(আগের পর্বের পর---)
---
(৬)
প্রচলিত অর্থে আমাদের কাছে কথিত জগত-স্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসীদেরকে আস্তিক এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসীদেরকে নাস্তিক হিসেবে মনে হলেও আস্তিক-নাস্তিক বিষয়ক ধারণার নিজস্ব উদ্গাতা প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেই তার কোন সমর্থন আমাদের চোখে পড়ে না। বরং সেখানে ঈশ্বর বিশ্বাসীদেরকে ঈশ্বরবাদী এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদেরকে বড়জোর নিরীশ্বরবাদী হিসেবেই চিহ্নিত হতে দেখা যায়। কেননা সেখানে দেখা যায় যে, আস্তিক-নাস্তিক বিভেদের প্রধান বিবেচনাই হচ্ছে স্মৃতিশাস্ত্র বেদের প্রামাণ্যে নিরঙ্কুশ বিশ্বাস ও অবিশ্বাস। এবং তা থেকেই দর্শনগুলোর প্রাথমিক পরিচয়ে আস্তিক-দর্শন ও নাস্তিক-দর্শন নামকরণের উদ্ভব, যা এখনো বহমান। ফলে নিরীশ্বরবাদী দর্শনগুলোর পঙক্তিতে একদিকে চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের মতো নাস্তিক দর্শনগুলোর স্বাভাবিক অবস্থানের পাশাপাশি এই নিরীশ্বরবাদিতায় মীমাংসা-দর্শনের মতো কট্টর আস্তিক দর্শনের উপস্থিতিই প্রমাণ করে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস আদৌ আস্তিক্য-নাস্তিক্য বিচারের মাপকাঠি নয়। ঈশ্বর-মত খন্ডনের যুক্তি বিচারে এই নিরীশ্বরবাদী দর্শনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতৈক্যে অদ্ভূত সামঞ্জস্য থাকলেও অন্যান্য অনেক বিষয়ে এদের মধ্যেই পরস্পর মতবিরোধ এতো তীব্র ও মৌলিক যে, কোনোভাবেই এদেরকে এক পঙক্তিতে ফেলার উপায় নেই। ভাববাদ-বাহ্যবস্তুবাদ প্রসঙ্গে ইতঃপূর্বের আলোচনাতেই আমরা এদের এবং অন্য ঈশ্বরবাদী দর্শনগুলোর অবস্থানের ভিন্ন বিন্যাস অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। একইভাবে অন্যান্য প্রসঙ্গেও আবার তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানের পুনর্বিন্যাস রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে আমাদের প্রসঙ্গ ঈশ্বর বিষয়ক।
নিরীশ্বরবাদিতায় নাস্তিক দর্শনগুলোর অবস্থান আমাদের কাছে সহজেই অনুমেয়, এরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন। কিন্তু একান্ত বেদনির্ভর প্রচন্ড আস্তিক দর্শন হয়েও মীমাংসক দার্শনিকেরা যে তাঁদের নিজস্ব যৌক্তিক অবস্থান থেকে কতোটা চরম নিরীশ্বরবাদী হতে পারেন তারই সামান্য কিছু নমুনা আমাদের বিবেচনাবোধকে বিশ্লেষণের সুবিধার্থে সংক্ষেপে উপস্থাপন করতে পারি। এ প্রেক্ষিতে আমাদের এই আলোচনার উৎস হলো মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসাসূত্রের প্রখ্যাত ভাষ্যকার শবরস্বামীর ভাষ্য এবং তার ব্যাখ্যাকার দার্শনিক প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্টের উত্থাপিত যুক্তি। তবে এ বিষয়টাতে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান সাপেক্ষে তাঁদের স্ব-স্ব যুক্তি-বিস্তার এতো জটিল-সম্বন্ধযুক্ত ও বিশাল-বিস্তৃত যে, তা থেকে তুলে আনা গুটিকয় নমুনা দিয়ে ক্ষণিক স্বাদটুকু হয়তো আঁচ করা যেতে পারে, বিষয়ের গুরুত্ব ও গভীরতা পরিমাপ করা আদৌ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পন্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-কৃত ‘ভারতীয় দর্শন’ এবং মহামহোপাধ্যায় হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত ‘বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন’ গ্রন্থ দুটিকে এ বিষয়ে আপাত সহায়কসূত্র হিসেবে নেয়া হয়েছে।
ঈশ্বর প্রসঙ্গে এ-জাতীয় কোনো স্রষ্টার কল্পনা যে অবাস্তব সে-বিষয়ে মীমাংসক শবরের যুক্তি হলো, তৎ-সম্বন্ধে প্রমাণাভাব- অর্থাৎ, কোনো প্রমাণের সাহায্যেই স্রষ্টার সত্তা সিদ্ধ হতে পারে না। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা তাঁর অস্তিত্ব সিদ্ধ নয়, কেননা এ-জাতীয় স্রষ্টারা প্রত্যক্ষ হয় না। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ নয় বলেই অন্য কোনো প্রমাণও তাঁর সত্তার প্রতিপাদক হতে পারে না, কারণ অপরাপর অনুমান উপমান ইত্যাদি প্রমাণ প্রত্যক্ষমূলক। কেননা, যুক্তিন্যায় মতে- ‘সাধ্যের সাথে নিয়ত সম্বন্ধবিশিষ্ট কোনোও ধর্ম যদি প্রত্যক্ষ গ্রাহ্য না হয়, তাহলে সেই সাধ্য প্রমাণান্তরের বিষয় হতে পারে না।’
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপাদনার্থে ঈশ্বরবাদী নৈয়ায়িক দার্শনিকদের উপস্থাপিত যুক্তির মধ্যে প্রধান যুক্তি হলো, জগৎ-স্রষ্টা হিসেবে ঈশ্বরের সত্তা অবশ্য-স্বীকার্য; কারণ মাটি, জল প্রভৃতি সমস্ত সংহত বা জটিল বস্তুই কার্যাত্মক, কেননা এগুলি অবয়বদ্বারা গঠিত; এবং কার্য বলেই এগুলির কারণ থাকতে বাধ্য এবং সেই কারণ কোনো বুদ্ধিমান কর্তা না হয়ে পারেন না। সহজ কথায়, অবয়ব দ্বারা গঠিত সমস্ত বস্তুই কার্য এবং কার্য বলেই কার্য-কারণ তত্ত্ব অনুযায়ী তার কারণও থাকবে। যেহেতু মাটি, জল প্রভৃতি পরমাণু নামের অবয়ব দ্বারা গঠিত সেহেতু এগুলিও কার্য। তাই পরমাণুপুঞ্জ থেকে সুসমঞ্জস্য ও নির্দিষ্ট আকারে ক্ষিতি বা মাটি, জল প্রভৃতি সংহত বা জটিল বস্তুগুলি কোনো বুদ্ধিমান কর্তার নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত উৎপন্ন হতে পারে না; অতএব এই বুদ্ধিমান কর্তা অর্থে জগতের নিমিত্তকারণ হিসেবে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অনুমেয়- তাঁরই নিয়ন্ত্রণে সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটে।
এর উত্তরে নিরীশ্বরবাদী মীমাংসক প্রাভাকররা বলেন, জাগতিক বস্তুগুলি অবশ্যই অবয়ব দ্বারা গঠিত, অতএব এগুলির উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু তাই বলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোনো সৃষ্টি বা প্রলয়ের কথা কল্পনামাত্র; অতএব জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের নিয়ন্ত্রণকর্তা ঈশ্বরের পরিকল্পনাও অবান্তর। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক বস্তুগুলির দৃষ্টান্তে সুস্পষ্টভাবেই অভিজ্ঞতা হয় যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই সেগুলির জন্ম হচ্ছে- যেমন মানুষ ও জীবজন্তুর দেহ শুধুমাত্র তাদের পিতামাতার দরুনই উৎপন্ন হয়। এবং এ-জাতীয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে অতীত ও ভবিষ্যতের বস্তুগুলিরও উৎপাদন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অতএব, জাগতিক বস্তুগুলির স্রষ্টা হিসেবে কোনো অতি-প্রাকৃত নিয়ন্ত্রাতার কথা অনুমিত হয় না।
নৈয়ায়িকরা আরো দাবি করেছেন, ব্যক্তির ধর্মাধর্ম পরিচালনা করার জন্য সাধারণভাবে কোনো পরিচালক- অর্থাৎ ঈশ্বর- স্বীকারযোগ্য।
তার উত্তরে প্রাভাকররা বলেন, প্রথমত যার ধর্মাধর্ম সেই এ-জাতীয় পরিচালক হতে পারে, অতএব ঈশ্বর বলে স্বতন্ত্র পরিচালকের প্রসঙ্গ অবান্তর। দ্বিতীয়ত, একের ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান অপর কারুর পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়; অতএব তথাকথিত ঈশ্বরের পক্ষে কোনো মানবের ধর্মাধর্ম জানাই সম্ভব নয়।
প্রাভাকররা আরো বলেন, তথাকথিত ঈশ্বরের পক্ষে মানবাদির ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞানই যদি সম্ভব না হয় তাহলে তাঁর পক্ষে এই ধর্মাধর্মের পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া, উক্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা থাকলেও ঈশ্বরের পক্ষে ধর্মাধর্ম পরিচালনা করা সম্ভব হতো না। কেননা, পরিচালনার জন্য সম্বন্ধ প্রয়োজন; কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে মানবাদির ধর্মাধর্মের কোনো সম্বন্ধ অসম্ভব। ন্যায়মতেই সম্বন্ধ মাত্র দুরকম হতে পারে- সংযোগ ও সমবায়। ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মাধর্মর সংযোগ সম্ভব নয়; কারণ ধর্মাধর্ম হলো গুণ এবং ন্যায়-মতেই শুধুমাত্র দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের সংযোগ সম্ভব। ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মাধর্মের সমবায়-সম্বন্ধও সম্ভব নয়; কারণ এই ধর্মাধর্ম মানবাদিরই গুণ, অতএব মানবাদির সঙ্গেই তার সমবায় হতে পারে- মানবাদির গুণের সঙ্গে ঈশ্বরের সমবায় অসম্ভব। কেননা ন্যায়মতে, কেবল সংশ্লিষ্ট দ্রব্যের সঙ্গেই তার গুণের সমবায়-সম্বন্ধ সম্ভব।
এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকরা সূত্রধর বা ছুতোরের উপমা দিতে পারেন। অবশ্যই দেহবিশিষ্ট বলে এই ছুতোরের সঙ্গে তার যন্ত্রপাতির এবং যন্ত্রপাতির সঙ্গে কাষ্ঠাদি বস্তুর সংযোগ সম্ভব; কিন্তু তথাকথিত ঈশ্বর দেহবিহীন বলেই পরিকল্পিত, অতএব তাঁর দৃষ্টান্তে এ জাতীয় প্রশ্ন ওঠে না।
প্রাভাকরা আরো বলেন, নৈয়ায়িকরা এ কথাও বলতে পারেন না যে পরমাণুসমূহ ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে। কারণ এ-জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনার কোনো দৃষ্টান্তই অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একমাত্র দেহস্থ আত্মাই দেহকে পরিচালনা করতে পারে; কিন্তু পরমাণুসমূহ বা মানবীয় ধর্মাধর্মও ঈশ্বরের দেহ নয়, অতএব ঈশ্বরের পক্ষে এগুলির পরিচালনাও সম্ভব নয়। আর যদিই বা তর্কের খাতিরে এগুলিকে ঈশ্বরের দেহ বলেই পরিকল্পনা করা হয় তাহলেও এগুলির নিয়ন্ত্রণের জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টার কথা স্বীকার করতে হবে এবং সে ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা যদি নিত্য হয় তাহলে পরমাণুসমূহের সৃষ্টিকার্যকেও, অর্থাৎ জগতের সৃষ্টিকেও, নিত্য বা নিয়ত ঘটনা বলে স্বীকার করতে হবে।
ঈশ্বরবাদী ন্যায়-বৈশেষিকরা বলে থাকেন, মানবদেহ বুদ্ধিহীন বলেই তার নিয়ন্ত্রণের জন্য এক বুদ্ধিমান স্রষ্টা বা ঈশ্বর অনুমেয়।
উত্তরে নিরীশ্বরবাদী মীমাংসক প্রাভাকররা বলছেন, নিয়ন্ত্রণ-কার্য উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে না; কিন্তু এই তথাকথিত নিয়ন্ত্রণের পেছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী হতে পারে ? তাছাড়া, নৈয়ায়িকরা যে যুক্তিবলে বুদ্ধিমান নিয়ন্ত্রণকর্তা প্রমাণ করতে চান সেই যুক্তি অনুসারেই উক্ত নিয়ন্ত্রণকর্তা দেহ-বিশিষ্ট বলেই প্রমাণিত হবেন। কেননা, কাষ্ঠাদি বস্তুর উপর সূত্রধর-এর নিয়ন্ত্রণ-কার্যর দৃষ্টান্ত অনুসারেই তাঁরা জগৎ-স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ করতে চান; কিন্তু সূত্রধর দেহবিশিষ্ট, তারই উপমান অনুসারে কল্পিত ঈশ্বরও দেহবিশিষ্ট বলে প্রমাণিত হবেন। কিন্তু দেহবিশিষ্ট কারুর পক্ষেই পরমাণু বা ধর্মাধর্মের মতো সূক্ষ্ম বিষয়কে বুদ্ধিসম্মত এবং কার্যকরিভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এবং যদিই বা তা সম্ভব হয় তাহলে দেহবিশিষ্ট বলেই তাঁর পরিচালনার জন্য আরো কোনো স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ-কর্তার কথা স্বীকৃত হতে বাধ্য, আবার এই স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ-কর্তার পরিচালনার জন্য অপর কোনো এক নিয়ন্ত্রণ-কর্তার কথা স্বীকৃত হতে বাধ্য- এবং এইভাবে অনবস্থা-দোষ ঘটবে।
এইভাবে প্রাভাকররা স্রষ্টা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খন্ডন করেছেন। এবং তাঁরা সৃষ্টি বা প্রলয় মানেন নি বলেই বিশ্বজগৎ তাঁদের কাছে নিয়ত পরিবর্তনশীল ঘটনাস্রোত বলেই প্রতীত হয়েছে। তবে স্বকীয় দার্শনিক গুরুত্বের দিক থেকে বিখ্যাত নিরীশ্বরবাদী মীমাংসক কুমারিল ভট্টের যুক্তিগুলি সাধারণভাবে ভারতীয় দর্শনের পটভূমিতে প্রায় বৈপ্লবিক বলে প্রতীত হতে পারে। কুমারিল বস্তুত নিরীশ্বরবাদের সূচনা করেছেন সর্বজ্ঞতা-খন্ডনের দ্বারা।
সর্বজ্ঞ মানে যিনি বিশ্বজগতের ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সবকিছু জানেন। কী করে জানেন ? আমরা মানুষ, তাই মানুষ যেভাবে জানে, সেভাবে জানার বাইরে অন্য কোনো অতিমানবিক উপায় যদি থাকে তা আমরা কী করে জানবো, আর না জানলে কী করে বলবো আমাদের মানববুদ্ধির অগোচরে এক সবজান্তা অতিমানব আছেন যিনি কোনো অতিমানবিক উপায়ে বিশ্বের প্রতিটি ধূলিকণা প্রতিটি অণুপরমাণু ও প্রতিটি বীজাণু পর্যন্ত আপন নখদর্পণে প্রত্যক্ষ করেন। জানার উপায়কে বলে প্রমাণ, যেমন প্রত্যক্ষ ও অনুমান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপায় আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়, চোখ, কান, জিহ্বা প্রভৃতি। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলিকে বলে প্রত্যক্ষপ্রমাণ যা দ্বারা প্রত্যক্ষ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। প্রত্যক্ষ কেবল বর্তমানগ্রাহী, যেমন চক্ষু শুধু বর্তমান বস্তুকেই গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু অতিদূর স্থিত, অন্তরালিত, অতীত বা ভবিষ্যৎ বস্তুকে গ্রহণ করতে পারে না। এখন যদি কেউ সর্বজ্ঞ হন, তিনি কোন্ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছু প্রত্যক্ষ করবেন ?
মানুষের ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা প্রকৃতির নিয়মে সীমাবদ্ধ। তাই কোন ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই বিশ্বের সবকিছুই জানা সম্ভব নয়। ‘সব’ ইন্দ্রিয়ের ‘অবিষয়’ অর্থাৎ অগোচর- এটাই স্বভাবনিয়ম বা প্রাকৃতিক নিয়ম। কেউ সর্বজ্ঞ হলে তাকে হতে হবে এই প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম। আমরা কিন্তু ব্যতিক্রম নই। তাহলে আমরা কী করে বুঝবো যে এমন কোনো সত্তাপুরুষ আছেন যিনি স্বভাবনিয়মের ব্যতিক্রম ? বুঝতে হলে আমাদেরও ব্যতিক্রম হতে হবে। তাই কুমারিল বিদ্রূপ করে বলেছেন ( শ্লোকবার্তিক-২/১২২)- যিনি কোনো সর্বজ্ঞ পুরুষ আছে বলে কল্পনা করেন তিনি বোধহয় চোখ দিয়ে বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ চোখের দ্বারা দেখে, কানের দ্বারা শোনে, জিহ্বার দ্বারা রসগ্রহণ- এই প্রাকৃতিক নিয়মের উর্ধ্বে তিনি বিচরণ করেন। একথাই কুমারিল আরেকটি সাধারণ সূত্রাকারে উপস্থিত করেছেন- যে নিজে অসর্বজ্ঞ সে অন্য কাউকে সর্বজ্ঞ বলে সাব্যস্ত করতে পারে না। ( শ্লোকবার্তিক- ২/১৩৫)
ঈশ্বরবিশ্বাসীরা কিন্তু ঈশ্বরকে আক্ষরিক অর্থেই সর্বজ্ঞ মনে করেন, অর্থাৎ তাদের মতে ঈশ্বর বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণু প্রত্যক্ষ করেন। যোগদর্শনে যোগভাষ্যকার বেদব্যাস ঈশ্বরানুমান প্রণালী প্রমাণ করেন বিচিত্রভাবে-
কেউ স্বল্পজ্ঞানী, কেউ তার তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী, কেউ আরও অধিকতর জ্ঞানী; সুতরাং এমন একজন আছেন যিনি অধিকতম জ্ঞানী। ইনি হলেন নিরতিশয় জ্ঞানী, যার জ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান আর সম্ভব নয়; সুতরং তিনি সর্বজ্ঞ। সবজান্তার ওপর আর কোনো জ্ঞানী থাকা সম্ভব নয়। এহেন সর্বজ্ঞ পুরুষই হলেন ঈশ্বর।- (যোগভাষ্য-১/২৫)
মানুষের জ্ঞানের তারতম্য থেকে ‘অমানুষ’ সর্বজ্ঞ পুরুষে পৌঁছানোর অনুমান-প্রণালীটি কুমারিলের দৃষ্টি এড়ায়নি। ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা যে প্রাকৃতিক নিয়মে সীমাবদ্ধ, স্বাভাবিক অবস্থায় তার ব্যত্যয় ঘটে না, সর্বজ্ঞত্ব-খন্ডনে কুমারিল এই স্বভাবনিয়ম প্রয়োগ করেই বলেন- দূরসূক্ষ্মাদি বস্তুদর্শনে কোনো ব্যক্তির যে জ্ঞানাধিক্য পরিলক্ষিত হয় তা কিন্তু জ্ঞান ও বিষয়ের সুনির্দিষ্ট স্বাভাবিক সম্বন্ধকে লঙ্ঘন করে না, যেমন কোনো সমধিক জ্ঞানী ব্যক্তিও কর্ণের দ্বারা বস্তুর রূপ গ্রহণ করে না।
এরপর কুমারিলের যুক্তি হলো, যদি বলেন সর্বজ্ঞ পুরুষ প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা নন, তিনি সব নিয়ম লঙ্ঘন করে সবকিছু দেখতে পান তা হলেও একটা দুরুত্তর প্রশ্ন থেকে যায়। সর্বজ্ঞ পুরুষ নাকি অন্তহীন ভবিষ্যৎকেও বর্তমানের মতো স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেন। এ ধরনের উদ্ভট দাবি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দ্বারাও সমর্থিত হতে পারে না। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বে কোথাও জন্মগ্রহণই করেনি, যা এখনও কোথাও নেই সেই না-থাকা বস্তুগুলিকেও এখনই কেউ আক্ষরিক অর্থে প্রত্যক্ষ করছে, কেবল কল্পনা করছে না- এরকমের বক্তব্য প্রমত্তের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে ? তাই কুমারিল বলছেন- ‘ভবিষ্যৎ বস্তুর জ্ঞানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও পরিদৃষ্ট হয় না’। (শ্লোকবার্তিক-২/১১৫)
কুমারিল আরো বলেন, যদি কোন সর্বজ্ঞ-বিশ্বাসী বলেন- সমগ্র ভবিষ্যৎ সর্বজ্ঞ পুরুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞানে ধরা না পড়ুক, তিনি অনুমানের দ্বারা অনন্ত ভবিষ্যতের অনন্ত বস্তু জানতে পারেন, তবু কিন্তু সর্বজ্ঞতা সম্ভব নয়। অনুমান জ্ঞান হয় সামান্যাকারে। আমরা বিশ্বাস করি সকল মানুষ মরণশীল। এই সাধারণ সূত্র দেখে আমরাও অনুমান করতে পারি বর্তমানে জীবিত কোনো ব্যক্তিবিশেষও অমর নয়, একদিন তাকে মরতেই হবে। ‘সকল মানুষ মরণশীল’ এই সাধারণ সূত্রটি যখন আমরা জানি তখন অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষের অনন্ত কোটি চিতার আগুন সারিবদ্ধভাবে একে একে আমাদের কল্পনার আকাশে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে না। তিনকালের কোন্ লোকটি কীভাবে কোথায় কখন মরেছে বা মরবে তা কিন্তু আমাদের পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। আমরা প্রত্যেকেই একদিন মরবো, কারণ আমরা মানুষ এবং মানুষমাত্রেই মরণশীল- এ ধারণাটা হয় সামান্যাকারে বা সাধারণভাবে। প্রত্যেকটি মানুষকে আলাদা করে একে একে গুনে গুনে হয় না, কে কোথায় কখন কীভাবে মরবে তাও জানা যায় না। সর্বজ্ঞ হতে হলে কিন্তু এসব কিছুই বিশেষভাবে, বিভক্তরূপে আলাদা আলাদা করে জানতে হবে। না হলে আমাদেরই বা সর্বজ্ঞ হতে বাধা কোথায়। একথাই কুমারিল সংক্ষেপে বলেছেন- ভবিষ্যৎ বস্তুর জ্ঞানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিন্দুমাত্র সামর্থ্যও পরিদৃষ্ট হয় না। বিশ্বের সকল বস্তু সম্বন্ধে অনুমান করার কোনো ‘হেতু’ বা সূচক চিহ্ন নেই। (শ্লোকবার্তিক-২/১১৫)
কুমারিলের এ সকল আপত্তির পিছনে রয়েছে আসলে ন্যায়শাস্ত্রের অনুমানতত্ত্বের অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতা। আমাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জানা থেকে অজানার দিকে কতোটা উল্লম্ফন করা যুক্তিগত এই পরিমিতিবোধটুকু না থাকলে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব বলে প্রতিপন্ন করার জন্য বল্গাহীন কল্পনার আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। যে কোনো আজব কল্পনাকে সজীব করে তোলা যেতে পারে। মানুষের জ্ঞানের ক্রমিক উৎকর্ষ অনস্বীকার্য। কিন্তু এই উৎকর্ষ থেকে কোনো সর্বজ্ঞ পুরুষে পৌঁছানোর যৌক্তিক প্রয়োজন নেই। তাই সর্বজ্ঞতা খন্ডনের দ্বারা পরোক্ষভাবে বা প্রকারান্তরে ঈশ্বরকেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, কারণ সর্বজ্ঞ পুরুষ না হলে ঈশ্বর ঈশ্বর হতে পারে না।
এরপরই কুমারিল যখন সরাসরি ঈশ্বর খন্ডন করেছেন তখন আর তিনি আলাদা করে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞতা খন্ডন করেন নি। সেখানে তিনি নতুন নতুন যুক্তির অবতারণা করেছেন, যে যুক্তির গুরুত্ব অসাধারণ।
কুমারিল বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতির পরিকল্পনা নিয়ে নানা রকম বিদ্রুপ করেছেন। তিনি বলেন, যদি বলো কোনো এককালে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি হয়েছিলো তাহলে প্রশ্ন করবো, সৃষ্টির আগে বিশ্বের অবস্থা কী ছিলো ?
ঈশ্বরবাদী তখন হয়তো বলবেন, তৈত্তিরীয়-সংহিতায় বলা আছে ‘সৃষ্টির পূর্বে প্রজাপতি একাই ছিলেন’-(তৈত্তিরীয়-সংহিতা-২/১/১)। আবার ঋগ্বেদের প্রজাপতি-সূক্তেও বলা হয়েছে- ‘সর্ব প্রথমে কেবল (প্রজাপতি) হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাত মাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হলেন। তিনি এ পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করলেন।’ (ঋগ্বেদ-১০/১২১/১)
কুমারিলের প্রশ্ন, সৃষ্টির পূর্বে বিশ্বই যদি তখন না থাকে তাহলে বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতিই বা কোথায় ছিলেন ? তাঁর রূপই বা কী রকম ছিলো ? থাকার জন্য কোনো অধিকরণ বা আশ্রয় প্রয়োজন। তা ছাড়া সৃষ্টির জন্য উপাদানগুলি তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন ? তিনি ছাড়া আর কিছুই তো ছিলো না।
কুমারিল বলেন, যদি বলো ঈশ্বর তার ইচ্ছাবলেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, দেহবিশিষ্ট চেতনপদার্থেরই ইচ্ছা থাকতে পারে। ঈশ্বর তো অশরীরী। যদি বলো ঈশ্বরেরও দেহ আছে, তবে শরীরের উপাদানগুলি কোথা থেকে এলো ? তবে কি ঈশ্বরের দেহ তৈরি করার উপাদানগুলি আগে থেকেই ছিলো ? অর্থাৎ ঈশ্বরের পূর্বেই জগৎ ছিলো ? তাহলে বলতে হবে জগৎ ঈশ্বরের সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করেনি।
কুমারিল আবার প্রশ্ন করেন, সৃষ্টির পূর্বে তো কোনো মানুষেরই অবস্থান সম্ভব নয়; তাই তোমাদের মতে প্রজাপতি তখন যে উপস্থিত ছিলেন এ কথা কার পক্ষেই বা জানা সম্ভব ? এবং কেই বা পরবর্তীকালে সৃষ্ট মানুষদের কাছে প্রজাপতির কথা পৌঁছে দিতে পারেন ? যদি বলো, প্রজাপতির পক্ষে কোনো মানুষেরই প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানের বিষয় হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে প্রশ্ন করবো তাঁর যে একান্তই কোনো রকম অস্তিত্ব আছে সে কথাই বা জানা গেলো কীভাবে ? তোমাদের মতে কোনো এককালে বিশ্বের সৃষ্টি বা শুরু হয়েছিলো; কিন্তু তা কীভাবে সম্ভবপর হতে পারে ? প্রজাপতির ইচ্ছায় সৃষ্টি শুরু হলো ? কিন্তু সে-কথা তোমরা কী করে বলবে ? কেননা, তোমাদের মতেই স্রষ্টা দেহ-বিশিষ্ট নন; এবং দেহ ছাড়া ইচ্ছা সম্ভবই নয়। তাই দেহহীন স্রষ্টার পক্ষে সৃষ্টি করার ইচ্ছাও অসম্ভব। যদি বলো, স্রষ্টার দেহ আছে, তাহলে সেই দেহটিকেও তো তাঁরই সৃষ্টি বলতে পারো না। অতএব তাঁর দেহ সৃষ্টির জন্য আর একটি স্রষ্টার কথা, আবার তাঁরও দেহ সৃষ্টির জন্য আর একটি স্রষ্টার কথা- এইভাবে অবিশ্রাম ভেবে যেতে হবে। স্রষ্টার দেহকে নিত্য বা অনাদিও বলতে পারো না, কেননা সৃষ্টির পূর্বে ক্ষিতি অপ্ প্রভৃতি দেহের উপাদান পঞ্চভূতই যখন নেই তখন কী দিয়ে তাঁর দেহ নির্মিত হতে পারে ?
তাছাড়া, প্রাণীদের পক্ষে নানা রকম জ্বালা-যন্ত্রণায় পূর্ণ এই পৃথিবীটি সৃষ্টি করবার ইচ্ছেই বা তাঁর হলো কেন ? এ-কথাও বলতে পারো না যে প্রাণীদের কর্মফলের দরুনই পৃথিবীতে এই সব জ্বালা-যন্ত্রণা। কেননা, সৃষ্টির পূর্বে এ জাতীয় কর্মফল সম্ভবই নয়। অতএব প্রাণীদের কর্মফল অনুসারে স্রষ্টার পক্ষে পৃথিবী সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়।
কুমারিল বলেন, উপকরণাদি ব্যতিরেকেও সৃষ্টি সম্ভব নয় এবং সৃষ্টির পূর্বে এ-জাতীয় উপকরণ বলে কিছুর অস্তিত্ব অসম্ভব। উর্ণনাভ বা মাকড়সার জালও উপাদানহীন সৃষ্টি নয়, কেননা ভক্ষিত পতঙ্গ থেকে মাকড়সার লালা উৎপাদন হয় এবং জালের উপাদান হিসেবে এই লালা ব্যবহৃত। আর এ কথাও বলা যায় না যে, করুণা বা দায় থেকেই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন; কেননা, সৃষ্টির আগে কোনো প্রাণীই ছিলো না, অতএব করুণা বা অনুকম্পা দেখাবার মতো কোনো জীবই ছিলো না, কাকে অনুকম্পা দেখাবেন ? যখন করুণার কোনো পাত্রই নেই তখন করুণাও সম্ভব নয়। তাছাড়া করুণা বা দয়া-পরবশ হয়ে সৃষ্টি করলে তিনি শুধুমাত্র সুখী ব্যক্তিই সৃষ্টি করতেন। যদি বলো, কিছুটা দুঃখ না থাকলে জগতের সৃষ্টি বা স্থিতি সম্ভব নয়, তাহলে উত্তরে বলবো, তোমাদের মতে সবই তো স্রষ্টার শুধুমাত্র ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল, তাই তার পক্ষে আবার অসম্ভব কী হতে পারে ? আর সৃষ্টির জন্য তাঁকেও যদি নিয়মাদির উপর নির্ভরশীলই হতে হয় তাহলে তাঁর আবার স্বাধীনতা কোথায় ? তোমাদের মতে তাঁর মধ্যে সৃষ্টির ইচ্ছা জেগেছিলো; কিন্তু বলতে পারো কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থতার জন্য তাঁর এই ইচ্ছা জেগেছিলো- এমন কোন্ উদ্দেশ্যই বা সম্ভব হতে পারে যা কিনা সৃষ্টি-ব্যতিরেকে চরিতার্থ হওয়া অসম্ভব ? নির্বোধও উদ্দেশ্যবিহীন কাজ করে না। অতএব তিনি যদি বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তাঁর বুদ্ধিকে নিষ্ফল বলতে হবে। যদি বলো, এই সৃষ্টি তাঁর লীলা- প্রমোদ বা বিলাসমাত্র, তাহলে তাঁকে আর সদানন্দ বা চিরসন্তুষ্ট বলতে পারো না, অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে তিনি নিশ্চয়ই প্রমোদের অভাব অনুভব করেছিলেন, অতএব তখন তাঁর সন্তুষ্টির অভাব ছিলো। তাছাড়া সৃষ্টি-ব্যাপারে যে পরিমাণ দুর্ভোগ ও পরিশ্রম প্রয়োজন তার তুলনায় প্রমোদ আর কতটুকুই বা ? আর সৃষ্টি যদি প্রমোদের জন্যই হয় তাহলে তোমরা যে প্রলয়ের কথা বলো তারই বা ব্যাখ্যা কী ?
আর সর্বোপরি কথা হলো, কারুর পক্ষেই এ জাতীয় স্রষ্টাকে জানা সম্ভব নয়। যদিই মানা যায় যে তাঁর রূপ সংক্রান্ত অবগতি সম্ভব, তবুও তিনিই যে স্রষ্টা এ বিষয়ে জ্ঞান অসম্ভব। সৃষ্টির শৈশবে যে সব প্রাণীদের আবির্ভাব তাদের পক্ষে কতটুকুই বা বোধ সম্ভবপর ? অতএব, কীভাবে তাদের জন্ম হলো এবং সৃষ্টির পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা কী ছিলো- এ সব কথা তাদের পক্ষে বুঝতে পারা অসম্ভব, অর্থাৎ বুঝতে পারা অসম্ভব যে প্রজাপতিই সৃষ্টি করেছিলেন। যদি বলো, প্রজাপতিই সেই প্রাণীদের বলে দিয়েছিলেন যে, তিনিই স্রষ্টা তাহলেও তাদের পক্ষে তাঁর কথায় আস্থা স্থাপন সম্ভব নয়; কেননা, এমনও তো হতে পারে যে, তিনি নিজের শক্তিসংক্রান্ত শুধু দম্ভই প্রকাশ করেছেন।
সাধারণ লোকের ধারণায়, প্রজাপতি যে স্রষ্টা এ-কথা বেদ-এ আছে। কিন্তু কুমারিল বলছেন, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আসলে কয়েকটি বিধির প্রশংসামূলক বাক্যের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা থেকে এ ধারণার উদ্ভব- কোনো একটি বাক্যের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বাক্যের সঙ্গে সঙ্গতি ব্যতিরেকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এ জাতীয় ভ্রান্তির উদ্ভব হয়। কুমারিল আরো দাবি করছেন, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী থেকেও প্রমাণ হয় না যে, প্রজাপতিই স্রষ্টা। আসলে নিছক কাহিনী হিসেবে কোনো কাহিনীই সার্থক নয়; অতএব তথাকথিত কাহিনীগুলিকে নিছক কাহিনী হিসেবে না বুঝে প্রকৃতপক্ষে বিধি বা যজ্ঞকর্মের প্রশংসা বা অর্থবাদ হিসেবেই বুঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
ঈশ্বরবাদী ন্যায়-বৈশেষিকরা ঈশ্বরকে কেবলমাত্র নিমিত্তকারণ বলে স্বীকার করেন। তাদের মতে, জগৎ সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য বা স্বনির্ভরতা নেই। জীবের কর্ম ও অদৃষ্টের ওপর ঈশ্বরকে নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া নিমিত্ত-কারণ কখনো উপাদান-কারণ হতে পারে না। ঘটের উপাদান-কারণ মৃত্তিকা। কুম্ভকার মাটি দিয়ে ঘট তৈরি করে, কুম্ভকার কখনো নিজেই মৃত্তিকা হতে পারে না। কুম্ভকার ঘটের নির্মাতা, মাটি উপাদান। জগতের উপাদান পরমাণু, ঈশ্বর পরমাণুর সাহায্যে জগৎ নির্মাণ করেন জীবের কর্ম ও অদৃষ্ট অনুসারে।
নিরীশ্বরবাদী কুমারিল এখানে বলেন, প্রথমত, বৈশেষিকরা যে মনে করেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় অকস্মাৎ সৃষ্টি হয় তা সম্ভব নয়; কেননা ঘট প্রভৃতি নির্মাণের দৃষ্টান্তে দেখা যায় একটি বস্তুর নির্মাণ ক্রমপদ্ধতি মাত্র। দ্বিতীয়ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রলয় স্বীকার করা যায় না, কেননা তার কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া প্রলয়ের কথা স্বীকার করলে মানতে হবে যে ঈশ্বরের মনে প্রলয়ের ইচ্ছা জাগে; কিন্তু এ জাতীয় ইচ্ছায় লাভ কী ? অর্থাৎ বুদ্ধিমান স্রষ্টার পক্ষেই নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করবার ইচ্ছা জাগা সম্ভব নয়।
বৈশেষিকরা বলেন, প্রলয়কালে মানবাত্মার ধর্মাধর্ম নিষ্ক্রিয় বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কুমারিল বলছেন, তা কোনোমতেই সম্ভব নয়। প্রথমত কৃতকর্মের ফলাফল অবশ্যম্ভাবী; তাই এমন কোনো অবস্থা সম্ভবই নয় যখন কৃতকর্মের পরিণাম স্থগিত থাকবে। বৈশেষিকরা বলবেন, ঈশ্বরের ইচ্ছা নামক কর্মটির দরুন বাকি সকলের কর্মফল এইভাবে স্থগিত থাকে; কিন্তু তাও সম্ভব নয়, কারণ একজনের একটি কর্মের ফলে বাকি সকলের কর্মফল স্থগিত থাকতে পারে না।
যদি বলা হয়, প্রলয়কালে সকলের ধর্ম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তাহলে কুমারিল বলছেন, আর কখনো সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকবে না, কেননা সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কর্মগুলিকে আবার কীভাবে সঞ্জীবিত করা যাবে ?
বৈশেষিকরা যদি বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তা সম্ভব হতে পারে, তাহলে, কুমারিল বলছেন, শুধু এই ঈশ্বরের ইচ্ছার কথা বলাই তো যথেষ্ট- বৈশেষিকরা আবার কেন সৃষ্টির জন্য ধর্মাধর্মের কথা তোলেন ? তাছাড়া, ঈশ্বরের ইচ্ছাও সম্পূর্ণ অকারণ হতে পারে না; এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার কারণ হিসেবে যদি কিছু স্বীকার করা হয় তাহলে সেই কারণটির সাহায্যেই তো সৃষ্টির ব্যাখ্যা সম্ভব, তদুপরি ঈশ্বর মানার প্রয়োজন কী ?
ন্যায়-বৈশেষিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করবার উদ্দেশ্যে বলেন, গৃহাদির দৃষ্টান্তে দেখা যায় বিভিন্ন অবয়ব দ্বারা গঠিত বস্তুর উৎপত্তি বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণব্যতীত সম্ভব নয়; অতএব অবয়ব-বিশিষ্ট মানবদেহের নিয়ন্তা বা নিয়ন্ত্রণ-কর্তা হিসেবেও বুদ্ধিমান ঈশ্বর অনুমেয়।
কিন্তু কুমারিল বলছেন, এই বুদ্ধিমান নিয়ন্তা অর্থে ঈশ্বরের কথা বাহুল্য মাত্র। কেননা সকলেই জানে যে মানবাদি বুদ্ধিমান জীবের নিয়ন্ত্রণ ফলেই পৃথিবীতে যাবতীয় উৎপাদন সম্ভব হয়; অতএব তার জন্য ঈশ্বর মানবার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বৈশেষিকরা যে বলেন, ঈশ্বরেচ্ছায় আকস্মিকভাবে বা হঠাৎ জগৎ সৃষ্ট হয় তাও মানবার কারণ নেই; কেননা গৃহাদি নির্মাণের দৃষ্টান্তেই দেখা যায় কোনো কিছুই নির্মাণকর্তার ইচ্ছা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয় না।
বৈশেষিকরা বলেন, সকলের দেহই বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন। কুমারিল বলছেন, কিন্তু এই যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর-দেহের নিয়ন্ত্রণকর্তা কে হবেন ? তথাকথিত ঈশ্বরের দেহও দেহ, এবং আমাদের দেহের মতোই অবয়ব-গঠিত; অতএব তারও কোনো নিয়ন্তা স্বীকার্য। যদি বলো, ঈশ্বরের ইচ্ছাই এই নিয়ন্ত্রণের কারণ, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই মূল যুক্তির বিরুদ্ধে যেতে হবে; কেননা তোমাদের মূল যুক্তি হলো, অবয়ব-গঠিত বস্তুর নিয়ন্তা হিসেবে স্বতন্ত্র কোনো বুদ্ধিমান অনুমেয়। তাছাড়া, ঈশ্বরেচ্ছার দ্বারাই বা কীভাবে তাঁর দেহ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে ? কেননা, ঈশ্বর যদি তাঁর দেহ সৃষ্টি করতে চান তাহলে তাঁকে দেহীপূর্ব বা দেহবিহীন অবস্থাতেই এ প্রয়াস করতে হবে,- উক্ত প্রয়াসের পূর্বে তাঁর দেহের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। এবং দেহবিহীন অবস্থায় ঈশ্বরের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
ঈশ্বরানুমানের জন্য বৈশেষিকরা কুম্ভকারের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেন- অবয়ব-বিশিষ্ট ঘট যেমন কুম্ভকারের সৃষ্টি, অবয়ব-বিশিষ্ট সমগ্র জাগতিক বস্তুও তেমনি ঈশ্বরের সৃষ্টি।
কিন্তু কুমারিল বলছেন, ঘটাদি যদি প্রকৃতপক্ষে কুম্ভকারের সৃষ্টি হয় তাহলে তা ঈশ্বরের সৃষ্টি হতে পারে না, অর্থাৎ সমস্ত জাগতিক বস্তুর স্রষ্টা ঈশ্বর হতে পারেন না; অপরপক্ষে যদি বলো, ঘটাদি প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরেরই সৃষ্টি- অর্থাৎ কুম্ভকারের সৃষ্টি নয়, তাহলে যে দৃষ্টান্তের উপর নির্ভর করে তোমরা ঈশ্বর অনুমান করো সেইটিই প্রত্যাখ্যান করতে হবে- অর্থাৎ ঈশ্বরানুমানের দৃষ্টান্তাভাব ঘটবে। তাছাড়া, ঘটাদির সৃষ্টি সাধারণত যেভাবে কুম্ভকারাদির কীর্তি বলে স্বীকৃত হয়, বৈশেষিকরাও যদি তা স্বীকার করেন তাহলে তাঁদের সিদ্ধান্তই খন্ডিত হবে; কেননা, তাহলে মানতে হবে জীবদেহ প্রভৃতিও মরলোকের জীবদেরই সৃষ্টি- ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়।
উত্তরে বৈশেষিকরা বলবেন, ঈশ্বরের সৃষ্টিকাজ কুম্ভকারাদির মতো নয়; বস্তুত ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত হয়ে পরমাণুসমূহই সৃষ্টিকাজ সম্পাদন করে।
এক্ষেত্রে কুমারিল বলছেন, এ কথাও যুক্তিযুক্ত হবে না; কারণ পরমাণুসমূহ জড় বা অচেতন, অতএব তাদের পক্ষে ঈশ্বরেচ্ছা অনুসারে কোনো কাজ করাই সম্ভব নয়; কেননা অচেতন পরমাণুর পক্ষে ঈশ্বরেচ্ছার অবগতিই সম্ভব নয়।
ঈশ্বর এবং সৃষ্টি-প্রলয় সংক্রান্ত ন্যায়-বৈশেষিক মত খন্ডন করেই কুমারিল ক্ষান্ত নন; এই প্রসঙ্গে তিনি বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্বও খন্ডন করতে অগ্রসর হয়েছেন এবং সাংখ্যমতেরও সমালোচনা করেছেন। তাছাড়া মীমাংসা দর্শনে কেবল ঈশ্বরই নয়, বৈদিক দেব-দেবীর অস্তিত্বও স্বীকৃত হয়নি স্রেফ দেবতার নামটুকুর উপস্থিতি ছাড়া।
জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জগতের প্রচলিত লোকব্যবহারের দৃষ্টান্তমূলক তাবৎ বিষয়কেই তৎকালীন দার্শনিকেরা যুক্তি-তর্কের মোক্ষম হাতিয়ার বানাতে দ্বিধা করেননি। কেননা বিজ্ঞানের শনৈ শনৈ উন্নতির ফলে বিজ্ঞানদৃষ্টির বর্তমান অভূতপূর্ব বহিঃ ও অন্তর্মুখী শক্তিমত্তা সেই প্রাচীনকালের চিন্তকদের কাছে কল্পনারও অগম্য ছিলো। কিন্তু নিজস্ব পরিমন্ডলের সাপেক্ষে তাঁদের যুক্তির শৃঙ্খলা, পরিশীলতা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্নের শক্তিমত্তাকে অবমূল্যায়নের কোন সুযোগ নেই। অথচ হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসে একালে এই আমরাই যখন আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিমুখ হয়ে যুক্তিশীলতাকে পাশকাটিয়ে অর্থহীন প্রপঞ্চ নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠি তখন নিশ্চয়ই তা অবহেলায় এড়িয়ে যাবার উপায় থাকে না।
যুক্তি ও বিশ্বাস কখনোই একে অপরের পরিপূরক হয় না। নিজস্ব বিশ্বাসে একান্তই আবিষ্ট থাকার অধিকার যেমন যে-কোনো ব্যক্তির রয়েছে, তেমনি যুক্তিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অধিকারও ব্যক্তির জন্য প্রশ্নহীন অধিকার। যুক্তি প্রামাণ্য নির্ভর, বিশ্বাস তা নয়। একটিকে আরেকটির উপর চাপানোর বিষয়টাই অযৌক্তিক। যুক্তি মানেই প্রশ্নের বহমান ধারা, যার প্রতিটাকে সমাধান করে করেই যুক্তিকে এগুতে হয় এবং এভাবেই এর যথার্থতা নির্ণিত হয়। বিশ্বাসের এ দায় নেই বলেই তার সাথে জ্ঞানচর্চার সংগতি খোঁজারও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সমাজ-বিকাশের ধারায় যুক্তি ও বিজ্ঞানকে সংগতির দায় কাঁধে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। অথচ যুক্তিকেই যদি বিশ্বাসের দায় নিতে বলা হয়, তারই নাম হবে অযাচিত আধিপত্য। এটি হলো যুক্তিকে জোর করে থামিয়ে দেয়া, প্রশ্নকে স্তব্ধ করে দেয়া, সমাজের জ্ঞান-তাত্ত্বিক বিকাশকে রুদ্ধ করে দেয়া, সমস্ত বৈজ্ঞানিক অর্জনকে অস্বীকার করার নামান্তর। এটি কোন সুস্থ সমাজ বা রাষ্ট্রের লক্ষণ হতে পারে না, তা সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কময় একটি অথর্ব প্রবণতারই ইঙ্গিতবাহী কেবল।
তৎকালীন ভূ-কেন্দ্রিক বাইবেলীয় ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করায় ব্রুনোকে পুড়িয়ে কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের জনক বলে খ্যাত দার্শনিক গ্যালিলিওকে অবরুদ্ধ করেও যেমন সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করানো যায় নি, পৃথিবীই বস্তুত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, তেমনি সমাজ-সভ্যতার এই বর্তমান লক্ষ্যণীয় বিন্দুতে দাঁড়িয়ে একটি প্রাচীন পরিত্যক্ত আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্বকে বিকৃত ও কৃত্রিমভাবে জাগিয়ে তোলার মধ্যেও পেছন-দিকে হাঁটার আধ্যাত্মবাদী রাজনৈতিক কূটাভাস ছাড়া ইতিবাচক কিছু রয়েছে বলে মনে হয় না। আগেই বলা হয়েছে যে এটি একটি সুস্পষ্ট প্রাচীন জ্ঞানতাত্ত্বিক দার্শনিক দ্বন্দ্ব। অন্তত ঈশ্বর নামক কোন জগতস্রষ্টার অস্তিত্বে স্বীকার বা অস্বীকার করার সাথে যে আস্তিক্য-নাস্তিক্যের কোন সম্পর্কই নেই তা যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি এ বিষয়ে পক্ষাপক্ষ অবস্থান ও বিরোধিতার নৈতিক হাতিয়ারও ছিলো চিন্তকদের মধ্যে জ্ঞান-যুক্তি ব্যবহারের যুক্তিশীল চর্চা। সেকালে তার কতোটা প্রভাব বা গ্রহণযোগ্যতা ছিলো তা এর বুৎপত্তিগত ইতিহাসও আমাদেরকে পথ দেখাতে পারে।
---
(চলবে---)
---
[পর্ব-০১] [পর্ব-০২] [*] [পর্ব-০৪]
---
মন্তব্য
আরে দুর্ধর্ষ! সেইকালে এই পর্যায়ের যুক্তিচর্চা ছিলো! জানতামই না!
সাধু! সাধু!
আজকের পর্বটা অনন্য!
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্যই হলো যুক্তিবিচার। প্রতিপক্ষে বক্তব্যকে যুক্তির ন্যায় দিয়ে খণ্ডনের মাধ্যমে নিজের সিদ্ধান্তের যুক্তিসিদ্ধতা প্রতিপাদন করা। একালে যাকে আমরা যুক্তিশাস্ত্র বলি, হাজার-দেড়হাজার বছর আগেই তাকেই বলা হতো তর্কশাস্ত্র, আর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্বকালে তাকে বলা হতো ন্যায়-শাস্ত্র। আপনাকে কোন সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যুক্তির সিঁড়ি বেয়েই আসতে হবে, তার বাইরে কোন উপায় নেই।
বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের আগে সেকালে জ্ঞানচর্চার একমাত্র মাধ্যমই ছিলো যুক্তিবিচার। অত্যন্ত মজার ব্যাপার হলো, এখন আমরা যেসব পাশ্চাত্য দর্শনের পাণ্ডিত্যে বিহ্বল হয়ে পড়ি, তার প্রতিটা দর্শনেরই সুস্পষ্ট ছায়া কিন্তু হাজার হাজার বছর আগের ভারতীয় দর্শন খুব সমৃদ্ধভাবে ধারণ করে আছে। অথচ আমরা ভুলেই বসে আছি যে, কী সমৃদ্ধ জ্ঞান-দর্শন আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়ে গেছে। এর কারণও আছে। তৎকালীন যাবতীয় জ্ঞানচর্চার মাধ্যম ছিলো মূলত সংস্কৃত ভাষা।
একালে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সুযোগ নাগালে রেখেও যে কোন কিছু যাচাই-বাছাই না করেই নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে বসে থাকি। অথচ সেকালে তার কোন সুযোগ ছিলো না। যুক্তিসিদ্ধ প্রামাণ্য ছাড়া কোন জ্ঞানকে জ্ঞান বলেই স্বীকার করা হয় নি। এটুকু বোঝাতেই আসলে এই পর্বের সামান্য নমুনাটুকু উপস্থাপন করেছি। একমাত্র কামনা, আমরা যেন নিজ জীবনে যুক্তিশীল হয়ে উঠি।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
ধারনা করি চার্বাক দর্শন মাধ্যমেই পৃথিবীতে দর্শনের চর্চা শুরু। গ্রীক দর্শনে শুরুতো চার্বাকের পরে।
বড্ড কঠিন লাগলেও পড়ছি এবং নতুন অনেক কিছুই জানছি।
আমরা এখানে সরাসরি চার্বাক না বলে যদি ভারতীয় দর্শন বলি, তাহলে এটা বলতেই পারি যে গ্রিক দর্শনের আগেই ভারতীয় দর্শনের উন্মেষ হয়েছে হয়তো। তবে তখন তো আর চার্বাক নামে ছিলো না, ছিলো লোকায়ত দর্শন নামে। যেহেতু চার্বাকদের নিজস্ব সাহিত্য বিলুপ্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত, তাই অন্যান্য দর্শনের পূর্বপক্ষ উপস্থাপন থেকে চার্বাক সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাকে সূত্রাবদ্ধ করেই পেছনে এগুতে হয়। বিষয়টা বেশ বিতর্কিত ও জটিল বলেই প্রচুর উৎস ও তথ্যের সমাহারের দরকার হয় কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে। সেটা নিয়ে অবশ্য কাজ করছি অনেকদিন ধরে। আগামীতে গ্রন্থাকারে তা প্রকাশের ইচ্ছা রয়েছে, যদিও আরো বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে।
তবে এটা নিশ্চিত যে, দর্শনে আধ্যাত্মের মিশেল কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেই সূত্রপাত।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
নতুন মন্তব্য করুন