(আগের পর্বের পর---)
---
(৪)
ধরা যাক আপনি কোথাও ভ্রমণে বেরোবেন যেখানে আগে কখনো যান নি। যেহেতু বেশ দূরবর্তী হাঁটার রাস্তা, তাই অতি প্রত্যুষে অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে পড়েছেন এবং বাড়ি থেকে কিছুদূর এগিয়েই সামনে রাস্তায় কিছু একটা বস্তু আড়াআড়ি পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বিষাক্ত সাপই তো মনে হচ্ছে ! যাত্রার শুরুতেই এরকম একটা অপয়া বাধা পড়ায় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো আপনার। এখন কি বাড়ি ফিরে যাবেন, না কি তুচ্ছ অপয়া চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সাপটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবেন তা ভাবছেন। ইতোমধ্যে সকালটা আরো ফর্সা হয়ে উঠতেই বিস্ময়ের সাথে দেখলেন যে, আরে ওটা তো সাপ নয়, আসলে একটা মোটা দড়ি বা রজ্জু পড়ে আছে ! দেখতে অনেকটা সাপের মতোই লাগছিলো তখন। আশ্বস্ত হয়ে আবার এগিয়ে চললেন। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে বেলা বেড়ে বেশ গরম হয়ে ওঠছে। হাঁটতে হাঁটতে যতই বেলা বাড়তে লাগলো ততই সামনের এলাকাটা গাছপালাহীন খা খা বিরান ভূমিতে পরিণত হতে লাগলো। এদিকে মধ্য দুপুর হয়ে মাথার উপর সূর্যটা তার গনগনে আগুন ঢেলে দিচ্ছে যেন। ঘেমে নেয়ে একাকার আপনার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু সাথে পানি না থাকায় এদিক ওদিক খুঁজছেন কোথাও পানির সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। আসার পথে কয়েকটা পুকুর জলাশয় পেরিয়ে এসেছিলেন বটে, তাও বেশ আগে, কিন্তু এখন আর তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ বেশ দূরে পানির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে বলে মনে হলো। ছায়া-ছায়া মতো গাছপালাও হবে হয়তো ওখানে, যা কিনা পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। সেদিক লক্ষ্য করেই ছুটলেন এবার। কিন্তু হায় যতই এগুচ্ছেন ওটা একই দূরত্বেই পেছনে চলে যাচ্ছে ! তবুও ঐ দূরের ঢিবিটার পাশে চকচকের পানির অস্তিত্ব ঠিকই বুঝতে পারছেন। আরো বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে যখন ঢিবিটার পাশে এলেন তখন দেখা গেলো ঢিবিটা আছে ঠিকই কিন্তু পানির কোন চিহ্নই নেই। কেন এমন হচ্ছে ! আর কোনভাবেই যখন পানির কাছে ভিড়তে পারলেন না তখনই উপলব্ধি হলো যে, আরে ওটা তো পানি ছিলো না, মরীচিকা ! পানির পিপাসায় বুকটা বুঝি এবার সত্যিই ফেটে যাবে। এখন কী করা ? আবারো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। দূর থেকে এবার একটা দিঘির মতো কিছু নজরে এলো। এগিয়ে চললেন। একসময় পৌঁছেও গেলেন। টলটলে পানিই তো দেখা যাচ্ছে। সকালের সাপের ঘটনা এবং কিছুক্ষণ আগের মরীচিকার বিষয়টি মনে এলো আপনার। তাই যত টলটলেই হোক পানি স্পর্শ না করে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না যে ওটা সত্যিই পানি কিনা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ওটা আসলে পানিই। হাতমুখ ধোয়ে শীতল পানিতে গা’টা মুছে নিয়ে প্রাণ ভরে পান করে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলেন। যাক এবার শান্তি। নিশ্চয়ই আপনার গন্তব্যও আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু এ পর্যন্ত ভালোই অভিজ্ঞতা হলো বলতে হবে।
এই ছোট্ট ঘটনা বা কাহিনী থেকে আমাদের কী কী অভিজ্ঞতা হলো এবং তা থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা গেলো ? এই দায়টা যদি কোনভাবে আমাদের সেই প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকদের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া যায় তাহলে বিস্ময়ের সাথে দেখবো যে, এই ছোট ছোট অভিজ্ঞতাগুলোকেই মহান আচার্যরা কী করে একেকটা কালজয়ী তত্ত্বে রূপ দান করে যুক্তিজাল বিস্তারের মাধ্যমে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত কতকগুলো দার্শনিক প্রস্থানেরও ভিত্তি বানিয়ে ফেলেছেন ! যার একটির সাথে অন্যটির সংরাগ-বিরাগ ঐক্য-অনৈক্যের অম্ল-মধুর সম্পর্কের জ্ঞান-চিহ্ন দর্শনের পাতায় পাতায় কালের সাক্ষি হয়ে রয়ে গেছে। এ পর্যায়ে আমরা বরং সেখানে না ঢুকে আমাদের প্রাসঙ্গিক বিষয়টুকুই খুঁটে খুঁটে তুলে আনার চেষ্টা করতে পারি।
এ প্রেক্ষিতে প্রথমেই প্রশ্ন আসে, জ্ঞান কী ? সহজ কথায়, কোন বিষয় সম্বন্ধে প্রাপ্ত উপলব্ধিই হলো জ্ঞান। দর্শনের ভাষায় যাকে বলে ‘প্রমা’। তবে প্রমার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো প্রকৃষ্ট জ্ঞান। প্রকৃষ্ট জ্ঞান বলতে সেই জ্ঞানকেই বোঝায় যে জ্ঞান অন্য জ্ঞানের দ্বারা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত না হয়। যেমন রজ্জুতে সাপ দেখার জ্ঞানকে প্রমা বলা যাবে না। কারণ প্রথম জ্ঞানটি সাপ-বিশিষ্ট হলেও পরবর্তীতে অন্যভাবে প্রাপ্ত রজ্জুজ্ঞান প্রথম জ্ঞানটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে যে, ওটা আসলে সাপ নয় রজ্জু। জ্ঞানের এই যে ভ্রান্তি তাকে দর্শনের ভাষায় বলে ভ্রম। এই ভ্রমকে বলা হয় মিথ্যা জ্ঞান বা অযথার্থ জ্ঞান। একইভাবে মরীচিকায় জলের জ্ঞানও মিথ্যা জ্ঞান। তবে দিঘিতে যে জলের সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা, সেখানে জলে জল-জ্ঞান হলো যথার্থ জ্ঞান বা সত্য জ্ঞান। কেন তা যথার্থ জ্ঞান ? কারণ সেই জল পান করে বা হাত-মুখ ধোয়ার মাধ্যমে প্রবৃত্তি নিবারণ করে আমরা উপলব্ধি করেছি যে এই জল আসলে জলই, অন্য কিছু নয়। নইলে আমাদের প্রবৃত্তি নিবারণ হতো না।
এখান থেকে কী সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলো ? জ্ঞান দু’প্রকারের- প্রমা বা যথার্থ জ্ঞান এবং অপ্রমা বা অযথার্থ জ্ঞান। যথার্থ জ্ঞানের যে যথার্থতা বা সত্যতা তাকে বলে প্রামাণ্য। আর অযথার্থ জ্ঞানের যে অযথার্থতা বা মিথ্যাত্ব তাকে বলে অপ্রামাণ্য। কারো কথায় কোন সন্দেহ দেখা দিলে আমরা কিন্তু তৎক্ষণাৎ বলে ফেলি, তোমার কথা যে সত্যি তার প্রমাণ কী ? এটা কিন্তু আমরা এমনি এমনি বলি না। জানতে বা অজান্তেই আমরা আসলে আমাদের সেই হাজার বছরের দার্শনিক যুক্তির ধারাবাহিকতাটুকুই পালন করে যাচ্ছি। অর্থাৎ যে-কোনো প্রামাণ্য বা সত্যতা নির্ণয় করা হয় প্রমাণের মাধ্যমে।
এতটুকু পর্যায় পর্যন্ত সবগুলো ভারতীয় দর্শনই প্রায় একমত ছিলো। জ্ঞানের এই প্রামাণ্য নির্ণয়কল্পে ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শব্দপ্রমাণ, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি এসব নানা প্রকার প্রমাণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে সবগুলো দর্শন সম্প্রদায় কিন্তু সবগুলো প্রকারের প্রমাণকে একইসাথে স্বীকার করেন নি। কেউ কেবল প্রথমটি অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন, আমরা যেমন পানিটুকু স্পর্শ করে এবং পান করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছি যে ওটা পানিই ছিলো। কেউ আবার প্রথম দুইটিকে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও অনুমানকে প্রমাণ মানেন, কেউ প্রথম তিনটি, কেউ প্রথম চারটি, পাঁচটি বা ছয়টিকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় মূলত এটি নয়।
বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়গুলির মধ্যকার মূল বিতর্কটি হচ্ছে মূলত জ্ঞানের প্রামাণ্য বা সত্যতা এবং অপ্রামাণ্য বা মিথ্যাত্ব এর প্রকাশ ও অবগতির উপায় বা প্রক্রিয়া নিয়ে। আরেকটু সহজ করে বললে, যেমন জ্ঞানের বিষয় হিসেবে সাপ বা রজ্জু বা জল বা মরীচিকা ইত্যাদি প্রমা বা অপ্রমার যে প্রকাশ ঘটে তা কীভাবে ঘটে এবং আমরা যে উপলব্ধি করি এটা সাপ বা রজ্জু বা জল বা মরীচিকা তার সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ধারণের প্রক্রিয়াই বা কী, তার উপর নির্ভর করেই বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি এবং তা থেকেই প্রত্যেকেরই নিজস্ব একেকটি প্রামাণ্যবাদ গড়ে উঠেছে। একদলের সাথে অন্যদলের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক তফাৎও রয়েছে। এই যে একটি বিষয় নিয়ে একেক দলের একেকটি অবস্থান, তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের প্রধান আলোচ্য আস্তিক্য ও নাস্তিক্য বিষয়ক ধারণার মূল সূত্রটুকু। আর এটুকু বোঝার জন্যেই আসলে এতোক্ষণ এই ভণিতাটুকু করে আসতে হয়েছে। সহনশীল পাঠক এটুকু মার্জনা করবেন নিশ্চয়ই।
বাকি বিষয়টুকু বোঝার জন্যে আমাদেরকে অবশ্য প্রামাণ্যবাদের জটিল দর্শন-পাঠে ঢোকার প্রয়োজন হবে না। বরং এর সীমান্ত ঘেষে হাঁটতে হাঁটতেই আমরা আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের আপাত সন্তোষজনক একটা ব্যাখ্যা মোটা দাগে পেয়ে যাবার আশা করছি। তবে যেহেতু বিষয়টা আস্তিক-নাস্তিক সম্পর্কিত, এবং বিষয়-বিচারে অনেকটা সংবেদনশীলও, তাই এ ট্র্যাকের বাইরের পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে কয়েকটা তথ্য জানিয়ে রাখা আবশ্যক। তা হলো, ভারতীয় দর্শনের উল্লেখযোগ্য প্রধান নয়টি দার্শনিক-প্রস্থানের তিনটিকে বলা হয় নাস্তিক দর্শন, এবং বাকি ছয়টিকে একসাথে বলা হয় আস্তিক ষড়দর্শন। নাস্তিক দর্শন তিনটি হলো চার্বাক-দর্শন, জৈন-দর্শন ও বৌদ্ধ-দর্শন। একটু ভেবে দেখুন তো, পৃথিবীতে জনসংখ্যার আধিক্য বিবেচনায় প্রধান চারটি ধর্মাবলম্বীদের একটি হলো বৌদ্ধ। অথচ এই বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠিত দুটি নাস্তিক দর্শনের উপর ! অন্যদিকে ছয়টি আস্তিক দর্শন হলো ন্যায়-দর্শন, বৈশেষিক-দর্শন, সাংখ্য-দর্শন, যোগ-দর্শন, মীমাংসা-দর্শন ও বেদান্ত-দর্শন। এই সবগুলো দর্শন আবার সম্মিলিতভাবে জড়িয়ে আছে প্রচলিত সনাতন বা হিন্দু ধর্ম তথা বৈদিক সংস্কৃতির সাথে। কিন্তু ? হাঁ, এখানেও বড়োসড়ো একটা কিন্তু রয়ে গেছে।
এই সরল বিভাগ থেকেই যদি আস্তিক ও নাস্তিক সম্পর্কিত ধারণাটি সহজে নির্ধারণ করা যেতো তাহলে পাঠক-ধৈর্য্যরে প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত অবিচার করে এতোটা কাসুন্দি ঘাঁটার প্রয়োজন হতো না। কারণ এই দর্শনগুলির মধ্যে আবার অদ্ভূত ধরনের আরেকটি আকর্ষণীয় শ্রেণীবিভাগ রয়ে গেছে। বাহ্যবস্তুবাদী ও ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। বাহ্যবস্তুবাদী মতাদর্শীরা আমাদের চারদিকে এই যে প্রত্যক্ষগ্রাহ্য পরিমন্ডল বা বাহ্যজগত গাছ-পালা নদী-পাথর আকাশ-বাতাস জীব-জন্তু ইত্যাদি রয়েছে তার বাস্তব অস্তিত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করেন না বরং এদের অস্তিত্বকে অনিবার্য সত্য বলেই স্বীকার করেন। অন্যদিকে ভাববাদী মতাদর্শীরা এই ইহজগতকে মনে করেন স্বপ্নদর্শনের মতোই অসত্য অলীক বা মিথ্যা মায়া। আসল সত্য নিশ্চয়ই অন্য কোথাও অন্যলোকে। আমাদের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে হয়তো সরল হিসাবে বলে ফেলতে পারি যে নাস্তিকেরা নিশ্চয়ই বাহ্যবস্তুবাদী হবেন আর আস্তিকেরা হবেন অবশ্যই ভাববাদী। কিন্তু জটিলতার আকর্ষণটা এখানেই যে, এই বাহ্যবস্তুবাদীর দলে যেমন নাস্তিক মতাদর্শী রয়েছেন তেমনি আস্তিকও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। একইভাবে ভাববাদীর দলেও আস্তিক নাস্তিক মিলিয়ে কয়েকটি দর্শনের মুখর উপস্থিতি। যেমন, নাস্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চার্বাক দর্শন এবং আস্তিক সম্প্রদায়ের ন্যায়, বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শনগুলো হলো দারুণভাবে বাহ্যবস্তুবাদী। আর বাহ্যজগতকে অসত্য বা মিথ্যা মায়া বলে মনে করা চরম ভাববাদী দর্শনের কাতারে রয়েছে নাস্তিক সম্প্রদায়ের জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন এবং আস্তিক সম্প্রদায়ের সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত দর্শন।
জটিলতার এখানেই শেষ নয়। জগত-স্রষ্টা হিসেবে কোন সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার প্রসংগে আবার দর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিন্ন রকমের শ্রেণীবিভাগ। জগৎ¯স্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে যারা স্বীকার করেন তাদেরকে বলা হয় ঈশ্বরবাদী এবং যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না তাদেরকে বলা হয় নিরীশ্বরবাদী। আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের বিবেচনা এখানে নিশ্চয়ই বলবে যে আস্তিকেরা অবশ্যই ঈশ্বরবাদী আর নাস্তিকেরা নিরীশ্বরবাদী, তাই না ? কিন্তু এখানেও বিধি বাম ! ঈশ্বরবাদীর দলে কোন নাস্তিক দর্শনের উপস্থিতি না থাকলেও নিরীশ্বরবাদীর দলে কট্টর আস্তিক্যবাদী দর্শনের উপস্থিতি আমাদের বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চরমভাবে অস্বীকারকারী নিরীশ্বরবাদী দর্শনগুলোর মধ্যে জড়বাদী নাস্তিক চার্বাক দর্শন, ভাববাদী নাস্তিক জৈন ও বৌদ্ধ দশর্নের পাশাপাশি আস্তিক শিরোমণি মীমাংসা দর্শনের উপস্থিতি গোটা ভারতীয় দর্শন জগতের জন্য কেবল যে বিস্ময় তা-ই নয়, দার্শনিক অবস্থানগত কারণেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব খন্ডনে মীমাংসকেরা একেবারে সম্মুখ সারিতে উপস্থিত হয়ে যেসব বৈপ্লবিক যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা আধুনিক মনন-দৃষ্টিতেও বিস্ময়কর বলে প্রতীয়মান হয়। এ ব্যাপারে এতটুকু সন্দেহ থেকে থাকলে যুক্তিশীল পাঠকদের উদার বিবেচনার জন্য যথাস্থানে প্রখ্যাত মীমাংসক আচার্যদের উত্থাপিত ক্ষুরধার যুক্তির সামান্য কিছু নমুনা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হবে। অন্যদিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় কেবল নামমাত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ঈশ্বরবাদী দর্শনগুলো হলো বাহ্যবস্তুবাদী আস্তিক ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন এবং ভাববাদী সাংখ্য দর্শন। যদিও প্রাচীন সাংখ্য-দর্শনকে বিদ্বজ্জনেরা নিরীশ্বর-সাংখ্য বলেও উল্লেখ করে থাকেন। আর চরমভাবে ঈশ্বরবাদী দর্শনগুলো হলো যোগ ও বেদান্ত দর্শন। অবশ্য অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিকেরা আবার প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের যুক্তির জালে আটকে ঈশ্বর প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিজেদেরকে কৌশলে ব্রহ্মবাদী হিসেবে দাবী করে থাকেন।
এছাড়া নিত্য আত্মার অস্তিত্ব কিংবা স্বর্গ নরক মোক্ষ ও পরকাল বিষয়ক ধারণা প্রসঙ্গেও দর্শনগুলোর মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। বিভেদ রয়েছে জগত-সৃষ্টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গেও। যে উৎস-গ্রন্থ বেদের প্রামাণ্য স্বীকার-অস্বীকারের মধ্য দিয়ে মূলত বৈদিক দর্শনগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বলে ধরে নেয়া হয় সেই বেদের নিত্যতা নিয়েও রয়েছে দর্শনগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক মত-পার্থক্য। এক্ষেত্রে আবার কট্টর বেদপন্থী হিসেবে দর্শনজগতে সুপরিচিত মীমাংসকরা হিন্দু বা বৈদিক ঐতিহ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালীও।
অতএব, এতোসব জটিলতার নিরসন না করেই কাউকে একবাক্যে নাস্তিক বলে খারিজ করে দেয়া কিংবা আস্তিক বলে বুকে টেনে নেয়ার বিভ্রান্তিকর প্রবণতা আমাদের একালের ধর্মবাদীদের বাহুল্য রেওয়াজে পরিণত হলেও বর্তমানের সাপেক্ষে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভাবনীয় পর্যায়ে পিছিয়ে থাকা সেকালের প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে কিন্তু এই নেতিবাচক প্রবণতার নিদর্শন খুব একটা দেখা যায় না। যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রম প্রথার উচ্চ-নীচ স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বর্ণভেদজনিত অমানবিক সমাজ ব্যবস্থা তৎকালীন শ্রমজীবী উৎপাদনমুখী বৃহত্তর জনজীবনকে দারুণভাবে বিষিয়ে তুলেছিলো। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রেক্ষিত, যা আমাদের বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়।
(৫)
না চাইলেও বিষয়গত কারণে আলোচনাটা যে দর্শনকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে, এতে করে অন্তত এই ধারণাটুকু পেতে সহায়ক হবে যে, আমাদের যাপিত জীবনের মনোজাগতিক ভূমিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দর্শন-দৃষ্টিটুকু রুদ্ধ হয়ে গেলে আমাদের সম্ভাবনাময় অস্তিত্বটা অন্যের যুক্তিহীনতার ক্রীড়নক হয়ে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মুখগামিতাকেই স্তব্ধ করে দিতে পারে। কীভাবে ?
যে পাঠক এ মুহূর্তে এ লেখাটা পড়ছেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন মাধ্যমের সহায়তায় পড়ছেন। হতে পারে কোন সংবাদপত্র বা গ্রন্থ কিংবা কোন কম্পিউটারের মনিটরে ? যদি বলা হয় যে, না, আপনি আসলে একটা মিথ্যার মধ্যে অবস্থান করছেন, এই যে সংবাদপত্র বা গ্রন্থ বা কম্পিউটার দেখছেন এগুলো আসলে কিছু নয়, সব বিভ্রম, সব মিথ্যা, এমনকি এই লেখাটা যে পড়লেন তাও মিথ্যা বিভ্রম, আপনি আসলে পড়েনই নি, তখন কেমন মনে হবে আপনার ? এই আবিষ্কারগুলো কি তবে মিথ্যা আবিষ্কার ছিলো ? কেমন মনে হবে যদি বলা হয়, আপনার পরিবারের দীর্ঘদিনের পরিজন-ব্যক্তিটি আসলে কেউ নন, কখনো ছিলেনও না, এখনও নেই, তবুও আপনি যে তাঁকে সামনে দেখছেন তা মিথ্যা বিভ্রম বা ব্যক্তি-প্রতীতি মাত্র ? তার মানে মিথ্যে বসতির মিথ্যে সংসারে মিথ্যে উত্তরাধিকার বানাচ্ছেন ? আপনি হয়তো দুপুরে লাঞ্চ করছেন। কিন্তু বলা হলো, এসব মিথ্যা, কারণ আপনার সামনের ওই ভাত-তরকারি নামক খাদ্যবস্তুগুলি আসলে কিছু নয়, এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই, সবই বিভ্রম, স্বপ্নে যেমন আমরা মিথ্যা বস্তু দেখি সেরকম, তাহলে কি আশ্চর্য হবেন ? হয়তো বা নিজের শরীরে চিমটি কেটে উফ করে ওঠে বললেন, কই, আমি তো স্বপ্ন নয় বাস্তবেই দেখছি সব ! তাহলে এর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে ? ব্যাখ্যাটা আপাত-দৃষ্টিতে কিঞ্চিত নিরস মনে হলেও কিছুটা অন্তর্দৃষ্টির দাবি রাখে।
ভাববাদীরা বলেন, বুদ্ধি বা জ্ঞান হলো প্রতীতি বা চেতনামাত্র। চেতনা না থাকলে যেমন কোন কিছুরই অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমরা অবগত হই না, তেমনি বাহ্যবস্তু বলে কিছু নেই, আমরা যা দেখি বা অনুভব করি তা আসলে বাহ্যবস্তুর প্রতীতি বা চেতনা কেবল। যে মতবাদে জগতের সমস্ত জ্ঞান বা প্রতীতিকে মিথ্যে বলে ঘোষণা করা হয়, আপাত-দৃষ্টিতে মতবাদটিকে অতি-অদ্ভুত মনে হতে পারে। কেননা, রজ্জুতে সর্পজ্ঞান অবশ্যই ভ্রম, কিন্তু রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান কী করে ভ্রম হতে পারে ? কিন্তু প্রকৃত ভাববাদী দার্শনিকের পক্ষে এ জাতীয় মতবাদের প্রস্তাব অস্বাভাবিক নয়। কারণ, ভাববাদী মতে বহির্জগত বলে কিছু নেই, বাহ্যবস্তু বলে কিছু নেই। অথচ আমাদের সাধারণ প্রতীতি বলতে যে বাহ্যবস্তুর প্রতীতি বুঝি, ভাববাদীদের মতে তা হলো যা নেই তারই প্রতীতি। অবস্তুতে বস্তুর প্রতীতি। অতএব এ সব মিথ্যা। তাদের মতে রজ্জুতে সর্পজ্ঞান মিথ্যা তো বটেই, কিন্তু জগতে রজ্জু বলে সত্যিই যদি কিছু থাকতো তাহলে রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞানও সত্য হতে পারতো। তথাকথিত রজ্জুও শেষপর্যন্ত স্বপ্নপ্রতীত বিষয়ের মতোই মিথ্যা, অথচ আমাদের রজ্জুজ্ঞান রজ্জুর বাহ্যত্বরূপের জ্ঞান। কিন্তু ভাববাদীদের সিদ্ধান্ত হলো, সমস্ত বুদ্ধিই নিজের অবাহ্য আকারকে বাহ্যত্বরূপে বিষয় করায় মিথ্যাবুদ্ধি। তাঁদের মতে, জ্ঞানের অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্ব স্বতঃসিদ্ধ। আর অযথার্থত্ব স্বতঃসিদ্ধ হলে স্বীকার করতে হবে যে জ্ঞানমাত্রই ভ্রম বা অপ্রমা।
এর দার্শনিক ব্যাখ্যা হলো, যে কারণ বা কারণ-সামগ্রির ফলে জ্ঞানের উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি বা প্রকাশ সেই একই কারণেই অপ্রমারও উৎপত্তি ও জ্ঞপ্তি হলে কোনো জ্ঞানের পক্ষেই যথার্থ হবার সুযোগ থাকে না, জ্ঞানমাত্রেই স্বতঃসিদ্ধভাবে মিথ্যা হতে বাধ্য। ফলে তথাকথিত যথার্থজ্ঞানও আসলে অযথার্থই।
উপরিউক্ত ভাববাদী ব্যাখ্যা অনুসারে লোকব্যবহারমূলক সমস্ত প্রতীতিই মিথ্যা, বিষয়-বস্তু সবই মিথ্যা, কেননা তা অবস্তুতে বস্তুর প্রতীতি, চেতনাপদার্থেরই বাহ্যবস্তুরূপে প্রতীতি। আপনি যে ভাত-তরকারি নিয়ে খেতে বসেছেন এবং খাচ্ছেন তা আসলে ভাত-তরকারি নামক কোন বস্তু নয়, আপনার বস্তুগত জ্ঞান আসলে মিথ্যা জ্ঞান, তা কেবলই চেতনাগত বিভ্রম, বাস্তবে কিছুই নেই। কেননা তা সবই মিথ্যা প্রতীতি। একটা মিথ্যা মায়াময় জগতে মিথ্যা আমাদের মিথ্যা বসবাস। এই অদ্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি যে তীব্র ভাববাদে আকীর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে প্রশ্ন আসে, এই বাহ্যজগতে অবস্থান করে দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মাদির প্রত্যক্ষ উৎযাপন করেও ভাববাদীরা এই যে প্রমাণ-প্রমেয়স্বরূপ বাহ্যজগতটাকে ‘অধ্যাস’ বা মিথ্যা-মায়া বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তাহলে তাদের কাছে প্রাত্যহিক লোকব্যবহারের প্রত্যক্ষতা কি অর্থহীন মিথ্যা ? ভাববাদী দর্শন বস্তুত তা-ই বলে। উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিতে জগতের যাবতীয় বস্তু বা বিষয় তা সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক সবই প্রমাণ-প্রমেয়র অন্তর্গত। ভাববাদী দার্শনিকেরা এই প্রমাণ-প্রমেয়স্বরূপ জগতটাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে উৎসাহী।
দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিগত বিচারে এই ভাববাদী সম্প্রদায়ের বিপরীত-ধর্মী অবস্থানে রয়েছেন বাহ্যবস্তুবাদী সম্প্রদায়। এরা বাহ্যজগতকে সত্য বলে স্বীকার করেন। তবে তার যথার্থতা প্রমাণ হয় অন্য আরেকটি বাহ্যজ্ঞান দ্বারা। তাদের মতে, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়া অন্য কিছুর ফলে যথার্থ জ্ঞান বা প্রমার জ্ঞপ্তি বা প্রকাশ ঘটে। কেননা, জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রির সাথে প্রবৃত্তি-সামর্থ্য যুক্ত থেকে প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের প্রকাশ হয়। প্রবৃত্তি-সামর্থ্য মানে প্রয়োগক্ষেত্রে সাফল্যদানের ক্ষমতা। অর্থাৎ, একটি জ্ঞান প্রমা বা যথার্থ কিনা তা জানা যায় কী করে ? জ্ঞানটির প্রবৃত্তি-সামর্থ্য আছে কিনা তা থেকে। জ্ঞানটি সফল-প্রবৃত্তির জনক হলেই তার প্রামাণ্য নিশ্চয় সম্ভব হয়। যেমন, জলে যে-জল দর্শন সেই জ্ঞানকে অবলম্বন করে বাস্তবিকই তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব হয় অর্থাৎ, এই জ্ঞান তৃষ্ণা-নিবারণ নামের সফল-প্রবৃত্তির জনক হয় এবং সেই কারণেই তা যথার্থ বলে জ্ঞাত হয়। তাই প্রামাণ্যের জ্ঞপ্তি বা প্রকাশ জ্ঞান-জ্ঞপ্তির কারণ-সামগ্রি ছাড়াও অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল। আপনার সামনে ভাত-তরকারি জাতীয় বস্তুগুলো যে প্রকৃতই খাদ্যবস্তু এই জ্ঞানটি যথার্থ বা প্রামাণ্য নিশ্চিত হয় স্বাদগ্রহণ বা ক্ষুধানিবারণস্বরূপ প্রবৃত্তি-সমর্থ হলে।
একইভাবে বাহ্যবস্তুবাদী মতে, উৎপত্তি বা জ্ঞপ্তি কোনো দিক থেকেই জ্ঞানকে স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা বা অযথার্থও বলা যায় না। কেননা, তাঁদের মতে, যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয় তার থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি হতে পারে না, তার বদলে ‘দোষ’ নামের একটি বাড়তি কারণ থেকেই অপ্রমার উৎপত্তি। এবং যে-কারণসামগ্রি থেকে জ্ঞান-জ্ঞপ্তি অর্থাৎ জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে তা থেকেই অপ্রমা-জ্ঞপ্তি বা অপ্রমার প্রকাশ ঘটে না, তার পরিবর্তে ‘প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য’ বলে স্বতন্ত্র কারণ থেকে অপ্রমার জ্ঞপ্তি বা প্রকাশ হয়। অর্থাৎ, অপ্রামাণ্যের উৎসে এই ‘দোষ’ বলে বাড়তি কারণ বর্তমান। অতএব, জ্ঞান-কারণ-বাহ্য কারণে অপ্রামাণ্যের উৎপত্তি। যেমন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের কারণ-সামগ্রি বলতে ইন্দ্রিয়াদি। কোন কিছুর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে হলে আমাদের চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ইত্যাদি ইন্দ্রিয়কে কারণ-সামগ্রি হিসেবে থাকতে হয়। কিন্তু এই ইন্দ্রিয়ে যদি কোন দোষ থাকে তাহলে জ্ঞানটি অপ্রমা হয়। উদাহরণস্বরূপ দার্শনিকেরা বলেন, পিত্তদোষ থাকলে শ্বেত শঙ্খ পীত বলে প্রতীত হয়, চক্ষুদোষ থাকলে একই চন্দ্র দ্বিচন্দ্র বলে প্রতীত হয়। বা প্রয়োজনীয় আলোর উপস্থিতি না থাকলে রজ্জুকে সর্প বলে ভ্রম হয়। অতএব, অপ্রামাণ্য এই দোষ-জনিত। জ্ঞান-কারণ-সামগ্রিজনিত নয়।
তাহলে ভাববাদী ও বাহ্যবস্তুবাদী দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক পার্থক্যটি নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছি আমরা। বাহ্যবস্তুবাদীরা বাহ্যজগতকে অস্বীকার তো করেনই না, বরং বাহ্যজগতবিষয়ক জ্ঞানকে প্রবৃত্তি-সামর্থ্যরে ভিত্তিতে প্রামাণ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাদের মতে জ্ঞাত জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাও নয় অপ্রমাও নয়। প্রমা বা যথার্থতা নির্ণীত হয় প্রবৃত্তি-সামর্থ্যরে ভিত্তিতে, আর অপ্রমা বা অযথার্থতা নির্ণীত হয় প্রবৃত্তি-অসমার্থ্যের ভিত্তিতে। কিন্তু ভাববাদীরা এই বাহ্যজগত বিষয়ক জ্ঞানমাত্রকে একবাক্যে মিথ্যা অলীক বলে প্রতিপন্ন করেন। তবে ভাববাদীরা বাহ্যজগতটাকে ‘অধ্যাস’ বা মিথ্যা-মায়া বলে উড়িয়ে দিলেও অর্থাৎ সমস্ত জ্ঞানকেই স্বতঃসিদ্ধভাবে অপ্রমা বিবেচনা করলেও তথাকথিত অর্থে এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কোনো জ্ঞানকে যথার্থ বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ নিজের জলজ্যান্ত অস্তিত্ব ও নিজের প্রবৃত্তিকে কতো আর মিথ্যা বলে অস্বীকার করে থাকা যায় ! তাই তথাকথিত সত্য হিসেবে শেষপর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাদের ব্যাখ্যাটা আকর্ষণীয় বটে।
তাদের মতে, পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণ-প্রমেয় মিথ্যা স্বীকৃত হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা নয়। যেমন, ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান সত্য, রজ্জুতে সর্পজ্ঞান মিথ্যা। অর্থাৎ, রজ্জুতে রজ্জুজ্ঞান শেষ পর্যন্ত মিথ্যা হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে সত্য। ভাত-তরকারি খাদ্যবস্তুর জ্ঞান প্রকৃত অর্থে মিথ্যা হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে সত্য। কারণ তা আপনি খাচ্ছেন, স্বাদ উপলব্ধি করছেন। অর্থাৎ, তাঁদের মতে দার্শনিক বিচারে সমস্ত জ্ঞানই অযথার্থ, তবুও ব্যবহারিক জীবনের দিক থেকে কোনো কোনো জ্ঞানকে তথাকথিত অর্থে যথার্থ বলে গ্রহণ করা হয়। কোন্গুলিকে ? যেগুলির প্রবৃত্তিসামর্থ্য বর্তমান। তার মানে, ভাববাদী মতবাদটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হলো, দার্শনিক বিচারে সমস্ত জ্ঞানই জ্ঞান হিসেবে ভ্রান্ত হলেও যে-জ্ঞান কর্মজীবনে কার্যকরি হয় তাকে ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তথাকথিত অর্থে যথার্থজ্ঞান বলা হবে। নইলে লোকব্যবহার জীবনযাত্রা সবই যে অর্থহীন হয়ে যায় ! না মেনে উপায় কী !
অন্যদিকে বাহ্যবস্তুবাদীরা বলছেন যে, কোন জ্ঞানই স্বতঃসিদ্ধভাবে সত্য বা মিথ্যা বলা যাবে না, তা নির্ভর করবে ওই জ্ঞানের জ্ঞানবাহ্য অন্য একটি জ্ঞান-কারণের উপর, সেটি হলো প্রবৃত্তি-সামর্থ্য বা প্রবৃত্তি-অসামর্থ্য। যেমন, মরীচিকা জল নয় কারণ তার জল-রূপ জ্ঞানের প্রবৃত্তি-সামর্থ্য নেই। এটা ভ্রম। তবে এই ভ্রমজ্ঞানের ক্ষেত্রেও বিষয়টা কিন্তু অলীক বা অসৎ নয়, সত্যই। অর্থাৎ জ্ঞান নির্বিষয়ক হয় না। কেননা মরীচিকায় জল-জ্ঞান অপ্রমা বা মিথ্যা হলেও বিষয় হিসেবে জল কিন্তু অলীক বিষয় নয়। নইলে আমরা জলের বিষয়টা ভাবলাম কী করে বা কল্পনা করলাম কী করে !
এখানে আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো, ভাববাদীরা জগতকে যে মায়া-মরীচিকা বা স্বপ্ন-প্রতীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখান, বাহ্যবস্তুবাদী দার্শনিকদের মতে এই দৃষ্টান্ত ব্যবহারের যুক্তিও ভাববাদীদের নিজেদের বিপক্ষেই যায় বলে তারা মনে করেন। কেননা প্রমা বা প্রকৃষ্ট জ্ঞান বলতে সেই জ্ঞানকেই বোঝায় যা অন্য জ্ঞান দ্বারা বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। সেক্ষেত্রে স্বপ্ন-প্রতীতি যে মিথ্যা জ্ঞান সেটা উপলব্ধি হয় জাগ্রত হয়ে যখন স্বপ্ন-প্রতীতির কথা স্মরণ হয়। স্বপ্ন-দর্শনকারী যতক্ষণ মিথ্যা স্বপ্নে অবস্থান করেন ততক্ষণ তার কাছে সেটাই সত্য বলে প্রতীত হবে। সেটা যে মিথ্যা-স্বপ্ন তা উপলব্ধির জন্যেই পরবর্তী বাধক-জ্ঞান হিসেবে জাগ্রত উপলব্ধির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভাববাদীরা তো বলেন যে জগতটাই মিথ্যা, আমি মিথ্যা আপনি মিথ্যা, যা দেখছি তা মিথ্যা, যা উপলব্ধি করছি তাও মিথ্যা, সবই মিথ্যা। তাহলে তিনি কোন্ জাগ্রত বা সত্য প্রতীতিতে অবস্থান করছেন ?
রসিক পাঠক হয়তো এবার কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হয়ে সেই প্রশ্নটিই করতে পারেন, আস্তিক্য-নাস্তিক্যর সাথে জ্ঞানের প্রামাণ্য-অপ্রামাণ্য জাতীয় দর্শন-তত্ত্বের সম্পর্ক কোথায় ? নিঃসন্দেহে যথার্থ প্রশ্ন। কিন্তু জ্ঞানের প্রামাণ্য-অপ্রামাণ্য বিষয়ক এই দার্শনিক তাত্ত্বিক বিতর্কটা আসলে আমাদেরকে কোন্ দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তা কি উপলব্ধি করতে পারছি ? প্রকৃতপক্ষে লৌকিক ও অলৌকিক বিষয়ক যে ধারণা-প্রপঞ্চটি আমাদের চিন্তাজগতে এক অনির্বচনীয় সত্তা নিয়ে অবস্থান করছে তারই একটি নিষ্পত্তি-প্রক্রিয়া মাত্র। একইসাথে এটিকে ইহকাল ও পরকাল বিষয়ক বিতর্ক বললেও বোধকরি অত্যুক্তি হবে না। তাই এ বিতর্কটা যে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন নয়, আস্তিক ও নাস্তিক শব্দ দুটোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালেই তা অনেকাংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে আশা করি। কিন্তু তার আগে অনিবার্যভাবেই আমাদেরকে আরেকটি দার্শনিক সমস্যা অবলোকন করে যেতে হয়, যা একাধারে আকর্ষণীয় ও বিতর্কিতও। নইলে বক্ষ্যমান আলোচনাটি কার্যত অসম্পূর্ণ হিসেবে অস্পষ্ট হয়ে যায়। সেটি হলো কোন সর্বজ্ঞ-সর্বশক্তিমান স্রষ্টা নামক অদৃশ্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকা-না-থাকা বিষয়ক দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ধারণাগত দ্বন্দ্ব ও অবস্থানের মতদ্বৈধতা।
তবে এ পর্যায়ে এসে বিচক্ষণ পাঠককে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, দর্শন-তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবে বক্ষ্যমান লেখাটিকে কেউ যেন ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছকে ফেলে নিজের মানস-চেতনাকে অহেতুক উৎপীড়িত না করেন এবং উদারনৈতিক যুক্তিশীল অবস্থান থেকেই বিভিন্ন দার্শনিক-মতের নিজ নিজ যুক্তি-তর্কের উপস্থাপন হিসেবে উপভোগ করেন।
---
(চলবে---)
---
[পর্ব-০১] [*] [পর্ব-০৩] [পর্ব-০৪]
---
মন্তব্য
সাধারণপ্রাপ্য ধারালোঅস্ত্রহস্ত ধার্মিক, যতটা দেখেছি, পড়তে জানে না, বা পারে না, বা পারলেও সেটা পাঁচ শব্দের বেশি দিয়ে তৈরি বাক্যে এসে বিনাসম্মানে ঘাড় বেঁকিয়ে পালায়। তবুও, পাঁচ শব্দের বেশি দিয়ে বাক্য লিখতে হবে। আর কারও জন্য না-ই হোক; দায়টা নিজের কাঁধেই সবচেয়ে বেশি বর্তায় তো! বাহ্যতার যত উপরচাপানো মিথ্যা আছে, তার অধিকাংশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েও তাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর মিথ্যে আশ্বাসটুকু দিয়ে রাখি।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
ধন্যবাদ। তবে আমরা যে যতো আপেক্ষিক অবস্থানেই দাঁড়াই না কেন, তাই বলে সত্য কিন্তু সত্যই থাকে, মিথ্যা হয়ে যায় না। আর সত্য-অসত্য না জেনেও একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়, তাতে সত্য-অসত্যের কিছু যায়-আসে না। আমাদের জীবনদৃষ্টিটাই সমাধানরহিত হয়ে থাকে। ফলে উটকো কিছু জটিলতাকে কাঁধে নিয়েই চলতে হয়। এটুকুই যা।
তবে সত্য-অসত্যের ব্যবধান বা অবস্থানটা নির্ণয় করতে পারলে জীবন-চলাটা অনেক বেশি সাচ্ছন্দ্যের হতে পারে। এটা আমরা অনেকেই বুঝেও না-বোঝার ভান করি। বিজ্ঞান তো আর অসত্যের উপর দাঁড়াতে পারে না, তার নিজস্ব প্রয়োজনেই সে সত্য-সন্ধানী হয়। আমরা আমাদের যাপিত জীবনে প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞানের প্রতিটা অবদানের ফসল ভোগ-উপভোগ করেও শেষপর্যন্ত কাল্পনিক অধিবিদ্যাকেই বুকে টেনে নেই, বিজ্ঞানকে নয়। তাহলে বলেন তো দেখি, উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না তাকে কী বলে ? আর অকৃতজ্ঞ বা কৃতঘ্ন ব্যক্তিকে ধর্মীয় নৈতিকতায় কী বলে ? আর ধর্ম নিজেই যদি এই নীতিগত জটিলতায় আক্রান্ত হয় তাকে আমরা কী বলবো ! হা হা হা !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
বাবা রে, আপনার নতুন নামকরণ "দর্শনের পন্ডিতমশাই"
--------------------------------------------------------------------------------
এবার তো দেখি ভিখ চাই না মা কুত্তা সামলা অবস্থা হয়েছে ! হা হা হা !
আসলে কী, যে সমস্যাটা প্রকৃতই দার্শনিক প্রস্থানের, তাকে খুঁজতে হলে তো দর্শনেই ঢু মারতে হয় ! আমার কী দোষ ভাবী !
আর এটাও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, সচলের কাস্টমাইজ ক্যাটেগরিতে কিন্তু দর্শন বলে কিছু নেই ! অতএব চালচুলোহীন এই পণ্ডিতমশাইয়ের কোনো বেইল-ই নেই ! আবারো হা হা হা !!
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
সনাতন বা হিন্দু ধর্ম, এখন সনাতন শব্দটি বাদ দিয়ে একেবারে হিন্দু ধর্মই হয়ে গিয়েছে। যদিও পুরাকালে হিন্দু বলতে একটি জাতিগোষ্ঠীকেই বোঝানো হতো। কোন ধর্মকে নয়। আরও একটা বিষয়, ভারতীয় দর্শন, সেটাও অনেকের কাছে হিন্দু দর্শন। এই যেমন, 'হিন্দু দর্শনে ছয়টি আস্তিক দর্শন বা ষড়দর্শন > সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈষেশিক, মীমাংসা ও বেদান্ত।
আর তিনটি নাস্তিক দর্শন > বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক।' অনেক ক্ষেত্রে এ ভাবেও লেখা হচ্ছে।
যাহোক, পড়ছি এবং আগ্রহভরে অপেক্ষা করছি।
এ জন্যেই দর্শন জগতে হিন্দু ধর্ম নামে কিছু নেই, যা আছে তাকে বৈদিক-সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করা হয়।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
এই সংখ্যায় বিশ্লেষণ আরো গভীর হয়েছে, কিন্তু ভালভাবেই সেটা সামলান হয়েছে। যেমনটি চেয়েছেন - উপভোগ করেছি। অপেক্ষায় থাকলাম পরের কিস্তির জন্য।
- একলহমা
উপভোগ করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে শেষ প্যারার এই উপভোগের আহ্বানটা করা হয়েছে মূলত তৃতীয় পর্বটাকে উদ্দেশ্য করে। পরের পর্বে গেলেই বুঝতে পারবেন যে কেন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে-
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
তবে এ পর্যায়ে এসে বিচক্ষণ পাঠককে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, দর্শন-তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবে বক্ষ্যমান লেখাটিকে কেউ যেন ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছকে ফেলে নিজের মানস-চেতনাকে অহেতুক উৎপীড়িত না করেন এবং উদারনৈতিক যুক্তিশীল অবস্থান থেকেই বিভিন্ন দার্শনিক-মতের নিজ নিজ যুক্তি-তর্কের উপস্থাপন হিসেবে উপভোগ করেন।--- ছাইড়া দিলাম মশাই! পরের পর্ব ছাড়ুন
facebook
এতোই যখন চাপাচাপি করতেছেন, তো দিলাম ! এইবার নিজের বুঝ নিজে বুঝেন গিয়া ! আমারে কিছু কইতে পারবেন না কইলাম হুমম !
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন