একটি অবৈশাখি ভাবনা : কাঁঠালেও আমসত্ত্ব হয়!

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৪/২০১৫ - ১২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:



(১)
‘সোনার পাথরবাটি’ কিংবা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ জাতীয় প্রবাদগুলো ছোটকাল থেকেই আমরা সবাই শুনে আসছি এবং এসব অবাস্তব বস্তু বা বিষয়ের মর্মার্থও আমাদের বোধের অগম্য নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু একালে এসে যখন তথাকথিত কোন বিদ্বানপ্রবরের মুখে নতুন আঙ্গিকে এমন কথা বলতে শুনি- ‘বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’, তখন আঁৎকে উঠে পুরনো কাসুন্দিকেই আবার নতুন করে ঘুটানো ছাড়া গত্যন্তর থাকে কি! কথাটা কি কোন বিদ্বানের অসতর্ক মুহূর্তে ক্ষণিকের প্রলাপ ভাববো, না কি এর ভেতরে কোন রহস্য ও গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে, তা খোঁজার আগে আমরা মনে হয় কিছু তরল কথাবার্তা সেরে নিতে পারি!

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’ কাহিনীটা কম-বেশি আমরা প্রায় সবাই হয়তো জানি। কথিত আছে রাজা দ্বিতীয় হিয়েরোর জন্য গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী লরেল পাতার মুকুটের মতো দেখতে একটি সোনার মুকুট প্রস্তুত করা হয়েছিলো। মুকুটটি খাঁটি সোনার তৈরি কিনা তা নিশ্চিত করতে আর্কিমিডিসকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মুকুটটি গলিয়ে তার ঘনত্ব নির্ণয় করার সহজ পদ্ধতিটি সেকালে জানা থাকলেও রাজা কোনোভাবে মুকুটটি নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। ফলে মুকুটটিকে একটুও ক্ষত না করে কিভাবে তার খাটিত্ব যাচাই করবেন তা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন আর্কিমিডিস। এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভাবতে একদিন তিনি গোসলে নেমে খেয়াল করলেন যে, তাঁর নামা মাত্র বাথটাবের পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে এবং তার নিজের ওজন হালকা অনুভূত হচ্ছে! হা হা হা! নিশ্চয়ই সেদিনই এই প্রাকৃতিক নিয়ম প্রথমবার এবং কেবল আর্কিমিডিসের ক্ষেত্রেই ঘটেনি! চিরকাল সবার জন্যেই সেরকমই ঘটে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না! যেভাবে কোনো আপেল গাছের তলায় বিজ্ঞানচিন্তায় রত আইজাক নিউটনের মাথায় যে প্রাকৃতিক নিয়মে একটি আপেল পতিত হয়েছিলো বলেও কাহিনী প্রচলিত আছে, ঠিক সেই নিয়মে আগেও নিশ্চয়ই গাছ থেকে এভাবেই আপেল পড়তো! এখনো পড়ছে বৈ কি!

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে ‘ব্রাহ্মমুহূর্ত’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এটির আভিধানিক অর্থ হলো সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পূর্বকাল। রাত আর দিনের সংযোগকাল। আর এর ভাবগত অর্থ হলো পরস্পর সম্পর্কিত কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দুটো ভিন্ন বিষয় বা অবস্থার সংযোগ বা সংগমকাল। বিমূর্ত চিন্তাজগতে এমন একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে, অন্যদিকে একইসময়ে কোন একটি ভিন্নমাত্রিক সাধারণ বা প্রাকৃতিক ঘটনা ইন্দ্রিয়গোচর হলো যার সাথে ওই বিমূর্ত সমস্যাটির আকস্মিক সমাধানের একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে গেলো! আপেলটি কেন উপরের দিকে না উঠে নিচে এই পৃথিবী বা মাটির দিকেই পড়লো, ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে’র এই ভাবনা থেকে যেমন খ্রিস্টীয় সতেরো শতকের বিজ্ঞানী নিউটন তাঁর বিখ্যাত মাধ্যাকর্ষণ-সূত্র আবিষ্কার করলেন, তারও প্রায় দু’হাজার বছর পূর্ববর্তীকালের আরেক ভাবুক আর্কিমিডিস তেমনি এক ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে’ বুঝতে পারলেন যে, তাঁর পর্যবেক্ষিত পানির এই ধর্মকে বস্তুর ঘনত্ব পরিমাপে ব্যবহার করা সম্ভব! যেহেতু ব্যবহারিক কাজের জন্য পানি অসংকোচনশীল, তাই পানিতে নিমজ্জিত মুকুট তার আয়তনের সমান পরিমাণ পানি স্থানচ্যুত করবে। এই অপসারিত পানির আয়তন দ্বারা মুকুটের ভর বা ওজনকে ভাগ করে মুকুটের ঘনত্ব পরিমাপ করা সম্ভব। যদি মুকুটের উপাদানে সোনার সাথে অন্য কোন কম ঘনত্বের সস্তা ধাতু যোগ করা হয় তাহলে তার ঘনত্ব খাঁটি সোনার ঘনত্বের চেয়ে কম হবে। কথিত আছে, এই আবিষ্কার আর্কিমিডিসকে এতোটাই উত্তেজিত করেছিলো যে, তিনি বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে নগ্ন অবস্থায় শহরের রাস্তায় ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ অর্থাৎ ‘আমি পেয়েছি’ ‘আমি পেয়েছি’ বলে চিৎকার করতে করতে দৌঁড়াতে শুরু করেছিলেন!

আমাদের ভুলে গেলে চলে না যে, আর্কিমিডিসকে ক্ল্যাসিকাল যুগের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একাধারে ভূবনবিখ্যাত গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক। কিন্তু এই যে এতোগুলো বিশিষ্ট পরিচয়ে তাঁকে অলংকৃত করা হচ্ছে এর সবই পরবর্তীকাল তথা আধুনিককালের বিদ্বান-গবেষকদের দেয়া বিশেষণ। তাঁর সময়কালে কিন্তু আর্কিমিডিস বা এ জাতীয় সমধর্মী ব্যক্তিবর্গকে কেবলই দার্শনিক নামেই অভিহিত করা হতো। তবে কি তিনি অন্য পরিচয়ে বিশেষিত হবার জন্য বিবেচিত হতেন না বা যোগ্য ছিলেন না? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। কেননা গণিতবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, সমাজবিদ্যা, অর্থবিদ্যা বা জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য যাবতীয় শাখা ও বিভাগগুলো আসলে বিষয়ের প্রভূত চর্চাজনিত সমূহ বিস্তৃতির কারণে অনেক পরবর্তীকালের সুবিধাজনক বিভাজন বা বিশেষায়ণ। তার মানে বর্তমানকালে আমরা জ্ঞানচর্চার অদ্ভূতুড়ে বিভাজন হিসেবে বিজ্ঞান, মানবিক, অর্থনীতি নামের প্রধান বিভাজন এবং এর যে শাখা-বিভাগগুলোর নাম জানি, এককালে তার সবগুলোই একসাথে সামগ্রিক দর্শনচর্চারই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তবে তা হয়তো তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক হিসেবে দুটো গৌণ বিভাজনে বিভক্ত হয়েছিলো। বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা হিসেবে তাত্ত্বিক দর্শন এবং ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে যে নতুন নতুন উদ্ভাবন তা ব্যবহারিক দর্শনের আওতাভুক্ত করা যেতে পারে। যাকে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু একেই বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করা কতোটুকু যথার্থ হবে তা নিশ্চয়ই প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়! কেননা প্রতিটি ব্যবহারিক দর্শনের পেছনের প্রধান উৎসটাই হলো তার তাত্ত্বিক দর্শন। এই যেমন চিরায়ত প্রাকৃতিক নিয়ম বা পানির বস্তুগত ধর্মের সাথে অন্য একটি বস্তুর তথা স্বর্ণবস্তুর অভ্যন্তরীণ কোন প্রাকৃতিক নিয়মের যোগসূত্র আবিষ্কারের অনুসন্ধিৎসা, এটা কি বিশুদ্ধ দর্শনচিন্তা নয়? এবং তা থেকে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের যে তাত্ত্বিক অভিযোজন, তাকে কি বিজ্ঞান বলা দোষণীয় হবে? কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গাণিতিক যুক্তি ও উপাত্ত প্রয়োগ করে এই দর্শনরূপ চিরায়ত বিজ্ঞানকে একটি সুনৃত সিদ্ধান্তে প্রতিভাসিত না করা পর্যন্ত তার ব্যবহারিক উপযোগিতা তৈরি হয় না, যাকে আমরা গণিতের ভাষায় বলি উপপাদ্য কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে আধুনিক পোশাকি ভাষায় বলি বিজ্ঞান-সূত্র। কিন্তু এপর্যন্ত যেটুকু অভিযাত্রা তা আসলে দর্শন বা জ্ঞানের বিমূর্ত বা তত্ত্বীয় পর্যায়। এই তত্ত্বীয় জ্ঞানকে ব্যবহারিক উপযোগিতা প্রদানের জন্য এরপর প্রয়োজন হয় প্রযুক্তিক কলা-কৌশল প্রয়োগের। পরীক্ষামূলকভাবে দরকার হয় প্রয়োজনমাফিক কিছু নতুন নতুন উপকরণ-সম্ভারের। একেই আমরা বলি প্রযুক্তিক উপাদান। নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যখন সেই চিন্তাজগতের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটা একটা সার্থক বস্তুগত আকার প্রাপ্ত হয়ে ব্যবহারিক প্রয়োজনকে সিদ্ধ করতে সক্ষম হলো, তখনই আমরা তাকে বস্তুগত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছি।

দার্শনিকই বলি আর বিজ্ঞানীই বলি, আর্কিমিডিস কী কী উপকরণের সহায়তায় সেই সোনার মুকুটের বিশুদ্ধতা নির্ণয় করেছিলেন তার বয়ান এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে একালে দুগ্ধজাতীয় প্রয়োজনীয় তরলের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিমাপকারী যে ছোট্ট যন্ত্র বা উপকরণটি ব্যবহৃত হয় তা যে সেই প্রায় আড়াইহাজার বছর আগের আর্কিমিডিসের দর্শনচিন্তার আধুনিক মূর্ত রূপ তা বোধকরি লেখা বাহুল্য। যে কোন প্রযুক্তিক উপকরণের ক্ষেত্রেই জ্ঞানচর্চার এই ধারাবাহিকতা প্রযোজ্য। কিন্তু শুরু থেকে এই সার্বিক প্রক্রিয়াটাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আমরা কি বলতে পারি তার কতটুকু দর্শন, কতটুকু বিজ্ঞান আর কতটুকু প্রযুক্তি? এবং এর প্রতিটা ভাগ কি স্বনির্ভর, কিংবা স্বতন্ত্র স্বাধীন? বস্তুত কোনো প্রযুক্তি একটি বিজ্ঞানকে ধারণ ও কার্যকর করে। প্রযুক্তি স্রেফ একটি বিশেষ কলা-কৌশলের সুনির্দিষ্ট উপকরণ মাত্র, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানের কোন একটি দিককে ব্যবহারিক উপযোগিতা দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রযুক্তি হলো সেই কারিগরি জ্ঞান, যার পেছনে একটি বৈজ্ঞানিক ধারাবাহিতা রয়েছে। আবার বিজ্ঞানের প্রাণ হলো সেই দর্শন, যা তাকে কোন একটি সত্তা দান করেছে। যে চিন্তাসত্তাটি না হলে তার সৃষ্ট তত্ত্বীয় বিজ্ঞান ভৌত বিজ্ঞান হিসেবে প্রযুক্তিতে মূর্ততা পেত না, সেই চিন্তাসত্তাই হলো দার্শনিকসত্তা। আর চিন্তার এই যে যৌক্তিক প্রক্রিয়া তাকেই আমরা বলতে পারি বিজ্ঞানবাদিতা। এ পর্যায়ে এসে এখন যদি বলা হয় ‘বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’, এর অর্থ কী দাঁড়ায়? আদৌ কি এর কোন অর্থ হয়? পিতামহকে অস্বীকার করে পৈত্রিক দাবি তুলে নিজেকে কেমন বস্তু হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়! একেই কি ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ বলে না! না কি কাঁঠালেও আমসত্ত্ব হয়! বিজ্ঞান থেকে দর্শনটুকুকে বাদ দিলে বাকি যেটুকু থাকে তাকে কি প্রযুক্তিও বলা চলে?

প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধদর্শনে বিজ্ঞান-প্রবাহ নামে একটি তত্ত্ব আছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ আত্মার বৈদিক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তাই বৌদ্ধদর্শনকে অনাত্মবাদী দর্শন বলা হয়। অবশ্য তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বেও বিশ্বাসী নন বলে বৌদ্ধদর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শনও বলা হয়। কিন্তু আত্মার ধারণায় বিশ্বাসী না হলেও তিনি ভবচক্র ও জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন। ফলে এই জন্মান্তরের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বুদ্ধ একধরনের সংস্কার বা চেতনা-প্রবাহের কথা বলতেন, যার বৌদ্ধ-পারিভাষিক নাম হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রবাহ। তার মানে, বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে চেতনা। এই চেতনার-প্রবাহের সংস্কারই জীবকে জরা-মরণ-দুঃখে পরিপূর্ণ ভবচক্র বা জন্মচক্রে বারবার ফিরিয়ে আনে যতক্ষণ না সংসার-তৃষ্ণা বা আকাঙ্ক্ষার অবলুপ্তির মাধ্যমে নির্বাণলাভ হয়। প্রাচীন মাগধি-প্রাকৃতে (খুব সম্ভবত) বুদ্ধ-সৃষ্ট এই ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি পরবর্তীকালের বাংলাভাষায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হলেও গৌতমবুদ্ধের ভাববাদে আকীর্ণ ধারণার সাথে শব্দটির দূরবর্তী যোগসাজস হয়তো বা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ইংরেজি ‘সায়েন্স’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ হিসেবে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির সাথে বৌদ্ধধারণার মিল খুঁজতে যাওয়া কষ্টকল্পনা হবে বলেই মনে হয়। তাই আমরা বিজ্ঞানবাদিতা ছাড়া বিজ্ঞানকে খোঁজার পণ্ডশ্রম না করে বরং কেন এবং কোন্ রহস্যজনক কারণে বিজ্ঞানবাদিতা ছাড়া বিজ্ঞান চাওয়া হচ্ছে তার সুলুকসন্ধান করতে পারি।

(২)
প্রথমেই আমাদের এটুকু বুঝতে হবে যে, বিজ্ঞানবাদিতা মানে সেই বিমূর্ত দর্শনচিন্তা যা বাস্তব যুক্তিপরম্পরা মেনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে, রূপ নেয় বিজ্ঞানে। তার এই এগিয়ে চলা এতোটাই অবিসংবাদিত যে, তার গন্তব্য পথে কোন অস্পষ্ট অযৌক্তিক ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। কেননা পথভ্রষ্ট হলে সেই দর্শনচিন্তা আর বিজ্ঞানবাদিতা থাকে না, তা হয়ে যায় এমনই এক অবাস্তব কল্পদর্শন যা যৌক্তিক যুক্তি হারিয়ে নিজেরই তৈরি এক পিচ্ছিল চক্রে ঘোরপাক খেতে থাকে অনির্দিষ্টকাল। তার কোন যৌক্তিক পরিণতি থাকে না বলে পাশ্চাত্য দর্শনে তাকেই বলা হয় ‘ইউটোপিয়া’ বা কাল্পনিক। চিরকাল যুক্তিপরম্পরাহীন কোন বদ্ধ-ধারণার উপর একটা পরিণতিহীন ধোঁয়াশা তৈরি করে রাখাই যার একমাত্র নিয়তি। কিছু অন্ধবিশ্বাস ছাড়া তার কোন উন্মুক্ত সৃষ্টিক্ষমতা থাকে না। কেননা যুক্তিহীন সৃষ্টি চূড়ান্ত বিচারে কোন সৃষ্টিই নয়, কাল্পনিকতা মাত্র! প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে এরূপ কাল্পনিক সৃষ্টিকে প্রতীকী অর্থে বলা হয় ‘শশশৃঙ্গ’ কিংবা ‘আকাশকুসুম’, অর্থাৎ অলীক কল্পনা। যেখানে যুক্তি থেমে যায় যুক্তিহীনতার ঘোরপাকে। এখন তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, যুক্তি মানে কী?

একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, যুক্তি মানে হলো ক্রমাগত প্রশ্ন-পরম্পরার মাধ্যমে উত্তর খোঁজার এক ধারাবাহিক জৈব প্রক্রিয়া। জৈব বলা হচ্ছে এজন্যেই যে, কান টানলে মাথা আসার মতোই এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দর্শনের উন্মেষকালে যে মৌলিক প্রশ্নগুলো মানবচিন্তায় প্রথম অনুরণন তুলেছিলো বলে মনে করা হয় সেগুলো হচ্ছে- কী, কেন, কীভাবে? আর এর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিলো জ্ঞানচর্চার পথ পরিক্রমা। এই জ্ঞানচর্চাই দর্শন। অতএব, বিজ্ঞানবাদিতা হলো সেই ইহলৌকিক দর্শনচিন্তা যা সুপ্রাচীন কাল থেকে মানবসভ্যতার প্রতিটি অগ্রযাত্রার উৎসস্রোত হয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছে মানুষকে, মানবজাতিকে। আর এই বিজ্ঞানবাদিতাকে যাঁরা গভীর আস্থায় মেধা-মননে নিজের মধ্যে ধারণ করেন, উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার মধ্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তাঁরাই হলেন বিজ্ঞানমনস্ক। অর্থাৎ বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই জ্ঞানচর্চা মানে জ্ঞানদর্শন। এ-প্রসঙ্গে গত শতকের প্রখ্যাত অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক কার্ল পপারের (১৯০২-১৯৮৪) একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক হবে- ‘আমার আগ্রহ শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তত্ত্ব নয়, বরং সাধারণভাবে জ্ঞানের তত্ত্ব। তৎসত্ত্বেও আমার বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ সাধারণভাবে জ্ঞানের বিকাশ চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায়। কারণ বলা চলে যে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছে সাধারণ মানবীয় জ্ঞানের বিকাশের সহজবোধ্য ও সুচিহ্নিত রূপ।’ (সূত্র: কার্ল পপার নির্বাচিত দার্শনিক রচনা দ্বিতীয় খণ্ড, ভাষান্তর আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, বাংলা একাডেমী, জুন ২০০৮, পৃষ্ঠা-চৌদ্দ)

প্রসঙ্গত, আমরা জানি যে, গ্যালিলিওকে ইউরোপীয় রেনেসাসের এক প্রধান পুরুষ বিবেচনা করা হয়। তাঁর মধ্য দিয়েই আন্দাজমূলক জ্ঞানলাভের প্রচেষ্টা প্রস্ফূটিত হয়েছে এবং সেইসাথে যৌক্তিক কারণে জ্ঞানের বিষয়গততা স্ব-গুরুত্বে আবির্ভূত হয়েছে। ‘প্রচলিত ধারণায় প্লেটোকেই জ্ঞানতত্ত্বের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক বলা হয়ে থাকে। তিনিই প্রথম জ্ঞানতত্ত্বের মূল প্রশ্নসমূহ, যেমন ‘জ্ঞান কী?’, ‘সাধারণত কোথায় জ্ঞানের সন্ধান মেলে, এবং সচরাচর আমরা যা জানি বলে বিশ্বাস করি তা সত্যিকার অর্থে জ্ঞান কি না?’, ‘ইন্দ্রিয় কি আমাদের জ্ঞানদান করে’, ‘যুক্তিবুদ্ধি কি জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে?’, ‘সত্য বিশ্বাসের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক কী?’ ইত্যকার প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপৃত থেকেছেন এবং সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।’

অথচ মজার ব্যাপার হলো, ওই সমসাময়িককাল থেকেই প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও যে ‘জ্ঞান কী, জ্ঞানের প্রকাশ বিকাশ’ এইসব অবিমিশ্র বিষয়ে বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও তুমুল তর্ক-বিতর্কে মুখরিত যুক্তি ও জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিলো, বর্তমান পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিক জ্ঞান-ধারণার পরমুখাপেক্ষিতার কারণেই হয়তো আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী উপমহাদেশীয় নিজস্ব প্রাচীন দর্শনশাস্ত্র-গ্রন্থগুলোকে উদ্দেশ্যমূলক অবহেলা করে এসেছি। নয়তো আর্থ-সামজিক পরিবেশগত কারণে যুক্তিবহির্ভূত বিশ্বাসাশ্রিত ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় প্রভাববলয়ের সর্বগ্রাসিতায় চাপাপড়া যুক্তিবুদ্ধিকে আর খুড়ে বের করার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু জ্ঞানযাত্রা যে থেমে থাকার নয় এই বোধ পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানীরা ধারণ করেছিলেন ঠিকই। তাই-
ইউরোপীয় ‘রেনেসাঁসের পর থেকে মানবমুক্তি, সাম্য, সমধর্মী-আইন, ন্যায়বিচার মানুষের আরাধ্য হিসেবে দেখা দিল, তখন বিষয়গত ফ্যাক্টের প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে দেখা দিল। বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যদিও জ্ঞানের সাধনা অগ্রসর হয়েছে, তবু একটি অব্যাহত আশাবাদ তার পেছনে কাজ করেছে; মানুষ সত্যকে চিনতে পারে, মানুষ জ্ঞান আহরণ করতে পারে। জ্ঞানকে শুধু তার পর্দা সরিয়ে দিতে হবে। মানুষের নিজের ক্ষমতা আছে জ্ঞান চিনে নেওয়ার; কোনও অথরিটির দরকার নেই তার। এই আশাবাদই জন্ম দিয়েছে নতুন প্রযুক্তি, নতুন বিজ্ঞানের।’- (সূত্র: ঐ, পৃষ্ঠা-সাতাশ)

অতএব বিজ্ঞানকে দর্শন থেকে কিংবা দর্শনকে বিজ্ঞান থেকে আলাদা করা সম্ভব কি? বস্তুত দর্শন ও বিজ্ঞান একই সত্তার দুটি রূপ মাত্র, যে অভিন্ন সত্তার নামই বিজ্ঞানবাদিতা। আর এই বিজ্ঞানবাদিতায় আস্থা রেখে সেইমতো নিজেকে পরিচালনা করাই হলো বিজ্ঞানমনস্কতা। ফলে চোখ বুজে আবদ্ধ চিন্তায় নিজেকে অন্ধ বানিয়ে রাখতে কিংবা অন্যকে অন্ধ-অন্ধকারে আবদ্ধ রাখতে আগ্রহীদের নিকট নিশ্চয়ই বিজ্ঞানবাদিতা বা বিজ্ঞানমনস্কতা কাম্য নয় কখনো! তবে কি অন্যকে কল্পগ্রস্ত জড়বুদ্ধি বানিয়ে রাখতেই এরা আগ্রহী? ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে ‘বুদ্ধি’ অর্থে ‘জ্ঞান’কেই বোঝানো হয়ে থাকে। সেই অর্থে জড়বুদ্ধি মানে জড়জ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞানহীনতা বোঝায়। অতএব, ‘বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’ বলে যাঁরা মাতম তোলেন তাঁদের পক্ষে অন্য কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো আদৌ সম্ভব বলে কি মনে হয়? আর বিজ্ঞানবাদিতা না চাইলে খুব যৌক্তিকভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির অবস্থিতিও নিশ্চয়ই তাঁদের চাওয়া হতে পারে না। বিজ্ঞানবাদিতার বিপক্ষবাদী হয়ে এরা আসলে কিসের মদতদাতা হতে চাইছেন, এমন প্রশ্ন আসা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক? আমাদের সাম্প্রতিক ইহলৌকিক বাস্তবতা, বিশেষ করে বিজ্ঞানলেখক ব্লগার অভিজিৎ রায় কিংবা সমমনা অন্যান্য বিজ্ঞানমনস্কদের নৃশংস হত্যা, কি সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে না!

অন্যদিকে বিজ্ঞানবাদিতা না চাইলেও ‘বিজ্ঞান চাই’ বলে যে টুইস্ট তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে, তার কী ব্যাখ্যা হতে পারে? এর একটি হতে পারে কেবলই কথার কথা! বিজ্ঞানবাদিতা ছাড়া বিজ্ঞান তো আর হাওয়া থেকে এসে পড়বে না! কোন অলৌকিক পন্থাতেই যদি বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়ে যেতো তাহলে কাঁঠালের আমসত্ত্বও কোন অবাস্তব বস্তু হতো কি? ভুতের পা নাকি পেছনদিকে থাকে! ‘বিজ্ঞান চাই’-এর মতো সামনের দিকে মুখ করে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তার গতি কিন্তু ‘বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’র মতো পেছনদিকেই!
নতুবা এর আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, বিজ্ঞান বলতে তাঁরা কি আসলে নিথর কোন প্রযুক্তিজ্ঞানকেই বোঝাতে চাচ্ছেন! এটাও একধরনের বিজ্ঞানবুদ্ধির ঘাটতিই বলা চলে। অনেক প্রযুক্তিপ্রেমী ব্যক্তিকে প্রযুক্তিমনস্ক অর্থে ভুল করে আমরা অনেকেই বিজ্ঞানমনস্ক বলে ফেলি! প্রযুক্তির বস্তুগত একটা নির্দিষ্ট বৃত্তপরিধির পর যাঁদের যুক্তিবোধ শেষতক যুক্তিহীনতার অন্ধপঙ্কে হারিয়ে যায় তাঁদেরকে কি কোন অর্থে বিজ্ঞানমনস্ক বলা চলে? বিজ্ঞানমনস্কতা আর প্রযুক্তিমনস্কতার মধ্যে যে রাত আর দিনের মতোই ব্যাপক ও মাত্রাগত পার্থক্য রয়ে গেছে তা হয়তো আমরা অনেকে বুঝিই না, কিংবা বোঝার চেষ্টাও করি না। অথচ বিজ্ঞানমনস্কতাহীন প্রযুক্তিলেখককেও আমরা সগর্বে বিজ্ঞানলেখক বলেই নির্দ্বিধায় চালিয়ে দেই! কিন্তু চালাতে চাইলেই কি সবকিছু চালানো যায়! তবু প্রকৃত বিজ্ঞানলেখককেই চেনা হয়ে ওঠে না আমাদের। ভুল সংজ্ঞায় তাঁকে হাপিশ করে ফেলি অনায়াসে !

‘বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’- এই যুক্তিহীন কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্যের অসারতা নিয়ে আর বক্তব্য না-বাড়িয়ে বরং প্রাসঙ্গিক আরো কিছু উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা যায়। যেমন-
‘মনে করা হয় যে, ইউরোপ যখন তার গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহৎ বিশ্বে বেরিয়ে পড়ল এবং ঘটনাক্রমে তার কিছুটা-অবিচল-পরিকাঠামোতে যখন গ্রিক সভ্যতা ও বিশ্বদৃষ্টির জলসিঞ্চিত হল, তখন তা ফুলে-ফলে-পত্রে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল। নব মানুষের জ্ঞান আহরণের এই আগ্রহ, ধর্মীয় বেড়াজাল ছিড়ে বেরিয়ে পড়ার এই আকুতি, মানুষকে নতুন সাধনায় নিযুক্ত করল। আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তি যে আশাবাদ দ্বারা প্রণোদিত হল তার মূল প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে দাঁড়ালেন বেকন ও দেকার্ত।’- (সূত্র: ঐ)

কৌতুহলি পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন যে, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শক্তিসঞ্চয় ও আশাবাদের জায়গাটা কোথায়? পাশ্চাত্য আধুনিক দর্শনে মহাদেশীয় যুক্তিবাদ, বা বুদ্ধিবৃত্তিবাদ,-এর প্রতিনিধি হচ্ছেন দেকার্ত, স্পিনোজা ও লাইবনিৎস এবং ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ-এর প্রধান প্রতিনিধি হচ্ছেন বেকন, লক, বার্কলি ও হিউম। তাঁদের জ্ঞানাচারী ভিন্ন অবস্থান ও দ্বন্দ্ব সুবিদিত হলেও তাঁদের উত্তরসূরী দার্শনিক কার্ল পপার তাঁর ‘মিথ্যা-প্রতিপাদনবাদ’-এর পেছনের জ্ঞানতাত্ত্বিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ওই পূর্বসূরীদের সম্পর্কে বলেন- ‘তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন যে, সত্যের ব্যাপারে কোনও কর্তৃপক্ষের কাছে কারও আবেদন জানানোর প্রয়োজন নেই, কারণ প্রত্যেক মানুষ তার নিজের মধ্যে, তার ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধির ক্ষমতার মধ্যেই জ্ঞানের উৎস ধারণ করে। প্রকৃতিকে সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য সে এটি ব্যবহার করতে পারে; অথবা সত্য এবং ভ্রান্ততার পার্থক্যকরণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্রভাবে উপলব্ধি করা ছাড়াও কোনও ধারণাকে গ্রহণ না করার বিষয়টি অস্বীকার করে বুদ্ধিবৃত্তিগত স্বজ্ঞা ক্ষমতার মাধ্যমে সে তাকে ব্যবহার করতে পারে।’- (সূত্র: ঐ)।

উপরের এই উক্তিতে ‘কোনও কর্তৃপক্ষ’ বলতে কী বা কাকে বোঝানো হয়েছে বুদ্ধিমান পাঠককে নিশ্চয়ই তা ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। এ তো গেলো পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ধারার দর্শন ও সেইসাথে জ্ঞানতত্ত্বের জন্মের প্রেক্ষাপট। যদি এবার আমাদের নিজেদের উপমহাদেশের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখবো প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম ও একমাত্র জড়বাদী চার্বাক মতবাদসহ অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে জ্ঞান ও যুক্তিবাদের কী বিপুল সমারোহ! বর্তমান আলোচনায় আপাতত সেদিকে বিস্তৃত হওয়ার দরকার নেই। পরিশেষে বলতেই হয়, মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পেছনেই ফল্গুধারার মতো সক্রিয় থাকে তাঁর অন্তলীন এক জীবনদর্শন। যা তাঁর জীবনাচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিচালিত করে তাঁকে। ব্যক্তির এই আচরণ কোনো-না-কোনোভাবে দাগ রাখে সমাজের গায়ে, কখনো প্রভাবিত করে সমাজকেও। কিন্তু এই জীবনদর্শন কোনো অলৌকিক বস্তু নয়, নিরন্তর চর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়েই তা অর্জন করতে হয়, লালন করতে হয়। তাই ‘বিজ্ঞান চাই, কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না’- শ্লোগানটি যদি কোনো সহজ-সাধারণ ব্যক্তির অসতর্ক মুখে উচ্চারিত হতো, সেটাকে হয়তো বা অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতো। যেমন বলা যেতো, তিনি তো আসলে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানমনস্কতা কোনোটাই চাচ্ছেন না, চাচ্ছেন স্রেফ প্রযুক্তির সুবিধাটুকু নিরঙ্কুশভাবে পেতে! এভাবেই সুবিধাবাদিতার কাছে অন্য সবকিছুই গৌণ হয়ে যায়! কিন্তু কোনো তথাকথিত বিদ্বান কিংবা প্রথিতযশা সুকৌশলি ব্যক্তির মুখেই যখন সুচিন্তিত প্রয়াসে এই রহস্যময় শ্লোগানের অন্বিষ্ট-উচ্চারণ শুনি, তখন আর এই উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্যের গূঢ়তম লক্ষ্যকে হালকাভাবে নেয়ার উপায় থাকে কি? আমাদেরকে তা গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণে নিতে হয়। কেননা, বাঁচার মতো বাঁচতে হলে জানতে হবে নিরন্তর, এবং এই জানাটুকু যেন যথার্থই অর্থময় হয়।

সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ! নতুন বছর সবার জন্যে মঙ্গলময় হয়ে ঊঠুক। ভালো থাকুন সবাই। শুভ নববর্ষ !!


মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

অশ্ব চাই না, অশ্বডিম্ব চাই!

****************************************

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আমসত্ত্ব চাই। সেটা আমের হোক কিংবা কাঁঠালের, হাগুর কিংবা মুতুর, কুচ পরোয়া নাই।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

নতুন বছর সবার জন্যে মঙ্গলময় হয়ে ঊঠুক। শুভ নববর্ষ হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রণদীপম বসু এর ছবি

শুভ নববর্ষ !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আয়নামতি এর ছবি

আমাকে এখন বাস ধরতে হবে। পরে এসে পড়বো পোস্ট।
নববর্ষের শুভেচ্ছা থাকলো ভাইয়া। শুভ হোক, মঙ্গল হোক! হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

শুভ নববর্ষ !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মাসুদ সজীব এর ছবি

অসাধারণ দাদা, ডাবল পাঁচতারা চোখ টিপি

কিন্তু শিরোনাম টা বোধহয় লেখার মূল বক্তব্যের সাথে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারতো, যেমন বিজ্ঞান না বিজ্ঞানবাদিতার নামে অপ-প্রচার কিংবা অন্যকিছু।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

রণদীপম বসু এর ছবি

ইচ্ছে করেই এখানে শিরোনামটাকে আধা-বিমূর্ত করে দিয়েছি ! মূল শিরোনাম এইখানে দেখেন : https://horoppa.wordpress.com/2015/04/13/bigganhin_projuktimonoskota/

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রানা মেহের এর ছবি

যারা বিজ্ঞান চান কিন্তু বিজ্ঞানবাদীতা চান না
তারা আসলে জামাতের ভাল চান।

আপনার লেখা অনেক ভাল লাগলো রণদীপম দা।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

রণদীপম বসু এর ছবি

ধন্যবাদ। শুভ নববর্ষ !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদীতা চাই না- এটা সোজা কথায় বাটপারি।

একটা লেখা শুরু করেছিলাম ‘কাগজের ইশকুল’ নামে বেশ আগে, মূলত মৌল কিছু ষিয় (যুক্তি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন ইত্যাদি) নিয়ে। আপনার এই লেখায় তার মূল কথাটাই আছে। আমার আর জঞ্জাল বাড়িয়ে কাজ নেই। আবারো পড়তে হবে।

নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানবেন।

স্বয়ম

রণদীপম বসু এর ছবি

একই মূল বক্তব্য ধরে ভিন্ন ভিন্ন গড়ন-গাড়নে বহু বহু লেখা বহু বহু লেখক বহু বহু কাল যাবৎ লিখে আসছেন, লিখবেনও আরো ! অতএব পাঠক-কৌতুহল নিরসনে আপনার লেখাটাও লিখে ফেলেন ! এবং পোস্ট করে দেন !

শুভ নববর্ষ !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

এক লহমা এর ছবি

"কিন্তু কোনো তথাকথিত বিদ্বান কিংবা প্রথিতযশা সুকৌশলি ব্যক্তির মুখেই যখন সুচিন্তিত প্রয়াসে এই রহস্যময় শ্লোগানের অন্বিষ্ট-উচ্চারণ শুনি, তখন আর এই উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্যের গূঢ়তম লক্ষ্যকে হালকাভাবে নেয়ার উপায় থাকে কি? আমাদেরকে তা গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণে নিতে হয়। কেননা, বাঁচার মতো বাঁচতে হলে জানতে হবে নিরন্তর, এবং এই জানাটুকু যেন যথার্থই অর্থময় হয়।" - চলুক
নবর্ষের অনেক শুভেচ্ছা হে প্রিয় কবি-দার্শনিক-বিজ্ঞানবাদী-বন্ধু!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

রণদীপম বসু এর ছবি

আপনাকেও নববর্ষের শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

"ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী কিছু একটা হল দর্শন । ধর্মতত্ত্বের মতো দর্শনেও বিষয়বস্তুর উপর অনুমান করার রীতি বিদ্যমান যেটা দ্বারা এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট জ্ঞান অনির্ধারণযোগ্য হয়ে এসেছে; কিন্তু বিজ্ঞানের মতো দর্শনমানুষকে প্রথা অথবা প্রগতিশীলতার কর্তৃত্ব এর বদলে কারনের দিকে আকৃষ্ট করে । আমার মতে সকল সুস্পষ্ট জ্ঞানই বিজ্ঞানের ঘরে; অপর দিকে সব অন্ধ বিশ্বাস যা বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে যায়, সেগুলো ধর্মতত্ত্বের ঘরে । কিন্তু ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যে একটা নো ম্যান’স ল্যান্ড আছে যেটাকে দুই পক্ষই আক্রমন করতে পারে; এই নো ম্যান’স ল্যান্ডই হল দর্শন।"

-- বারট্র‌্যান্ড রাসেল, অ্যা হিস্টোরি অব ওয়েষ্টার্ন ফিলোসফি, ১৯৪৫, প্রারম্ভিকা, পৃষ্ঠা ১২

হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ওডিন এর ছবি

চমৎকার লাগলো। হাততালি

কিন্তু কোনো তথাকথিত বিদ্বান কিংবা প্রথিতযশা সুকৌশলি ব্যক্তির মুখেই যখন সুচিন্তিত প্রয়াসে এই রহস্যময় শ্লোগানের অন্বিষ্ট-উচ্চারণ শুনি, তখন আর এই উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্যের গূঢ়তম লক্ষ্যকে হালকাভাবে নেয়ার উপায় থাকে কি?

বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদিতা চাই না, এইরকম প্রপঞ্চময় একটা ধারণা একমাত্র ধর্মেও থাকা আর জিরাফেও একই সাথে থাকা ধান্দাবাজ লোকজনের পক্ষেই প্রচার সম্ভব। তো এইরকম দেখলে একটাই উপসংহারে আসা যায়- - ধান্দাবাজ এলার্ট হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

নিঃসন্দেহে চলুক

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আয়নামতি এর ছবি

দারুণ লেখা চলুক চলুক
সুবিধাবাদী মনোভাব থেকেই এসব ফতোয়াবাজি আসলে। শ্যামও থাকলো, কূলটাও রক্ষা পেল!
এমন ভণ্ডামি সবযুগেই চলে এসেছে। এসবকে পাত্তা দিলে কোন দর্শন/বিজ্ঞান-ই হালে পানি পেতো না।
আরেকটা ব্যাপার আমার মনে হয় প্রশ্ন করবার চর্চার মুখে ঝামা দিয়ে চুপ করিয়ে রাখবার জন্যও এমন সব ফতোয়ার জন্ম দেন এরা। আমাদের সমাজ আচরণে প্রশ্ন করার বিষয়ে আগ্রহ নেই যেন। ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে সেটা আরো বেশি রক্ষণশীল, আরো বেশি বিরুদ্ধ মনোভাবের স্বীকার।

প্রাচীন ভারতীয় দর্শনেও যে ‘জ্ঞান কী, জ্ঞানের প্রকাশ বিকাশ’ এইসব অবিমিশ্র বিষয়ে বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও তুমুল তর্ক-বিতর্কে মুখরিত যুক্তি ও জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিলো,

কাজেই, এইসব ভণ্ডামিপূর্ণ ফতোয়াবাজিকে পাশ কাটিয়েই যুক্তি ও জ্ঞানচর্চাকে সচল রাখতে হবে।

রণদীপম বসু এর ছবি

সহমত।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

বন্দনা এর ছবি

শিরোনাম দেখে পড়তে এসে পুরাই তব্দা খাইলাম দাদা, তবে কন্টেন্ট শিরোনামের চাইতে ও ব্যাপক গভীর।দারুণ একটা লিখা রণদা।

রণদীপম বসু এর ছবি

শিরোনামেই দর্শনে কথা কইলে বাঙাল কি আর এই দিকে পা মাড়াইবো ! তাই ভুলাইয়া ভালাইয়া মূল কন্টেন্টের মধ্যে ঢুকাইয়া দেয়ার ফন্দি আর কি ! হা হা হা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু কিছু ব্যাপারে আপনার সাথে দ্বিমত আছে, দেখি কতটুকু বুঝিয়ে বলতে পারি, কারণ ভাবনাচিন্তাগুলি নিতান্তই আমার, কারো সাথে শেয়ার করে যাচাই বাছাই করার সুযোগ পাইনি।

প্রথমেই বলে নেই, "বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদীতা চাই না", এটা ফরহাদ মঝার বা সমগোত্রীয় কেউ বলেছেন, এটুকুই জানি, কিন্তু বিস্তারিত জানিনা, তাই আমার ব্যাখ্যার সাথে ফরহাদ মঝারের মিল থাকলে সেটা অনাবশ্যক (এবং দুঃখজনক) কাকতাল মাত্র।

আপনার ২য় পরিচ্ছদের ১ম কয়েকটা লাইন তুলে ধরি

প্রথমেই আমাদের এটুকু বুঝতে হবে যে, বিজ্ঞানবাদিতা মানে সেই বিমূর্ত দর্শনচিন্তা যা বাস্তব যুক্তিপরম্পরা মেনে একটি সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে, রূপ নেয় বিজ্ঞানে। তার এই এগিয়ে চলা এতোটাই অবিসংবাদিত যে, তার গন্তব্য পথে কোন অস্পষ্ট অযৌক্তিক ধারণা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

এই কয়েকটা লাইন অসম্পূর্ণ। আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন সেটা বুঝেছি, যে বিজ্ঞানের পথ কীভাবে তৈরী হবে সেটা নির্দিষ্ট---এটায় একমত। কিন্তু গন্তব্য সবসময় একই হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিশেষ করে, আমরা যখন কোনো "জেনারেল" প্রশ্নের সঠিক উত্তরে আসতে চাই, বিজ্ঞান-ধারা এবং বিজ্ঞান-ধারা-প্রসূত তথ্য উপাত্ত দিয়ে, তখন কিন্তু এতো সহজে সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়া সম্ভব হয়না সবসময়। (আমি কম্পু-প্রকৌশলের ছাত্র, আমাদের ফিল্ডে অনেক বড় বড় প্রশ্নের উত্তরই শেষ হয় "ইট ডিপেন্ডস" বলে। প্যাকেট সুইচিং ভালো না সার্কিট সুইচিং? ইট ডিপেন্ডস। মার্জ সর্ট না বাবল সর্ট? বা ধরেন আরো জেনারেল---ম্যাকের ল্যাপটপ ভালো না লেনোভো থিংকপ্যাড? এই প্রশ্নের কি আসলেই সম্পুর্ণ নৈর্ব্যাক্তিক, সম্পূর্ণ সঠিক , "হ্যাঁ অথবা না" উত্তর দেয়া সম্ভব? আমার কাছে যদি আরো অনেক ডিটেলস তথ্য না থাকে, তবে সঠিক উত্তর দেয়া প্রায় অসম্ভব। ল্যাপটপটা কে ব্যাবহার করবে? ঘরে না অফিসে করবে, নাকি পার্কে বসে? ব্যাবহারকারীর বয়স কত? আগে কী ম্যাক ব্যবহার করেছে? আগে কি কখনো পিসি ব্যাবহার করেছে? কালো রং ভালো লাগে না সাদা? ব্রান্ড চায় না ফাংশনালিটি চায়?---এই ধরনের আরো প্রায় হাজারখানেক প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে হয়ত সম্ভাব্য একটি হ্য্য/না উত্তরে আসা যায়, প্রায় ৯০% নিশ্চয়তা সহ।)

কিন্তু যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, একটি নতুন ম্যাকের ম্যাকবুক এয়ার আইফাইভ ২০১৩ মডেলের সিপিউ, নাকি নতুন থিংকপ্যাড টি-৪৫০এস এর সিপিউ----কোনটা সবচেয়ে কম সময়ে একটা সাধারণ যোগ অংক করতে পারবে?----এটার উত্তর বিজ্ঞান খাটিয়ে ১০ মিনিটেই মোটামুটি ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা সহকারে দেয়া সম্ভব।

আরেকটা উদাহরণ দেই, মাখন খাওয়া স্বাস্থের জন্য ভালো, না খারাপ? মাঝে মধ্যে দেখি, লোকজন বিজ্ঞানীদের ওপর ক্ষেপে ওঠেন, "আরে!! গতবছর পর্যন্ত এরা বলল মাখন থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতে, আজকে আবার বলে পরিমিত খেলে ক্ষতি নেই---বিজ্ঞান কি তাহলে এক বছরে উল্টিয়ে গেল?" না, আসল কারণ হচ্ছে যে, ইট ডিপেন্ডস। মাখনের স্যাচুরেটেড ফ্যাট আমাদের হার্টের ক্ষতি করা সম্ভাবনা রাখে, সেটা ঠিক, কিন্তু খাবার দিয়ে মানুষের শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করা যায় মাত্র ২৫ ভাগ, আর তার উপর মাখন এড়াতে গিয়ে লোকে মার্জারিনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সেটার ট্রান্স ফ্যাট হার্টের জন্য আরো বেশী ক্ষতিকর। তাই "মাখন ভালো না খারাপ" সেটার যখন আপনি একটা হ্যা-না উত্তর চাইবেন, তখন আসলে অনেক অনেক জিনিস মাথায় রাখতে হবে, এবং নব-উদ্ভাবিত ছোট একটা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নিক্তির পাল্লা এদিক এদিক হয়ে যেতে পারে।

এবার আসি বিজ্ঞান বনাম "বিজ্ঞানবাদীতা"য়। ধরুন হঠাৎ করে পৃথিবীতে নতুন একটা মহাদেশ আবিষ্কৃত হল, আর সেখানে আমি এবং আমার মত আরো কয়েক বিলিয়ন লোক একটা ধর্মে বিশ্বাস করি, যেটার নাম হচ্ছে "সাতটা-কাছিম ধর্ম"। আমি বিশ্বাস করি মহাবিশ্বের বাইরে সাতটা অসীম সাইজের কচ্ছপ বসে আছে, আর তারা আমাদের কাছে বাণী পাঠিয়েছেন "পিঠে সবসময় কূলো বেঁধে চলো, আর সাত মাস পর পর কাউকে ল্যাং মেরে দাও। না দিলে মরার পর সারা জীবন সাত কাছিমের কামড় খাবে।"

এখন বাইরের বিশ্বে বসে একজন মনে মনে ভাবছে

১। "এই ধর্মে যা বলে, সেটা ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?"

আপনি ও পাঠকরা বুদ্ধিমান, এটার হ্যা-না উত্তর বের করা আপনার জন্য কঠিন নয়।

২। "এই কাছিমওয়ালারা যখন বাইরের বিশ্বে আসবে, তখন কী তাদের জানিয়ে দেওয়া দরকার, যে ল্যাং মেরে কাউকে ফেলে দেওয়া আইনত দন্ডনীয়?"

অবশ্যই জানানো দরকার। উত্তর কঠিন নয়।

এবার নতুন প্রশ্ন:
৩। "এই কয়েক বিলিয়ন লোককে কি এখনই জানিয়ে দেয়া উচিৎ, যে তারা সবাই গর্দভ, এবং গর্দভ/গর্দভীয় চিন্তাভাবনা যেন তারা কালকেই ঝেড়ে ফেলে?"

---এইটার উত্তর, অতি অবশ্যই, ইট ডিপএন্ডস। এই লোকগুলো কতটা ম্যাচিউর? আমি কি এই লোকগুলোর ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত, না তেমন চিন্তিত না? এদের হাতে যে ঢিলগুলো আছে, সেটা থেকে আমি ঠিক কত দূরে? আমি কি কয়েক বিলিয়নের সবাইকে নিয়েই চিন্তিত, না ২/১ বিলিয়ন লোক কমে গেলেও আমার সমস্যা নেই? আর এতো এত লোক গর্দভীয় চিন্তাভাবনা করে চলেছে, তার মানে কী এই ধরেনের ভাবনার অন্য কোনো পর্যবেক্ষণ-যোগ্য উপযোগিতা আছে, নাকি এরা আসলেই নিপাট গর্দভ?----ইত্যাদি আরো লাখখানেক প্রশ্নের উত্তরের পরেই হয়ত একটা সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব।

যারা ১ আর ২ং নং প্রশ্নের উত্তর জানেন দেখে মনে করেন যে ৩ নং প্রশ্নের উত্তর তো একই হবে, এতো ভাবার কী আছে----বিজ্ঞানবাদী বললে এদের চেহারাই আমার সামনে আসে।

লম্বা মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি।

------যান্ত্রিক বাঙালি

অতিথি এর ছবি

আমার ব্যাখ্যার সাথে ফরহাদ মঝারের মিল থাকলে সেটা অনাবশ্যক (এবং দুঃখজনক) কাকতাল মাত্র।

ঠিকাছে। আপনাকে না, মঝার গং-কে মাথায় রেখেই আমার উত্তরটা দিচ্ছি তাহলে। আমার উত্তর ব্যক্তিগত নয়, এবং অ-মঝারীয়, বিশেষ করে সচলে লিখেন বা পড়েন, এমন কেউ দুঃখ পেলে সেটা অনাকাঙ্খিত, অনাবশ্যক (এবং দুঃখজনক) কাকতাল মাত্র।
----------------------------------------

আর ৩ নং প্রশ্নের উত্তর - শুধু উত্তর না, প্রশ্ন ও উত্তর দু'টো দেখেই - নিরেট ফরহাদ মজহারীয় ধান্ধাবাজদের চেহারাই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে খালি। এরা এতই ধান্ধাবাজ যে, ইস্যুটাকে নিজেদের মনোমত ও সুবিধামত একটু বিকৃত করে নিয়ে তারপর পাব্লিককে ধোঁকা দেয়ার জন্য প্রশ্নোত্তরের বিভ্রান্তিকর উদাহরণ-খেলা সাজান। তবে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি, আগে দেখি ৩ নং প্রশ্নের বরবাদ মঝারীয় উত্তর কি।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন - এইটার উত্তর, অতি অবশ্যই, 'ইট ডিপএন্ডস'। যেমন প্রশ্ন, তেমনি উত্তর। দুটোই পাক্কা মঝারীয়। প্রশ্নটার পুরোপুরি আইসিসীয় বা সমগোত্রীয় উত্তর কি হত? এক কথায় সেটা হত - কাভি নেহি‍! নেভার! মার ডালেগা! এখানেই মঝারীয় চালাকি ও টুইস্ট। তারা আমাদের ছদ্ম-শিক্ষিত ভদ্দরনোকের পাতে দেয়ার জন্যই 'কাভি নেহি'-কে বানিয়েছেন 'ইট ডিপএন্ডস'। দুইয়েরই মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সেই একই। অশিক্ষিত, অপরিণত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিভ্রান্ত মানুষকে চিরকাল তাদের অজ্ঞানতার নিগড়েই আবদ্ধ করে রেখে দেয়া। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না দেয়া। আর তারপর তাদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে তাদেরই মাথায় চিরকাল কাঠাল ভেঙে নিজের নিজের পলিটিক্স করে যাওয়া। তারা ঐ সাত-কাছিমের-মহাদেশ থেকে বাইরের আলোকিত জগতে বেরিয়ে আসলে জঙ্গি, মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদী, বা তাদের বুদ্ধিজীবীয়-ট্রোজান-হর্স দালাল মঝার গং-দের পলিটিক্স মার খেয়ে যাবে যে! কাদের নিয়ে রাজনীতি করবেন তারা তখন? কি ভয়ঙ্কর! ফলে এদেরকে তাদের অন্ধকুপেই আটকে রাখতে আইসিসের কাস্তে-কুড়াল-বোমা-বন্দুকের সমান্তরালে মঝারীয় সফিস্টিকেটেড বুদ্ধিবৃত্তিক চাপাতি হচ্ছে - ইট ডিপেণ্ডস! বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদীতা চাই না! ইত্যাদি। এরা ম্যাচিউর না, এরা সত্য হ্যান্ডল করতে পারবে না - নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে যাবে বা নাছাড়ারা মেরে যাবে, এদের হাতে ঢিল আছে, এত এত লোক কুসংস্কারে বিশ্বাস করে সুতরাং কুসংস্কারের মধ্যেও নিশ্চয়ই কোন রহস্যজনক কিন্তু এখনও অনাবিশকৃত মহান সত্য লুকিয়ে আছে যা জানার চেয়ে না জেনেই ওদের আঁকড়ে থাকা ভাল - যদিও আমরা বুদ্ধিমানেরা তা বিশ্বাস করি না কিন্তু ধোঁয়া দেই, মুর্খদের জন্য মুর্খতাই ভাল - জ্ঞানের আলো ওদের বদহজম হয়ে যাবে তখন ফ্লাজিল পাব কোথায়, মুর্খদের মুর্খতা আসলে মুর্খতা না - ছদ্মবেশী মহাজ্ঞানের অবতারমাত্র - ইত্যাদি ইত্যাদি এমন আরও লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি আজগুবি প্রশ্নোত্তর নিয়ে আমরা অনন্তকাল ধরে বিতর্কের নামে কুতর্ক করে যাব - এবং যতদিন না আমাদের সেই অন্তহীণ কুতর্ক শেষ হচ্ছে যা আসলে কোনদিনও শেষ হবে না, ততদিন "ইট ডিপেণ্ডস"-এর অজুহাতে ওদেরকে ওদের ঐ অজ্ঞানতার জগতেই আটকে রাখব এবং ওদের মাথায় মহাসুখে চিরকাল কাঠাল ভেঙে খেতে থাকব নির্বিবাদে। কি মজা! আর ঐ অর্ধ-শিক্ষিতগুলা কোনরকম ট্যাঁ-ফো করলে ওদের মুখের সামনে "বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদীতা চাই না"-র মুলা ছুড়ে দিব। এরা এটা দারুন একখান জ্ঞানী কথা বা আপ্তবাক্য মনে করে মরীচিকার মত এই অর্থহীণ মুলার পিছনে ছুটতে ছুটতে মরুক গে!

এই গেল ৩নং প্রশ্নে মঝারীয় উত্তরের মাজেজা। এখন দেখা যাক, খোদ প্রশ্নটাই কেন আসলে মঝারীয়। আগেই বলেছি - ইস্যুকে নিজেদের মনোমত ও সুবিধামত একটু বিকৃত করে নিয়ে তারপর পাব্লিককে ধোঁকা দেয়ার জন্য প্রশ্নোত্তরের বিভ্রান্তিকর উদাহরণ-খেলা সাজান তারা। তো এখানে প্রশ্নের মধ্যে বিকৃতি কোথায়? লক্ষ্য করুন –

"এই কয়েক বিলিয়ন লোককে কি এখনই জানিয়ে দেয়া উচিৎ, যে তারা সবাই গর্দভ, এবং গর্দভ/গর্দভীয় চিন্তাভাবনা যেন তারা কালকেই ঝেড়ে ফেলে?"

উপরে আন্ডারলাইন করা ৪টি বাক্যাংশ থেকে ১ম ও শেষটি প্রশ্নটি থেকে বাদ দিয়ে এবং অন্য দু’টির ক্ষেত্রে আরো শোভন কোন শব্দ ব্যবহার করে দেখুন তো! দেখবেন প্রশ্নের উত্তরটা কেমন আগপাস্তলা বদলে যাচ্ছে। আসলে আসল ইস্যু ও তার সমাধান বা অর্থপূর্ণ আলোচনা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে উত্তরের নামে একটা বিভ্রান্তিকর মঝারীয় মুলা ঝুলানোর সুযোগ সৃষ্টির জন্যই এই অতি অসদুদ্দেশ্যপূর্ণ “টুইস্ট”-এর অবতারনা।
১। “এখনই জানিয়ে দেয়া উচিৎ”। এটা পড়ে মনে হচ্ছে, এটা যেন রাস্তায়-রাস্তায় মাইক দিয়ে ঘোষণা করে বা মিটিং-মিছিল করে গলা ফাটিয়ে ঘোষণা করে জানিয়ে দেয়ার বিষয়। কিম্বা, অটোরিক্সায় মাইক লাগিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে “আজকে অত্র এলাকায় পানি বন্ধ থাকিবে” জাতীয় ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ দেয়ার মত কিছু। কিম্বা সাইক্লোন ওয়ার্নিং। প্রথমত, ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই বুঝবে এভাবে রাস্তায় বা মঠে-ময়দানে নেমে (বা টকশোয়ে বসে, ইত্যাদি ) অশিক্ষিত-বদ্ধচিন্তার মানুষকে প্রকাশ্যে সামনাসামনি “গর্দভ-টর্দভ” গালি দিয়ে তাদের বিশ্বাস-সংস্কার কত বড় গাধামি ইত্যাদি বলে গালাগালি করে তাদের চোদ্দ-গুষ্ঠি উদ্ধার করে তাদেরকে তৎক্ষণাত গাধা থেকে মানুষ হয়ে যেতে বললে, তারাতো সেটা শুনবেই না – বরং প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্নক। অশিক্ষিত কেন, যেকোন মানুষেরই এমন রিয়্যাকশন হবে। কিন্তু বিজ্ঞান তো এভাবে মাঠে-ময়দানের ভায়োলেন্ট পলিটিক্সের মত চর্চা হয় না, বিজ্ঞানবাদিতাও না। এমনকি সভ্য দেশে পলিটিক্সও এভাবে চর্চা হয় না। জ্ঞানের প্রসার দূরে থাকুক। জাতীয় বা সামাজিক পরিসরে এরকম এপ্রোচের ফলাফল নেতিবাচক বৈ গঠনমূলক হয় না, এবং আমার জানামতে আমাদের দেশের কোন বিজ্ঞানবাদীও এমনটা বলেন না। এই পোস্টের লেখকতো বলছেনই না। এটা কি প্রশ্নকারী মঝারীয়রা জানেন না? জানেন বৈকি। কিন্তু ইস্যুটা বিকৃত করে টুইস্ট দিয়ে এটকে নিজের মত ফ্রেম করে নিজের সাজানো উত্তরটার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর মধ্যে এরকম উষ্কানীমূলক কথাবার্তা অপ্র্যোজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইঞ্জেক্ট করতে হবে যে! প্রমান করতে হবে না, বিজ্ঞানবাদীরা কত ভয়ঙ্কর, খারাপ, হঠকারী, ধ্বংসাত্নক। বিজ্ঞানবাদ কত ক্ষতিকর। এজন্যেই ৩নং প্রশ্নটার মধ্যে ২য় ও ৩য় আণ্ডারলাইনকৃত উষ্কানীমূলক বাক্যাংশ দু’টি আরোপিত ভাবে যোগ করা হয়।
বিজ্ঞানের মতই বিজ্ঞানবাদীতা ও যুক্তিবাদিতাকে আসতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়, যা ধীরে ধীরে চেতনার মধ্যে অনুপ্রবেশ করবে। আসতে হবে মিডিয়া, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক চর্চায়। গদাপেটা করে নয়, রক্তগরম মুগুরপেটা ভাষণ বা গালাগালির তুবড়ি ছুটিয়ে নয় – অন্তর্নিহিতভাবে, নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে, প্রয়োজনে যুক্তি দিয়েই বোঝানোর মাধ্যমে। মঝারীয় বা চরমপন্থীদের বজ্জাতি কুযুক্তির ডিস্ট্র্যাকশনের খপ্পরে পড়ে একেবারেই বিভ্রান্ত না হয়ে গেলে, অশিক্ষিত মানুষকেও বোঝালে তারা কিন্তু ঠিকই যুক্তি বুঝে (সমস্যা হয় আসলে ভণ্ডদের নিয়ে)। আর সবচেয়ে বড় কথা, বিজ্ঞানবাদিতা অবধারিতভাবে কোন সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস, সংস্কার বা কুসংস্কারকে সরাসরি আক্রমণ করার বিষয়ই না। এটা একটা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া। যা কেউ আত্নস্থ করতে পারলে বাকি কাজের দায়িত্ব এই পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নিজেই নিজের ঘাড়ে নিতে পারবে অনেকখানি। কোন সুনির্দিষ্ট কুসন্সকারকে মাইক ফাটিয়ে দামামা বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে আক্রমণ করতে হবে না। কিন্তু, মঝারীয়রা বোধহয় এটা চান না। যুদ্ধ না বাধলে, সারাক্ষণ বেঁধে না থাকলে, বাঁধার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে, বা অন্তত বাঁধার ভয় দেখাতে না পারলে – তারা ফাঁকতালে ফায়দা লুটবেন কিভাবে? বিজ্ঞানবাদীতা প্রতিষ্ঠা পেলে তাদের অপরাজনীতির কোন জায়গাই তো থাকে না আর।
২। কোন্‌ বিজ্ঞানবাদী বা যুক্তিশীল মানুষ বলেছেন যে স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষের কাছে বিজ্ঞান বা যুক্তিশীলতার কথা বললে তারা ‘কালকেই’ বা রাতারাতি কুসংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদের ধ্বজাধারীতে পরিণত হবে? যে কোন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই জানেন এটা রাতারাতি হওয়ার বিষয় না। কেউ তেমন দাবিও করেননি। সবাই জানেন, আমাদের মত দেশে এটা একটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হতে বাধ্য। সবখানেই আসলে তাই। এবং এই প্রক্রিয়াটাও আরেকটা পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও সে সম্পর্কে চেতনা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া। তো সেটা শুরু ও চর্চাতো করতে হবে! তাহলে এই প্রশ্নের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ও আরোপিতভাবে এই “কালকেই ঝেড়ে" (৪র্থ আণ্ডারলাইনকৃত বাক্যাংশ) ফেলার আবদার কেন? এটাই হচ্ছে, আবারও, ইস্যু বিকৃত করে সাজানো উত্তর বের করার মঝারীয় উষ্কানীমূলক টুইস্ট। যে সাজানো উত্তরের লক্ষ-লক্ষ, আসলে অন্তহীণ, ত্যানা-প্যাঁচানো কুতর্কের পথ ধরে এগুলে অনন্তকাল পরে যে কঙ্কলুশন আসবে - যদি আসে কোনদিন (ততদিনে অবশ্য আমরা কেউ বেঁচে থাকব না), তা হলো – জ্বি জনাব, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, কঙ্কলুশনটা হচ্ছে – অতি অবশ্যই, বাট যেহেতু ইট স্টিল ডিপেন্ডস অন জিলিয়ন্স এ্যান্ড জিলিয়ন্স অফ ইয়েট মোর আনএ্যান্সারড কোয়েশ্চন্স, প্রশ্নোত্তরস এ্যান্ড ত্যানা-প্যাঁচানিস, সেহেতু ইট স্টিল ডিপেণ্ডস, এ্যান্ড যেহেতু ইট স্টিল ডিপেণ্ডস, সেহেতু ইট স্টিল ডিপেণ্ডস, এ্যান্ড যেহেতু..... । বাদ্দেন, সব ডিপেণ্ডসের ফাইনাল কঙ্কলুশন আমিই বলে দিচ্ছি – আমাদের সূর্যটা হোয়াইট ডোয়ার্ফ থেকে একটা ব্ল্যাক ডোয়ার্ফে পরিণত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আমরা উত্তর পাব – এখন আর বিজ্ঞানও চাই না, বিজ্ঞানবাদীতাও চাই না। ভূত হয়ে কত ট্রিলিওন বছর ধরে সেই একই ত্যানা প্যাঁচাইতাসি। ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ হয়ে গেলাম গা, আর কত! বাদ্দেন!
হ্যাঁ, আনটিল দেন (সূর্য ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ হওয়ার আগে সেই অকথিত কঙ্কলুশনে না পৌঁছানো পর্যন্ত), আপনারা বুঝতেই পারছেন - অফ কোর্স আমাদের অন্তর্বর্তীকালীণ মঝারীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে - আমরা "বিজ্ঞান চাই কিন্তু বিজ্ঞানবাদীতা চাই না"। কিম্বা আরও ভালভাবে বললে ‘প্রযুক্তি’ ছাড়া আর কিছুই চাই না আসলে। চাই না যুক্তিবাদ, জ্ঞান-দর্শন, নাথিং। প্রযুক্তিটা এযুগে লাগে নেহাৎ ঐ নাছাড়ারা কিছু দারুন যন্ত্রপাতি বানাইসে, ঐগুলা কাজে লাগিয়ে মাস্তানি চর্চার জন্য। নাহলে ঐটাও লাগত না।

রণদীপম বসু এর ছবি

ভাইরে ভাই ! উপরের দুই মন্তব্য পড়ে তো মনে হয় আমারই মস্তিস্ক-প্রযুক্তির জোড়া-জাড়া সব লুজ হইয়া গেলো ! হা হা হা ! তাই আসেন আগে জোড়া-জাড়া সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে এইখান থেকে একটু ঘুরে আসি ! পরে নাহয় চা-মুড়ি নিয়ে বসা যাবে !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম... কথা হইল গিয়াঃ

নাস্তিক চাই** নাস্তিক্যবাদিতা চাই না খাইছে

( **বলি দিতে তো পাঁঠা লাগে, তাই না? )

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রণদীপম বসু এর ছবি

বলিতে বলিদাতা নাকি স্বর্গ পায়, কিন্তু পাঁঠার কী লাভ হয় ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতিথি লেখক এর ছবি

রণদীপম, হাহাহা, মাথার জোড়া-জাড়া লুজ হলে হবে কেন, ইন্টারেসটিং আলোচনা, আর এসব নিয়ে কথা বলার লোক কম, তাই ব্লগ আলোচনা চলুক, সেটাই তো ব্লগের গুণ, নাকি হাসি

আপনার দেয়া লিংকটা আগেই আপনার হরপ্পা ব্লগে গিয়ে দেখেছি, ধন্যবাদ। আমার মন্তব্যটা আপনার ঐ লেখার জন্যও খাটে, "বিজ্ঞানবাদিতা"র অংশটুকুবাদ দিলে। আপনি ঐ লেখায় বলেছেন

দর্শন-তাত্ত্বিক বিবেচনায় নিরপেক্ষতা একটা আহাম্মকি শব্দ। হাঁ এবং না এর মাঝামাঝি কোন অবস্থান থাকা কি বাস্তবে আদৌ সম্ভব ? যুক্তিশাস্ত্রও তা অনুমোদন করে কিনা জানি না। তবে এই নিষ্ক্রিয় মধ্যবর্তী জড়-অবস্থান যে সত্য ও মিথ্যার মাঝামাঝি থাকার মতোই একটা পরাবাস্তব-রূপ শূন্য অবস্থা, তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না।

আপনার এই লেখাতেও একই যুক্তি দিয়েছেন, যেটা আমার মতে, অসম্পূর্ণ। অনেক প্রশ্নের হ্যাঁ এবং না এরকম সরাসরি উত্তর সম্ভব হয় না, সেটাই আমার বিস্তারিত মন্তব্যের আসলকথা।

আমার মন্তব্যের "এখন আসি বিজ্ঞান বনাম বিজ্ঞানবাদিতায়" থেকে পরের অংশটুকু বাদ দিলে বাকিটুকু আপনার এই ব্লগ ঐ ব্লগ দুটাতেই যায়।

আপনি চাইলে ঐ ব্লগে গিয়েও আলোচনা করা যায়, অথবা এখানেও।

---যান্ত্রিক বাঙালি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যে আমার ৩ নং প্রশ্ন নিয়ে আপনার যা মতামত দেখতে পাচ্ছি, তাতে "বিজ্ঞানবাদী" বললে যাদের কথা আমি বলেছি, তাদের সাথে আপনার কোনো মিল দেখছিনা। আপনার আর আমার পার্থক্য হচ্ছে "বিজ্ঞানবাদী" কারা, সেটার নির্ধারণে। আপনি যখন বলেন,
"কিন্তু (বিজ্ঞানবাদিতা) তো এভাবে মাঠে-ময়দানের ভায়োলেন্ট পলিটিক্সের মত চর্চা হয় না",
"আমার জানামতে আমাদের দেশের কোন বিজ্ঞানবাদীও এমনটা বলেন না।"
" কোন্‌ বিজ্ঞানবাদী মানুষ বলেছেন যে স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষের কাছে বিজ্ঞান বা যুক্তিশীলতার কথা বললে তারা ‘কালকেই’ বা রাতারাতি কুসংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদের ধ্বজাধারীতে পরিণত হবে?"
"কেউ তেমন দাবিও করেননি"

তখন অনুমান করছি যে আপনি বিজ্ঞানবাদীদের একটা আদর্শিক সংজ্ঞা তৈরী করেছেন, এবং অনেক স্বঘোষিত বিজ্ঞানবাদীদের হয় বাদ দিয়েছেন, অথবা, তাদের অনেক "উস্কানিমূলক মতপ্রচার" আপনার চোখে পড়েনি (আমাদের দেশে নবী-"ুন্দানি দিবস ফেসবুকে জোরেশোরেই পালন করা হয়, অনেক নিও-এথিস্ট সর্বসমক্ষেই বলেন যে ধর্ষণ অপেক্ষা ধর্ম দূর হওয়া অধিকতর জরুরী, অথবা বাংলাদেশের ফেসবুক ধর্ম আলোচনায় এন্টি-মুসলিম-রেসিজমএর সরব উপস্থিতি) এদের অনেকেই আপনার আদর্শিক সংজ্ঞায় আটকে যাবেন, আর এদের কথাই আমি মূলত মাথায় রেখেছি।

শেষ পর্যন্ত দেখছি সেই "সহী-মুসলিম" বনাম "মুসলিম" এই বিতর্কে এসে পড়েছি, নতুন বোতলে।

-------যান্ত্রিক বাঙালি

এক লহমা এর ছবি

সুন্দর উত্তর। ভালো লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।