লোকাল বাস ...(ভেজাল গদ্য)

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: শনি, ২৩/০৮/২০০৮ - ৪:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

আনসার ক্যাম্পের বাস স্টপিজটাতে দাঁড়িয়ে আছি। টাউন বাসে উঠবো। কোন ডাইরেক্ট বা গেইটলক সার্ভিসের গাড়ি থামে না এখানে। লোকাল সার্ভিসই ভরসা। কিন্তু অফিস ফেরতা শেষ বিকেলের লোড নিয়ে মিরপুর এক নম্বরের দিক থেকে মুরগিবোঝাই হয়ে যেভাবে গাড়িগুলো একের পর এক সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, বাদুরঝোলা হয়ে আদৌ যে কোনো গাড়িতে উঠতে পারবো সে ভরসা পাচ্ছি না। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই আছি। আগে যা-ও দু’একটা বাস থেমেছে, এখন তাও আর হচ্ছে না। দরজায় ঝুলে থাকা হেলপারের ডবল-থাবার ছন্দে ছন্দে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। এদিকে কালো হয়ে ওঠা আকাশের মতিগতিও সুবিধের মনে হচ্ছে না, কখন যে ঝাঁপিয়ে পড়ে !

আমার পাশের মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটিও বোধ করি আমারই দশায়। তবে তার প্রকাশ্য উশখুশকে তিনি আড়াল করার প্রয়োজন বোধ করছেন না, এটা তাঁর অস্থিরতাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মনে হয় ফুটন্ত উষ্মাকেও আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। কী জানি কী মনে করে আমাকেই উদ্দেশ্য করলেন।
দেখেছেন ! দেখেছেন !
কী ?
গাড়িগুলো থামছেই না এখানে !
তাঁর উত্তাপ মাখানো কণ্ঠস্বরে একটু ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগিয়ে আমি বললাম, ঝুলবেন যে, সে জায়গাটাও খালি না থাকলে শুধু শুধু কেনই বা থামবে, বলেন ?
ভদ্রলোক এবারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠলেন। কেন ? ফাইজলামী নাকি ! এটা কি ওদের স্টপিজ না ? থামবে না কেন ? যা ইচ্ছা তাই করবে ? যখন লোক থাকেনা, তখন তো পারলে ঘর থেকে টেনে নিয়ে আসে ! যত্তোসব বদমাইশ !...
এমনভাবে বলতে থাকলেন, যেন আমিই সেই অপরাধী ড্রাইভার। বুঝতে পারছি, তাঁর হয়তো কোনো অসম্ভব তাড়া আছে, কিন্তু ফাঁড়ায় আটকে গেছেন। আমি আর কী বলবো। তাঁর কথার তোড় বাড়তেই থাকলো,
..ওগুলোকে ধরে ধরে আচ্ছা করে যদি পাছায় চাবকানো যেতো !...
কথা শেষ হবার আগেই খ্যাশ্শ্শ করে এসে ব্রেক করলো গাড়িটা। এতক্ষণের দাঁড়ানো ভীড়টা পড়িমরি করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমিও ছুটলাম। ভদ্রলোকের কথা ভুলে গেলাম।

মুহূর্তের কয়েকটা ঘূর্ণিপাকের পর গাড়ির পেটের ভেতরে দুমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরে আবার ব্রেক। আবারো কিছু মানুষের হুড়োহুড়ি পাড়াপাড়ি। কোথা দিয়ে কীভাবে কে যে উঠছে আর নামছে তা উপলব্ধি করছি, নিজেকে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া থেকে বাঁচাতে বাঁচাতে ওগুলো ঠাহর করার কোন উপায় নেই। কয়েক কদম গিয়ে আবার ব্রেক। লোকাল বাসে চড়ার এই এক হ্যাপা, না মেনে উপায় কী ? কিন্তু সবাই তো আর আমার মতো নিরীহ নয় ! তাই এদিক ওদিক থেকে প্রতিবাদ ঝলসে ওঠে, এই ড্রাইভার, পাইছো কী ? যাও ! কেউ বলে, শালারা যত পায় আরো খাইতে চায়, এদের পেট ভরে না ; যাও মিয়া ! গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। তা কি যাত্রীর তাড়া খেয়ে, না কি হেলপারের ডবল থাবার প্রভাব সেটা ড্রাইভারই জানে।

একটু গিয়ে আবার ব্রেক। এবার বুঝি যাত্রীদের উত্তেজনা আরেকটু তেতে ওঠেছে। অই মিয়া, ফাইজলামি পাইছো ! কথা কানে যায় না ? কোন এক যাত্রীর হুঙ্কার। এদিকে হুল্লোড়ের মধ্যে ঢাকার অসহ্য পরিবহন সমস্যা নিয়ে যাত্রীদের পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। কারো কারো ক্ষোভ গোস্বাও কানে আসছে, বিশেষ করে যারা সীটে বসার সৌভাগ্যে একটু আয়েশ করার মাজেজা পাচ্ছেন। তাঁদের এতো গুরুগম্ভীর আলোচনার গভীরতা, বেশির ভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।
বুঝলেন, আইয়ুব খানের ডাণ্ডাই এ জাতির জন্য উপযুক্ত !
ঠিকই বলেছেন, বেশি প্রশ্রয় দিয়ে এদেরকে এক্কেবারে মাথায় তুলে ফেলা হয়েছে !
যেখানে সেখানে যাত্রী নেবে, গাড়ি থামাবে, দেশে কোন আইন কানুন নাই !
আ-রে আইন কানুন দিয়ে হবেটা কী ? কেউ কি আইন মানে ? এদের জন্য দরকার ডাণ্ডার !
আরে ভাই, কয়জনকে ডাণ্ডা মারবেন ! আমাদের চরিত্র পাল্টাতে হবে।...
কিন্তু আলোচনা এগিয়ে যেতে পারে না। আচমকা ব্রেক খেয়ে গাড়িশুদ্ধো সব হুমড়ি খেয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লো। ওই হালার পুত, আন্ধা নি ? দেইখ্যা ব্রেক করতে পারোছ নাহ্ ! যাত্রীদের এমন উটকো মন্তব্যে যৌক্তিকতা কতটুকু জানি না। তবে কয়েক মুহূর্ত পরে ফের ব্রেক করা মাত্র আমার পাশ থেকে কে যেন ড্রাইভারকে উদ্দিষ্ট করে চীৎকার করে ওঠলো, শালার পাছায় লাত্তি দেন ! ওই শালার পুত, গাড়ি থামাইলি ক্যান ! পথে কি তোর সম্মন্ধি দাঁড়াইয়া আছে !

মন্তব্যের তীব্রতায় ফিরে দেখি সেই ভদ্রলোক ! চোখাচোখি হলো। তাঁর ভাবসাব দেখে মনে হলো না যে তিনি এর আগে আমাকে আর কখনো দেখেছেন। সদ্য আরোহী যাত্রীরা হয়তো এসব মন্তব্যের প্রচলিত অভ্যস্ততায় অপরাধীর মতো আনমনা ভাব করে থাকলেন। কিন্তু আমার কী জানি হয়ে গেলো। ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে প্রায় সবাই শুনতে পায় মতো ভদ্রভাবে বলেই ফেললাম, আপনারা কি কখনো এরকম পথ থেকে গাড়িতে উঠেন নাই ?
আমার প্রশ্ন তিনি শুনলেন বা বুঝলেন কি না বুঝা গেল না। শুধু আমার মুখের দিকে কটমট করে চেয়ে রইলেন !
(২১/০৮/২০০৮)


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার একটা সহজ হিসাব মেলানো আছে
যারা রাস্তায় চোর পেলে বেদম পিটায় ওরা মূলত সবগুলাই চোর
নিজে ধরা পড়লে যে মাইরটা খাবে বলে ঠিক করে রেখেছে সেই মাইরগুলাই ওরা অন্যকে আগে দিয়ে রাখে

বাসে উঠে যেগুলা বেশি চিল্লায় সেগুলাই কিন্তু নালে বেনালে বাসে উঠে আর নালে বেনালে নামে...

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনার ডায়াগনোসিসের সাথে সম্পূর্ণ একমত আমি।

পথ আপথ থেকে ওঠবে এরা লোকাল বাসে। নিজে ওঠতে পারলেই ব্যস্, এরপর একেকজন নবাবপুত্তুর। তার মতো আরো অনেককেই যে পথ থেকে ওঠতে হবে, কার্য হাসিলের পর এরা আর মোটেও তা ভাবে না। কী অসম্ভব স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি আমরা ! অথচ কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

কি করবেন বলেন, আজকাল অধিকাংশ সবার মনমানসিকতাই এমন হয়ে গেছে। লোকাল বাসের গেইটে বাদুরঝোলা হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকজন যাতায়াত করে, অথচ বাসের পেছনের অংশ দেখবেন অনেকাংশে ফাঁকাই থাকে। তারপরও কেউ পেছনে যেতে নারাজ!

অনেককে দেখবেন গাড়ির ভেতর থেকে বাইরের রিকশাওয়ালাদের গালিগালাজ করবে রাস্তা জুড়ে থাকার জন্য, অথচ ওই একই লোকই যখন রিকশায় কোথাও যাবেন তখন একইভাবে গালি দেবেন গাড়ির চালকদের ধৈর্যচ্যুতির জন্য।

মোদ্দাকথা, আমরা সবসময় নিজেদের নিয়েই ভাবি। একারণেই এইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আমাদের চারপাশে, প্রতিনিয়ত!
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।