[পর্ব-০১] এর পর...
(০২)
রাস্তা আর সাঁকো এক নয়। আমুয়া বাজারের পেটের দিকে ঢুকতে গেলে সিমেণ্টের পাকা বা ইট বিছানো রাস্তাই এর সাক্ষ্য দেয়। প্রশস্ততাও দু থেকে আড়াই হাতের বেশি হবে না। রিক্সার দুটো চাকা পাশাপাশি ধরবে না। কোন যানবাহনের প্রশ্ন তো আসেই না, রিক্সা বা সাইকেলও চোখে পড়েনি একটিও। জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র খাল নালায় ভরপুর এ অঞ্চলে আসলে এসবের চল গড়ে ওঠেনি ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে। যে কোন দিকে এক কিলো যেতে যেখানে সাঁকো পড়বে কমপক্ষে কুড়িটি, সেখানে আগেভাগে এমন অগ্রসর চিন্তা করাও নির্বুদ্ধিতা বৈ কি। নদীর যে পাড়ে বাজার, আমার অফিস তার অপর পাড়ে। ঘাটে খেয়াপাড়ানী পঁচিশ পয়সা দিয়ে খেয়া নৌকায় চড়ে মাঝির সামনের ছোট পাটাতনে ফেলে রাখা দশ পয়সা পাঁচ পয়সার কয়েনগুলো দেখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম কতোক্ষণ। এখনো এর চল রয়েছে ! এক খিলি পানের দাম পঞ্চাশ পয়সা তখন এবং আমাদের বাজার ব্যবস্থায় ওটাকেই লেনদেনের সর্বকনিষ্ঠ মুদ্রা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। গোলাকার ঢেউ খেলানো দশ পয়সা ও চৌকোণো পাঁচ পয়সার মুদ্রাগুলোতে খেয়ার তালে তালে আমার কৈশোরও দুলে ওঠছে যেন।
(০৩)
পাকা ভিটা নির্মাণের সময়েই প্রয়োজনীয় পয়েণ্টগুলোতে পিলার আটকানোর উপযোগী করে কতকগুলো লোহার এঙ্গেল আগে থেকেই স্থাপন করে রাখা হয়। পরে শুধু মোটা মোটা নাটবল্টু দিয়ে কাঠের পিলারগুলোকে আটকে ঘরের ফ্রেম তৈরি করে টিনের ছাউনী লাগিয়ে অথবা পিলার গুলো বসিয়ে ঘরের বাকি দেয়াল বা আড়ালগুলো আলাদা তৈরি করে পার্ট পার্ট এনে বসিয়ে দিয়ে বাড়িঘর বানানোর যে প্রক্রিয়া, এরই আধিক্য এখানে। জামাকাপড়ের মতোই, যদিও দেখিনি এমনটা, নানা রঙের নানা ঢঙের বৈচিত্র্যময় দেয়াল লাগানো আর সরিয়ে ফেলার কী চমৎকার ব্যবস্থা ! আর্থিক সঙ্গতির বিষয় বিবেচনায় নিলে এতোটা বিলাস ব্যসনের সুযোগ কি এখানকার মানুষদের আছে ? ঢাকার মুন্সিগঞ্জ এলাকায়ও এরকমের বাড়িঘর বানানোর প্রবণতা ল্ক্ষ্য করেছি। তবে মুন্সিগঞ্জের সাথে এখানকার ঘরের প্যাটার্ণে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ওখানে টিনের দোতলা ঘর চোখে পড়েনি। দ্বিতীয়ত এখানকার ঘরগুলোতে টিনের ছাউনীর সামনের ঢালের দৈর্ঘ্য নরমাল হলেও পেছনের দিকে নামতে নামতে এতোটাই নীচে নেমে আসে যে মাথাটাকে শরীরসমেত নব্বই ডিগ্রী না নুইয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরুনোর উপায় থাকে না। উপকূলীয় এলাকার প্রতিকূল বাতাসের তীব্র ধাক্কা কাটানোর অন্যতম উপায় হয়তো। পাকা বাড়ি থাকলেও পরিমাণে নগন্য।
এরকমই টিনের দোতলা একটি বাড়ি আপাতত আমার ঠিকানা। নীচতলায় অফিস, উপরতলায় থাকার ব্যবস্থা। কাঠের সরু সিঁড়ি মাড়িয়ে দোতলা মানেই কাঠের পাটাতনের উপর তিন দিক বন্ধ এক দিক খোলা আধো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। যদিও দুপাশে দুটো ছোট্ট গরাদ বা জানালা রয়েছে, তার কার্যকারিতা যে কী, তা অবগত হওয়ার বিশেষ কোন সুযোগ খুব একটা পাওয়া হয়নি। ব্যাচেলর বা ম্যারেড ব্যাচেলরদের থাকার সুব্যবস্থা হিসেবে আমিও দোতলার এই প্রকোষ্ঠে ঠাঁই নিলাম। পোক্ত দেখে সস্তায় একটা ওয়ান টাইম খাট কিনে বিছিয়ে দেয়া হলো গণবোর্ডিং স্টাইলে। এই খাটই আবাস, খাটই সংসার আমার।
সম্পূর্ণ হাওয়াই মাধ্যম দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে আসার কোন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আবিষ্কৃত না হওয়ায় চারদিকের পানি সাঁতরে এলাকায় বিদ্যুতের শুভ পদার্পণ তখনো দুর্মর আকাঙ্ক্ষার পর্যায়েই রয়ে গেছে। ফলে এখানে রাত মানে হ্যারিকেনের টিমটিমে কেরোসিন আলোয় সন্ধ্যায় মধ্যরাত্রি নেমে আসা, আর দ্বিপ্রহরে রোদের খরতাপে চুল্লির মতো ফুটতে থাকা চারদিকে টিনবেষ্টিত এই দ্বিতল প্রকোষ্ঠকে দোজখের ওম বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না। কটকটে দুপুরে মানুষ যখন ঘরের শীতল ছায়ায় শরীরটাকে বিছানায় গড়িয়ে দিয়ে দিনের দ্বিতীয়ভাগের জন্য ঝনঝনে প্রস্তুত করে তোলে, আমরা তখন ঘরপালানো এতিম নাবাল কয়েকজন পাশের সরকারি গোডাউনের দেয়ালের ছায়ায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মধ্যদুপুরে জীবন ও জগত নিয়ে দার্শনিক আলাপে মত্ত হয়ে ওঠি। আর অভাগা দেশটার জন্য আফসোস করতে থাকি, আহা, এই বিরল প্রতিভাগুলোর ভয়ঙ্কর সব গুণাবলীর কী দুঃখজনক অপচয় ! গরীব দেশ, এ ক্ষতি পোষাবে কী দিয়ে !
(০৪)
মেসের লঙ্গর ব্যবস্থা। কাজের বুয়া, ওখানকার আঞ্চলিক ভাষায় মাতারি, মাথা গুনে তরকারি বাটি করে রেখে যায়। নতুন এলাকার সবকিছুই নতুন আমার কাছে। খাবার উপকরণ, রান্নার ভিন্নতা, স্টাইল, স্বাদ সবই। খুব আয়েশ করে শাকভাত চিবুচ্ছি। লোকমার ভেতরে আর কী কী আছে তা কি আর খুটে খুটে দেখা হয়। সবকিছুতেই কমন আইটেম নারিকেলের ব্যবহার আমার কাছে অত্যন্ত উপাদেয়। নতুন যে উপকরণটা চিবুচ্ছি, প্লাস্টিকের মতো, কিছুতেই দাঁতের ফাঁকে ভাতের সাথে মিশছে না। পাশের সহকর্মী দেখছি নিরুপদ্রবে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে মুখ থেকে খাদ্যবস্তুটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে পরখ করছি কী এটা। কালো ইঞ্চি দেড়েক লম্বা। এটা কী ? সহকর্মীর নির্বিকার উক্তি, জোঁক, ফেলে দেন। আমি হা করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
আল্লা মালুম, আরো কতো কী যে ভাতের সাথে গলে গলে পেট ও শরীরের পুষ্টি বাড়িয়েছে জানি না। এই বিশেষ প্রাণীটির গঠন বৈশিষ্ট্যও কেন যে গলন্ত স্বভাব পেলো না ! তাহলে কি আর এই দুর্বিপাকে পড়তে হতো ! চাইলেই তো আর খাবার খানা ছেড়ে দেয়া যায় না। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এমনিতেই সর্বভুক প্রজাতির মানুষ আমি। এবার নিজেকে অনুপ্রাণিত করলাম এই ভেবে যে, যাক্ মন্দ কী, খাওয়াদাওয়ায়ও সর্বগ্রাসী চর্চার বিরল একটা সুযোগ পাওয়া গেলো ! তবে জোঁকের উৎপাত যে কেবল ভাতের প্লেট বা তরকারির কড়াইতেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। এটা এ এলাকার সর্বত্র বিরাজিত অন্যতম প্রাণী। বাইরে এক পাক ঘুরে আসবেন আর জোঁকের আদরের ছোঁয়া পাবেন না, এটা কী করে হয় ! হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ ফার্স্ট এডিশনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। হঠাৎ দেখি মেরি ওল্ডস্টোনক্রাফ্ট না কি ভার্র্জিনিয়া উলফ-এর ছবিটার কপালের উপরের ভাগটা লম্বা হযে দুলে দুলে আমাকে টা টা জানাচ্ছে ! বিষয় কী ? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখি জোঁক। এক মাথা ছবির কপাল কামড়ে অন্য মাথায় বিজয় নিশান উড়াচ্ছে। পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ভীষণ চুলকাচ্ছে। চুলকাতে গিয়ে হাতের আঙুল একটা রবারের ফাঁসের সাথে আটকে গেছে। চমকে পা টেনে মাথা কাছে নিয়ে দেখি দুদিক থেকে সজোরে কামড়ে আটকে আছে গা সিনসিন করে ওঠা জোঁকটা।
[চলবে...]
মন্তব্য
রণ দা, পাঠক হিসেবে আমার ওপর অস্থা রাখতে পারেন; আছি আপনার সঙ্গে। কী সুন্দর চিত্রকল্প : "গোলাকার ঢেউ খেলানো দশ পয়সা ও চৌকোণো পাঁচ পয়সার মুদ্রাগুলোতে খেয়ার তালে তালে আমার কৈশোরও দুলে ওঠছে যেন (ওঠছে নয়, উঠছে সঠিক। শুধরে নেবেন)।" আমিও দুলছি কৈশোরের স্মৃতিতে।
.................................................................................
"নোবেল-বুকার নিয়ে এত কেন ফুর্তি করে বোকা পাঠকেরা?/মিডিয়ার উলুবনে সবই যেনতেনপ্রকারেণ।/প্রাচ্যের পদক হাতে স্নানে যায় বনলতা সেন।" -আবু হাসান শাহরিয়ার
____________________________
বন্ধুত্ব মানেই তুমি বিচ্ছেদের চুক্তি মেনে নিলে
[আবু হাসান শাহরিয়ার]
আপনি কি সেখানকার জোয়ার-ভাটাতে বড় হয়েছেন ? না কি বুকে বিষখালীর স্রোত ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ওর বাবা বলেন কী এত জোঁক। সাংঘাতিক কিন্তু!
কী যে বলেন না ! যে জিনিস ভাতের সাথে রীতিমতো চিবানো যায়, সেটা আবার সাংঘাতিক হলো কী করে !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
কালো ইঞ্চি দেড়েক লম্বা। এটা কী ? সহকর্মীর নির্বিকার উক্তি, জোঁক, ফেলে দেন।
আপনি একটা বিরল জিনিসের স্বাদ নিলেন যা অনেকেই নিতে পারেনি বা পারবে না। চিয়ার্স।
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
সেই সৌভাগ্যটা না হলে কোন্ মুখ নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতাম বলেন ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দুর্ধর্ষ স্যার
দুর্ধর্ষ ? কোনটা ?
খাওয়ার স্টাইল, না কি খাবারের উপাদান ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
অসম্ভব ভাল লাগল রণ'দা। চমৎকার বর্ণনা। এগুলোকেই বোধহয় বলে "ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম" অভিজ্ঞতা!
__________________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?
"ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম" বলেই রক্ষা। 'ফারদার ইন দ্য হোলটাইম' হলেই খবর আছিলো !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
হু... আপনে তো দেখি বড় হয়া আবু ইসহাক হইতে পারবেন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমি...বড়...হমু...না..আ..আ..!
বাচ্চাদের মতো সুর কইরা পড়েন।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
হা হা হা
নতুন মন্তব্য করুন