।আমাদেরকে যেন আফসোস করতে না হয় !

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: রবি, ০৫/০৭/২০০৯ - ৯:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের জীবনকালেই হয়তো সেই সময়টা আমরা দেখে যাবো, এই দেশ এই মাটি এবং আমাদেরকে রাহুমুক্ত করতে নির্দ্বিধায় জীবনটাকে বাজী রেখে যাঁরা পাহাড়ের মতো অদম্য বুকটাকে টানটান করে দাঁড়িয়েছিলেন ট্যাঙ্ক গুলি আর বন্দুকের মুখে, আমাদের প্রচণ্ড অপরাধবোধ আর তীব্র পাপবোধ থেকে রেহাই পেতে ঋণশোধ তো দূরের কথা, একটুখানি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যেও তখন আর একজনকেও খুঁজে পাবো না আমরা ! তাঁরা আমাদের ভাই, বন্ধু, পিতা, প্রাণের প্রিয়জন। তাঁরা আমাদের অহঙ্কার, বীর মুক্তিযোদ্ধা। কৃতজ্ঞ সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতিটা ফোঁটা দুধের ঋণ শোধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা। ভাই হিসেবে ভ্রাতৃত্বের অমোঘ বন্ধনকে করেছেন পবিত্র, বন্ধু কিংবা প্রিয়জন হিসেবে স্বতঃস্ফূর্ত দায়বোধের পবিত্রতা ধারণ করে এই জাতিকে কলুষমুক্ত করতে সর্বোচ্চ ত্যাগে মহীয়ান তাঁরা আজ আমাদের পিতার আসনে অধিষ্ঠিত।

কিন্তু জাতি হিসেবে বুঝি বড়ই দুর্ভাগা আমরা, মানুষ হিসেবেও আজ প্রশ্নবোধে আক্রান্ত। যে পিতারা তাঁদের অবিকল্প জীবনরস দিয়ে আমাদেরকে তিলে তিলে বেড়ে ওঠার নিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ্য হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কুৎসীৎ শৃঙ্খল ছিঁড়ে মুক্ত পা দুটোকে যেখান খুশি সেখান যাবার এক মায়াবী ভূখণ্ড নিষ্কণ্টক করে দিয়েছিলেন, উচ্ছল উদ্দাম মনটাতে ইচ্ছেখুশি ডানা জুড়ে নিতে বিশাল মুক্ত এক আকাশের ঠিকানা গুঁজে দিয়েছিলেন আমাদের বুকে, সেই পিতাদের প্রতি আমাদের অপরাধ আজ আকাশচুম্বী ! তাঁদেরই ছিনিয়ে আনা মহান স্বাধীনতার প্রশ্নযোগ্য উত্তরাধিকারী হয়ে আজ আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে প্রয়োগ করছি তাঁদের প্রতিই অমার্জনীয় অবজ্ঞা আর অবহেলা নিক্ষেপ করে।

আহা, আমরা সেই জাতি, যারা বুঝে কি না বুঝে আমাদের পিতৃ-পরিচয়কেই কলুষিত করছি আজ ! অসহায় অবলম্বনহীন করে দিয়ে তাঁদেরকে বাধ্য করছি তাঁদের সেই অগ্নিক্ষরা বজ্র-কঠিন হাতকে ভিক্ষার হাত বানিয়ে নিতে। বিনা চিকিৎসায় বিনা শুশ্রূষায় কঠিন অসুখে ভোগে ধুকে ধুকে পুষ্টিহীন হাত বাড়িয়ে অনুগ্রহ চাইতে সেইসব স্বাধীনতা বিরোধী কুলাঙ্গারদের কাছেও, যাদেরকে একদিন লাথি দিয়েও মহানুভব উদারতায় প্রাণভিক্ষাও দিয়েছিলেন এঁরা। সেইসব উদারতা আজ সত্যিই কি সংশোধনের অযোগ্য ভুল হয়ে নিজেকেই গ্রাস করতে এসেছে ?

অকৃতজ্ঞ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না, আমাদের আফসোসের কোন সীমা-পরিসীমা থাকবে না, আমাদের অপরাধ আর কখনোই মার্জনাসীমায় ফিরিয়ে আনা যাবে না, যদি না আমাদের স্বতঃস্ফূর্ততা আমাদের দায়বদ্ধতা আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে এখনো আমরা যথাযথ মানবিক হয়ে ওঠতে পারি। সময় থাকতে যে জনগোষ্ঠি মানবিক হতে ব্যর্থ হয়, তার রাষ্ট্র তার সরকার তার জাতিসত্তা বিমূর্ত হয়ে যায়।

পিতাকে অবজ্ঞা মানেই নিজের পিতৃপরিচয়কেই অস্বীকার করা, মাতৃরসের অবমাননা করা। সময় আমাদের জন্য অপেক্ষায় নেই। যাকে দান করা যায়, তার কাছ থেকে কিছু চাইতে নেই। তাঁরাও আমাদের কাছে কিছু চাইতে আসেন না। কিন্তু আমরা তো অকৃতজ্ঞ নই ! আমাদের রক্ত তো তাঁদের অবদান অস্বীকার করতে পারে না। যদি তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করি আমরা, তাহলে তাঁদের জন্য কিছুই কি করার নেই আমাদের ? নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের আশেপাশে যে ক’জন সেই অঙ্গিকার লালন করা বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন তাঁদেরকে খুঁজে বের করে তাঁদের পা ছুঁয়ে কিংবা হাত ধরে শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় অবনত চিত্তে অন্তত সেই অপরিশোধ্য ঋণস্বীকারটুকু কি করতে পারি না আমরা ? আমাদের মানবিক ব্যক্তিসত্তা কি এতোটাই বিপর্যস্ত যে বিনা চিকিৎসায় একে একে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায় মৃত্যু আমাদের একটুও নাড়া দিতে পারে না ! আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার পরও আমাদের সামর্থের নগন্য অংশও কি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে রাঙাতে পারি না আমরা ?

হাঁ পারি। যে স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যমে একদিন তাঁরা আমাদের জন্য তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে একটুও পিছ-পা হন নি, একমাত্র প্রাণটাকে উৎসর্গ করতে কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক অনিশ্চিত অসম যুদ্ধে, উত্তর-প্রজন্ম হিসেবে আমরাও আমাদের অহঙ্কারী প্রণোদনাগুলো জড়ো করে তাঁদের প্রতি শর্তহীন কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পবিত্র হয়ে ওঠতে পারি। নিজেকে নিজে সম্মান করে নিজের কাছেই নিজের মানবিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরো উন্নত করে তুলতে পারি। কেউ হয়তো বলবেন, আমরা কি কোনো কৃতজ্ঞতাই দেখাইনি ! হাঁ, দেখিয়েছি বৈ কি ! তবে এটাও মনে রাখতে হবে, প্রাণহীন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বিদ্রূপের নামান্তর। তাই আসুন না, আমরা আমাদের প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়েই না হয় সবাই মিলে একবার চেষ্টা করে দেখি, কিছু করতে পারি কিনা ! নিজের সত্তার কাছে যেন পরাজিত না হই, সমস্ত মতভিন্নতা ভুলে সেরকম উদ্যোগ নিয়ে ওই উদ্যোগগুলোকেই সার্থক করে তুলি। উত্তরপুরুষের কাছে একদিন আমাদেরকেও যে জবাবদিহি করতেই হবে !

প্রিয় পাঠক, আপনার ধৈর্য্য আর মহার্ঘ সময় ব্যয় করে লেখাটি পড়েছেন বলেই সকৃতজ্ঞ অনুরোধ করি, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন’ এই উদ্যোগটিতে আপনার অবিকল্প সহমর্মিতার সামান্য স্বাক্ষরও রাখতে পারেন কিনা দয়া করে একবার দেখবেন কি ?


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

মুক্তিযোদ্ধা এজেএসএম খালেদ'কে নিয়ে 'তিনি লড়ছেন দেশের জন্য, আসুন লড়ি তার জন্য' শিরোনামে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখাটি পড়ুন (০৫-০৭-২০০৯) আজকের দৈনিক 'সমকাল' পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

আমাদের পায়ে পাযে ঘুরে বাতাসের বল

আমরা অনেক বেশি কেবলই চায়ের কাপে ঝড়

বাস্তবতার মাটি অনেক কঠিন
কঠিনেরে কে বাসে ভালো?

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

কর্তৃপক্ষের কাছে একটু অনুরোধ রাখছি (যেহেতু এই পোস্টের নিচে এখনকার স্টিকি পোস্ট-টারই লিঙ্ক দেয়া আছে, সো), এখনকার স্টিকি-টা সরিয়ে এই গরম ডাকটাকে একটু স্টিকি করা হোক। প্লিজ।
(নাকি সবজান্তা? নাকি রণদা'? আশা করি এতে কারো মতদ্বৈততা থাকবে না)

অনেক ধন্যবাদ।
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

রণদীপম বসু এর ছবি

উঁহু সাইফুল, সবজান্তার পোস্টটাই স্টিকি থাক। সেটা অনেক কাজের ও গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট।
ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ধন্যবাদ।
সমকালের অনলাইন ভার্সনে সেলিনা হোসেনের লেখাটি পেলাম না।
____________
অল্পকথা গল্পকথা

রণদীপম বসু এর ছবি

পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সনে সম্ভবত তাঁদের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোই উপস্থাপিত হয়ে থাকে, যেগুলোর কাটতি বা পাঠক চাহিদা বেশি হবে বলে মনে করে এরা।

সে বিবেচনায় এই বাণিজ্য সংস্কৃতিতে মানবিকতার চাইতে পণ্যমূল্যই প্রাধাণ্য পাবে সে আর আশ্চর্যের কী ! নইলে এস এম খালেদের মতো একজন ত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সেলিনা হোসেনের মতো একজন উঁচুমাপের কথাসাহিত্যিকের সম্পাদকীয় কলামের আবেদনময় লেখাটিও অনলাইন ভার্সনে স্থান না পেয়ে থাকে কী করে !

সত্যি বলতে কী, প্রথম শ্রেণীর কোন পত্রিকার সম্পাদকীয় তথ্য উপস্থাপনাকে আমরা রামছাগল পাঠকরাই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে ফেলি, যা ওই পত্রিকা নিজেও মূল্যায়ন করে না। যাক্, অভিজ্ঞতা মানেই জ্ঞান। এই নবলব্ধ জ্ঞানটা আগামীতে পত্রিকাগুলোর সংবাদ-মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কাজে দেবে আশা করি।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

চলুক

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

সিরাত এর ছবি

আমি ইতোমধ্যে কন্ট্রিবিউট করেছি।

চলুক

মামুন হক এর ছবি

সবাই মিলে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসা দরকার।
নয়তো পরে এমন দিন চলে আসতে পারে যে আমরা এটা নিয়ে আফসোস করব, কিন্তু করার কিছু থাকবেনা। এখনও সময় আছে, দয়া করে সবাই আরেকটু কোমর বেধে নামি।

নিবিড় এর ছবি

চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আসুন না, আমরা আমাদের প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামর্থ দিয়েই না হয় সবাই মিলে একবার চেষ্টা করে দেখি, কিছু করতে পারি কিনা ! নিজের সত্তার কাছে যেন পরাজিত না হই, সমস্ত মতভিন্নতা ভুলে সেরকম উদ্যোগ নিয়ে ওই উদ্যোগগুলোকেই সার্থক করে তুলি। উত্তরপুরুষের কাছে একদিন আমাদেরকেও যে জবাবদিহি করতেই হবে !

জয় হোক!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।