবে।

তখন হুজুরকে বলেছিলাম যে, আপনার জ্বিনদের বলে দেন, আজ আমি ওইগাছটার মাঝখানে পেশাব করবো। কিছু করতে পারলে করুক!

কিন্তু আমার কিছুই হয়নি। এখন আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে রণদীপম বসুর ভূতগুলোর মাথায় যদি একবার পেশাব করতে পারতাম! তাহলে হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনাটি ঘটতো।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

রণদীপম বসু এর ছবি

এখন আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে রণদীপম বসুর ভূতগুলোর মাথায় যদি একবার পেশাব করতে পারতাম! তাহলে হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক ঘটনাটি ঘটতো।

আমার জন্যেও তা আনন্দদায়ক হতো ! কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের মাথায়ই ওই ভূতেরা পেচ্ছাব করছে। এখনও কিছু একটা না করলে তো মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভেসে যেতেই হবে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

গা জ্বলে যাচ্ছে অসহ্য রাগে!

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍জামাতের মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ থাকতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলগুলো কি এখন রাজাকার পরিষদ গঠন করতে পারে না? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- শালার দেশ ছেয়ে গেছে হারামী বেজন্মায়।
ছাগলের মুখে আজ বাঘের ডাক শোভা পায়।
ক'দিন আগে শুনেছিলাম, চিত্রনায়িকা ময়ূরী নাকি সিনেমায় অশ্লীলতার বিরুদ্ধে মাইকের সামনে বিরাট ভাষন দেয়। জামাতী রাজাকারের বেজন্মারা মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান দেবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। আশ্চর্য হওয়ার যদি কিছু থেকে থাকে তা হলো প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেন। আর যাঁরা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান, বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান, উইং কমাণ্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খান, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক রেজোয়ান সিদ্দিকী, নিউ নেশনের সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন গাজী, সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর প্রমুখ।
- এই নামগুলো। নিজের পাছায় নিজেরই লাত্থি মারতে ইচ্ছে করে, এই হারামীদের আমরাই আমাদের জাতীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত করে রেখেছি বলে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

কীর্তিনাশা এর ছবি

অক্ষম ক্রধেই কি হবে সব দায় শোধ?
------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ইফতেখার নূর এর ছবি

জামাতের মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ=হালাল pork

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।