‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: বুধ, ১২/১১/২০০৮ - ১০:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গল্পটির নাম খুব সম্ভবত ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’। ছোট্ট, এখন যাকে অণুগল্প বলা হয়। বেশ ক’বছর আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম। কিন্তু অনুতাপ হচ্ছে, গল্পকার বা বইটির (বই নাকি ম্যাগাজিন নিশ্চিত নই) নাম এখন মনে পড়ছে না। একান্তই স্মৃতিনির্ভর হয়ে উঠার এই এক হ্যাপা।

গল্পের বিষয়বস্তু সাধারণ, কিন্তু ভেতরটা অসাধারণ। সারাৎসার অনেকটা এরকম, অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে অনিবার্য প্রয়োজনেই চাকরির বাজারে পা দিলো। কিন্তু যেখানেই আবেদন করুক, প্রচলিত নিয়মে আবেদনপত্রে যাবতীয় সার্টিফিকেটের সাথে একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটও জমা দিতে হয়। তার যে স্বভাব-চরিত্র অতিউত্তম, রাষ্ট্র বা সমাজবিরোধী কোন সন্ত্রাসী বা অবৈধ কর্মকাণ্ডে যে সে কখনোই জড়িত ছিলো না, একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক প্রত্যয়ন না পেলে চাকুরিদাতা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হয় কী করে ! এটা প্রমাণ করতেই মেয়েটি ইতোমধ্যে বারকয়েক চেষ্টা করেও একটি সার্টিফিকেট পেতে ব্যর্থ হলো। একে তো অভাবী, তাও আবার অপরিচিতা, এরকম মেয়েকে সরকারের কোন দায়িত্ববান কর্মকর্তা না জেনে না শুনে প্রত্যয়ন দেবেন কী করে ! অত্যন্ত সঙ্গত কারণ। অথচ এই একটি সার্টিফিকেটের অভাবে তার সবকিছু যে ভেস্তে যায় যায়। অতঃপর একজন নিকটাত্মীয়ের চ্যানেল ধরে কোন এক ভীষণ ব্যস্ত সরকারি কর্মকর্তার অফিসে গেলো সে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও সিরিয়াল পাচ্ছে না। বেলা গড়িয়ে অবশেষে যখন ডাক পড়লো, সার্টিফিকেট নেবে কী, প্রথম প্রশ্নেই মেয়ে কুপোকাৎ ! সেই একই সমস্যা। ‘তোমাকে আমি কতোটুকু চিনি যে সার্টিফিকেট দেবো ? তোমার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে আমি নিশ্চিৎ হবো কী করে ?’ মেয়ে আর কী বলবে, ফেলফেল করে অসহায় চেয়ে থাকে। হয়তো কর্মকর্তার একটু দয়াও হলো, ‘ঠিক আছে, অমুক যখন বলেছে, দেখা যাক্‌ কী করা যায়। তুমি পাশের রুমে গিয়ে বসো।’

ছোট্ট এ গল্পটির শেষটুকু সম্ভবত এরকম ছিলো যে, ভিজিটরদের সাক্ষাৎদান শেষে দায়িত্ববান কর্মকর্তা উঠে ধীরে ধীরে পাশের রুমে ঢুকলেন এবং ভেতর থেকে দরজাটি বন্ধ হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজাটি আবার খুলে গেলো। উস্কুখুস্কু চুল আর বিস্রস্তপ্রায় পোশাকে উদ্ভ্রান্তের মতো যে তরুণীটি বেরিয়ে এলো, তার হাতে একটি ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট। ওটাতে স্পষ্টাক্ষরে ইংরেজিতে জ্বলজ্বল করছে, ‘ ...... সে আমার পূর্ব পরিচিত। তার স্বভাব চরিত্র ভালো। ব্যক্তিগত জীবনে সে অত্যন্ত সৎ, কর্মঠ ও পরিশ্রমী। আমার জানামতে সে সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কোন অবৈধ কর্মকাণ্ডে কখনোই জড়িত ছিলো না। আমি তার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি।’

সমকালীনতার সংজ্ঞা আমি কেন যেন মাঝে মাঝেই ভুলে যাই। আমাদের এই সমাজ বা রাষ্ট্রে ‘ক্যারেক্টার’ নামীয় জিনিসটার দরকার আদৌ আছে কিনা তাও আমার জানা নেই। কিন্তু ‘ক্যারেক্টারের’ দরকার না থাকলেও ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’-এর প্রয়োজন যে এখনো ফুরিয়ে যায় নি, এটা কি আমাদের পরিচয়, না পরিহাস ?


মন্তব্য

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

যাউক মাইয়াডা তয় ক্যারেক্টার সালটিকেট পাইলো, আমি তো ভাবলাম, এত্তকিছু করে যদি না পায়
প্রহসনই বটে !!!

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

রণদীপম বসু এর ছবি

তবে পোলাগোর জন্যেও এই পদ্ধতিটা মন্দ হইতো না যদি একই পদ্ধতিতে মহিলা কর্মকর্তারা পোলাগোরেও এমোন ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিতো !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

তাইলে তো পোলাগো পোয়া বারো, তাগো আর ঠেকায় কে !!
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

এনকিদু এর ছবি

সাবধান, সেই ভদ্রমহিলা যদি নুশেরা আপার মত সরকারী কর্মকর্তা হয়ে থাকেন তাইলে কিন্তু খবর আছে । ... ছ্যাঁচা দিয়ে দিবে ।

-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বড়ো হয়ে আমি গেজেটেড অফিসার হয়ে কারেক্টার সার্টিফিকেট দিতে চাই...

এনকিদু এর ছবি

ভাই বড় তো কম হইলেন না, এবার একটু ছোট হন ।

-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

ধুসর গোধূলি এর ছবি
দময়ন্তী এর ছবি

আমি একটু বিভ্রান্ত ৷ ঠিক কি কি চাকরীতে "ক্যারেকটার সার্টিফিকেট' লাগে, কেউ একটু জানাবেন প্লীজ৷ আর এই নিয়ম কবেকার? এখন সম্প্রতি ঝয়েছে? নাকি অনেক আগে ছিল, এখন নেই? এটা জিজ্ঞাসা করার কারণ হল পাশ করার পরে পরেই আমি কিছু সরকারী ও আধা সরকারী চাকরীতে অ্যাপ্লাই করেছিলাম৷ কিন্তু কোনোদিন এরকম কোন শংসাপত্র দেবার কথা তো লেখা দেখিনি৷ আর সারাজীবনে বিভিন্নরকম বেসরকারী চাকরী করে চলেছি৷ তাতেও কোনোদিন আবেদনপত্রের সাথে এরকম কিছু চাওয়া হয় নি৷ তাই জানতে চাইছি এই নিয়ম কবেকার? কোথাকার?

আর একটা কথা হল, মেয়েরা বিভিন্নভাবে ভায়োলেটেড হয়, হয়ে থাকে ---- সত্যি কথা৷ তবে এটাও সত্যি যে সেই ভায়োলেটেড হওয়ার গল্পগুলো লোকে পড়তে খুব ভালোবাসে৷, আর সেজন্যই লেখকগণ সেই "ভায়োলেটেড হওয়া'টাকেই নিজেদের লেখার বিষয়বস্তু করেন৷ অথচ যে মেয়েগুলো এইসমস্তকিছুর সাথে লড়ে অথবা এগুলিকে এড়িয়ে নিজস্ব পথ খুঁজে ডানা মেলে, তাদের গল্প কত কম লেখা হয়, পাবলিকেও কত কম আহাউহু করে ---- সম্মান তো দূরের কথা ৷ ভাওয়েলেটেড হওয়ার গল্পগুলো লেখার দরকার আছে অবশ্যই -- কিন্তু অনবরত সেই গল্পগুলৈ সামনে আসতে থাকলে ঐ লড়াকু মেয়েগুলির লড়াইকে অসম্মান করা হয়৷

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

এনকিদু এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

রণদীপম বসু এর ছবি


ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট যে এই বাংলাদেশে চাকুরির জন্য অত্যাবশ্যক ছিলো, আমি নিজেই তো এর প্রমাণ। সাতাশিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর যে সার্টিফিকেটের জন্য আমাদেরকে আমাদের সরকারী কলেজের শিক্ষকের কাছে যেতে হয়েছিলো, তা এটাই। কেননা চাকরির আবেদনে এক কপি করে দিতে হতো। খোঁজ করলে পুরানো কাগজের ভাঁজ থেকে নমূনা হয়তো এখনো পাওয়া যেতে পারে। এখন কোনটাতে প্রয়োজন হয় আর কোনটাতে হয় না তার জন্য হয়তো একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। যদি উঠে গিয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে যে আমাদের চরিত্রগত অনেক উন্নতি ঘটেছে !


গল্পটাকে আপনি যেভাবে নিগেটিভ অর্থে নিচ্ছেন, আমি কিন্তু ওটা পড়ে এতো বেশি শকড হয়েছিলাম যে আজো মন থেকে মুছে যায় নি। এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের অর্থহীন ব্যবস্থাটাকে বিদ্রুপ করতেই তো লেখক এটা লিখেছিলেন, তাই না ? একটা অর্থহীন প্রক্রিয়া কোথায় গড়াতে পারে এই দিব্যদৃষ্টি না হলে আর সৃজনশীল লেখক কেন ? আর কষ্টের, বেদনা, অপদস্ত হওয়ার বিষয়গুলোই মানুষের মনে দাগ কাটে। যতক্ষণ কিছু দাগ না কাটবে ততক্ষণ ওটা অতিক্রমের উপায় নিয়েও কেউ ভাববে না। অবশ্যই আপনার সাথে একমত যে এগুলোর সাথে লড়াই করে এগিয়ে যাবার কথাগুলো আসতে হবে। আর এই সব লড়াইয়ের কাহিনীই তো এগুলো। তাই যদি বলা না যায়, তাহলে লড়াই করার হাইপোথিটিক্যাল কথাই বলা হবে, কিসের লড়াই তা আর বলা হয় না।
এখানে মেয়েদের অসম্মান করা হচ্ছে না। বরং মেয়েদেরকে যে অসম্মান করা হচ্ছে তাই তুলে ধরা হচ্ছে। ইলা মিত্র অনেক লড়াই করেছেন,অত্যাচার সহ্য করেছেন বললে আসলে বোঝার মতো কিছুই বলা হয় না। কী অত্যাচার সহ্য করেছিলেন তা যখন প্রকাশ করা হয়, সুস্পষ্ট অবগত হয়ে তখনই আমাদের বিবেকবোধ স্তব্ধ করে দেবার মতো অত্যাচারের কাহিনীগুলো জানতে পারি আমরা এবং তিনি যে কোন অবস্থা অতিক্রম করেই ইলা মিত্র হয়েছিলেন তা উপলব্ধি করতে পারি আমরা।
বিবৃতি আর সাহিত্যের মধ্যে নিশ্চয় ফারাক একটা আছে ? একই সাহিত্যকর্মকে আবার প্রত্যেকে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিশ্লেষণ করি। যে সন্তানকে মা বুকের দুধ খাইয়েছেন, সেই সন্তান যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে এবং মা যদি তখনও বিগতযৌবনা না হয়ে থাকেন, নিজেকে সন্তানের সামনে উপস্থাপনে নিশ্চয়ই বিস্তর ফারাক থাকবে ! এটা কেন হচ্ছে ? মা কি সন্তানকে অবিশ্বাস করছেন ? আসলে দৃষ্টিভঙ্গির মডারেশন এবং ভিন্নতাও।

ধন্যবাদ দময়ন্তী, চমৎকার ও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

হায়, এই পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরিত্রহীন ব্যক্তিরাই দেয় অন্যেদের চরিত্রের সার্টিফিকেট!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

এমন সার্টিফিকেট তো কতই দেয়া হচ্ছে আমাদের চারপাশে, মোদ্দা কথা হল যারা এসব দেয় তাদের নিজেদেরই ক্যারেক্টার বলে কিছু নাই (বেশিরভাগ আরকি)।
এসব প্রহসনের শেষ কোথায় ?

--------------------------------------------------------

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মনের কথাটা সন্ন্যাসী'দাই বলে দিয়েছেন উপরে।

কীর্তিনাশা এর ছবি

সরকারী চাকরী ছাড়া আর কোথাও মনে হয় এখন আর ক্যারেকটার সার্টিফিকেট লাগে না।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

এনকিদু এর ছবি

এরকম আরো কিছু ষাঁড়ের গোবর নিয়ে আমাদের দেশে তেলেসমাতি করার বাতিক আছে । তার একটা হল ছবি সত্যায়িত করা । একবার একটা কলেজে ভর্তি ফরম জমা দেয়ার জন্য গেলাম, ভুলে সত্যায়িত করিনাই । খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম কি করব, সেদিনই ফরম জমা দেয়ার শেষ দিন । কলেজের গেটের বাইরে দেখি একটা লোককে ভিড় করে আমার মত কিছু পোলাপান দাঁড়িয়ে আছে । সেই লোক দেখি সাবাইকে সত্যায়িত করে দিচ্ছে । খালি দশ খালি দশ ...

-----------------------------------------
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

'চারিত্রিক সনদপত্র' ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হুমম...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।