[এইটাকে নাকি ডিসক্লেইমার বলে : এইখানে কোন বিনোদন নাই। মানসিক ভাবসাম্যহীনদের জন্য এই পোস্ট যথোপযুক্ত বলে গণ্য হইবে। অন্য কেউ লেবুচিপা দিয়া রস খুঁজিলে লেখকের কিছু বলিবার নাই। ]
(০১)
পড়ার সামর্থ যতটুকুই থাক, পাঠক হিসেবে নিজেকে কখনোই খাটো করে দেখি না আমি। আর আমিই বা কেন ! নিজের ক্ষেত্রে কেউই তা দেখেন না। কারণ এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, স্রোতের মতো। স্রোত ভারী হলে গন্তব্য দূরবর্তী হবে, নয়তো নিকটবর্তী। তবে পাঠ যেটুকুই হোক, পাঠকের মৌলিক চরিত্র একটাই, পাঠের আগ্রহ।
যেহেতু আমি বহুভাষী নই, অন্য কোন ভাষা আমি জানি না বা বুঝি না, তাই মাতৃভাষা বাংলাই শেষ ভরসা আমার। অনেকটা অসহায়ত্বে আক্রান্ত নিরূপায় মানুষের ঈশ্বর-ভরসার মতো। ভিন্নভাষী কোন বই নিয়ে যদি কোথাও কোন তোলপাড় উঠতে শুনি, তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো সেটার অনুদিত বাংলার অপেক্ষাতেই থাকতে হয় আমাকে। সে অপেক্ষা সার্থক হোক বা না হোক। তৃষ্ণাও কখনো মেটে, কখনো মেটে না। যেটুকু না মেটে সেটা আমারই সীমাবদ্ধতা হিসেবে মেনে নেই। এছাড়া কিছু তো করার নেই। যাদের নির্ভর করার মতো একাধিক ভাষা-বিকল্প থাকে তাঁরা হয়তো আমার মতো এতোটা অসহায় নন। তবে এ নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। আফসোস যেটা, সেটা অন্য জায়গায়।
আমার প্রয়াত পিতার পরিশুদ্ধ বাংলায় কতোটা দখল ছিলো তা জানার বা দেখার সুযোগ আমার হয় নি। তবে দু’কলম ইংরেজী লিখলে ওখানের পিছলে যাওয়া বানান-ত্রুটিগুলো যে তাঁর তীক্ষ্ণ চোখে এড়াতো না ঠিকই, সাথে এটাও বুঝিয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না, সেকালের এন্ট্রান্স পাশ চাট্টিখানি কথা নয় ! এই প্রবণতা কেবল যে আমার পিতারই ছিলো তা নয়। সে আমলের শিক্ষিত ও প্রায়-শিক্ষিত অধিকাংশ মুরব্বীদের ক্ষেত্রেই কম-বেশি প্রযোজ্য ছিলো। হতে পারে ঐতিহাসিকভাবে এটা তাঁদের একাধারে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের ত্রিভঙ্গ সময়-ভ্রমণের এক অদ্ভুত আপতিক ফলাফল, যা তাঁদের মানসিক জগতটাকে সেভাবেই গড়ে দিয়েছিলো। তাই বলে বাংলা ভাষাটা যে এতো অপয়া ছিলো তাও নয়। আমাদের ধর্ম-স্যারের মতো আকাট মূর্খ-পরিবেষ্টিত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজনের পাল্লায় পড়ে এটাও বুঝতে বাকী ছিলো না যে, নিরেট মূর্খ আমরা কোনোভাবে ছাব্বিশটা ইংরেজী অক্ষর শিখে একটু গড়াগড়ি দিতে পারলে আমাদের দ্বারা ইংরেজীটা শিখে ফেলা অসম্ভব নয়। কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলা শেখা মামার বাড়ির আবদার নাকি ! কারণ সংস্কৃত ভাষার পর বাংলাই হচ্ছে পৃথিবীর জটিলতম ভাষা। আর তাই আমরা মূর্খরা আসলে বাংলা ব্যাকরণ শিখতে গিয়ে ব্যাকরণ তো শিখি না, দড়ি ছেঁড়া বকনা-বাছুরের মতো ব্যা-করণটাই শিখি। বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হলে আগে যে সংস্কৃত ব্যাকরণটা ভালোভাবে শিখতে হবে, এই কথাটা মূর্খরা বুঝবে কী করে ! নইলে আমাদের বাংলাভাষা ব্যবহারের এই ছিড়িদশা হবে কেন ! পণ্ডিত স্যারের বিরক্তি-মাখানো কথাগুলো আমরা একসময় ভুলে যাই। হয়তো আবার ভুলিও না, মনের গোপনে কোথায় কিভাবে যেন আটকে থাকে।
(০২)
ব্যাকরণ মানে কী ? ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে শিখেছিলাম- ‘যে পুস্তক পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, বলিতে ও পড়িতে পারা যায় তাহাকে ব্যাকরণ বলে।’ পরীক্ষা পাশের জন্য সংজ্ঞাটা যে ভালোভাবে মুখস্থ করেছিলাম তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে এখনো অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে কী করে ! এখানেই শেষ নয়, পরীক্ষা পাশের আয়োজনে অতঃপর পদ, প্রকরণ, বাক্য, সন্ধি, প্রত্যয়, কারক, বিভক্তি, বাগধারা, নত্ব-বিধান, ষত্ব-বিধান, কিছু ভাব সম্প্রসারণ, সারাংশ, পত্র আর গুটিকয় রচনা মুখস্থ করে রীতিমতো গুডবয় হয়ে পরীক্ষা পাশও করে ফেললাম ঠিকই। কিন্তু শুদ্ধরূপে ভাষা শিক্ষা কি হয়েছে আদৌ ? বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা হাতে নিয়েও একদিন নিজের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম- বাংলায় শুদ্ধভাবে একটি বাক্যও বলতে পারি না ! লিখবো আর কী ?
এরপর মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে শেখার জন্যে লাইব্রেরি লাইব্রেরি ঘুরে আমাকে আদর্শ বাংলা ব্যাকরণের খোঁজ করতে দেখে বন্ধুরা অনেকেই হাসাহাসি করলো- ‘বেটা বলদ, হাহ্ ! মাতৃভাষা শিখবে ব্যাকরণ পড়ে !’ সত্যিই তো ! অবোধ শিশুরা ব্যাকরণ শিখে এসে কথা বলা শুরু করে নাকি ! আমার কোন জবাব থাকে না। কেননা কাউকে এটা বুঝাতে পারি না যে, ব্যাকরণ তো ভাষার মধ্যে নতুন করে কিছু আরোপ করে না, বরং ভাষার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলোকে শ্রেণীবদ্ধভাবে প্রকাশ করে মাত্র। এতে ভাষা ব্যবহারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি সেই নিয়মগুলো জানতেই আগ্রহী হয়েছি কেবল। কোন কোন কবিবন্ধু তো আরো এক কাঠি সরেস- যাও, ব্যাকরণ শিখে তর্কালঙ্কার হয়ে এসে দেখি দু’কলম ব্যাকরণিক কাব্য রচনা করো ! আমি হাঁ-না কিছুই বলতে পারি না। তারুণ্যের একটা বিশেষ বয়সে নাকি বাঙালি সন্তান মাত্রেই কবি হয়ে উঠে। আমিও তো এর বাইরে নই। তাই ‘ব্যাকরণ মেনে কবিতা চলে না’ জাতীয় কথাগুলো শুনে মনে মনে যে বেশ পুলকিত বোধ করতাম তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! তারপরও নিজের কাছেই প্রশ্নমুখি হয়ে উঠি- তাহলে কবিতা বা কাব্যভাষা কি ভাষারীতির বাইরের কিছু ?
বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও বাচনভঙ্গির যে বৈচিত্র্য, তারও একটি আদর্শ-রীতি রয়েছে যা শিখতে ওই ভাষার ব্যাকরণের দরকার পড়ে। তাহলে মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে জানতে ব্যাকরণের গুরুত্ব কম কিসে ! আসলে ব্যাকরণের কাজটা কী তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের অমনোযোগ বা অস্পষ্টতাই আমাদেরকে ব্যাকরণ-বিমুখ করে রেখেছে। তাই, শেষপর্যন্ত বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরিগুলোতে ব্যাকরণের নামে যে সব বই হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়, তা হচ্ছে পরীক্ষাপাশের কতকগুলো গাইডবুক। মন-মতো আদর্শ ব্যাকরণ আর পাওয়া হয় না। এ অতৃপ্তিটা থেকেই গেলো। হয়তো অনেকেরই থেকে যায়। নইলে বিভিন্ন অফিস-আদালতের চিঠি-চালাচালি ও নথিপত্রে এবং কখনো কখনো পত্র-পত্রিকা ম্যাগাজিন বই-পত্রে এমন কি পাঠ্যপুস্তকেও বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষা ও বানানে যে তুঘলকি রামলীলায় হাবুডুবু খেতে হয় আমাদেরকে, এর মূল কারণ বা উৎস কী হতে পারে বলে মনে হয় ? বিশেষ করে বানান নৈরাজ্যের যে চেহারা, তাতে মনে হয় না শুদ্ধরীতি ব্যবহারে আমরা কেউ খুব বেশি আন্তরিক। ব্যবহারিক অভিধান উল্টে উল্টে বানান সংশোধনের কাজ হয়তো এগিয়ে নেয়া সম্ভব, কিন্তু প্রকৃতই ভাষার শুদ্ধরীতি ও বানান-বিভ্রাট থেকে মুক্ত হতে ব্যাকরণের আবশ্যকতাকে খাটো করে দেখার কোন উপায় আছে কি ? এই দুর্ভাগ্যের কারণ কি বাংলা ভাষায় একান্ত নির্ভর করার মতো আদর্শ ব্যাকরণ গ্রন্থের অপ্রতুলতা ? না কি শূন্যতা !
(০৩)
বাংলাভাষার ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস খুব পুরাতন নয়। বাংলা ব্যাকরণ রচনার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে বিদেশীরাই প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। জানা যায় ভাওয়াল পরগণার একটি গীর্জায় বসে পর্তুগীজ ধর্মযাজক মনোএল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৭৩৪-১৭৪২) বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। ল্যাটিন গ্রামার অনুসরণে পর্তুগীজ ভাষায় রচিত এই বইটি ১৭৪৩ সালে ছাপা হয় পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। পরবর্তীতে ১৭৭৮ সালে ইংরেজী ভাষায় ‘A Grammar of the Bengal Language’ রচনা করেন নাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেড। বইটি রচনায় তিনি আবার ইংরেজী গ্রামারের রীতি নীতি অনুসরণ করেন।
আরো পরে বিদেশীদের বাংলা ভাষা শিখানো এবং দেশীয় ছেলেমেয়েদের ভাষার লিখন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনে বেশ কিছু ব্যাকরণ গ্রন্থ রচিত হয়। সম্ভবত রাজা রামমোহন রায়’ই প্রথম এ কাজটি করেন। তিনি সংস্কৃত ও অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণ থেকে নিজেকে মোহমুক্ত রেখে বাংলাভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন, যদিও তা ইংরেজী ভাষায়। এরপর ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’। এর কিছুকাল পর চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার রচনা করেন ‘কাব্যতন্ত্র ছন্দ:প্রক্রিয়া’। পরবর্তীতে অবশ্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বিকাশে অবদান রাখতে শুরু করে।
বিংশ শতকে এসে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড.সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলাভাষার আধুনিক রীতিনীতির বিকাশ ঘটাতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা একাডেমী কর্তৃক গৃহীত ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রকল্পের সংকলন ও সম্পাদনার প্রাথমিক পর্যায়ে (১৯৬১-১৯৬৪) প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষা বিকাশে বাংলা একাডেমী যথেষ্ট অবদান রাখার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে ব্যবহারিক বাংলা অভিধান রচনার মধ্য দিয়ে প্রমিত বানানরীতি প্রচলনে বাংলা একাডেমী যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। কিন্তু বাংলা আদর্শ ব্যাকরণ গ্রন্থের শূন্যতা বোধ করি এখনো পূর্ণ হয় নি।
আর তাই বেশ ক’দিন আগে পত্রিকায় (ইত্তেফাক) খবরটা পড়ে খুবই স্বস্তি অনুভব হলো যে, বাংলা ভাষার আদর্শ ব্যাকরণ রচনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমী। এ লক্ষ্যে দু’দিনের এক কর্মশালাও নাকি হয়ে গেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার প্রয়াস হিসেবে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমী বোধ করি এই প্রথমবারের মতো বাংলাভাষার আদর্শ ব্যাকরণ রচনার উদ্যোগ নিলো। দেরিতে হলেও এই উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এতোদিনে অন্তত একটা চোখ-টাটানো গভীর শূন্যতা পূরণের আশাবাদ জেগে উঠলো বৈ কি ! এই প্রকল্পের চূড়ান্ত সফলতার মধ্য দিয়ে আশা করি বাংলা একাডেমী তার নামটিকে আরো উজ্জ্বল বিভায় রাঙিয়ে তুলবে। এখানে তো কারো আন্তরিকতায় ঘাটতি থাকার কথা নয়, এ যে আমাদের মাতৃভাষা, আ-মরি বাংলা ভাষা !
...
মন্তব্য
একটু দ্বীমত করি দাদা
০১
প্রাচীনদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি তাদের এক্ষেত্রে গতানুগতিক বলতে চাই
কারণ তারা অনেক সময় বোঝেন না যে ভাষা একটা গতিশীল বিষয় এবং ভাষা কোনো অক্ষয় বিষয় না
আর ব্যাকরণ কোনো চিরন্তন বস্তু না
একটা ভাষার মানুষ দীর্ঘদিন থেকে যে ভাষা ব্যবহার করে ব্যাকরণ তাকেই সংকলিত করে মাত্র
এবং মানুষের ভাষাকে ভাষা না জানা মানুষের কাছে কাঠামোবদ্ধ করার জন্য ব্যাকরণ তৈরি
ব্যাকরণকে অনুসরণ করা কোনো ভাষাভাসী মানুষের কাজ না
প্রাচীনরা নিজেদের পুরোনো চিন্তার আদর্শ দিয়ে নতুন (এবং গতিশীলদের) বিচার করতে যান বলেই পদে পদে ভুল ধরেন
০২
একটা ভাষার মানুষ যদি দীর্ঘদিন থেকে কোনো ব্যাকণ জাতিগতভাবে (বেশিরভাগ) অনুসরণ না করে কিংবা না করতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই ব্যাকরণ তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে
নতুন ব্যাকরণ দরকার কিংবা ব্যাকরণকে আপডেট করা দরকার বর্তমান মানুষের চালচলন অনুযায়ী
০৩
বানানের জন্য লেখক না লেখকের জন্য বানান?
বাংলা ভাষায় এমন কতগুলো বানান আছে যা ৯৯% অন্য বানানে লেখে (সূত্র অনুযায়ী যাকে বলা হয় ভুল বানান)
এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয় তথাকথিত শুদ্ধ বানানটাই বরং তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে
কারণ মানুষ তাকে আর বদার করে না
এখন ব্যাকরণের উচিত এই প্রচলিত রীতিকে স্বীকার করে নেয়া
না হলে ৯৯% এর রীতিকে ভুল বলার মতো গোঁড়ামি থেকে রেহাই পাবো না আমরা কখনওই
০৪
বাংলা একাডেমির বানান অভিধানটা যখন বের হয় আমি খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তারা প্রচলিত ট্রেন্ডটাকে কোনো আমলেই আনেননি
প্রাচীন সূত্র ধরেই তারা বানান রীতির সূত্র দিয়েছেন
এখন তারা বসেছেন ব্যাকরণ ঠিক করতে
আমার আশংকা এখনও আছে
বাংলা ভাষার গতিপরিবর্তনের ট্রেন্ডটাকে তারা কি আমলে আনবেন?
নাকি পোকায় খাওয়া বই ঘেঁটেই তারা বানাবেন এই শতাব্দির ব্যাকরণ?
০৫
পোকায় খাওয়া পুরোনো বই মানেই সব সময় মূল্যবান বই নয়
কথাটা বোধহয় আমরা ভুলে যাই মাঝেমধ্যে
আপনি এখানে দ্বিমত করলেন কই ! কেবল বানান প্রসঙ্গ ছাড়া আর কোথাও দ্বিমত দেখছি না।
বানানের বর্তমান ট্রেন্ডকে আমিও স্বীকার করি, নইলে সৃজনশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। তবে জেনেশুনে আর না জেনে করার মধ্যেই পার্থক্যটা। জেনেশুনে করার মধ্যে একটা যুক্তিবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে, যা ব্যবহারকারীর একটা ব্যাখ্যাও থাকে। কিন্তু যে না জেনেই ভুলটা করে বসে, সমস্যাটা তো সেখানেই। ওখানে তো কোন নতুন ধারণার বিষয় থাকে না।
আর এই উভয়ক্ষেত্রের জন্যই অভিধান জরুরি বৈ কি। একইভাবে ব্যাকরণের বিষয়টাকেও ভাবতে পারি আমরা। যে সদর রাস্তাটা আমি চিনি, ওখান দিয়ে না গিয়ে আমি মেঠোপথ ধরতেই পারি, প্রয়োজনে নতুন একটা পথ তৈরির পরিক্রমাও বানাতে পারি। কিন্তু রাস্তাই যদি না চিনি, অনিশ্চিৎ পথচলাকে নিশ্চয়ই সৃজনশীলতা বলবো না। এজন্যেও আদর্শ ব্যাকরণটা অন্তত জানা থাকা জরুরি নয় কি ?
[অফটপিক: কেমন চলছে দিনকাল ?]
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সাধু সাধু সাধু
শুভাশীষ দাশ
স্যার
যে রাস্তায় বেশিরভাগ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই হাঁটে না কিংবা হাঁটতে চায় না কিংবা পারে না
সেইরাস্তায় বাপদাদা হাঁটতো বলে তারে খামাখা রাস্তা হিসাবে বাঁচিয়ে রাখা ভালো নাকি বেশিরভাগ লোক যে রাস্তায় (হোক ভুল করে) হাঁটে সেইটারেই মহাসড়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ভালো?
গুরুজী, বেশিরভাগ লোক যেটা করে সবাই কিন্তু ভুল করে করে না। প্রথম ভুল বা শুদ্ধ যেভাবেই হোক একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে এবং ভুলক্রমে হলেও একটা চলাচলোপযোগী রাস্তা তৈরি হয়েছে বলেই পরবর্তীরা সেই রাস্তা মাড়ায়, যদি তা অধিকতর সাচ্ছন্দ্যের মনে হয় । সেটার সাথে ভাবনা চিন্তা বাস্তবতার একটা মিথষ্ক্রিয়া হয়ে যায়। মিছিলের পর মিছিল নিশ্চয়ই অনিশ্চিত ভুল রাস্তায় একাদিক্রমে চলতে থাকে না।
ভুলক্রমে আমি 'পূর্ণ' শব্দটাকে পুর্ণ লিখলাম এবং অনেকেই যদি এরপর যুক্তিসম্মত চিন্তাভাবনা করে এই ভুলটাকেই প্রয়োগযোগ্য হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন, তাহলে হয়তো তা গ্রহণযোগ্য হতেও পারে পূর্বোক্ত যুক্তিতে। কিন্তু একদিন লিখলাম 'পূর্ণ', একদিন 'পুর্ণ', আরেকদিন 'পূর্ন', অন্য আরেকদিন 'পুর্ন', তাহলে আর শৃঙ্খলা থাকলো কই ! শেষমেষ অন্যকেউ না জেনে একে 'পর্ন' বলেও চালিয়ে দিতে পারে।
জেনেশুনে ভুল আসলে ভুল না। হয় তা নতুন কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তিতে শুদ্ধ হিসেবে গৃহিত হবে, নয় তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ভুল তো ভুল করেই হয়। এই ভুলগুলো শুধরানোর জন্য অভিধান বা ব্যাকরণ দরকার।
আমার বক্তব্য মূলত এটাই।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রন'দা এবং লীলেন্দা
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ভাষার ভাসাভাসা যুদ্ধ হলো শুরু। কবি বলেন যতি চিহ্ন নয়তো কোন ছেদ/ পাঠক বলে ভাগ্য ভালো এটা কিন্তু বেশ।/ যে যার মতো বলছে লিখছে/ কেউ তাতে জুড়ছে খেদের রেশ।
ব্যাকরণ শেখা দরকার তা জীবনের সব কিছুরই, কিন্তু ভাষা তো চলমান তাই তার ব্যাকরণও হওয়া প্রয়োজন চলমান। আমরা যতটা ভয়েজ-ন্যারেশন ফলো করি ততটা কি আম বাচ্য-উক্তি'র পরোয়া করি। কারণ শুদ্ধতার ছড়ি হাতে কেউ আর শেখায় না প্রকৃত ব্যাকরণ। আমার বাবা বেঁচে থাকতে কখনো ডিকশনারী খুলে শব্দের মানে শিখিনি কিন্তু ডিকশনারী দেখার চলন রপ্ত করিয়েছিলেন আগেই। পাশের বাড়ীর মেশোমশাই অফিস যেতে গিয়ে ফিরে এসে শুদ্ধ করতেন মুখস্থ করতে থাকা বাক্যের বিন্যাস।
দাদা, ভালো লাগল ... এই চিহ্নটি কি 'চলবে' বহন করছে। ?।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
ভালো লাগলো খুবই, রণদীপমদা। আমার ব্যাকরণ শিক্ষা (বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত বা হিন্দি, যাতেই হোক না কেন) এতো কম যে ঐ বিষয়ে লেখা দেখলে এড়িয়ে যাই। ভাগ্যিশ এইটা পড়লাম। সিরিয়াস বিষয় নিয়ে এমন লেখাই চাই।
একটা কৌতূহল ছিলো, এক জায়গায় লিখেছেন, "সংস্কৃত ভাষার পর বাংলাই হচ্ছে পৃথিবীর জটিলতম ভাষা", সে বিষয়ে। এর কোনো তথ্যসূত্র দিতে পারেন? তাহলে অন্যভাষীদের উপর একটু রোয়াব ঝাড়তে পারি। আমরা যে ভাত জল বিড়ি সবই খাতা হুঁ সেই নিয়ে আওয়াজ শুনলে আমার একটা তৈরি জবাব আছে ('বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উন্নতির পথে ক্রমেই সিম্পলিফায়েড হয়, আমাদের ভাষাটিও উন্নত বলেই সরল' ইত্যাদি)। সবাই মানে না, বলাই বাহুল্য, এবং কেউ কেউ জানতে চায়, তো বাস ট্রেনে না চড়ে বাস খাতা হুঁ বলো না কেন? তবে এই তথ্যটা পেলে জবাবটা আরো জোরদার হয়।
আরেকটা প্রশ্ন: সংস্কৃতের আগে কি জটিলতায় আর কেউ আছে? ল্যাটিনের স্থান কোথায়?
সম্ভবত বক্তব্যের থিমটা আমি ধরাতে পারি নি পাঠক দা।
বক্তব্যটা আমার নয়, সেই দূরবর্তী অতীতের কোন এক পণ্ডিত স্যারের, যাঁর আশেপাশে আমরা সবাই মূর্খ। আর পণ্ডিত স্যাররা অপগণ্ড মূর্খদেরকে তথ্যসূত্র দেয়ার মতো এতো হালকা কাজ করবেন, তাও সেই আমলে, এটা আপনি ভাবলেন কী করে ! বুঝেছি, আপনার অবস্থা আমার চাইতেও খারাপ ! আপনি সেইরকম কোন পণ্ডিত স্যারও পাননি। হা হা হা !
এবার কি বুঝাতে পারলাম কিঞ্চিৎ ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
এইবারে বুঝলাম, এবং বুঝে দুঃখ পেলাম। আমি ওদিকে অস্ত্রে শান দিচ্ছিলাম, এইবারে সব কটার মুণ্ডু উড়িয়ে দেবো এই নতুন তথ্যাস্ত্রে। যাক গে।
উদ্ধৃতি,
এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয় তথাকথিত শুদ্ধ বানানটাই বরং তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে
কারণ মানুষ তাকে আর বদার করে না
হ্যাঁ, ঐ নতুন কয়েকটা বানান মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই।
কিন্ত
একটা ভাষার মানুষ যদি দীর্ঘদিন থেকে কোনো ব্যাকণ জাতিগতভাবে (বেশিরভাগ) অনুসরণ না করে কিংবা না করতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই ব্যাকরণ তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
আমি মনে করি ব্যাকরণ নিয়ে এখনও এরকম কিছু হয়নি।
আর
যে রাস্তায় বেশিরভাগ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই হাঁটে না কিংবা হাঁটতে চায় না কিংবা পারে না
সেইরাস্তায় বাপদাদা হাঁটতো বলে তারে খামাখা রাস্তা হিসাবে বাঁচিয়ে রাখা ভালো নাকি বেশিরভাগ লোক যে রাস্তায় (হোক ভুল করে) হাঁটে সেইটারেই মহাসড়ক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ভালো?
রাস্তাটাতো পাকা করলেই ভালো হয় এবং চলে।
কেননা, আস্ত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, ভাষার পুরা রাস্তা বাদ দিয়ে একেবারে নতুন রাস্তা হয়েছে বলে আমার জানা নাই। রাস্তা আপডেট হয়েছে ঠিক। (রাস্তার উদাহরণে পেঁস লাইগ্গা যাইবো দেখতাছি)
তাই
নতুন ব্যাকরণ দরকার কিংবা ব্যাকরণকে আপডেট করা দরকার বর্তমান মানুষের চালচলন অনুযায়ী আপডেট করা অবশ্যই দরকার।
??
এখন তারা বসেছেন ব্যাকরণ ঠিক করতে
আমার আশংকা এখনও আছে
বাংলা ভাষার গতিপরিবর্তনের ট্রেন্ডটাকে তারা কি আমলে আনবেন?
রণদা যদি এই গ্যারান্টী দিতে পারেন আমি রণদার সাথে থাকবো।
একটা ভোট দিয়া আর লেখাটারে ফেভারিট কইরা গেলাম গা, আমার নিজের পোস্টের মন্তব্য পইড়াই শেষ করতে পারতেছি না। রিয়াজ ভাই এবং হিমু ভাই চিপার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু করছে, তা শেষ হইতেছে না। এই কাওয়াজ দেখতে গিয়া আমার ক্যানভাসের মাইয়ার চোখের ভ্রূ একটা উপরে একটা নিচে নাইমা গেছে। স্কিমিং কইরা পড়লাম, ভালোই লেখছেন মনে হইতেছে, পরে পইড়া আবার মন্তব্য দিমুনে। ভালো কথা, সুনীতিবাবু না বইলা গেছে- "পাণিনি-ই মানিনি, আর রবীন্দ্রনাথ? ঘ্যাঁচ করে কেটে দিন।" এই গল্প জানা আছে আপনার? ওই যে, দীর্ঘ-ই যখন বেশি দীর্ঘ হবে তখন ৫/৬ টা দীর্ঘ ইকার ব্যবহারের সাজেশন দিসিলেন গুরুদেব। কিন্তু বৈয়াকরণ-রা এইভাবে পাণিনি-কে অস্বীকার করলে, আমরা কই যামু?
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...
সুন্দর লেখা। তবে ভাষার ব্যপারে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমাদের ভাষায় বিদেশী শব্দকে গ্রহণ করে নেবার যে প্রবণতা, তাতে টিভি, রেডিও এগুলোকে এখন বাংলা শব্দই বলা চলে। লিখতে গেলে সচেতন থাকার চেষ্টা করি যেন ইংরেজী শব্দের আধিক্য লেখাকে দুষিত করে না ফেলে, কিন্তু টিভির জায়গায় যদি দূরদর্শন লিখি তাহলে পড়তে গেলে কেন জানি মনে হয় লেখা গতি হারালো। এ ব্যপারে কি করণী্য়?
এই প্রবণতা প্রায় সব ভাষারই কমবেশি আছে। ইংরেজি তো অসংকোচে শব্দ ধার করেছে এবং করছে বিভিন্ন ভাষা থেকে। বাংলা শুধু ইংরেজি না আরো অনেক ভাষা থেকেই বিভিন্ন সময়ে শব্দ ধার করেছে। 'ইংরেজি' শব্দটিই পর্তুগিজ থেকে এসেছে। আমরা যদি রিকশা, লুঙ্গি, আঁতাত, রেস্তোরাঁ, চা, চিনি, পানি ইত্যাদিকে বাংলার মর্যাদা দিতে পারি তাহলে চেয়ার, টেবিল, ট্রেন, টিভিতেও সমস্যা থাকার কোন কারণ নেই। তবে সহনশীলতার একটি মাত্রা থাকা উচিৎ। বুঝতে হবে বিদেশি শব্দ আরোপিত ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা। অদ্ভূত লাগে যখন চীনা রেস্তোরাঁয় গিয়ে আমরা 'রাইস' আর 'চিকেন' খাই আর ঘরে এসে ভাত দিয়ে দেশি মুরগি না হলে চলে না।
রণদীপম বসুকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর বিষয়টির জন্য।
তুমুল লেখা রণ দা!!!
কিছু বিচ্ছিন্ন চিন্তা যোগ করছিঃ
১। বানানের ব্যাপারে আমার মত হল হায়াৎ মাহমুদের মতই। আমরা স্রেফ আলস্যের কারণে বানান নিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করি।' উজ্জল' আর' উজ্জ্বল' এর মাঝে তফাত যদি না করি---তাহলে শব্দটার জন্ম ইতিহাসকে আমরা উপেক্ষা করলাম।প্রতিটা শব্দের একটা জন্ম ইতিহাস (Etymology) আছে। হাজার হাজার বছর ধরে নানা বিবর্তনের হাত ধরে শব্দগুলো বদলায়। কিন্তু যতই বদলাক, তার একটা গোত্র পরিচয় থেকেই যায়। বানানের ব্যাপারে আমাদের স্বেচ্ছাচারিতা এই ইতিহাসটুকুকে মুছে দিচ্ছে।
২। কোন ভাষা কতটুকু প্রসিদ্ধি লাভ করবে সেইটার একটা বড় নিয়ামক, আমার মতে, অর্থনীতি। বৈশ্বিক অর্থনীতি ঠিক করে দেয় কোন ভাষা কতটুকু জনপ্রিয় হবে।
কঠিন পোস্ট রণমোচড় দা (আমি বউনি করলাম )
তবে, এ কথাটা মানি না:
বাংলা অনেক সহজ ভাষা, অন্তত ইংরেজীর চেয়ে সহজ।
নতুন মন্তব্য করুন