…
বাংলায় ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ও ভবনগুলোর মধ্যে ঢাকার ফরাশগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত লালকুঠি (Lalkuthi) হিসেবে পরিচিত নর্থব্রুক হল (Northbruck Hall) অন্যতম। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় বা গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক (১৮৭২-৭৬ খ্রিঃ) ১৮৭৪ সালে এক সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। নর্থব্রুকের এই ঢাকা সফরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ঢাকার প্রখ্যাত ধনী ব্যক্তি ও জমিদারগণ ‘টাউন হল’ ধাঁচের একটি হল নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
.
.
সে সময় রাজা রায় বাহাদুর ও দানশীল প্রখ্যাতনামা ধনী ও জমিদারগণ দশ হাজার পাঁচ হাজার করে প্রচুর চাঁদা দানের মাধ্যমে এই হলের নির্মাণ তহবিল গঠন করেন। প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব অভয় চরণ দাস ছিলেন উদ্যোক্তা কমিটির সেক্রেটারি, যিনি ঢাকার আরো বহু লোকহিতকর কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও আমৃত্যু উদ্যোক্তা হিসেবে জড়িত ছিলেন। ১৮৭৯ সালে নর্থব্রুক হলের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ঢাকার তৎকালীন কমিশনার ১৮৮০ সালের ২৪ মে নর্থব্রুক হলের দ্বারোদ্ঘাটন করেন।
.
.
পরবর্তীতে নর্থব্রুক হলকে গনগ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৮৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নর্থব্রুক হলের সাথে ‘জনসন হল’ (Johnson Hall) নামে একটি ক্লাবঘর মতান্তরে গণপাঠাগার সংযুক্ত করা হয়। যদিও তা ‘নর্থব্রুক হল লাইব্রেরী’ নামেই খ্যাত ছিলো। পাঠাগারটির সংগ্রহের খুব সুনাম ছিলো। এই পাঠাগার গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিকভাবে যে তহবিল সংগ্রহ করা হয়, তাতে ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ পাঁচ হাজার, ত্রিপুরার মহারাজ এক হাজার, বালিয়াটির জমিদার ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এক হাজার, রানী স্বর্ণময়ী সাতশ’, কালীকৃষ্ণ পাঁচশ’ এবং বিশ্বেশরী দেবী পাঁচশ’ টাকা দান করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে এক হাজার বই নিয়ে ১৮৮৭ সালে পাঠাগারটি খোলা হয়। এই পাঠাগারের জন্য নাকি বিলেত থেকে বই এনে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাঠাগারের অনেক বই নষ্ট হয়ে যায়।
.
নর্থব্রুক হল নির্মাণের পর ঢাকার জাকজমকপূর্ণ নাগরিক অনুষ্ঠানগুলো এখানেই আয়োজন করা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধু প্রতিমা ও অন্যান্যসহ শেষবার ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা, অনুষ্ঠান ও সংবর্ধনাসভায় অংশগ্রহণ করেন। এবং তাঁর ঢাকা পৌঁছার দিনই অর্থাৎ ৭ তারিখ বিকেলে ঢাকার নাগরিক সমাজ এই লালকুঠির নর্থব্রুক হলে এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে (সূত্র: The Independent 30 July 2011)। এমনকি প্রথমবার ১৮৯৮ সালে ঢাকা এলে তখনও এই নর্থব্রুক হলে একটি ভোজসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
.
.
নর্থব্রুক হল ভবনটির নির্মাণশৈলীতে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যরীতির সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁ-উত্তর স্থাপত্যরীতির মিশেল ঘটেছে। এর অশ্বক্ষুরাকৃতির অর্ধবৃত্তাকার খিলান, উত্তরে প্রশস্ত প্রবেশদ্বার ইত্যাদি ইউরোপীয় রীতির বৈশিষ্ট্যের সাথে উত্তর দিকের চারটি অষ্টভূজ মিনার, আলঙ্কারিক নকশামণ্ডিত নিচু পাঁচিল এবং সুউচ্চ চূড়াসমূহ মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক। ১৯৫০-এর দিকে নর্থব্রুক হল টেলিগ্রাফ অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে কিছুদিন ‘সেন্ট্রাল উইমেন কলেজ’ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিলো বলে জানা যায়। এরপরই নর্থব্রুক হলের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে ঢাকা পৌরসভা।
.
.
দলিল-দস্তাবেজে স্থাপনাটির নাম নর্থব্রুক হল হিসেবে উদ্ধৃত থাকলেও লাল বর্ণের স্থাপনা হওয়ায় ভবনটি সাধারণ্যে ‘লালকুঠি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। তবে এটাকে ‘কুঠি’ হিসেবে উল্লেখ করার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক কারণ হয়তো আরেকটু পেছনে। সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় বাণিজ্যের শুরু থেকে আমাদের মাতৃভাষায় কুঠি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও এ অঞ্চলে অষ্টাদশ শতক থেকে সিল্ক ও নীল ব্যবসার সাথে যুক্ত প্রতিনিধিদের বাসস্থানের সাথেই সাধারণভাবে ‘কুঠি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা। নীলের গুদাম বা কারখানা সংলগ্ন এর উদ্যোক্তা ইউরোপীয় সাহেবদের বাসভবনের ক্ষেত্রে কুঠি শব্দটি সাধারণত ব্যবহৃত হতো।
.
.
পরবর্তীকালে একক বাড়ির ক্ষেত্রেই এই নামটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং একটা সময়ে এসে এটি সব সাদা চামড়ার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বাসভবন বা বাংলো, এমনকি শেষ পর্যন্ত স্থানীয় জমিদারদের বাগানবাড়ি চিহ্নিতকরণেও কুঠি শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। অর্থাৎ কুঠি হচ্ছে শক্তিধরদের বাসস্থান এবং চিত্তবিনোদনেরও জায়গা। ফলে উনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুতে সাধারণভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের লাল রংয়ের বাংলো এবং কোন কোন জমিদারের বাগানবাড়িকে জনগণ কুঠি হিসেবে আখ্যায়িত করে।
.
.
একই কায়দায় ইউরোপীয় বা সাদা চামড়া সংশ্লিষ্ট লাল বর্ণের ভবন কুঠি হিসেবে আখ্যায়িত হওয়া অস্বাভাবিক ছিলো না হয়তো। সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় শেষপর্যন্ত নর্থব্রুক হলও লালকুঠি হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে। নর্থব্রুক হলের দক্ষিণে জনসন হলের লাগোয়া সামনে বাম পার্শ্বে ছোট্ট করে ‘লালকুঠি পানির পাম্প’ সাইনবোর্ডটি হয়তো এরই বর্তমান নিদর্শন।
.
.
…
তথ্য সহায়তা:
০১) স্থাপত্য / বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-২ / বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
০২) ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী / মুনতাসীর মামুন।
০৩) ছবি : রণদীপম বসু।
…
মন্তব্য
রবীন্দ্রনাথ আসছিল নর্থব্রুক হলে। এই হলের মিলনায়তনটা খুবই সুন্দর। এখনও মেইনটেইন করা হয়। মানে আমি বছর তিন আগে গিয়া তাই পাইছিলাম। আর বই ... বইটই কে পড়ে। পাশেই সিটিকর্পরেশনের জিম। পোলাপাইন মুগুর ভাজে।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
ধন্যবাদ অনিন্দ্য। রবীন্দ্রনাথের এই তথ্যটা জানা ছিলো না। কত সালে কখন কিভাবে এসেছিলেন তার রেফারেন্সটা কি দেয়া যাবে ? তাইলে এই তথ্যটাও পোস্টে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া যেতো।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ - এ এসেছিলেন বোধহয়। এখানে পেলাম।
উইকিপিডিয়া অবশ্য বলছে সংবর্ধনার তারিখটা ছিলো - ৮ ফেব্রুয়ারি। তবে ৭ ফেব্রুয়ারি বোধহয় সঠিক তারিখ।
লেখা ভালো লাগলো। তবে আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর বেহাল দশা দেখে খুব কষ্ট লাগে।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। খুব কাজের তথ্য।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
র.ঠা প্রথম আসছিল ১৮৯৮। সেকেন্ড টাইম ২৬ এ। প্রথমবার নর্থব্রুকে প্রোগ্রাম ছিল। সেইখানে একটা ভোজসভা ছিল বলে শুনছিলাম। অনেকদিন আগের কথা, এত কী আর মনে আছে
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
আবার ধন্যবাদ।
দেখেন তো, উপরে যোগ করে দেয়া তথ্য ঠিক হয়েছে কিনা ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১৯২৬ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা পৌরসভা ও দি পিপলস অ্যাসোসিয়েশন মানপত্র দেয়। নথব্রুক হলের সেই অনুষ্ঠান লোকারণ্যে পরিণত হয়। সেই মানপত্র নেয়ার অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ একটা লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেন। প্রবাসী প্রত্রিকার সেই বক্তৃতা ছাপা হয় "ঢাকা ম্যুনিসিপালিটির অভিনন্দনের উত্তরে" - এই শিরোনামায়। ঐ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন "নিজের শক্তিতে নিজের অভাব দূর করবার ভার যদি আমরা না নিলাম তাহলে দেশকে পাওয়াই হলো না"। ভূঁইয়া ইকবাল রচিত বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা বইয়ে এই বর্ণনা পাওয়া যায়। ভোজসভার বিষয়টা আমি কোথায় পাইছি মনে করতে পারতেছি না। মনে পড়লে সূত্র দিয়া যাব।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
লালকুঠি এতবার দেখেছি কিন্তু সেটা নিয়ে জানার প্রয়োজন বোধ করিনি কখনো। আপনার লেখা পড়ে এটা সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। আমি কয়েকবার গিয়েছি সেখানে, শেষবার এক বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতে।
আমার অবশ্য পছন্দ আহসান মঞ্জিল। সেটা নিয়ে একদিন লিখেন না।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
আহসান মঞ্জিল নিয়ে লেখা তৈরি আছে অবশ্য। সময় করে সচলে পোস্ট দিয়ে দেবো না হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ঢাকায় কিন্তু আরেকটা লালকুঠি আছে, মিরপুর মাজার রোডে...
আমি সেই লালকুঠির বাসিন্দা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আপনি কোন্টার কথা বলছেন নজু ভাই ? তাড়াতাড়ি কন ! সাথে কাহিনীটাও একটু জানান !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ঢাকায় কিন্তু আরেকটা লালকুঠি আছে, মিরপুর মাজার রোডে...
আমি সেই লালকুঠির বাসিন্দা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভালো লাগলো খুবই।
ধন্যবাদ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধন্যবাদ আপনাকে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নিজের দেশের অনেক কিছুর ইতিহাসই ঠিকমত জানিনা। আপনার পোষ্টগুলো এইজন্য খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি রণদীপমদা।
ধন্যবাদ আপনাকে।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দারুণ!
এই সিরিজটা চলুক।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন