। লোকটা নাকি পাগল ছিলো...!

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: শনি, ১৮/০৭/২০০৯ - ১২:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

টোনা কহিলো- টুনি পিঠা করো। টুনি কহিলো- চাল আনো, তেল আনো, নুন আনো, গুড় আনো ইত্যাদি ইত্যাদি। টোনা কহিলো- ঠিক আছে, আমি যাইতেছি, তুমি রান্নার বুঝ-ব্যবস্থা করো। এইভাবে টুনি ঘরের কাজে আটকা পড়িলো। আর টোনা ফুড়ুৎ কইরা উড়াল দিয়া গেলোগা। এবং অন্য আরেক টুনির সঙ্গে পুটুর-পাটুর করিতে লাগিলো।
এই গল্প থেকে থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই ? শিক্ষা পাই- ছাগল দুই ধরনের। দেশি ছাগল আর রাম-ছাগল। দেশি ছাগল হইলো ব্ল্যাক বেঙ্গল। কান দুইটা ছোট ছোট। আর রামছাগল ? কান দুইটা এই লম্বা লম্বা ! বদমাইশি কইরা কইরা জীবনে বহুৎ কানমলা খাইছে তো, শরীরটা মাশাল্লা হৃষ্টপুষ্ট হইছে ! কিন্তু কানগুলা আমার চ্যাঙ্গের মতো ঝুইল্যা গেছে !

কী বুঝলি ?

আমার প্রথম কৈশোরের অভিজ্ঞতা তখনো এতো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে নি। লোকটির সঙ্গতিহীন কথা আর আচানক ধরনের শব্দগুলোর অর্থ খুঁজতে খুঁজতে আমার অনভ্যস্ত কান দুটো গরম আর সম্ভবত লাল হয়ে ওঠছে। অতএব আমি আর কী বুঝবো !
আমাকে নিরুত্তর দেখে ফের প্রশ্ন- কিছুই বুঝস নাই ?
হ, বুঝছি !
কী বুঝছস ?
আপনি একটা পাগল !

উত্তর শুনে কটমট করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি ইতস্ততবোধ করছি। হঠাৎ হৈ হৈ করে ওঠলেন- তুই তো বড়ো সত্যিবাদী পোলা রে !
বলেই হেঁচকা টানে নিজের লুঙ্গিটা খুলে ফেললেন। আচম্বিতে এই অভুতপূর্ব ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি আতঙ্কিত নাক মুখ কুঁকড়ে অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। লাঞ্চিত হবার সমূহ আশঙ্কা সত্য হয় নাই দেখে আশ্বস্ত হলাম ঠিকই। কিন্তু এই বিব্রতকর অবস্থা কিভাবে সামাল দেবো ভাবতে ভাবতে কুচকানো বন্ধ চোখ দুটো আস্তে একটু একটু করে খুলতে লাগলাম। ধুয়াশা নজরে দেখছি সামনেটা ফাঁকা, কেউ নেই ! ঝট করে পুরো চোখ খুললাম।

লুঙ্গিটাকে কপালে বেঁধে রাস্তার রাজা শাহেনশাহের মতো নির্বিকার তিনি উন্মুক্ত নিম্নাঙ্গে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছেন ! আমি একইসাথে বিস্মিত, বিব্রত এবং মনে মনে কুঞ্চিতও ! আশ্চর্যের ব্যাপার ! আশপাশ দিয়ে আনমনা পথচারী নারী-পুরুষগুলো আচমকা এমন এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েও কেন যেন একটু না চমকিয়েই নির্দ্বিধায় পার হয়ে যাচ্ছে সবাই ! কেউ কেউ আবার লোকটির বিশেষ কোন জায়গায় হ্যাংলার মতো দৃষ্টি ফেলে অনায়াসে কৌতুক করতেও ছাড়ছে না !

একটু একটু করে অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হতে হতে আমাদের বোকা কৈশোরটা তারুণ্য কিংবা যৌবন পেরিয়ে যেতে যেতে অবাক হবার ক্ষমতাটা হয়তো হারিয়েই ফেলে ! তবু মানুষের বুকে কোন কোন কৈশোর বোধ করি চিরকাল থেকে যায়। অন্য অনেক ঘটনার মতোই কৈশোরের ওই ঘটনাটা আমাকে কতোটা প্রভাবিত করেছে জানি না। তবে মন-ভুলে সেই কথাটা কখনো মনে এলেই একটা প্রশ্ন এখনো আমাকে তাড়া করে-
লোকটা কি সত্যিই পাগল ছিলো ?
একটা শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে লোকটা নিজেই নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরে যায় একদিন।


মন্তব্য

স্বপ্নহারা এর ছবি

আমারও একই রকম একটি স্মৃতি আছে...এদের প্রতি খুব মায়া হত! একবার শীতে এমন একজনকে আমি আমার জ্যাকেট দিয়ে এসেছিলাম। মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে গেল।

---------------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

রণদীপম বসু এর ছবি

কিছু কিছু স্মৃতি আসলে এরকমই। বিষাদে আচ্ছন্ন করে দেয়।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

দুর্দান্ত এর ছবি

রবেরতো বেনিইনি'র ক্যারিকেচারের ছবি আর শিরোনাম দেখে অন্য একটা ধারনা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। তবে লেখাটি ভাল লেগেছে।
অচেনা এই 'পাগল' এর অন্তর্ধান আমাদের নিঃস্বার্থ হতে শেখাক।

রণদীপম বসু এর ছবি

আমার প্রায়ই কেন যেন মনে হয়, আমাদের তথাকথিত সুস্থ মানুষদের চাইতে ওই পাগল নামধারীরা অনেক বেশি মানবিক।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

জি.এম.তানিম এর ছবি

চলুক
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শামীম এর ছবি

পা চ্যাপ্টা ছিলো। গোল ছিল না .... চোখ বন্ধ রাখছিলেন জন্য বুঝতে পারেন নাই। খাইছে

পাগলের সংজ্ঞাটা কী? অন্যভাবে বললে সকলের মধ্যেই তো কমবেশি অস্বাভাবিক আচরণ থাকে ... যেটাকে বিচ্ছিন্নভাবে পাগলামী বলেই মনে হয়। অস্বাভাবিক আচরণের কি কোনো স্বাভাবিক রেঞ্জ/মাত্রা আছে, যা অতিক্রম করলে পাগল হিসেবে বলা হয়? অস্বাভাবিক বনাম স্বাভাবিক আচরণের এই অনুপাতটা সুস্থ আর পাগলদের জন্য কেমন? মনোবিজ্ঞানীরা কী বলেন এই ব্যাপারে?

অস্বাভাবিক আচরণটাই যদি সঠিক হয় তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? (সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে - একসময় পাগলের প্রলাপ ছিল)

অনেক প্রশ্ন ..... ..... ???????????????????????
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

রণদীপম বসু এর ছবি

জটিল আবর্তে ঠেলে দিলেন শামীম ভাই।

পাগল বলে কি আসলেই আলাদা কিছু আছে ? আমার তো মনে হয় নাই। অস্বাভাবিক আচরণের মাত্রাভেদে সে ক্ষেত্রে আমরা সবাই পাগল। তবু স্বীকৃত নিয়মে তুলনামূলক অল্পমাত্রার সহনশীল অস্বাভাবিকতাসম্পন্ন মানুষরা অধিকমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণকারীদেরকে পাগল আখ্যা দিয়ে ফেলি। এটাই যে আরেক ধরনের পাগলামী, তা কিন্তু কেউ ভাবি না। এখানেও শ্রেণী বৈষম্য প্রবল এবং মারাত্মক। গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন ফতোয়া প্রবণতাগুলোও কিন্তু এই তীব্র ক্ষতিকর প্রভাবেই আক্রান্ত।
সে যাই হোক, আমারো জানতে ইচ্ছা হয়, পাগল আর সুস্থ মানুষের আচরণভেদে পার্থক্যরেখার অনুপাতটা আসলে কত ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ সিমন।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রিয়াজ উদ্দীন এর ছবি

উত্তরাধুনিক দর্শনের পুরোধা মিশেল ফুকো পাগলামি নিয়ে বিখ্যাত একটা বই লেখেন - যার ইংরেজি অনুবাদ The History of Madness. তার মতে সমাজে পাগল হিসাবে কাউকে আখ্যা দেয়া একধরনের এক্সক্লুশন। এরা অন্যদের থেকে আলাদা - সমাজে বিদ্যমান অসংগতি এদের চোখে পড়ে সহজে। এরা প্রচলিত চিন্তার আবর্তে বদ্ধ নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই মাত্রাটি উপেক্ষিত হয়। বইটা পড়া হয়নি কিন্তু ইচ্ছা আছে।
লেখাটি ভাল লাগল।

বিপ্লব রহমান এর ছবি

একটু একটু করে অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হতে হতে আমাদের বোকা কৈশোরটা তারুণ্য কিংবা যৌবন পেরিয়ে যেতে যেতে অবাক হবার ক্ষমতাটা হয়তো হারিয়েই ফেলে ! তবু মানুষের বুকে কোন কোন কৈশোর বোধ করি চিরকাল থেকে যায়।

চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

তানবীরা এর ছবি

আর টোনা ফুড়ুৎ কইরা উড়াল দিয়া গেলোগা। এবং অন্য আরেক টুনির সঙ্গে পুটুর-পাটুর করিতে লাগিলো।

লোকটা কি সত্যিই পাগল ছিলো ?
একটা শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে লোকটা নিজেই নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরে যায় একদিন।
-

অবশ্যই পাগল ছিল, আমরা যারা সুস্থ তারা কি কোনদিন এমন একটা কাজ করবো, বলেন?

--------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

সাইফ তাহসিন এর ছবি

আহারে পাগলা, বড় ভালো লেখা, মনটা উদাস হইল

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।